কিছুদিন আগেও সন্ত্রাসীবাদের আখড়া দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বিশেষ বদনাম জুটেছিল।
কিন্তু আজকের পরিস্থিতিতে ভারতে জঙ্গিবাদী কার্যকলাপ নতুন চেহারায় হাজির হয়েছে।
বর্তমানে মাঠে হাজির হয়েছে ‘হিন্দু জঙ্গিবাদ’। বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও গুজরাট দাঙ্গায় সাম্প্রদায়িক দাপটের যে চেহারাটি দেখা গিয়েছিল; এটা তারই সম্প্রসারণ।
ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী মায় গণমাধ্যমেরও বুনিয়াদি বিশ্বাসও ছিল তাই। কিন্তু এখন তাদের পান্ডুলিপি বদলাতে হচ্ছে। পুরনো তত্ত্ব ঝাড়পোছ করতে হচ্ছে। কারণ, দেখা যাচ্ছে গত কয়েক বছরের বেশির ভাগ সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে জড়িত খোদ বিজেপি’র লোকজন। ভারতের একদল লেখক-সাংবাদিক-মানবাধিকার কর্মীরা অনেক আগেই ঘণ্টা বাজিয়ে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের এই উত্থানের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। তাদের অভিযোগের আঙুল ছিল বিজেপির লোক-লস্করদের দিকে। কিন্তু সব দেশেই কর্তাদের টনক এতই অনড় যে, তারা দ্বিতীয়বার ভাবতে বসেননি। উল্টো দোষানো হয়; সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর বদনাম হচ্ছে। আজ পরিস্থিতি উল্টে গেছে। সরাসরি নাশকতার অভিযোগে এক সন্ন্যাসিনী ও এক কর্মরত কর্নেলকে আটক করা হয়েছে। রাজ্যে রাজ্যে পাওয়া যাচ্ছে কর্মী ও আলামত। জেরার মুখে হিন্দু জঙ্গিবাদী নেটওয়ার্কের গুমর ফাঁস হচ্ছে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ তো সাপ, আস্ত আজদাহাই যেন বেরিয়ে আসছে।
এরই মধ্যে গত আগস্টে ভারতীয় সাপ্তাহিক তেহেলকায় কংগ্রেস এমপি দিদ্বিজয় সিং ভারতে সাম্প্রতিক বোমা বিস্ফোরণগুলির জন্য বিজেপিকে চিহ্নিত করেন। পার্লামেন্টে তথ্যপ্রমাণ হাজির করার কথাও ছিল তার। তার আগেই জঙ্গিবাদের সঙ্গে বিজেপি পরিবারের আঁটঘাট চাউর হলো। তাদের ভারতজোড়া প্রস্তুতি নিয়ে গণমাধ্যমে যা এসেছে, তাতে অনেকের পিলে চমকানোর যোগাড়। বিভিন্ন রাজ্যে চালু আছে প্রশিক্ষণ শিবির। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো হিন্দু জনজাগরণ মঞ্চ, পানভেলের সান্তনা আশ্রম এবং সেন্ট্রাল হিন্দু মিলিটারি এডুকেশন সোসাইটির ভোনশালা মিলিটারি স্কুল। এমনকি কর্মরত কয়েকজন সেনা অফিসারের নামও চলে এসেছে তালিকায়। এসব থেকে ভারতে সন্ত্রাসবাদের নতুন মুখচ্ছবিটা ধরতে পারা যায়। বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক আদর্শের সঙ্গে মিলিয়ে একে বলা হচ্ছে, ‘হিন্দু সন্ত্রাসবাদ’। তবে যে ধর্মেরই লোক এ ধরনের তৎপরতা চালাক, তার জন্য ওই ধর্মবিশ্বাস ও তার অনুসারীদের নির্বিচারে দায়ী করার বুশীয় খাসলত বিষয়ে সাবধান থাকা দরকার। ধর্মবিশ্বাসের চেয়ে বরং গোড়ার রাজনৈতিক স্বার্থটির দিকে মনোযোগ দেয়াই যুক্তিযুক্ত।
ওই আজদাহার ফণা আরএসএস তথা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। এর প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২৫ সালে ইতালির ফ্যাসিস্ট নেতা মুসোলিনীর আদর্শে। বিজেপি এর রাজনৈতিক শাখা। উগ্র সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি বাস্তবায়নে সামরিক ও সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণের ঘটনাও তাদের জন্য নতুন নয়। অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত বেঙ্গল ডিভাইডেড গ্রন্থে জয়া চ্যাটার্জি দেখিয়েছেন, কীভাবে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার অনেক আগে থেকেই শরীর চর্চা ক্লাবের আড়ালে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। মজুদ করা হচ্ছিল গোলা-বারুদ। সেসময়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলোতে এসবের আকছার ব্যবহারের নজিরও তিনি দিয়েছেন। জয়া চ্যাটার্জিসহ আজকের গবেষকরা তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বলছেন, সেসময়কার হিন্দুত্ববাদীদের কার্যকলাপেই সাম্প্রদায়িক দেশভাগ ছিল অনিবার্য।
মূলত: হিন্দুরা এখন খোদ বাংলাদেশ দখলেও মরিয়া হয়ে উঠেছে। আর তা এখন রাখঢাকের মধ্যেও থাকছে না। বিভিন্ন ওয়েব সাইটেও তা স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে। নিম্নে এর উদাহরণ দেয়া গেলো : গত ০৪ অক্টোবর/২০১১ অনলাইন পত্রিকা এখন সময়-এ খবর হয়েছে-
