ভারতে কোনো বোমা হামলা, সন্ত্রাসী তৎপরতা দেখা গেলেই মুসলিমব্যক্তিত্ব ও মুসলিম সংগঠনগুলোর নাম ভেসে আসে। ভারতীয় মিডিয়া ব্যাপকভাবে প্রচার করতে থাকে পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান, লস্কর-ই-তৈয়েবা ইত্যাদি দায়ী। একেবারে ‘সুস্পষ্ট’ প্রমাণের ভিত্তিতেই এসব দাবি করা হয়। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে সমঝোতা এক্সপ্রেস, মালেগাঁও, আজমির শরীফ, মক্কা মসজিদে হামলার পর এ দৃশ্য ব্যাপকভাবে দেখা গেছে। এসব ঘটনায় ব্যাপক ধরপাকড়, নির্যাতন ও সবশেষে ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও’ দেখা গেছে। মুসলিম তরুণরা নিরাপত্তা বাহিনীর সহজ শিকার হয়ে থাকে। কিন্তু সম্প্রতি কট্টর হিন্দুত্ববাদের ধ্বজাধারী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) নেতা স্বামী অসীমানন্দের বক্তব্যে হাক্বীক্বত ফাঁস হয়ে গেছে। আর সেই সাথে জানা গেল, মুসলিম তরুণরা নয়, কট্টর হিন্দুরাই এসব হামলা চালিয়েছিল।
হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের অন্যতম চরিত্র অসীমানন্দ ১৮ ডিসেম্বর তিস হাজারি আদালতে মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট দীপক দাবাসের কাছে ফৌজদারি দ-বিধি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। তিনি আরএসএস ও অন্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি কয়েকজন আরএসএস নেতার নামও প্রকাশ করেছেন।
ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভিস্টিগেশন (সিবিআই) তাকে গত নভেম্বরে হরিদ্বার থেকে গ্রেফতার করে। সে স্পষ্টভাবেই জানায়, তারাই আজমির শরীফ, মক্কা মসজিদ, মালেগাঁও ও সমঝোতা এক্সপ্রেসে হামলা চালিয়েছিল। সে বলে, ‘বোমার বিনিময়ে বোমা’ নীতি অনুসরণ করে সে এ হামলা চালিয়েছিল। ৪২ পৃষ্ঠার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে সে বলে, সন্ত্রাসী কার্যকলাপে আরএসএস নেতা ইন্দ্রেস কুমার, সুনীল যোশি, প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরসহ অনেক নেতাই জড়িত।
সে আরও জানায়, মালেগাঁওয়ের ৮০ শতাংশ মানুষ মুসলমান হওয়ায় আমরা সেখানেই বিস্ফোরণ ঘটানোর (২০০৬ ও ২০০৮) পরিকল্পনা করি। সে জানায়, হিন্দুরা যেহেতু আজমির শরীফে যায়, তাই আমি ভেবেছিলাম আজমিরে বিস্ফোরণ (২০০৭) ঘটানো হলে হিন্দুরা সেখানে যেতে ভয় পাবে।
মক্কা মসজিদে হামলা (২০০৭) চালানোর কারণ হিসেবে সে বলে, হায়দরাবাদের নিজাম ভারতবর্ষ বিভক্তিকালে পাকিস্তানের সাথে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। সমঝোতা এক্সপ্রেসে হামলা (২০০৭) চালানো প্রসঙ্গে সে বলে, যেহেতু এই ট্রেনটি প্রধানত পাকিস্তানিরা ব্যবহার করে।
স্বামী অসীমানন্দের এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর পর ভারতের মানবাধিকার কর্মী মনীষা শেঠি কিছু বিশ্লেষণ উত্থাপন করেছে। সে বলে, অথচ গত কয়েক বছরে এসব হামলার জন্য কোনো প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও অসংখ্য মুসলিম তরুণকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের উপর নির্যাতন চালানো হয়েছে এবং এমনকি তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিটও দাখিল করা হয়েছে।
