কথাটা হচ্ছে- ‘এগিয়ে যাওয়া।’
প্রধানমন্ত্রী বারবার এ উচ্চারণ করে থাকে।
দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়।
অনেকটাই এগিয়ে আনা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। আরো এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখানো হয়।
আসলে কতটুকু এগিয়েছি আমরা?
গত ৯ অক্টোবর-২০১৭ পত্রিকায় প্রকাশিত তিনটি খবর বিশ্লেষণে এগিয়ে যাওয়ার মাপকাঠি মূল্যায়নের অবকাশ পাওয়া যায়। প্রথম ঘটনাটি এরকম-
“সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ আয়েশা বেগম। স্বামীর নাম জহিরুল ইসলাম। সুন্দর আগামীর স্বপ্নে বিভোর হয়ে জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন জহিরুল ইসলাম। সেই স্বামীর মৃত্যুর পর যে এমন অসহায় অবস্থায় পড়তে হবে, তা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি আয়েশা বেগম। ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর মারা যায় জহিরুল ইসলাম। স্বামীর মৃত্যুর পর সরকারের দেয়া মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ যাবতীয় সুবিধা পাওয়ার কথা তার স্ত্রী আয়েশা বেগমের। অথচ তারই ঔরশজাত সন্তান বৃদ্ধ মাকে বঞ্চিত করে নিজেই সে ভাতা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই ভাতার লোভে নিজের মায়ের বিষয়ে অভিযোগ তুলে বলছে, তার মা তার বাবার স্ত্রী নয়। এখানেই শেষ নয়; বৃদ্ধার মাথাগোজার জন্য যে বাড়িটি ছিল নিজ নামে, তারই বিত্তলোভী সন্তানরা তাকে সেই বাড়ি থেকেও বের করে দিয়েছে। অথচ সন্তানরা কিন্তু অভাবগ্রস্ত নয়। তার আট সন্তানের মধ্যে আটজনই অবস্থাসম্পন্ন।
আয়েশা বেগমের ৯ ছেলেমেয়ে। রিয়াজুল হক নামে তার এক ছেলে ইংল্যান্ডে এবং ময়নুল হক নামে এক ছেলে ইতালি থাকে। ইমামুল হক নামে একজন গুলিস্তানে কাপড়ের ব্যবসা করে। রেহানা বেগম নামে এক মেয়ে টঙ্গী থাকে। মুশি নামে এক মেয়ে মগবাজার থাকে। শাবানা নামে এক মেয়ে ইতালি থাকে। আরেক ছেলে মারা গেছে। সবাই অবস্থাসম্পন্ন; কিন্তু কেউ তার খোঁজ নেয় না। তারা সবাই ব্যস্ত নিজেদের জীবন নিয়ে।”
বলাবাহুল্য, মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের এমন অকৃতজ্ঞতা তথা কৃতঘœতার ইতিহাস পুরানো। অনেক আগের। এ বঙ্গ অববাহিকায় তা কল্পনাতীত হলেও অকল্পনীয়ভাবেই বহু নজির দেখা গেছে। এর পরিবর্তন বহু আগ থেকেই প্রত্যাশিত ছিলো। কিন্তু পূরণ হলো কই? এ কৃতঘœ মানসিকতা একেবারে শূন্যের কোঠায় না হলে তার অনুপাত যদি আগ থেকে কমতো তাহলেও কিছুটা স্বস্তি হতো। কিন্তু তাও তো নয়। পেপার-পত্রিকায় এমন ঘটনা প্রকাশের সংখ্যা তো অতীত থেকে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাক্ষাৎ প্রমাণস্বরূপ একই দিনের আরেকটি খবর-
“নেত্রকোনায় সম্পত্তির লোভের কারণে দুই ইঞ্জিনিয়ার ছেলের হাতে নির্যাতিত হয়েছে এক মা। ভাই-বোনকে বঞ্চিত করে অবৈধপন্থায় পৈতৃক সম্পত্তি নিজেদের নামে ইচ্ছে মাফিক লিখে নিতে সহায়তা না করায় নিজ মাকে দফায় দফায় মারধর করেছে তার দুই ইঞ্জিনিয়ার ছেলে। গত ৮ অক্টোবর-২০১৭ ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) বিকেলে ছেলেদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এনে নেত্রকোনায় সংবাদ সম্মেলন করেছে বৃদ্ধ মা মাজেদা বেগম (৬৫)।”
বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রধানমন্ত্রীর সরকার বৃদ্ধার ছেলে-মেয়ে অবস্থাসম্পন্ন অথবা শিক্ষিত তথা ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছে। কিন্তু তারপরও তারা সে আগের অশিক্ষিত অথবা দরিদ্র কুলাঙ্গারদের মতোই রয়েছে। বরং অতীতের চেয়ে আরো নিকৃষ্ট হয়েছে। এবং সংখ্যায়ও বেড়েছে বহুগুণে। উল্লেখ্য, এর মাত্র কয়েকদিন পূর্বে পত্রিকায় আরেকটি খবর বের হয়-
“সত্তরোর্ধ্ব সাফাক আরা সোবহান ওরফে পারুল। স্বামী ছিলো নামকরা চিকিৎসক। রাজধানীর বনানীতে আছে বিরাট বাড়ি। আছে উত্তরাতেও। যার আনুমানিক মূল্য দেড়শ’ কোটি টাকা। বড় ছেলে মাহবুব চিকিৎসক। দুই মেয়ের একজন বিসিএস ক্যাডার। পরিবারে আছে বলতে ছেলে, ছেলের বউ আর নাতি-নাতনী। চিকিৎসক স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে ভালই কাটছিল। তবে স্বামীর মৃত্যুর পর বদলে যায় সব। তুমুল ঝড়-বৃষ্টির এক রাতে বাড়ি থেকে বের করে দেয় তার ছেলে। কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় অসহায়ের মতো ঘুরছিলো। সহায়তার হাত বাড়ায় কেউ একজন। পৌঁছে দেয় বনশ্রীতে এক স্বজনের বাসায়। সেখানেই কিছুদিন আশ্রয় হয় তার। বারবার সংসারে ফেরত আসতে চাইলেও ছেলে অনুমতি দেয়নি।”
তাহলে কী বলতে হবে? কোন্দিকে এগিয়েছি আমরা?
