আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে হিন্দি সিনেমাগুলো ভিডিও ক্যাসেটের মাধ্যমে এদেশে আসে এবং ক্রমান্বয়ে জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে।
এমনকি এখন মঞ্চায়ন বেশি হচ্ছে বিদেশি বিশেষ করে হিন্দু পুরাণভিত্তিক নাটক।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বছর দেড়েক ধরে ঢাকা কথিত নাট্য উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছে। প্রতিমাসে সরকারি-বেসরকারি মিলে একাধিক নাট্যোৎসব আয়োজিত হয়। তবে প্রায় সব উৎসবেই থাকে কলকাতার নাট্য সংগঠনের নাটক। ভারতীয় সংস্কৃতির নাটক কলকাতার নাট্যদলগুলো এসে মঞ্চায়ন করছে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এদেশের অনেক সংগঠন ভারতীয় সংস্কৃতির নাটক মঞ্চে আনছে। (নাঊযুবিল্লাহ)
দেশের স্বায়ত্তশাসিত, জাতীয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যপুস্তকের অধিকাংশ ভারতীয় লেখকদের লেখা। এসব বইয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে ভারতীয়দের মনগড়া ব্যাখ্যা। যা পড়ে এদেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী নিজেদের সংস্কৃতি গ্রহণ করছে ভারতীয় সংস্কৃতির আদলে। সরকারের অবহেলা, দেশীয় লেখকদের লেখা পাঠ্যপুস্তকের অভাব, অনেক শিক্ষকের উদাসীনতায় এ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন দীর্ঘদিন ধরে চলছে। পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পাশাপাশি ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে নতুন মাত্রা হিসেবে যোগ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ‘ভারতীয়করণ’।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভারতীয়করণে নেমেছে দেশটির কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিকরা। তারা মুক্তিযুদ্ধের মনগড়া ইতিহাস উপস্থাপন করছে এদেশের পাঠকদের কাছে। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের মাধ্যমে চলছে তাদের বিকৃতকরণ। দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত করার পাশাপাশি তারা মুক্তিযুদ্ধের সব কৃতিত্ব ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সরকারকে দিয়ে দিচ্ছে। এভাবে তারা সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তার করছে।
এদেশের সরকার, বুদ্ধিজীবী মহল, সুশীল সমাজ চুপ থাকায় তাদের বিকৃতি বাড়ছে। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই ভারতীয়রা গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, চলচ্চিত্রে ইতিহাস বিকৃত করছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ না থাকায় একের পর এক বিকৃত লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। ভারতীয় বাংলা, ইংরেজি ভাষার বিভিন্ন পত্রিকায় এসব লেখা প্রকাশ হচ্ছে।
কলকাতার ‘দেশ’সহ কয়েকটি পত্রিকার এদেশে বিরাট বাজার থাকায় সহজেই এসব লেখা পৌঁছে যাচ্ছে তরুণসহ সব বয়সের পাঠকের কাছে। এসবের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম বেশি বিভ্রান্ত হচ্ছে। আহমদ ছফা তার ‘বাঙ্গালি মুসলমানের মন’ বইয়ে উল্লেখ করেছে, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করে প্রবন্ধ ছাপানো হয়েছে।’
