সব প্রশংসা মহান আল্লাহ পাক উনার জন্য। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্্ নাবিয়্যীন, নূরে মুজাস্্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি অফুরন্ত দুরূদ ও সালাম।
বাংলাদেশ তথা গোটা বিশ্ববিবেক স্তম্ভিত, হতবাক হয়েছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের কথায়। ভদ্রতা শালীনতা, সভ্যতা তথা ঐতিহাসিক সত্যতা সবকিছুর উপর কবর রচনা করে দর্পভরে সে উচ্চারণ করেছে “আমরা আমাদের লোকদের দায়িত্ব নেবো কিন্তু আর নৃ-তাত্ত্বিকভাবে আমাদের লোক নয় সেই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা মুসলমানদের গ্রহণ করা অসম্ভব।”
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের যুক্তি, “নৃ-তাত্ত্বিকভাবে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের অধিবাসী নয়। তারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। সে কারণে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসবাসের অধিকার নেই। মিয়ানমার বরং রোহিঙ্গা মুসলমানদের অন্য কোনো দেশে পাঠিয়ে দেয়ার চিন্তা করছে। কোনো দেশ যদি রোহিঙ্গাদের নিতে আগ্রহী হয়, তাহলে তাদের সে দেশেই পাঠিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমারে আসতে ও বসবাস করতে দেয়া হবে না। এটাই নাকি রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান!” অন্যদিকে ইউএনএইচসিআরের প্রধান বলেছে, মিয়ানমারের উচিত রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেয়া এবং বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ইউএনএইচসিআরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মিয়ানমার প্রেসিডেন্ট সামরিক জান্তার মতোই কথা বলেছে। ঐতিহাসিক তথ্য ও সত্যের উপরও সে কষাঘাত করেছে। ভুল ব্যাখ্যার পাশাপাশি ইতিহাসও বিকৃতি করেছে সে। কারণ রাখাইন প্রদেশ তথা আরাকানে মুসলমানদের বসবাস হাজার বছর ধরে। আরাকান সেকালে ছিল রোসাঙ্গ রাজ্য। এর অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে। বাস্তবে রোসাঙ্গ রাজ্য গড়েই উঠেছিল বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের ভিত্তিতে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাজধানী গৌড়ের পতন ঘটলে আরাকানের রোসাঙ্গ রাজসভাই বাংলা সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর দৌলত কাজী, আলাওল, মরদন ও নাসুল্লা খানের মতো অনেক কবি-সাহিত্যিকের বর্ণনাতেও এসব বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। অর্থাৎ রোহিঙ্গা মুসলমানরা হঠাৎ করে গিয়ে হাজির হয়নি রাখাইন প্রদেশে তথা আরাকানে। তারা সেখানে বসবাস করছে হাজার বছর ধরে। তাছাড়া ইদানীংকালে মিয়ানমারের অধিবাসী হিসেবে তারা বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও আঞ্চলিক নির্বাচনেও ভোট দিয়েছে। সরকারকে খাজনা-ট্যাক্সও রোহিঙ্গারা বহুকাল ধরেই দিয়ে আসছে।
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বললেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হয়ে যায় না। নৃ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণেও রোহিঙ্গারাই ওই অঞ্চলের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, যুগে যুগে তাদের উপর মিয়ানমার তথা সাবেক বার্মার শাসক গোষ্ঠী ও মগসহ বিভিন্ন সম্প্রদায় নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতন চালিয়েছে। এমনকি ১৯৪২ সালেও আকিয়াব, রাছিডং, কাকথ, মার্বা, মিনবিয়া, পুনাজয় প্রভৃতি এলাকায় হত্যা করেছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে। হত্যা ও নির্যাতনের সে নিষ্ঠুর কর্মকা- এখনও অব্যাহত রয়েছে। এর প্রধান কারণ, তারা মুসলমান। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আধুনিক যুগের রাষ্ট্রনায়ক হলেও প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের মুখেও মুসলমানবিরোধী একই মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। রোহিঙ্গাদের নাক বোঁচা না হওয়াটা কারণ নয়, রোহিঙ্গারা মুসলমান বলেই যত আপত্তি!
ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায়, এই উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে ক’টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে উঠে, আরাকান তথা বর্তমান রাখাইন প্রদেশ তার অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরকানী মুসলমানদের বংশধর। এক সময় আরাকানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুইশ বছরেরও অধিককাল স্থায়ী হয়। ১৬৩১ থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ হয়। এরপর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। ১৬৬০ সালে আরাকান রাজ্য সান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোগল শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করে। এরপর শুরু হয় মুসলমানদের উপর তার নিপীড়ন ও নির্যাতন। প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছর মুসলমানদের এই দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে কাটাতে হয়। ১৭৮০ সালে বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে নেয়। সেও ছিল ঘোর মুসলিমবিদ্বেষী। বর্মী রাজা ঢালাওভাবে মুসলমানদের শহীদ করে। ১৮২৮ সালে বার্মা ইংরেজ দখলে গেলে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। তবে ১৯৩৭ সালে বার্মার স্বায়ত্তশাসন লাভের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক রূপ নেয় এবং অন্তত ৩০ লাখ মুসলমান শহীদ হয়। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু মুসলমানদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। স্বাধীন দেশের সরকার আজ পর্যন্ত তাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার দেয়নি। অত্যাচার নির্যাতন ও বিতাড়নের মুখে বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহুদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এরা বিশ্বের রাষ্ট্রহীন নাগরিক। ১৯৮২ সালে সে দেশের সরকার যে নাগরিকত্ব আইন করেছে, তাতে তিন ধরনের নাগরিকের কথা বলা হয়েছে। এর কোনটির মধ্যেই রোহিঙ্গারা নেই। সরকারীভাবে তাদের সে দেশে বসবাসকারী বা ‘জবংরবহঃং’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের সাংবিধানিক ও আর্থ-সামাজিক অধিকার নেই। তারা একার্থে বন্দী। কারণ মিয়ানমারের অন্য স্থানে তারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া যেতে পারে না। এক সময় যে আরাকান মুসলমান প্রধান ছিল, এখন সেখানে রাখাইন বসতি বাড়িয়ে তাদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়েছে।
ইতিহাসের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা দ্বারাও প্রতিভাত হয় মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের ঔদ্ধত্যমূলক উক্তি সর্বৈবই মিথ্যা। রোহিঙ্গারা যদি শত শত বছর ধরে বাস করার পরও মিয়ানমারের আদিবাসী না হয় তবে শুধু আদিবাসী সংজ্ঞাই পাল্টাবে না মিয়ানমার প্রেসিডেন্ট কথিত নৃ-তত্ত্ব বিজ্ঞানও পাল্টে যাবে। এক্ষেত্রে ইউএনএইচসি আর সহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে এবং এক্ষেত্রে অবশ্যই দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশকে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কারণ ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের মুসলমানরাও আরাকানের কাছে দায়ী। ইতিহাসের সুদীর্ঘ পরিক্রমায় আরাকানী মুসলমানরা আমাদের সাহায্য করেছেন। তাছাড়া হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, “প্রত্যেক মুসলমান ভাই ভাই।” কাজেই মুসলমান প্রধান দেশ হিসেবে; সংবিধানের শুরুতে, বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম সংযোজনকারী দেশ হিসেবে; রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণ ৯৭ ভাগ মুসলমান কখনই মানবিক ও ইসলামিক দিক থেকে কোনোভাবেই রোহিঙ্গা মুসলমানের প্রতি তাদের দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেনা।
মূলতঃ এসব অনুভূতি ও দায়িত্ববোধ আসে ইসলামী অনুভূতি ও প্রজ্ঞা থেকে। আর তার জন্য চাই নেক ছোহবত তথা ফয়েজ, তাওয়াজ্জুহ। যামানার ইমাম ও মুজতাহিদ, যামানার মুজাদ্দিদ, মুজাদ্দিদে আ’যম আলাইহিস সালাম উনার নেক ছোহবতেই সে মহান ও অমূল্য নিয়ামত হাছিল সম্ভব। মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদের তা নছীব করুন। (আমীন)
-মুহম্মদ মাহবুবুর রহমান
প্রসঙ্গঃ আমেরিকায় ইহুদী প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ- ২
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩৪
চাঁদ দেখা এবং নতুন চন্দ্রতারিখ শুরু নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা- ১