মোবাইলফোন, এসএমএস, ইন্টারনেট, ই-মেইল, ফেসবুক ইত্যাদি যেমন বর্তমান বিশ্বকে প্রায় হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে, তেমনি দেখা যাচ্ছে এর অপব্যবহারও শুরু হয়েছে মারাত্মকভাবে। বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি আমাদের দেশে সেলফোন, ভিওআইপিসহ নানা আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সাজসরঞ্জাম বিক্রি করে প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নেয়, এ খবর নতুন নয়। এটা এক রকম ওপেন সিক্রেট যে, মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার জন্য এ ব্যবসা শুধু বৈধভাবে নয়, অবৈধভাবেও হয়ে থাকে। এতে সংশ্লিষ্ট দেশটির সরকার বঞ্চিত হয় রাজস্ব থেকে। বাংলাদেশেও এরকম একাধিক ঘটনা ধরা পড়েছে। এছাড়া ছবি এমনকি বিদেশী অশ্লীল ছবি ও গান ইত্যাদির অনুপ্রবেশ ঘটছে মোবাইলফোনের অপব্যবহারে। এতে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের উচ্ছন্নে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
অতিরিক্ত মুনাফার জন্য প্রায় প্রতিটি সেলফোন অপারেটর নানারকম লোভনীয় অফার ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে গ্রাহকদের। এক্ষেত্রে উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরা তাদের অন্যতম টার্গেট। জীবনকে সঠিক পথে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এ বয়সটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ এ বয়সেই ভুল করে থাকে বেশি। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক সেলফোন অপারেটর নানা চটকদার বিজ্ঞাপন ও ছবি ছাপিয়ে, রিংটোন ও গান অফার করে তাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। অনেক সময় ফ্রি এসএমএস ও রাত ১২টার পর থেকে সকাল পর্যন্ত ফ্রি কথা বলারও সুযোগ দিয়ে থাকে তারা। যেমন- একটি কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ক্যাপশনে লেখা- ‘ভালোবাসার টানে পাশে আনে’।
রাতের বেলা প্রায় অবাধে কথা বলা ও গান-বাজনা শোনার সুযোগ করে দেয়ায় উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরা একদিকে যেমন উচ্ছন্নে যাচ্ছে, অন্যদিকে পড়ছে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাসহ লেখাপড়ায় মনোসংযোগের অভাবজনিত সমস্যায়। প্রায় রুটিনবিহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে তারা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস চলাকালেও মোবাইলে কথা বলতে দেখা যায় তাদের। বলাবাহুল্য, বর্তমানে ছেলে-মেয়েদের এসব সমস্যা সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে অভিভাবকদের। গত কয়েক মাসে দেশে নারী নির্যাতন ও উত্ত্যক্তকরণের মাত্রা বেড়েছে আশঙ্কাজনকহারে। অনেক ক্ষেত্রে বখাটে কর্তৃক খুন-সম্ভ্রমহরণ-আত্মহত্যাসহ অভিভাবকদের উপর হামলা ও হত্যার ঘটনাও আছে। এক্ষেত্রে সেলফোনের অবাধ ব্যবহারসহ হারাম ছবির অনুপ্রবেশ দায়ী সর্বাংশে। এভাবে দেশীয় সংস্কৃতি, পারিবারিক ও দ্বীনী সংস্কার সর্বোপরি মূল্যবোধ ও মানবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে বিভিন্ন কোম্পানির নিবন্ধনহীন মোবাইলফোনে চাঁদাবাজি, হুমকি ও মানসিক নির্যাতন ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। নেতা-নেত্রীসহ সমাজের প্রভাবশালীদের হুমকি দেয়ার পরিমাণ বেড়েছে বেশি।
পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, মোবাইলের মাধ্যমে সৃষ্ট অপরাধ তদন্তে প্রচলিত আইনে ঘাটতি রয়েছে। টেলিফোন অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়াবলি দ-বিধিতে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও প্রয়োগ নেই। এতে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে এসব অপরাধ চিহ্নিতকরণ বিদ্যমান আইনের দুর্বলতা দূর করতে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে।