কতজনে এগিয়েছি আমরা?
শুধু সম্পদ আর অবকাঠামোর উন্নতিই কী এগুনো?
সচ্ছল আর তথাকথিত সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত হয়ে নিজের মাকে পেটানোই কি এগুনো? বলার অপেক্ষা রাখে না, মনুষত্ব, মানবিক মূল্যবোধ, পারিবারিক বন্ধনের মূল্যায়নের অবক্ষয়কে কখনো এগিয়ে যাওয়া বলা যায় না।
অপরদিকে এগুনোর পরিবর্তে যে আমরা অনেক পিছিয়েছি তার প্রমাণ ঢের। কারণ অতীত বাংলার ইতিহাসে যে মায়ের অবস্থান তা নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে সন্তানের জীবন রক্ষার উদাহরণ ভুরিভুরি। কিন্তু আজ ডিজিটাল বাংলাদেশের শাশ্বত মাতৃত্বের মৃত্যু ঘটেছে। একইদিনে পত্রিকায় বিপরীত আরেকটি খবর-
“আট মাসের কন্যা শিশুকে পুকুরে ফেলে রাতের অন্ধকারে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়েছে এক ‘মা’। মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরি এলাকার একটি পুকুর থেকে তাহা ইসলাম নামে ওই শিশুর ভাসমান মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। শিশুটি বানিয়াজুরি ইউনিয়নের শোলধরা গ্রামের সোহেল মিয়ার মেয়ে। এলাকাবাসী ধারণা, শিশুটির মা তার পরকীয়া প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। শিশুটির লাশ সকালে উদ্ধার করা হলেও তার মা ও স্থানীয় এক যুবককে এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে না।”
প্রসঙ্গত, পরকীয়ার জন্য মা কর্তৃক সন্তান হত্যা এখন অহরহ হচ্ছে। এদিক থেকে স্পষ্টভাবে বলতে হচ্ছে- দেশে এখন পারিবারিক বন্ধন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে জঘন্যভাবে পশুবৎ প্রবৃত্তির দিকে যাচ্ছে।
বলাবাহুল্য, এ যাওয়া, এগিয়ে যাওয়া নয়।
পরকিয়ার জন্য আপন সন্তান হত্যা? মানসিকতায় বৈকল্য এগুনো নয়? এ যাওয়া পিছিয়ে যাওয়া। এ যাওয়া মনুষত্বের মৃত্যু হওয়া। এ মৃত্যু আমাদের কাম্য নয়। এ এগিয়ে যাওয়া আমাদের কাঙ্খিত নয়। এ এগিয়ে যাওয়া বাঞ্ছিত নয়। এ এগিয়ে যাওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। এ এগিয়ে যাওয়া শোভনীয় নয়।
এ এগিয়ে যাওয়া সভ্যতা নয়।
আর অসভ্যতার সংমিশ্রণে উন্নতি তথা এগিয়ে যাওয়া আমরা সমর্থন করতে পারি না।
মূলত, রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীনরা ইসলামবিমুখ হওয়ায় কর্মমুখী শিক্ষার নামে নাস্তিক্যবাদী ও বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছে। যার কারণে এ সামাজিক বিপর্যয়।
নিরেট বাস্তবতা হলো- কর্মমুখী শিক্ষার নামে নাস্তিক্যবাদী ও বস্তুবাদী সিলেবাসের গাদা গাদা বই পড়ে বড় অফিসার হয়তো হওয়া যায় কিন্তু ‘মানুষ’ হওয়া যায় না।
তাই সঙ্গতকারণেই আমরা মনে করি- ‘এগিয়ে যাওয়া’ কথাটির ব্যবচ্ছেদ করতে হবে। বিশ্লেষণ করতে হবে।
ঢালাওভাবে ‘এগিয়ে যাওয়া’র প্রচারণায় প্রলুব্ধ করা যাবে না। বরং নৈতিকতা, সভ্যতা, আদব-শিষ্টাচার, পরস্পরের হক্ব রক্ষা তথা পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার পথে পরিচালিত হওয়াই প্রকৃত ‘এগিয়ে যাওয়া’। সেদিকেই দেশবাসীকে ধাবিত করতে হবে। ক্ষমতাসীন সরকারকে তা সম্যক উপলব্ধি করতে হবে।
-আল্লামা মুহম্মদ মাহবুবুল্লাহ, ঢাকা
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০