কিছুদিন আগেও বাংলাদেশে শিশু পর্নোগ্রাফি তো দূরের কথা পর্নোগ্রাফি কথাটাই তেমন শোনা যেত না। কিন্তু বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক পর্নোগ্রাফি চক্র বাংলাদেশে ঘাঁটি গেড়েছে। তাদের ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্য হলো, শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি করা এবং তারা তাদের কার্যক্রম দেশের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে মামলা হলেও পর্নোগ্রাফি ব্যবসার মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর এই কারণে অনেক ব্যবসায়ী আটক হলেও নতুন নতুন নেটওয়ার্ক তৈরি হচ্ছে এবং উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে না। পর্নোগ্রাফি ছড়িয়ে দিতে যারা সহায়তা করছে, তাদের শিকড়ের অনুসন্ধানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতাও দিন দিন এর উৎপাদন সহায়ক পরিবেশ তৈরি করছে বলে মনে করছে অপরাধ বিশ্লেষকরা। আর সমাজ গবেষকরা বলছে, পর্নোগ্রাফির শিকার হচ্ছে শিশুরা।
পর্নোগ্রাফি তৈরি ও ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে আটক হওয়া, বা বিচারের মুখোমুখি হওয়া ব্যক্তিদের তদন্তের ক্ষেত্রে কোনও মামলাতেই মূল হোতাদের ধরা বা চিহ্নিত করার কোনও উদাহরণ নেই এখনও পর্যন্ত। ২০১৪ সালের ১০ ও ১১ জুন খিলগাঁও, মুগদা এবং গোড়ানে অভিযান চালিয়ে টিপু কিবরিয়া এবং তার তিন সহযোগী নুরুল আমিন, নুরুল ইসলাম ও সাহারুলকে গ্রেফতার করে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম টিম। স্টুডিওতে আপত্তিকর অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ১৩ বছরের এক শিশুকে। তখন টিপুর খিলগাঁওয়ের তারাবাগের বাসা ও স্টুডিও থেকে শতাধিক পর্নো সিডি, আপত্তিকর শতাধিক স্থির ছবি, ৭০টি লুব্রিকেটিং জেল, ৪৮ পিস আন্ডারওয়ার, স্টিল ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা, কম্পিউটার হার্ডডিস্ক, সিপিইউ, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় মুগদা থানায় মামলা হয়েছে। পরে তাদের আদালতের মাধ্যমে নেয়া হয় তিন দিনের রিমান্ডে। রিমান্ড শেষে ১৫ জুন টিপু কিবরিয়া আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। নির্যাতিত ওই শিশুটিসহ অন্যরাও জবানবন্দি দিয়েছে আদালতে। কিন্তু টিপু কিবরিয়ার মূল হোতাদের এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা সম্ভব হয় নাই। ওইসময়ে নরপশু ও দেশদ্রোহী শিশুসাহিত্যিক টিপু কিবরিয়া গ্রেফতার হওয়ার পর বেরিয়ে এসেছিলো ভয়ঙ্কর তথ্য। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সেই তথ্য সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে নাই। ওই চক্রটি গত প্রায় নয় (৯) বছরে ঢাকার ৫০০ ছেলেশিশুকে এই জঘন্য কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করেছে। এ চক্রের তৈরি এসব পর্নো সিডি বিদেশী গ্রাহকদের কাছে মোটা অর্থের বিনিময়ে সরবরাহ করা হতো।
প্রসঙ্গত, এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ঢাকার প্রায় ৭৭ ভাগ স্কুলগামী শিশু পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। এক পর্যায়ে আবার এরাই পর্নোগ্রাফি তৈরির মতো পেশায় যুক্ত হচ্ছে। আর পর্নোগ্রাফি তৈরির পেছনে দেশে আরেকটি সহায়ক ভূমিকা পালন করছে কিছু বৈদেশিক ইউটিউব ও অডিও ভিডিও চ্যানেল। একদিকে ইউটিউবে কিছু অডিও ও ভিডিও চ্যানেল এ কাজ করে যাচ্ছে দাপটের সাথে। ফেসবুকে কিছু আইডি, গ্রুপ ও পেইজ কাজ করে যাচ্ছে মহামারী আকারে। অপরদিকে অনলাইন নিউজপোর্টালগুলো নিয়ে কোনো নিয়ম না থাকায়, দেশের আনাচে-কানাচে জন্ম নিয়েছে হাজার হাজার নিউজ পোর্টাল। অনেক নিউজ পোর্টাল এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিউজের ফাঁকে-ফাঁকে প্রচার করছে অনেক পর্নো, নিজের ওয়েব সাইটের ভিজিটর বাড়াতে এবং সেসব পোর্টালগুলোতে সরাসরি পর্নো তৈরির বিজ্ঞাপনও দেয়া থাকছে।
