প্রতিদিন সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশিদের রক্ত ঝড়িয়ে, দেশের আমদানি রফতানিতে বাধার সৃষ্টি করে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পণ্যের নামে অপপ্রচার চালিয়ে, পেঁয়াজ নিয়ে চরম প্রতারণা করায় তুমুল সমালোচনা হলেও ভারত থেকে আসা পচা-গলা গোশতের বিষয়টি এখনো তেমন আলোচনায় আসেনি। বাংলাদেশ গবাদিপশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পর ভারত থেকে নিম্নমানের রোগাটে ভারতীয় গরু আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও প্রতি বছর পবিত্র কুরবানির মৌসুমে চোরাই পথে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় রোগাটে গরু প্রবেশ করিয়ে থাকে। এগুলো ভারতীয়দের মৌসুমভিত্তিক ষড়যন্ত্র। এখন তারা নতুন কুটপদ্ধতি প্রয়োগ করছে। গরু নয় কিংবা মহিষ নয় বরং এই পশুগুলোর পচা-গলা গোশত বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি, ভারত থেকে আমদানি করা কনটেইনার ভর্তি পচা গোশত দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরে। বন্দর শ্রমিক ইউনিয়ন জানায়, পচা গোশতে দুর্গন্ধে গত ৫-৬ দিন ধরে চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে কর্মরত শ্রমিকরা শ্বাস নিতে পারছেন না। শ্রমিকদের ত্রাহি অবস্থা। বন্দর সূত্র জানায়, ইগলু ফুডস লিমিটেড (ঠিকানা-রাজধানীর সিআর দত্ত রোড) ভারত থেকে কনটেইনারভর্তি মহিষের পচা গোশত আমদানি করেছে। কনটেইনারটি ইয়ার্ডে আনার পরই পচা দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে।
উল্লেখ্য, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ২০০৫ সালের একটি আইন রয়েছে, যা ‘বাংলাদেশ পশু ও পশুজাত পণ্য সঙ্গনিরোধ আইন, ২০০৫’ নামে পরিচিত। এই আইনের আওতায় কেউ যদি পশু ও পশুজাত পণ্য আমদানি করতে চান, তার অন্তত ১৫ দিন আগে এ সম্পর্কে নিয়োজিত কর্মকর্তাকে নির্ধারিত পদ্ধতিতে জানাতে হবে। সব বিষয় আমলে নিয়ে যদি এই প্রক্রিয়ায় অনুমতি দেয়া হয় তবেই একজন আমদানিকারক আমদানি করতে পারবেন। অথচ কোনো অনুমতি ছাড়াই দেশে প্রতিবছর লাখ লাখ কেজি মহিষের গোশত আমদানি হচ্ছে। আর এর সুযোগেই দেশে ঢুকছে ভারতীয় পচা গলা গোশত।
ভারতীয় পচা-গলা গোশত বাংলাদেশের বাজারে আসার ঘটনা একটা নয় বরং ভুরি ভুরি। মূলত ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ একটি ভারতীয় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কিছুদিন পরপর পচা-গলা গোশত বাংলাদেশে রফতানি করছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারতীয় প্রতারক চক্রটি ভাগাড় থেকে সংগ্রহ করে পচা গোশত পাঠাত গুদামে। সেখানেই ফরমালিন দিয়ে এসব গোশত ধোয়া হতো। এর পর চর্বি ও হাড় আলাদা করা হতো। এর পর পচন ঠেকাতে ওই গোশতে ক্যালসিয়াম প্রোপিওনেট মেশানো হতো। আর যাতে দুর্গন্ধ না হয় তার জন্য লেড সালফেট ব্যবহার করা হতো। এতেই পচা গোশত প্রক্রিয়ার কাজ শেষ হতো না। বরং এসব গোশত যেন খাওয়ার সময় টাটকা মনে হয়, সে জন্য অ্যালুমিনিয়াম সালফেট মেশানো হয়। কোলকাতার কাকিনাড়া, জগদ্দল এবং উত্তর ২৪ পরগনায় এরকম অনেক পচা গোশতের গুদাম পাওয়া গেছে। দিল্লি, পুনে এবং মুম্বাইয়েও এরকম কিছু সিন্ডিকেটের সন্ধান পাওয়া গেছে তারা পচা গোশত সংগ্রহ করে বাংলাদেশে পাঠায়।
