ভারত-পাকিস্তান বিভাজন কী ধর্মের ভিত্তিতে হয়েছিল? অধিকাংশেরও বেশি বলবে- হ্যাঁ। কিন্তু আসলে জবাব সত্য নয়। ভারত-পাকিস্তান বিভাগ হয়েছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রচারণাতে। বলা হয়েছিল- যেকোনো সংজ্ঞায়ই মুসলমানরা আলাদা এক জাতি। কিন্তু পবিত্র দ্বীন ইসলাম কথিত ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ বিশ্বাস করে না। ‘পবিত্র দ্বীন ইসলাম’ আর ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ এক নয়। যে কারণে পাকিস্তান আন্দোলনের সর্বসম্মুখে ছিল তথাকথিত মুসলিম জাতীয়তাবাদের কথিত ইংরেজি শিক্ষিত, নামধারী সাহেবী মুসলিমরা। জিন্নাহ, সোহরাওয়ার্দী, এ.কে ফজলুল হকসহ ইত্যকার নেতাদের তালিকা অনেক দীর্ঘ। এরা কথিত ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদের’ প্রতিভূ ছিল; কিন্তু ইসলামী ব্যক্তিত্ব ছিল না কেউই। এমনকি ‘কায়েদে আযম’ কথিত জিন্নাহ শুধু বিলেতী মদেই অভ্যস্ত ছিল না, তার বিরুদ্ধে বিকৃত চরিত্রহীনতারও বিস্তর অভিযোগ ছিল। মুসলিম জাতীয়তাবাদের তুখোড় প্রবক্তা এই জিন্নাহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম দিনেই প্রদত্ত ভাষণে মুসলিম জাতীয়তাবাদ ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের সদম্ভে ঘোষণা করেছিল। জিন্নাহ সেদিন বলেছিল- “আজ থেকে পাকিস্তানে কোনো মুসলমান, মুসলমান থাকবে না, কোনো হিন্দু, হিন্দু থাকবে না- সবাই হয়ে যাবে পাকিস্তানী।”
মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রচারণার ভিত্তিতে পাকিস্তান বিভাজনকারীরা তথা মুসলিম লীগাররা সেদিন পবিত্র দ্বীন ইসলাম ও মুসলমানগণ উনাদের সাথে গাদ্দারী করেছিল।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর একটি ইসলামী আইনও বাস্তবায়ন হয়নি। শাসন কাঠামোয় কোনো পরিবর্তন আসেনি। ফৌজদারী ও দেওয়ানী দ-বিধি হুবহু ব্রিটিশদেরই ছিল। এমনকি পাকিস্তানের প্রভাবশালী প্রতিভূ আইয়ুব খান বরং ১৯৬১ সালে খোদ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার তালাক ও ওয়ারিছ স্বত্ব আইনকে পরিবর্তন করেছিল। নাঊযুবিল্লাহ! কাজেই “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান; দস্তুর হোগা আল-কুরআন” নিখিল পাকিস্তানের সর্বত্র সরবে উচ্চারিত এ সেøাগান সম্পূর্ণই ভুয়া ও প্রতারণা প্রমাণিত হয়েছিল।
কিন্তু সে প্রতারণাকে পুঁজি করছে তথাকথিত প্রগতিশীলরা। তারা প্রচার করছে- ‘ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের জন্ম কখনো সুখকর নয়’। এমনকি ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পছন্দ করতো না এবং এক্ষেত্রে পাকিস্তানের উদাহরণ টানতো। ডানপন্থী, বামপন্থী উভয়ের বিভ্রান্ত প্রচারণায়, অজ্ঞতামূলক প্রপাগান্ডায় এখন অনেকের বিশ্বাস হয়েছে, ‘ধর্ম যার যার; রাষ্ট্র সবার।’ এ সেøাগান ধর্মনিরপেক্ষতার। ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য শুধু আওয়ামী লীগ আর ’৭২-এর সংবিধান দায়ী নয়। ডানপন্থী বিএনপি থেকে সব কথিত ইসলামিক দলগুলো ধর্মনিরপেক্ষতার নিরেট পৃষ্ঠপোষক। জিয়াউর রহমানই এদেশে থানায় থানায় সিনেমা হলের অনুমোদন দিয়েছিল। গান-বাজনা, খেলাধুলা, বেপর্দা-বেহায়াপনা ইত্যকার পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার বিরোধী কাজের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। কাজেই তারা ধর্মনিরপেক্ষতারই অবাধ প্রবেশ ঘটিয়েছিল; যা শুধু কাগজে-কলমে ছিল না।
