বাগেরহাটের রামপালে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা বেশ জমে উঠেছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক সুন্দরবনসংলগ্ন হওয়ায় দেশীয়-আন্তর্জাতিক পরিবেশবিদ, পেশাজীবী, রাজনৈতিক দলসহ দেশের প্রায় সব শ্রেণীর মানুষই এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে। তারা দাবি করছে, প্রস্তাবিত এ বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবন অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যাবে বা ঐতিহ্য হারাবে। বিষয়টি নিয়ে ইউনেস্কোও উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রকল্পটি নিরাপদজনক দূরত্বে স্থানান্তরের জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে।
শুরু থেকেই ব্যাপক বিরোধিতা হলেও সরকার কারো প্রতিক্রিয়াকে তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছে বলে মনে হয় না। বরং প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না বলে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকেও কাজে লাগানো হচ্ছে। এমনকি বিরোধিতাকারীদের জাতীয় উন্নয়নের প্রতিপক্ষ হিসেবেও আখ্যা দেয়া হচ্ছে।
বলা হচ্ছে, যারা এ প্রস্তাবিত প্রকল্পের বিরোধিতা করছে তারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নয়। তবে যারা প্রকল্পের পক্ষে সাফাই করছে তারাও যে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নয়, এ কথাও তো অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। আর কোনো বিষয়ে কথা বলতে গেলেই যে বিশেষজ্ঞ হতে হবে, এমনটি মনে করারও কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না।
সরকার ছাড়া এই প্রকল্পের পক্ষে কাউকেই কথা বলতে শোনা যাচ্ছে না। বিরোধিতা যত বাড়ছে, সরকারপক্ষের আত্মপক্ষ সমর্থনও ততই তীব্র হচ্ছে। ভাবসাব এ রকম যে, প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন হলে দেশের সব সমস্যার স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমাধান হয়ে যাবে। এদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধীদের প্রযুক্তিজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। দেশের উন্নয়নকে যারা বাধাগ্রস্ত করতে চায়, তারাই রামপালের বিরোধিতা করছে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেছে, এই প্রকল্প কেউ আটকে রাখতে পারবে না। অর্থাৎ অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার যেকোনো মূল্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বদ্ধপরিকর।
সুন্দরবন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কার্বন শোষণকারী অরণ্য। সেখানে কয়লাচালিত তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে বিনিয়োগকৃত প্রকল্পও ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। কারণ এ প্রকল্পের দরুন পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাবে, ফলে পরিচালন সৃষ্টি হতে পারে। ঝড়ো বাতাসসমেত সাইক্লোন তৈরি হতে পারে, যা পরবর্তী ১০ বছরই প্রকল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
উল্লেখ্য, ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার এবং আইইউসিএনের একটি প্রতিবেদনে এ প্রকল্প সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু উদ্বেগ উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাতাসে কয়লার ছাই, বর্জ্য পানি ও ছাইয়ের দরুন দূষণ সৃষ্টি হতে পারে। বেড়ে যাবে জাহাজ চলাচল ও ড্রেজিং। এছাড়া ক্রমবর্ধমান শিল্প ও অন্যান্য অবকাঠামোগত প্রভাবকেও সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত করা হয়।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৭০ শতাংশ অর্থ ঋণ দেবে ভারতের এক্সিম ব্যাংক। বাকি ৩০ শতাংশ পিডিবি ও এনটিপিসি যৌথভাবে বিনিয়োগ করবে। সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই কেন্দ্র স্থাপনে আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছে ২০১ কোটি ৪৫ লাখ ৬০ হাজার ডলার।
এই প্রকল্পের অর্থায়ন করবে ১৫ শতাংশ পিডিবি, ১৫ শতাংশ ভারতীয় পক্ষ আর ৭০ শতাংশ অর্থ ঋণ নেয়া হবে। ঋণ পরিশোধ করবে বাংলাদেশ। কিন্তু যে নিট লাভ হবে সেটা ভাগ করা হবে ৫০ শতাংশ হারে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি। যদি কয়লার দাম প্রতি টন ১০৫ ডলার হয়, তবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম হবে ৫ টাকা ৯০ পয়সা এবং প্রতি টন ১৪৫ ডলার হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮ টাকা ৮৫ পয়সা। অথচ দেশীয় ওরিয়ন গ্রুপের সাথে মাওয়া, খুলনার লবণচরা এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারাতে যে তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের যে চুক্তি হয়েছে পিডিবি’র সাথে, সেখানে সরকার মাওয়া থেকে ৪ টাকায় প্রতি ইউনিট এবং আনোয়ারা ও লবণচরা থেকে ৩ টাকা ৮০ পয়সা দরে বিদ্যুৎ কিনবে। সরকার এর মধ্যেই ১৪৫ ডলার করে রামপালের জন্য কয়লা আমদানির প্রস্তাব চূড়ান্ত করে ফেলেছে। তার মানে, ৮ টাকা ৮৫ পয়সা দিয়ে পিডিবি’কে এখান থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে হবে- সেটা এখন প্রায় নিশ্চিত।
