গত ২১ নভেম্বর-২০১৬ঈ. ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বাংলাদেশের কাছে মুক্ত আকাশ সুবিধা চেয়েছে। বাংলাদেশের আকাশসীমা ও বিমানবন্দর ব্যবহার করতে আগ্রহী ভারত। সর্বশেষ গত ১ ডিসেম্বর-২০১৬ শাহজালাল বিমানবন্দরে এক অনুষ্ঠানেও ভারতীয় হাইকমিশনার মুক্ত আকাশ সুবিধার বিষয়ে মন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব করেছে। এছাড়া বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের জন্য বহু দিন থেকে বাংলাদেশকে অনুরোধ করে যাচ্ছে ভারত।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশকে যেমন ক্রমশই সর্বোতমুখী করে ভারত নির্ভর করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশের কাছ থেকে কত ধরনের সুবিধা নেয়া যেতে পারে তার নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস ভারতের পক্ষ থেকে অব্যাহত রয়েছে। এমনকি এসব সুবিধা নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিষয়টিও তুচ্ছ বিবেচনা করছে ভারত। তারই সর্বশেষ প্রক্রিয়া হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্ত আকাশ সুবিধা ও দুটি প্রধান বন্দর ব্যবহারের অনুমতি চাওয়া।
উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পূর্ব-পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের কোনো বন্দর ছিলো না। পক্ষান্তরে ভারত কলকাতা বন্দর পায়। এ অবস্থায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ভারত সরকারকে বলেছিলো যে ‘পূর্ব-বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশ) তাদের কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। পাকিস্তান সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ৬ মাসের মধ্যেই পূর্ব-বাংলায় একটি সমুদ্রবন্দর বানাবে। তাই ৬ মাসের জন্য ভারত যেন পূর্ব-বাংলাকে কলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে দেয়। তখন ভারতের মন্ত্রিসভায় এবং কংগ্রেস পার্টিতে প্রভাবশালী নেতা ছিলো বল্লভ প্যাটেল। সে বলেছিলো- ‘৬ মাস কেন, ৬ ঘণ্টার জন্যও পূর্ব-বাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশকে কলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে দেবো না’। তৎকালীন সময়ে ভারতীয়রা বাংলাদেশকে তাদের বন্দর ব্যবহার করতে দেয়নি। উল্টো বলেছিলো- ‘সেটা তাদের দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি’। সেই নিমকহারাম ভারতই আজ বাংলাদেশের আকাশসহ বাংলাদেশের কাছে বাংলাদেশের প্রধান দুটি বন্দর ব্যবহারের অনুরোধ করেছে।
প্রসঙ্গত, ভারতবান্ধব সরকার ও ভারতনির্ভর সরকার এবং ভারতের প্রতি নিতান্ত নতজানু পররাষ্ট্রনীতির সরকার ইত্যাদি অভিযোগ ও সমালোচনা থাকার পরও বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার কিছু ক্ষেত্রে ভারতের বিপরীতে দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখেছে। গত ১৫ নভেম্বর-২০১৬ বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ দেশের স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে পাট ও পাটজাত পণ্য ভারতে রফতানীর ক্ষেত্রে যে অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন। ভারত তাদের কাঁচামাল বাংলাদেশে রফতানী করার সময় শুল্ক কমানোর জন্য দাবি জানিয়েছে। তার বিপরীতে তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশের পাট রফতানীর ক্ষেত্রে শুল্ক রদের জন্য ভারতকে আহবান জানিয়েছে। কয়েকদিন আগে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করে গিয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক উপকরণ কেনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু দেশের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে সেই প্রস্তাবকে বর্তমান সরকার পাত্তা দেয়নি। ভারতের পক্ষ থেকে এদেশের জনৈক ব্যক্তিকে চাওয়া হয়েছিলো। কিন্তু খোদ প্রধানমন্ত্রী তা নাকচ করে দেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের ক্রিকেটার মুস্তাফিজের বিনিময়ে মোদী সরকার বলেছে তারা তিস্তার পানি দিবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেটা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন- ‘তিস্তার পানির ব্যাপারে আমরা দেখবো, কিন্তু মুস্তাফিজকে দেয়া যাবে না’। অর্থাৎ দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে ভারতকে খোদ প্রধানমন্ত্রী ‘না’ বলেছেন।
