দেশে স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম হওয়ার হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। সরকারি জরিপেও এ তথ্যটি উঠে এসেছে। পরিসংখ্যান এবং বিশেষজ্ঞরা বলছে, সিজারিয়ান পদ্ধতিতে যে সংখ্যক নবজাতক জন্ম হচ্ছে এর ৩৫ শতাংশই অপ্রয়োজনীয়। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি একশ নবজাতকের মধ্যে ৩০ জনেরই জন্ম হচ্ছে সিজারের মাধ্যমে। অথচ সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম হওয়ার পর মা ও সন্তান দু’জনই যে দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে- সেই বিষয়টি জানানো হচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ বলছে, বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে- প্রকৃতপক্ষে ১০০ সিজারিয়ান প্রসূতির মধ্যে ৮০ ভাগেরই নরমাল ডেলিভারি করা যেত। কিন্তু একটি মহলের প্রচারণার কারণে ক্ষতিকর এ পথটিই অনুসরণ করা হয়েছে সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে। ২০১৬ সালে দেশে ৮ লাখ ২০ হাজার ৫১২ শিশুর জন্ম অস্ত্রোপচারে হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছে, সিজারিয়ান সেকশন এখন দেশের বেশির ভাগ প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকের বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ প্রবণতা রোধ তো করা যাচ্ছেই না, বরং দিন দিন প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। কোনো প্রসূতি পেলেই প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর এক শ্রেণীর চিকিৎসক থেকে শুরু করে সবাই বিভিন্ন অজুহাতে রোগীকে নরমাল ডেলিভারির ব্যাপারে কৌশলে মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। এমনকি সিজার না হলে মা কিংবা নবজাতকের ক্ষতি হওয়ার ভয়ও দেখানো হয় অনেক ক্ষেত্রে। দেশে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ১০০টির মধ্যে ৩০টি শিশুরই জন্ম হচ্ছে সিজারিয়ান পদ্ধতিতে। এক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ অস্ত্রোপচার হচ্ছে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে। সমাজে সবচেয়ে শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের ৫০ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান এবং সচ্ছল পরিবারে এই হার অনেক বেশি। ২০০৪ সালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম হতো ৪ শতাংশ শিশুর। ২০০৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ শতাংশে। ২০১১ সালে তা ছিল ১৭ শতাংশ। আর ২০১৪ সালে তা দেড়গুণের বেশি বেড়ে হয়েছে ২৩ শতাংশ।
প্রসঙ্গত, শুধু মা ও শিশুর শারীরিক ক্ষতিই নয়, সেইসাথে এই সিজার ব্যবসার মাধ্যমে একপ্রকার ব্যবসার পসরা খুলে বসেছে একটি মহল। নরমাল ডেলিভারির চেয়ে সিজারিয়ানে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বেশি টাকা পায়। হাসপাতাল বা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষেরও এতে ব্যবসা বেশি। কারণ বেশি সময় হাসপাতালে থাকতে হয়, ওষুধ বেশি লাগে, অপারেশন থেকে শুরু করে অন্যান্য খরচও বেশি আদায় করা হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশনের পর প্রসূতির অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের জীবাণু আক্রমণ দেখা দেয়। এতে হাসপাতালের ব্যবসা বেড়ে যায়। আর নরমাল ডেলিভারি হলে রোগী এক-দুইদিনের মধ্যে বাসায় চলে যেতে পারে। স্বাভাবিক প্রসবের খরচ সর্বোচ্চ ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা লাগে। কিন্তু এর বিপরীতে অস্ত্রোপচারে খরচ সর্বনিম্ন ১৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। এর বাইরে কেবিন ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ তো আছেই। সরকারি জেলা হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসবের সময় রোগীর পক্ষকে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার ওষুধ কিনলেই চলে, আর অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে কিনতে হয় কমপক্ষে ৩ হাজার টাকার ওষুধ। এক হিসেবে, বছরে সিজারিয়ানে