বলাবাহুল্য, সারা দেশই মোবাইলফোন নেটওয়ার্কের আওতাধীন। অভিভাবকরাই আজ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ছেলে-মেয়েদের হাতে ক্যামেরাসহ দেশী-বিদেশী দামি মোবাইলফোন সেট কিনে দেন অথবা অভিভাবকের অজান্তে কোনো একটি প্যাকেজ প্রোগ্রামের মাধ্যমেই বা উপহার হিসেবে দিয়ে যে ক্ষতি তারা করছেন তার ভয়াবহ মাশুলই আজকের এ অবস্থা। এতে অর্থ, মেধা, সময়, স্বাস্থ্য ও পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। মোবাইলফোন কোম্পানির কাস্টমার কেয়ার সেন্টারগুলোতে সিমকার্ডগুলোকে কঠোরভাবে আইনের আওতায় এনে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা জরুরী।
লক্ষ্য করা যায়, একজন বখাটে ছেলে বা মেয়ে বা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছেলে বা মেয়ের কাছে মোবাইলফোন আছে একটি, কিন্তু সিমকার্ড আছে প্রত্যেক কোম্পানির একটি করে প্রায় ১০-১২টি। একেকটি সিমকার্ডের দাম কয়েকশ’ টাকা। বিশেষ মুহূর্তে ৫ শত থেকে ৬ শত টাকা দিয়েও অনেকে সিমকার্ড কেনে, মেমোরি কার্ড তো আছেই।
পড়ালেখার সময় প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত কাজকর্ম ধর্ম-কর্ম ছেড়ে এবং ঘুম হারাম করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিশেষ করে রাত ১২টার পর শুরু হয়। বিভিন্ন মোবাইলফোন কোম্পানি ওই সময় বিশেষ সুবিধা-পারসেন্টেজ প্রদান করায় অবৈধ প্রেম-পরকীয়া, অবৈধ প্রেম বিনিময়, মোবাইলের মাধ্যমেই একজন মেয়েকে ঘরের বাইরে বের করে আনে। ওই মোবাইলফোন সেটে রিংটোন ও মেমোরিতে আজেবাজে গান, অশ্লীল ছবি (নীলছবি) ঢুকিয়ে রাস্তায় পথে, ঘাটে, বাজারে, বসতবাড়িতে, অলিগলিতে, দোকানে, বিভিন্ন আড্ডার আসরে অশ্লীল গান বাজিয়ে উঠতি মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে।
সঙ্গতকারণেই এতসব হারাম কাজের যোগানদার মোবাইলফোনের (সিমকার্ড) কোম্পানিগুলোকে নিয়ম-শৃঙ্খলা, কঠোর আইন ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং মোবাইলফোন কোম্পানির কাস্টমার কেয়ার সেন্টার, ইন্টারনেট, সাইবার ক্যাফে ও কম্পিউটারের দোকান ও সেন্টার, ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে যথাযথ আইন প্রয়োগ করতে হবে হারাম ছবিভিত্তিক সব কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য। সর্বপ্রকার যানবাহনে চালকের (ড্রাইভার) কাছে যানবাহন চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে অবশ্যই। স্কুলে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করতে হবে। ফোন-ফ্যাক্স-ইন্টারনেট, মোবাইল সেটে ছবি ও সিডি, গান লোড ব্যবসায়ী এবং প্রত্যক্ষ মদদকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং হারাম ছবিভিত্তিক সব কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন প্রাইভেট চ্যানেল (দেশী ও বিদেশী) ও স্যাটেলাইট (ডিশ) ব্যবসায়ীদের সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে এবং তা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
এলক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশনসহ তথ্য মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হতে হবে জরুরী ভিত্তিতে। মোবাইলফোনে আপত্তিকর কথা বলা ও লেখা প্রতিরোধে শক্ত আইন পাস করতে হবে। তা না হলে দেশের তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না।
-আল্লামা মুহম্মদ আশরাফুল মাহবূবে রব্বানী, ঢাকা
চাঁদ দেখা এবং নতুন চন্দ্রতারিখ শুরু নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা-১২
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৪৪
তথাকথিত খতীব উবাইদুল হক্বের লাশ বিকৃতি বদকারের সাক্ষাত বদ পরিণতি