এদিকে বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১৫ লাখেরও বেশি। যার মধ্যে ঢাকা শহরেই রয়েছে ৭ লাখ পথশিশু। টিপু কিবরিয়া গ্রেফতার হলেও তার মূল হোতারা এখনও বাংলাদেশে তাদের ঘৃণ্য পর্নো ব্যবসার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের ব্যবসার টার্গেট হিসেবে তাদের ফাঁদে পা দিচ্ছে এসব অসহায় পথশিশুরা। যেসব চক্রগুলো বাংলাদেশে শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরির সাথে সংশ্লিষ্ট তারা দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে এসব পথশিশুদের কৌশলে এসব ব্যবসার সাথে জড়াচ্ছে।
অনস্বীকার্য যে, পর্নোগ্রাফি পশুবৎ রুচি ও মানসিকতার প্রতিফলন। তাছাড়া শিশু পর্নোগ্রাফি যে আরো বেশি জঘন্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিশুসাহিত্যিক পরিচয়ে মানুষবেশী ওই নরপিশাচ অসহায় পথশিশুদের আর্থিক প্রলোভন দিয়ে যে অপরাধ সংঘটিত করিয়েছে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই প্রত্যাশিত। একই সঙ্গে আমরা বলতে চাই- গোটা দুনিয়া বাংলাদেশকে দ্বীনদার মানুষের দেশ হিসেবেই জানে। ফলে রাজধানী ঢাকায় শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরির এ সংবাদ বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল বার্তাই পৌঁছে দিয়েছে। বলাবাহুল্য, শিশু পর্নোগ্রাফির সঙ্গে জড়িতে এ চক্রের সদস্যদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পুলিশ কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচয় দিচ্ছে না। পাশাপাশি এদেশ থেকে পর্নোগ্রাফি ব্যবসার শিকড় উচ্ছেদে সন্দেহভাজন সব প্রতিষ্ঠানের দিকে যে তীক্ষ্ম দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। পুলিশ বা প্রশাসন যদিও তা করছে না। এদিকে পুলিশের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মধ্যে আর কোনো চক্র সক্রিয় রয়েছি কিনা তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। আটক অপরাধীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ গঠনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এগুলো সরকার বা প্রশাসনের রুটিন বক্তব্য। প্রকৃতপক্ষে আমরা মনে করি, সারা দেশে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলেই এ জঘন্য প্রবণতা রোধ করা সম্ভব, যা নিশ্চিতের দায়িত্ব সরকারের।
এ কথা ঠিক যে, পর্নোগ্রাফি বন্ধের জন্য সরকারের আইন রয়েছে। পর্নোগ্রাফি আইনে পর্নোগ্রাফি তৈরি, বিতরণ, বিক্রি এবং ব্যবহারের আলাদা আলাদা শাস্তির বিধান রয়েছে। সর্বনিম্ন শাস্তি দুই বছর এবং সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদ- ও এর সঙ্গে আর্থিক জরিমানার বিধানও আছে। এর সঙ্গে পর্নোগ্রাফি উৎপাদনের সরঞ্জাম, প্রচার সরঞ্জাম বা মাধ্যম জব্দ করার বিধানও আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, পর্ণোগ্রাফি বন্ধে সরকারের আইনই যথেষ্ট নয়। বিটিআরসি’র তথ্য অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ছয় কোটি ২২ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে পাঁচ কোটি ৮৩ লাখের বেশি মোবাইলফোন থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হয় এর মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই বেশি। এনিয়ে শুধু সরকারি আইনের প্রতি তাকিয়ে না থেকে আমাদের অভিভাবকদেরকে হতে হবে আরো সচেতন ও আন্তরিক। অযথা সন্তানদের স্মার্ট ফোন দেয়া বন্ধ করতে হবে। কড়া নজর রাখতে হবে তাদের গতিবিধি।
দেখা যাচ্ছে, বাবা-মা সন্তানদেরকে সময় দিচ্ছে না। তারা উভয়েই চাকুরীজীবি। উভয়েই ক্যারিয়ারিস্ট। সন্তানের ভবিষ্যতের চেয়ে তাদের ভবিষ্যতই তাদের কাছে মুখ্য। তারা সন্তানকে সময় দেয়া দায়িত্ব তো মনে করে না, বরং অলাভজনক মনে করে। যে কারণে তাদের সন্তানের ২/১ বছর বয়স থেকেই সময় কাটে টিভিতে কার্টুন দেখে। এরপর মোবাইলে প্রথম গেম পরে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে। অর্থাৎ আগামী প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে একটা পশুবৎ মানসিকতার পঙ্গু প্রজন্মে। এ থেকে রক্ষা পেতে হলে সরকার এবং অভিভাবক উভয়কে যুগপৎ ব্যাপক কাজ করতে হবে।
-আল্লামা মুহম্মদ মাহবুবুল্লাহ, ঢাকা।
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০