আওয়ামী লীগ পুনর্বার সে বিষয়টি কাগজ কলমে তথা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এতে করে ধর্মদ্রোহীদের আস্ফালন স্পর্ধামূলকভাবে বেড়ে গেছে। পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার পরিভাষায় যারা মুসলমান নামধারী হয়েও পবিত্র দ্বীন উনার বিরুদ্ধে বলে, তারা মুরতাদ। অনেক মুসলমান নামধারী তথাকথিত শিল্পী-সাহিত্যিক নতুন করে মুরতাদদের খাতায় নাম লিখিয়ে কুখ্যাত হবার জন্য ঘৃণ্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তারা ঘোমটার বিরুদ্ধে, পর্দা পালনের বিরুদ্ধে মূলত খোদ পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার পালনের বিরুদ্ধে বলছে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র এখানে নিশ্চুপ থাকছে। অথচ সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত রাষ্ট্রদ্বীন পবিত্র ইসলাম- বাংলাদেশ সরকারের এখানে চুপ থাকার কোনো অবকাশ নেই। বরং তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যায়িত করে আইনী ব্যবস্থা নেয়া অনিবার্য।
ধর্ম বা পবিত্র দ্বীন ইসলাম বিশ্বাসের বিষয়। রাষ্ট্রযন্ত্র বিধির বিষয়। বিশ্বাসের স্থান ঊর্ধ্বে। বিধি যদি বিশ্বাসের সাথে অসঙ্গত হয়, তাহলে মানুষ বিশ্বাস থেকে সরে আসে না, আসতে পারে না। বিধির সাথে তখন বিশ্বাসের সংঘাত হয়।
অপরদিকে বিশ্বাস থেকেই সব কাজের অনুপ্রেরণা। বিশ্বাস থেকেই সব কাজের চেতনা মুসলমান পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার থেকে পায়; সব কাজের নির্দেশনা। কাজেই ধর্মীয় বিশ্বাসই রাষ্ট্র, জাতি, সংবিধান, আইন সব কিছুর ঊর্ধ্বে। সংবিধানে মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের কথা নেই। কিন্তু এদেশের প্রায় বিশ কোটি মুসলমান ঠিকই মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখে। পবিত্র কালিমা শরীফ পড়েন। পবিত্র নামায পড়েন। পবিত্র রোযা রাখেন। পবিত্র যাকাত দেন। পবিত্র ঈদ পালন করেন। মুসলমান উনাদের পবিত্র ঈমান উনার কাছে সংবিধান তুচ্ছ ও ফালতু।
কাজেই পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার এ ব্যাপকতা বুঝতে হবে, স্বীকৃতি দিতে হবে। কিন্তু পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার সাথে মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা এ গাদ্দারী করেছে। এদের কারণেই তথাকথিত বাঙালি, প্রগতিশীলরাও চূড়ান্ত স্পর্ধাজনিত বেয়াদবি করার সুযোগ পেয়েছে। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বলার অবাধ সাহস পেয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসার ঘটাতে পেরেছে।
কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার দেশে পবিত্র দ্বীন ও পবিত্র দ্বীন ইসলামী অনুশাসনকে কটাক্ষ করে কথা বলার ক্ষমতা কোনো বাঙালি, প্রগতিশীল বা মুসলিম জাতীয়তাবাদীরও নেই। করলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পর্যবসিত হবে।
-আল্লামা মুহম্মদ মাহবুবুল্লাহ
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০