১৯৭১ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের আশা-আকঙ্খার মাঝে ভূমিহীনদের স্বল্প লালিত ছিল দেশের সম্পদের উপর নিজেদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা। দেশের গরিব, ভূমিহীন মানুষগুলো খাস জমি ও নীরাভূমির উপর তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলো। তাদের সে আশা-আকাঙ্খা স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও পূরণ হয়নি। শুধুমাত্র উত্তরাঞ্চলের ৬০ লাখ ভূমিহীন পরিবার দীর্ঘদিন থেকে বসতভিটার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ৩ লাখ ১৬ হাজার একরের বেশি খাস জমি রয়েছে। এর অর্ধেকের বেশি জমি প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলে। যার মূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার উপরে। পরিকল্পিতভাবে এসব খাস জমি থেকে যদি ৫ শতক করেও প্রত্যেক ভূমিহীনের মধ্যে বরাদ্দ দেয়া হতো, তা হলে এসব জমিতে প্রায় ১০ লাখ ভূমিহীনের বসতভিটা করে দেয়া সম্ভব হতো।
অবৈধ দখলে থাকা খাস জমি উদ্ধারে স্বাধীনতার পর কোনো সরকারই জোরালো উদ্যোগ নেয়নি। ভূমি ও জরিপ রেকর্ড অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দখলদারদের গোপন সমঝোতা থাকার অভিযোগ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে হাউজিং ব্যবসায়ী, ভূমিদস্যু, মহাজন, সুদখোর, সরকারি আমলা, দাদন ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, জ্যোতদার ও শিল্পপতিসহ স্থানীয় প্রভাবশালীরা জালদলিল ও ভুয়া রেকর্ডপত্রের মাধ্যমে খাস জমি অবৈধভাবে নিজেদের নামে নামজারি করে ভোগদখল করছে। অনেক জায়গায় সরকারের বরাদ্দ দেয়া খাস জমি থেকেও অনেক ভূমিহীনকে বিতাড়িত করে দখলে নিয়েছে প্রভাবশালীরা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে মোট ভূমির পরিমাণ ৩ কোটি ৭৪ লক্ষ একর, যার ৬০% হচ্ছে কৃষি জমি। খাস জমি (কৃষি ও অকৃষি) ও খাস নীরাভূমির পরিমাণ হচ্ছে ৫০ লক্ষ একর। খাস জমির ৮৮% ধনী ও প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে দখল করে আছে। মাত্র ১২% খাস জমি ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। বণ্টনকৃত খাস জমির উপর অধিকার বজায় রাখতে পেরেছে মাত্র ৪৬% সুফলভোগী ভূমিহীন কৃষক। এক একর খাস জমির দখল পেতে এবং রাখতে হলে গড়ে ৭-১০ হাজার টাকার উৎকোচ দিতে হয়।
খাস জমি-নীরাভূমির বণ্টন প্রক্রিয়ায় গ্রাম্য টাউট, মাতব্বর, অসৎ রাজনীতিবিদ ও শহরে উঠতি বুর্জোয়াদের একটা পরজীবী আঁতাত (অর্থাৎ দুর্বৃত্তায়ন চক্র) গড়ে উঠেছে, যা বাংলাদেশে প্রকৃত মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা।’ সরকারের নাকের ডগা দিয়ে ভূমিহীনদের কিছু কথিত প্রভাবশালীরা নিষ্পেষিত করলেও সরকার এ বিষয়ে দিনের পর নিষ্ক্রিয় থাকছে।
২০০৫ সালে দেশে ভূমিহীনের সংখ্যা ছিলো ৩৪ লাখ। বর্তমানে সরকারি হিসেবে তা ৪৮ লাখ বলে জানা গেছে। কিন্তু বেসরকারি হিসেবে সারাদেশে ভূমিহীনদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭১% জমির মালিক হচ্ছে দেশের ধনী ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ২২% জনগণ। অথচ ভূমি বিশেষজ্ঞদের মতে- দেশে যেহেতু ১ কোটি ভূমিহীন রয়েছে। অপরদিকে ৫০ লাখ একর খাস জমি রয়েছে। আর এই জমি দিয়ে প্রত্যেক ভূমিহীন পরিবারকে ০.৫০ একর বা ৫০ শতক খাস কৃষি জমি ও নীরাভূমি বণ্টন করা সম্ভব।