অভিযোগ আছে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এদেশে তাদের সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে ইতিহাস বিকৃতিতে মদদ দিচ্ছে। বিকৃত ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে এদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্প সম্পর্কে তাদের বিষিয়ে তুলছে। এদেশের জাতীয় বীরদের নিয়ে নানা অপকথা প্রচার করছে। গোয়েন্দা সংস্থাটির জরিপ মতে, কলকাতার অনেক কবি, লেখক এ দেশে খুব জনপ্রিয়। এদেশের পাঠকদের উপর তাদের প্রভাব আছে। আর এ কাজে এসব কবি-লেখককে সংস্থাটি ব্যবহার করছে।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠ্যবইয়েও ভারতীয় লেখকদের বইয়ের ছড়াছড়ি। এসব বইয়ে ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক, বাংলাদেশের নিরাপত্তাসহ সব বিষয়ে নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা দিয়েছে। শিক্ষকরা এসব বইয়ের বর্ণনা শিক্ষার্থীদের হুবহু পড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব বই পড়ে শিক্ষার্থীরা মূলত ভারতীয় সংস্কৃতিকে ধারণ করছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আছে দশ লাখ। অথচ দেশের শিক্ষকদের লেখা পাঠ্যবই নেই। সেখানে এমন শিক্ষক আছেন প্রায় ১৮০ জন, তাদের কাজ পরীক্ষা নেয়া ও খাতা দেখা। তাদের দিয়েও বই লেখানো সম্ভব। কিন্তু তাদের কাজে লাগানো হয় না।
অন্যদিকে ভারতীয় ইতিহাসবিদ শর্মিলা বোস তার সাম্প্রতিক লেখা ‘ডেড রেকনিং : মেমরিজ অব দ্য নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান বাংলাদেশ ওয়ার’ বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চরমভাবে বিকৃত করে। এতে একাত্তর সালে হত্যা, মহিলাদের সম্ভ্রমহরণের সংখ্যা নিয়ে সে প্রশ্ন তুলেছে।
অন্যদিকে ২০১০ সালে কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বসুধা আর তার মেয়ে’ নামে একটি উপন্যাস ছাপা হয়। এর বিষয়বস্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এতে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধী আর ভারতীয় সৈন্যের ভূমিকা মুখ্য আর এদেশের মুক্তিযোদ্ধারা গৌণ।
এতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে নানাভাবে খাটো করেছে সুনীল। পত্রিকাটির ওই সংখ্যার ৪৩২ পৃষ্ঠায় সুনীল বলে, ‘ইন্দিরা গান্ধী বুঝে গিয়েছিলেন, এ যুদ্ধে তাকে একাই লড়তে হবে। অবশ্য খুব বিপদে পড়লে পাশে থাকবে রাশিয়া। আর পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে যে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছে, তাদের সাহায্যও গুরুত্বপূর্ণ।’ তার মতে, এখানে ইন্দিরা গান্ধীই একমাত্র ফ্যাক্টর। স্বাধীনতার জন্য এদেশের যারা কাতারে কাতারে প্রাণ বিসর্জন দিতে পাকিস্তানের সুসজ্জিত বাহিনীর সামনে দাঁড়ান, প্রতিরোধ করেন, তারা নির্ধারক শক্তি নয়। ৪৩২ পৃষ্ঠায় সুনীলের বর্ণনায় আছে একাত্তরে আমেরিকার সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগর দিয়ে পাঠানোর গুজব সংক্রান্ত বিকৃত তথ্য। সে ৪৩৫ পৃষ্ঠায় পরোক্ষভাবে এদেশের জনগণকে বর্বর মানসিকতার বলেছে। উপন্যাসে বাংলাদেশের নাম নিয়ে যেসব কথাবার্তা বলা হয়েছে, তা যে কোনো স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত করে। উপন্যাসের ৪৩৭ পৃষ্ঠায় সুনীলের প্রশ্ন ‘ওরা পুরো বাংলাদেশ নামটি নিয়ে নিল কেন? নামটি এখন বদলানো যায় না? বাংলাদেশ-এর বদলে জয় বাংলা, শুনতেও বেশ। তাহলে বাংলাদেশ নামটা থাকবে সবার জন্য।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ওই উপন্যাস বই আকারে পরে প্রকাশ করে কলকাতার প্রকাশনা সংস্থা আনন্দ পাবলিশার্স। এ উপন্যাসের নকল কপি এখন ছড়িয়ে গেছে সারা বাংলাদেশ। এ বইয়ের জন্য সুনীলকে এদেশের কারও পক্ষ থেকে সমালোচনায় পড়তে হয়নি। এরপর সুনীল একাধিকবার ঢাকায় এসেছে। তাকে নিয়ে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপন্থী, পূজারী কবি-লেখকরা সভা, সেমিনার করেছে। কেউ তাকে এ বিষয়ে প্রশ্নও করেনি। মাস দুয়েক আগে সুনীল এদেশে এসে চট্টগ্রামের এক অনুষ্ঠানে ‘সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা রক্ষা করতে দুই বাংলাকে এক হওয়ার আহ্বান জানায়। (ইনশাআল্লাহ চলবে)
–মুহম্মদ আরিফুর রহমান
প্রসঙ্গঃ কমনওয়েলথ ও সি.পি.এ সম্মেলন