ব্যয় হয় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। সমালোচক ও বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিজারিয়ান ব্যবসা শুধু ব্যবসাই নয়; বরং এটি একটি ষড়যন্ত্র। এর মাধ্যমে একটি ষড়যন্ত্রকারী মহল বাংলাদেশের জনসংখ্যার হার হ্রাস করতে চাচ্ছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ডাক্তাররা যেকোনো অস্ত্রপাচার বা অপারেশন যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে, কারণ যেকোনো অপারেশনে অনেক বেশি রিস্ক নিতে হয়। সেইসাথে একটি সিজারের পর একজন মহিলার ফার্টিলিটি (বাচ্চা ধারণের ক্ষমতা) অনেকাংশে কমে যায়। নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে জন্মানো বাচ্চারা কষ্টসহিষ্ণু হয়, তাদের শ্বাসকষ্ট এবং এ্যাজমাজনিত সমস্যা কম হয়। সিজারিয়ান পদ্ধতিতে ডেলিভারি করার সময় মাকে যেসব অ্যানেস্থেটিক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, তা নবজাতকের উপরও প্রভাব ফেলে। সিজার সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারেও বাধা হয়ে উঠতে পারে। সিজারিয়ান পদ্ধতিতে জন্ম নেয়া নবজাতক শিশুর হাসপাতালে থাকার সময়কাল বেশি বলে তাদের ইনফেকশন ঝুঁঁকি থাকে। ওই সব শিশুর ব্লাড ইনফেকশনের হার বেশি। সিজার করায় ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সময়ের দুই-তিন সপ্তাহ আগেই সন্তান হয়ে যায়। শিশু ইনফেকশনে পড়ার এটিও একটি কারণ। যেসব মা সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সন্তান হওয়ার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী থাকে, সেসব নবজাতকের প্রথম ২৮ দিনে মৃত্যুহার তিনগুণ বেশি থাকে। নিউরোসায়েন্সের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে পেয়েছে, সিজারিয়ান পদ্ধতিতে জন্ম নেয়া শিশু পরবর্তী সময়ে সিজোফ্রেনিয়ার মতো গুরুতর মানসিক রোগে ভোগার ঝুঁকিতে থাকে বেশি।
বলাবাহুল্য, বাংলাদেশে সিজার নামক জন্মহার হ্রাসের এই প্রক্রিয়াটি ব্যাপকহারে বাড়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে সরকারের অব্যবস্থাপনা এবং অনিয়ম। দেশের প্রধানমন্ত্রী তিনি মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় অবদান রাখার নামে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। তবে এসবের পরেও সারাদেশে সিজারিয়ান অপারেশনের নামে গলাকাটা বাণিজ্য করছে একশ্রেণীর চিকিৎসক এবং ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। মফস্বলে অনেক গাইনি চিকিৎসক নামধারীদের গাইনি চিকিৎসায় কোনো অভিজ্ঞতা নেই। অ্যানেসথেশিয়া (অজ্ঞান করা) বিষয়ে কোনো উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেই। টাকার লোভে তারা সিজারিয়ান অপারেশন করে থাকে। সরকারি হাসপাতালের কিছু ডাক্তারও এসবের সঙ্গে জড়িত। অনভিজ্ঞ ডাক্তাররা স্পাইনাল কর্ডে অ্যানেসথেশিয়া দিয়ে অপারেশন করে যাচ্ছে। অনেক সময় হাতুড়ে ডাক্তারও প্রসূতির অপারেশন করছে। কোনো কোনো সময় নার্সরাও অপারেশন করছে। সরকারি হাসপাতালে গেলেও প্রসূতি মায়েদের পাঠিয়ে দেয়া হয় ক্লিনিকে। এসব ক্লিনিকে অত্যাধুনিক কোনো ব্যবস্থা নেই। উন্নত যন্ত্রপাতি, আইসিইউ এবং ইনকিউবেটর থাকার কথা থাকলেও তা নেই।
সঙ্গতকারণেই, প্রধানমন্ত্রী বলেছে- ‘জনসংখ্যা দেশের সম্পদ’। আর দেশের ভেতরই একটি দেশবিরোধী ও ষড়যন্ত্রকারী মহল এই সিজারের প্রবল বিস্তার করিয়ে দেশের জনসংখ্যা নামক সম্পদটিকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা করছে। তাই এক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে- অবিলম্বে শিশুর ডেলিভারি ব্যবস্থায় নরমাল ডেলিভারিতে উৎসাহিত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সেইসাথে দেশের চিকিৎসা খাতে যে দুর্নীতিবাজ মহলটি সিজারের নামে ব্যবসা করে বিপুল মুনাফা লুটে নিচ্ছে এবং রোগীদের দরিদ্র করে দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা। অন্যদিকে দেশের গাইনি খাতকে উন্নত করে এই সিজারিয়ান ব্যবসার মূল্যোৎপাটন করা।
-আল্লামা মুহম্মদ ওয়ালীউর রহমান, ঢাকা।
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০