‘সিলেট থেকে খুলনা পর্যন্ত দখল করার দাবি করেছে জনতা দল নেতা সুব্রাহ্মনিয়ান স্বামী’
বিশেষ সংবাদদাতা : ‘বাংলাদেশের সিলেট থেকে খুলনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ও কাশ্মীরের পাকিস্তান শাসিত অংশের দখল নেয়া হোক। তাহলে আগামী পাঁচ বছরেই সন্ত্রাসবাদের কবল থেকে ভারত মুক্ত হবে।’ এ মন্তব্য জনতা দলের নেতা সুব্রাহ্মনিয়ান স্বামীর। ভারতের ইংরেজি দৈনিক ডিএনএ’র উত্তর সম্পাদকীয়তে তিনি এ দাবি করেছেন। সেই সঙ্গে ভারতের মুসলিমদের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার কথাও তিনি বলেছেন। এই চূড়ান্ত জাতি বিদ্বেষী মন্তব্যের কারণে মহারাষ্ট্রের সংখ্যালঘু কমিশন সুব্রাহ্মনিয়ান স্বামীকে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে।
জয়পুর, মুম্বাই ও দিল্লি থেকে প্রকাশিত ডিএনএ’তে ১৬ জুলাই একটি উপ-সম্পাদকীয় লিখেছেন হার্ভার্ড বিশ¡বিদ্যালয়ের ডক্টরেট হাসিলকারী সুব্রাহ্মনিয়ান স্বামী।
‘হাউ টু ওয়াইপ আউট ইসলামিক টেরর’ শীর্ষক এ উপ-সম্পাদকীয়তে তার দাবি, ভারতে সন্ত্রাসবাদীদের বাড়বাড়ি ঠেকাতে অবিলম্বে মুসলিমদের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া উচিত। এর বিরোধিতা করে মহারাষ্ট্র সংখ্যালঘু কমিশনের উপ-চেয়ারম্যান ইব্রাহিম মাথাই চিঠি দিয়েছেন মুম্বাইয়ের পুলিশ কমিশনার অরূপ পট্টনায়েককে। তার দাবি, ভারতীয় দ-বিধির ১৫৩(৩) ধারায় ফরিয়াদি অভিযোগ দায়ের করে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে পুলিশকে। সংখ্যালঘু কমিশনের উপ-চেয়ারম্যান লিখেছেন, সুব্রাহ্মনিয়ান স্বামীর নিবন্ধ নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করেছে সংখ্যালঘুদের মনে, ‘যে চূড়ান্ত জাতিবিদ্বেষী চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে নিবন্ধে। তা চূড়ান্ত অস¡স্তির। এ নিবন্ধ সম্পূর্ণভাবে ইসলামবিরোধী ও সামাজিক দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক। এটি অত্যন্ত আশঙ্কাজনক যে, বাক স্বাধীনতার অপব্যবহার করে ইসলামভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন স্বামী।’
এ প্রসঙ্গে মাথাই লিখেছেন, তথাকথিত ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের একতরফাভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কোনো অর্থ হয় না। কেননা, এদেশের কারাগারে এমন ‘হিন্দু সন্ত্রাসবাদী’রা রয়েছে যারা একই ধরনের জঘন্য অপরাধে অভিযুক্ত।’ সংখ্যালঘু কমিশনের উপ-চেয়ারম্যানের অভিযোগ, ভারতীয় সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারাও লংঘন করেছেন ড. সুব্রাহ্মনিয়ান স্বামী। কারণ, প্রতিটি নাগরিকের নিজের ধর্ম বেছে নেয়ার যে অধিকার সংবিধানে রয়েছে, তা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নিবন্ধে সুব্রাহ্মনিয়ান সুপারিশ করেছেন, মুসলিমদের ইসলাম থেকে হিন্দুত্বে ধর্মান্তরিত করতে হবে। জনতা পার্টির নেতা সুব্রাহ্মনিয়ান স্বামী ডিএনএ ইংরেজি দৈনিকে যে অভিমতমূলক নিবন্ধ লিখেছেন তার কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ হলো- এক. ভারতে একটি সাচ্চা হিন্দু দল গঠন করতে হবে। সেই দল কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে।
দুই. ভারতের মুসলিমদের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে হবে। কেননা তাদের পূর্বপুরুষ হিন্দু, একথা তারা মানে না।
তিন. কাশ্মীরের জ্ঞানভাপী মসজিদও পূর্বতন মন্দিরের উপর তৈরি করা হয়েছে। এজন্য ৩০০টি অন্যান্য মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়া হোক।
চার. দখল নেয়া হোক কাশ্মীরের পাকিস্তানশাসিত অংশ ও বাংলাদেশের সিলেট থেকে খুলনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
পাঁচ. হিন্দুধর্ম থেকে অন্য ধর্মে দীক্ষিতকরণ নিষিদ্ধ করা হোক।
ছয়. ২০১২-এর পর ইসলাম হিন্দু ধর্মকে ধ্বংস করার সংগ্রাম শুরু করবে… ইত্যাদি। জানা গেছে, সুব্রাহ্মনিয়ান এহেন বিভেদকামী পরিকল্পনার কথা হার্ভার্ড বিশ¡বিদ্যালয়ের অনেকেই ভালোভাবে নেয়নি। ওই বিশ¡বিদ্যালয়ের ছাত্ররা হার্ভার্ড সামার স্কুলের প্রশিক্ষকের পদ থেকে সুব্রাহ্মনিয়ান স¡ামীকে অপসারণ করার দাবি জানিয়েছে। (ইনশাআল্লাহ চলবে)
-মুহম্মদ তা’রীফুর রহমান
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০