অথচ অসংখ্য প্রতিবেদনে প্রকাশিত হচ্ছিল মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশের পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবেই হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলোকে সন্দেহের তালিকার বাইরে রাখছিল। ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ঢিলেমির কারণেই সত্য প্রকাশিত হতে এত দেরি ঘটল। এমনকি ২০০৮ সালেও বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যেতে পারত। সেই সময়েই মহারাষ্ট্র এটিএস প্রধান হেমন্ত কারকারে হায়দরাবাদ পুলিশকে জানিয়েছিল, কর্নেল পুরোহিত ২০০৬ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের দায়িত্ব পালনের সময় সেনাবাহিনীর গুদাম থেকে আরডিএক্স সরিয়ে হিন্দুত্ববাদী গ্রুপের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন।
সেই সূত্র ধরে তদন্তকাজ চালানো হলে অনেক রহস্যের সমাধান হয়ে যেত। অথচ তা না করে হায়দরাবাদ পুলিশ অন্তত ৭০ জন মুসলিম তরুণকে গ্রেফতার করে তাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নিয়েছিল। কিন্তু তারা পুরোহিতকে তাদের হেফাজতে নেয়ার অনুরোধ পর্যন্ত করেনি। সমঝোতা এক্সপ্রেসে হামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আরডিএক্স’র ব্যবহার দেখেই নিশ্চিত হয়ে যায় এটি নিশ্চিতভাবেই পাকিস্তানিদের কাজ।
মুসলমানদের প্রতি নিরপেক্ষতার পরিবর্তে চলছে চরম নিপীড়ন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইন্ডিয়া টুডে বা অন্যান্য পত্রিকায় এক্সক্লুসিভ বা স্কুপ হিসেবে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, সেগুলো আসলে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোরই জোগান দেয়া তথ্য। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তাদের প্রিয় সাংবাদিকদের প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে থাকে। আর পত্রিকায় তাদের সরবরাহ করা সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর তারা তাদের ইচ্ছামতো গ্রেফতার অভিযান চালিয়ে যেতে পারে। মক্কা মসজিদের বিস্ফোরণের পর একইভাবে স্থানীয় মুসলিম যুবকদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। ইসলামী সন্ত্রাসবাদ দমনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে অবৈধভাবে আটক, নির্যাতন, আটকে রেখে স্বীকারোক্তি আদায়, নারকো টেস্ট ইত্যাদি সব কিছুই চালানো যায়।
শুধু মিডিয়ায় নয়, সরকারি দায়িত্বশীল অংশ থেকেও দায়িত্বহীন মন্তব্যও কম প্রকাশিত হয় না। ২০০৭ সালের ১১ অক্টোবর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করে, আজমির শরীফে-এর বিস্ফোরণের জন্য দায়ী লস্কর-ই-তৈয়েবা। পরদিনই প্রবীণ স্বামী চিৎকার করে জানাল, এটি আসলে লোকায়ত ইসলামের বিরুদ্ধে কট্টরপন্থীদের যুদ্ধ।
কিন্তু এখন জানা গেল, এটি লোকায়ত ইসলামের বিরুদ্ধে কট্টরপন্থীদের যুদ্ধ নয়, বরং ভারতে ঐতিহ্যবাহী সমন্বয়বাদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের হামলা। অসীমানন্দ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বলেছে, ‘যেহেতু হিন্দুরা আজমির শরীফে যায়, তাই আমরা ভেবেছি আজমিরে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হলে হিন্দুরা সেখানে যেতে ভয় পাবে।’
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এখন কী করবে? ভুল কি তারা স্বীকার করবে? ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শ্বেতপত্র প্রকাশ করে এসব বিস্ফোরণে ঠিক কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার হিসাব দিতে পারে। স্বামী অসীমানন্দের স্বীকারোক্তির পর এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, এসব হামলা তার সংগঠন ও সহযোগীদের কাজ। (ইনশাআল্লাহ চলবে)
-মুহম্মদ তা’রীফুর রহমান
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০