প্রস্তাবিত এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ১৮৩০ একর ফসলি জমি অধিগ্রহণের ফলে সাড়ে ৭ হাজার পরিবার উচ্ছেদ হয়ে যাবে। এতে কর্মসংস্থান হতে পারে সর্বোচ্চ ৬০০ জনের। ফলে উদ্বাস্তু ও কর্মহীন হয়ে যাবে প্রায় ৭৫০০ পরিবার। শুধু তাই নয়, আমরা প্রতি বছর হারাবো কয়েক কোটি টাকার কৃষিজ উৎপাদন।
কয়লাভিত্তিক যেকোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পে অন্য যেকোনো প্রকল্পের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। বিশেষত ভস্মীভূত কয়লার ছাই এবং উৎপন্ন গ্যাসের ফলে বায়ু ও পানি দূষণের যুগপৎ প্রভাবের এই ক্ষতি হয়। এ ধরনের প্রকল্প এলাকার আশপাশে এসিড বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে, যা বৃক্ষসহ বনাঞ্চলের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে ভয়ানক মাত্রায়।
এই প্রকল্প এলাকা সুন্দরবনের ঘোষিত সংরক্ষিত ও স্পর্শকাতর অঞ্চল থেকে বেশি দূরে নয়। অন্যান্য দেশে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটায় বলে সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির ১৫-২০ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয় না। এমনকি এই ভারতীয় কোম্পানিকেও তার নিজের দেশেই এই যুক্তিতে মধ্যপ্রদেশে অনুরূপ একটি প্রকল্প করতে দেয়া হয়নি। ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে, প্রস্তাবিত ১৩২০ মেগাওয়াট রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে! আবার সুন্দরবন থেকে দূরত্ব আসলেই ১৪ কিলোমিটার কিনা সেটা নিয়েও বিতর্ক আছে। খোদ ইআইএ রিপোর্টের এক জায়গায় বলা হয়েছে, প্রকল্পের স্থানটি এক সময় একেবারে সুন্দরবনেরই অংশ ছিল।
মূলত, ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি’র মধ্যপ্রদেশে প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ভারতীয় পরিবেশ মন্ত্রণালয় বাতিল করে দিয়েছে। ভারতীয় পরিবেশ মন্ত্রণালয় বলেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য প্রস্তাবিত স্থানটি কৃষি জমি, যা মোটেই প্রকল্পের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া নর্মদা নদী থেকে প্রকল্পের জন্য পানি টেনে নেয়া প্রকল্পের জন্য বাস্তবসম্মত নয়। কৃষিজমির স্বল্পতা, নিকটবর্তী জনবসতি, পানির স্বল্পতা, পরিবেশগত প্রভাব এসব বিবেচনায় এই প্রকল্প বাতিল করা হোক। যে বিবেচনায় এনটিপিসি নিজের দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে পারেনি, একই বিবেচনায় বাংলাদেশে কি তাদের প্রকল্প বাতিল হতে পারে না?
প্রকল্পে ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ সত্ত্বেও ভারতীয় মালিকানা ৫০ শতাংশ। বিদ্যুতের দাম পড়ছে দ্বিগুণেরও বেশি। উচ্ছেদ হচ্ছে ৭ হাজার ৫০০ পরিবার। কৃষিজ সম্পদ হারাচ্ছে দেশ। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে বাংলাদেশের; কিন্তু ৫০ শতাংশ মালিকানা ভারতীয় কোম্পানির। ভারত মধ্যপ্রদেশে যে প্রতিষ্ঠানকে কাজের অনুমতি দেয়নি বাংলাদেশ সেই এনটিপিসি’কেই সুন্দরবনের উপর ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সুযোগ করে দিচ্ছে পরিবেশের উপর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাবের তোয়াক্কা না করেই। তার উপর, ভারতীয় কোম্পানিকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র লাভের ট্যাক্সও দিতে হবে না। তাহলে এটা কিভাবে জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে হতে পারে? কিন্তু সরকার একেবারে নির্বিকার। তারা বোধহয় একেবারে জিদ ধরে বসেছে, যেকোনো মূল্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। পূজারী ব্রাহ্মণের মতো মরলেও ‘টিকি’ দিতে রাজি নয়। অপরদিকে বিরোধীরাও বলছে ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী’।
বাস্তবতা পরিহার করে একগুঁয়েমি কোনোভাবেই কল্যাণকর হতে পারে না। প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ উপেক্ষা করার বিষয় বলে মনে হয় না। যেহেতু এই প্রকল্প নিয়ে সব মহলেই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তাই এই বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীল আচরণই জনগণ আশা করে। সরকারের অবস্থান ও প্রকল্পবিরোধীদের উদ্বেগ নিয়ে প্রকল্পবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের সমীক্ষা চালানো উচিত। আর এই সমীক্ষায় যদি বিরোধীদের অবস্থানের যৌক্তিকতা থাকে, তাহলে এই প্রকল্প বাতিল অথবা নিরাপদ কোনো স্থানে স্থানান্তর করা উচিত। জাতীয় স্বার্থকেই বড় করে দেখতে হবে। কোনো বিষয় জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী হলে তা খোদ বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারেই অবশ্যই বর্জনীয়।
-মুহম্মদ ওয়ালিউর রহমান, ঢাকা।
প্রসঙ্গঃ আমেরিকায় ইহুদী প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ- ২
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩৪
চাঁদ দেখা এবং নতুন চন্দ্রতারিখ শুরু নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা- ১