২০১৮ সালে এই পচা গোশত বাংলাদেশে সরবরাহকারী এক হিন্দু ভারতীয় ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছিলো ভারতের গোয়েন্দারা। গ্রেফতার হওয়ার পর সে জানিয়েছিলো, প্রায় ১০ বছর ধরে তারা বাংলাদেশে পচা গোশত পাঠিয়ে আসছিলো। তাদের সেই পঁচা গোশতগুলো বাংলাদেশের কতিপয় ব্যবসায়ী ও সুপারশপগুলো কিনে নিতো। বাংলাদেশের খোলাবাজারে বিক্রি হলে সহজেই ধরা পড়ে যাবে এই চিন্তায় এসব পচা গোশত রাসায়নিক মেশানো পচা গোশত খোলাবাজারের পরিবর্তে ফ্রোজেন মার্কেট, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, হোটেল ও রেস্তোরাঁয় বিক্রি করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের বেশ কয়েকটি খাতের আয় বাংলাদেশের বাজারের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। যার মধ্যে গবাদিপশু তথা গোশতের খাত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছে। তাই তারা এবার এই পচা গোশতের পথ বেছে নিয়েছে বাংলাদেশের বাজার থেকে তাদের পকেটে মুনাফা তুলে নেয়ার জন্য। আর এরকম পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে তাহলে দেশের স্বার্থের পাশাপাশি দেশের মানুষের জনস্বাস্থ্যও ভারতের হাতে বন্দি হয়ে পড়বে। এককথায় বাংলাদেশের মানুষের জনস্বাস্থ্য চরম হুমকিতে ফেলার জন্যই আটবেধে নেমেছে ভারতীয় বিভিন্ন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ এখন গোশতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশে হাজার হাজার ডেইরি ফার্ম গড়ে উঠেছে। এ ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে ঘরে ঘরে গরু-ছাগল প্রতিপালন করা হচ্ছে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা নদীর চরাঞ্চলগুলোতে গরুর ফার্ম এবং বাতানে গরু প্রতিপালন করে দেশের গোশতের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। পবিত্র ঈদুল আদ্বহায় পবিত্র কুরবানির পশুর চাহিদাও দেশি গরু মেটাচ্ছে। বাংলাদেশে গরু প্রতিপালন ভোক্তাদের শুধু গোশতের চাহিদা মেটাচ্ছে না; কৃষি জমির জৈব সারের জোগান দিচ্ছে। গোবর সার জমির উর্বরা বৃদ্ধি করে। ফলে বাংলাদেশের অনেক জেলায় একই জমিতে বছরে তিন দফায় শস্য ফলানো হয়।
গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি প্রতিপালনে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। অনেক শিক্ষিত যুবক চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেই উদ্যোক্তা হয়েছেন। নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অন্যের কর্মসংস্থান করেছেন। কিন্তু ভারতীয় ষড়যন্ত্রকারী মহল নিজেদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া পচা গোশতের মাধ্যমে দেশের স্বয়ংসম্পূর্ণ এই খাতটিকে ধ্বসিয়ে দিতে চাচ্ছে।
আশঙ্কাজনক বিষয় হলো, ভারতের পচা গোশত নিয়ে এত গভীর ষড়যন্ত্রের পরেও দেশের সরকারের কর্তাব্যক্তিরা নীরব ভুমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের প্রধান দুইটি বন্দরের মধ্যে ভারতীয় পচা গোশত পচে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে কিন্তু সেগুলোর খবর রাখা হচ্ছেনা। সমালোচক মহলের মতে, বাংলাদেশ সরকারের ভারতের প্রতি নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণেই এমনটি হচ্ছে। সীমান্ত হত্যার মতোই পচা গোশত নিয়ে ভারতীয় ষড়যন্ত্রের প্রতি সরকারের বেখেয়ালী আচরণ প্রকাশ পাচ্ছে। যাতে চরম ক্ষুব্ধ দেশের ৩০ কোটি নাগরিক।
আমরা মনে করি, এমন পরিস্থিতির অবসান হওয়া প্রয়োজন। সংবিধান মতে, দেশের জনগনের জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে সরকার যেখানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সেখানে সরকার কোনোভাবেই ভারতীয় এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নীরব ও বেখেয়ালী থাকতে পারেনা। সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে ভারতীয় পচা গোশত যারা বাংলাদেশে আমদানি করে সেই সকল দেশীয় গাদ্দারদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।
আল্লামা মুহম্মদ মাহবুবুল্লাহ, ঢাকা।
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০