সমালোচক মহলের মতে, ভারত সবসময়ই বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করে থাকে এবং ক্ষতিসাধন করে থাকে। আর এর মধ্যে একটি বৃহৎ প্রকল্প ছিল কক্সবাজারে সোনাদিয়া সমুদ্রবন্দর।
কিন্তু বাংলাদেশ সরকার দেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বের কথা চিন্তা করে গভীর সমুদ্রবন্দর কক্সবাজারে না করে সেটা সরিয়ে পটুয়াখালিতে করার উদ্যোগ নিয়েছে। ভারত এখানে মোড়লগিরি করলেও মূল কাজ দেশের স্বার্থে চলে যাচ্ছে চীনের আওতায়। এই ক্ষেত্রে চীনের হাতে কাজ দেয়াতে সেটাতে দেশের স্বার্থ রক্ষা হয়েছে। পায়রায় যে প্রকল্প হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ ভারতকে বলতে পারবে, এটি চীনের স্ট্রিং অব পার্লে নেই। ফলে সোনাদিয়াকে ভারত যেভাবে দেখতো, পায়রায় সেভাবে দেখার সুযোগ নেই। সোনাদিয়ার তুলনায় পায়রা বন্দর নিয়ে চীনের সঙ্গে যে সমঝোতা হয়েছে, তা খুবই নগণ্য। বিশেষজ্ঞ মহল অভিমত দিয়েছেন, এটা দেশের পক্ষে সরকারের একটি কৌশলী পদক্ষেপ।
বলাবাহুল্য, একটি দেশের পক্ষ থেকে অন্য দেশের সাথে বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় সেই দেশের স্বার্থকে সমুন্নত রেখে। দেশের স্বার্থকে সবসময়ই বড় করে দেখতে হয়। দেশের স্বার্থকে বিলিয়ে দিয়ে ভিনদেশীদের সার্থে দেশবিরোধী চুক্তি করা কোনো দেশপ্রেমিক ক্ষমতাসীনের কাজ নয়।
ভারতীয়রা বাংলাদেশের কাছে মুক্ত আকাশ সুবিধা চেয়েছে। এতে করে ভারতের যেকোনো আকাশযান বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চলাচল করতে পারবে। কিন্তু দেশের স্বার্থে ভারতকে মুক্ত আকাশ সুবিধা দেয়া কোনোমতেই ঠিক হবে না। সেইসাথে দেশের মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ভারতকে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া যাবে না। আর তা দেয়া হলে সেটা দেশের স্বাধীন সার্বভৌমত্বের জন্য হবে হুমকিস্বরূপ। কারণ ওপেন স্কাই সুবিধার জন্য অবকাঠামো ও অন্যান্য সুবিধা এখনো সে পর্যায়ে বাংলাদেশের যায়নি। আমাদের অবকাঠামো, দক্ষ জনশক্তি পর্যাপ্ত নয়। এখনই গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে বিমান ফেল করে। আমাদের এভিয়েশন সিকিউরিটিতেও দুর্বলতা রয়েছে, যার কারণে আমাদের দেশ থেকে কোনো কোনো দেশে কার্গো সুবিধা বন্ধ রয়েছে। সবকিছু বিবেচনায় বাংলাদেশ ভারতকে এই সুবিধা দিতে পারে না। তাছাড়া আমাদের যে ফ্রিকোয়েন্সি আছে সেটাই আমরা পুরো ব্যবহার করতে পারছি না। ওপেন স্কাই সুবিধা দিলে ভারতের আলাদা ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ নেয়া লাগবে না। আকাশকে উন্মুক্ত করে দিলে গোটা ব্যবসা এমনকি দেশের সার্বভৌমত্বও ভারতের হাতে চলে যাবে।
সঙ্গতকারণেই আমরা বলতে চাই, বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে দেশের স্বার্থে যেভাবে ভারতের স্বার্থন্বেষী প্রস্তাবকে যেভাবে নাকচ করে দিয়েছে- আমরা আশা করি, দেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার ও মুক্ত আকাশ চুক্তির মতো দেশবিরোধী চুক্তিগুলোকেও সরকার একইভাবে নাকচ করে দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখবে। দেশপ্রেমিক দাবিদার সরকারের কাছ থেকে দেশের জনগণ এটাই প্রত্যাশা করে থাকে।
-আল্লামা মুহম্মদ আশরাফুল মাহবূবে রব্বানী, ঢাকা
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০