লেখাবাহুল্য, সারাদেশের বিভিন্ন চরবর্তী এলাকাগুলোতে প্রচুর পরিমাণে সরকারি খাস জমি রয়েছে যেগুলো খাস খতিয়ানে নেই। এই বিপুল পরিমাণ খাস জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করাও সম্ভব হচ্ছে না একটি বিতর্কিত আইনের কারণে। তা হলো শিকস্তি-পয়স্তি আইনের কারণে। আসলে বিদ্যমান নদী শিকস্তি-পয়স্তি আইনে যদিও বলা হয়েছে ৩০ বছরের মধ্যে শিকস্তি জমি পয়স্তি হলে তা পূর্বতন মালিককে ফেরত দেয়া হবে; কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। বিদ্যমান নদী শিকস্তি-পয়স্তি আইনটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সংশোধিত আইনে পুরোনো এবং নতুন দু’ধরনের চর নিয়েই বিবাদ তৈরি হয়েছে। পুরোনো চরে ১৯৯৪ সালের আগে যেসব ভূমিহীন বসবাস করতো, নতুন আইন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের উৎখাতে নেমে পড়ে জ্যোতদার ও ভূ-সন্ত্রাসীরা। নোয়াখালী, বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুরের বিভিন্ন চর থেকে গত ১০ বছরে বেশ হাজার হাজার ভূমিহীনকে উৎখাত করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ৩ মে-২০১৭ প্রধানমন্ত্রী বলেছে- ‘প্রত্যেক ভূমিহীনদের পুনর্বাবসন করা হবে।’ কিন্তু আমরা প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করতে পারছি না। কারণ এ পর্যন্ত শুধু প্রধানমন্ত্রীই নয়; বিভিন্ন সরকারি মন্ত্রী-এমপি’রাও ভূমিহীনদের ভূমির ন্যায্য অধিকার দেয়ার কথা বলেছে। কিন্তু সেগুলো শুধুই অতীত এবং চিড়ে ভেজানো কথা। বাস্তবে ভূমিহীনরা বছরের পর বছর বাংলাদেশের মতো স্বাধীন ও উন্নয়নশীল একটি দেশের মধ্যে বৈষম্যের কষাঘাতে জর্জরিত হচ্ছে। অপরদিকে দেশের কর্তাব্যক্তিরা দেশকে ডিজিটাল করা নিয়ে ব্যস্ত আছে। কিন্তু কখনোই দেশ সত্যিকার অর্থে ডিজিটাল হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না দেশের দারিদ্র্য ও ভূমিহীনতা সম্পূর্ণরূপে দূরীকরণ করা সম্ভব হবে। তাই সরকারের উচিত হবে- অবিলম্বে দেশের ভূমিহীনদের ভূমির ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা।
এজন্য সরকারকে ১৯৮৪ সালে ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ অনুযায়ী বর্গা আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। সিলিং আইন সক্রিয় করতে হবে এবং সিলিং উদ্বৃত্ত জমি প্রকৃত ভূমিহীনদের মাঝে বন্দোবস্ত দিতে হবে। চরের সব জমি দিয়ারা জরিপ শেষে খাস খতিয়ানভুক্ত করে প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে সঠিকভাবে বণ্টন করতে হবে। ১৯৯৪ সালের শিকস্তি-পয়স্তি আইনের সংশোধনী বাতিল করতে হবে। চরের খাস জমি নদীভাঙ্গা পরিবারের অগ্রাধিকার দিয়ে ভূমিহীনদের মাঝে অবিলম্বে বন্দোবস্ত দিতে হবে। আর জমি নিয়ে হয়রানি, দুর্নীতি বন্ধ করতে ভূমি ব্যবস্থাপনাকে পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি খাত ও প্রধান রাজনৈতিক দলের সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। ব্রিটিশ বেনিয়া আমলের ভূমি ব্যবস্থাপনা আইন রহিত করে পবিত্র দ্বীন ইসলাম অনুযায়ী আইন জারি করে ভূমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটালাইজড পদ্ধতি চালু হলে ভূমি জরিপ ও মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি, জমি কেনা-বেচা নিয়ে জাল-জালিয়াতি বন্ধ, পর্চা-মৌজার নকশা সংগ্রহে হয়রানি বন্ধ, খাস জমি উদ্ধার, সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় ও খাস-কবলা, বায়নাপত্র, চুক্তিপত্র, বণ্টননামা, অংশনামা, ফ্ল্যাট বাড়ি ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত রেজিস্ট্রেশনে ঘুষ, দুর্নীতি ও হয়রানি বন্ধ হবে।
প্রসঙ্গত আমরা মনে করি যে, যে দেশে ভূমিহীনদের সংখ্যা কোটির উপরে, সেদেশে এতো বিশাল ভূমি বেহাত হয়ে থাকতে পারে না এবং অব্যবহৃত হয়েও থাকতে পারে না। এসব ভূমি অবশ্যই অবিলম্বে সত্যিকার ভূমিহীনদের মাঝে বণ্টনে সরকাকে এগিয়ে আসতে হবে।
-আল্লামা মুহম্মদ ওয়ালীউল্লাহ, ঢাকা।
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০