(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বাগেরহাটের রামপালে সুন্দরবনের কাছে ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হলে ঝুঁকিতে পড়বে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানির (এনটিপিসি) সঙ্গে এ বিষয়ে পিডিবির ইতিমধ্যে চুক্তি সই হয়েছে।
কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি করার জন্য প্রস্তাবিত আরেকটি জায়গা ছিল খুলনার লবণচরা এলাকা। পরিবেশবিদদের মতে, লবণচরায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে সুন্দরবন রক্ষা পেত। জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ‘প্রাথমিক পরিবেশগত সমীক্ষা’ চালায় বাংলাদেশ সরকারের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (সিইজিআইএস)।
‘প্রাথমিক পরিবেশগত সমীক্ষায় তারা প্রকল্পের স্থান নির্ধারণে সম্ভাব্য দুটি জায়গার (রামপাল ও লবণচরা) একটি তুলনা করে। সেখানে লবণচরায় প্রকল্পটি করার ক্ষেত্রে কয়েকটি বাধার কথা উল্লেখ করা হয়। এগুলো হচ্ছে, সংলগ্ন কাজিবাছা নদীর অগভীরতা, জনসংখ্যা ও ঘরবাড়ির ঘনত্ব এবং জমি পাওয়ার ক্ষেত্রে শঙ্কা। অন্যদিকে রামপালের সমস্যা হিসেবে দেখা হয় পশুর নদীর অগভীরতাকে। তদুপরি কয়লা পরিবহনের সুবিধা থাকায় রামপালকেই তারা অগ্রাধিকার দেয়।
প্রশ্ন উঠেছে, সিইজিআইএস কিসের ভিত্তিতে এই পরিবেশগত সমীক্ষা দিল? রামপালের সমস্যা হিসেবে তারা পশুর নদীর গভীরতাকে চিহ্নিত করেছে কিন্তু সুন্দরবন কেন তাদের চোখে পড়ল না? কয়লাভিত্তিক একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র কী ধরনের পরিবেশগত ক্ষতি করতে পারে তার হিসাব সিইজিআইএস দিয়েছে। কিন্তু সুন্দরবনের সন্নিকটে হওয়ায় বনের উপর এর কী প্রভাব পড়বে তা এতে বলা হয়নি। কোনো প্রভাব পড়বে না তাও বলা হয়নি।
এটা স্পষ্ট যে, সিইজিআইএস’র সমীক্ষায় সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সুন্দরবন প্রসঙ্গ। অথচ এই সমীক্ষার উপর ভিত্তি করেই অবস্থানগত ছাড়পত্র পেল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
‘সিইজিআইএস আসলে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এটা প্রতিবেদন দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়। প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের নামের প্রতি অবিচার করে সরকারি হুকুম তামিল করেছে। চাইলেই সরকার এ প্রকল্পটি লবণচরায় করতে পারত। লবণচরায় করলে সুন্দরবন রক্ষা পেত। সিইজিআইএস’র সমীক্ষায় সব ক্ষতির হিসাব আছে কিন্তু সুন্দরবনের ক্ষতির কোনো হিসাব নেই কেন? সমীক্ষায় তো আসা উচিত ছিল যে, রামপালে করা যাবে না। কারণ এখানে সুন্দরবন আছে। লবণচরায় করা যাবে, কারণ এখানে সুন্দরবন নেই। তা না করে তারা কয়লা পরিবহনের সুবিধার জন্য রামপালকেই অগ্রাধিকার দিল। এটা খুবই হতাশার যে, সরকার তো বটেই, পরিবেশ সম্পর্কিত একটি প্রতিষ্ঠানও সুন্দরবনের মূল্য বুঝতে পারছে না। সরকারের উচিত অবিলম্বে এই প্রকল্পের স্থান পরিবর্তন করে তা সুন্দরবন থেকে অন্তত ১০০ কিলোমিটার দূরে নিয়ে যাওয়া।’
সুন্দরবনের পাশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নানামুখী ক্ষতির কারণ হতে যাচ্ছে। তা জেনেও সরকার এ প্রকল্প থেকে পিছু হটছে না। কিন্তু এ প্রকল্প থেকে আসলে কী পাওয়া যাবে। হিসাব করে দেখা গেছে, সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম হবে চড়া। জানা গেছে, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল্য ঠিক করতে প্রাক সমীক্ষা করার দায়িত্ব দেয়া হয় ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এনটিপিসিকে।
এনটিপিসি তাদের সমীক্ষা শেষে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য প্রথমে প্রস্তাব করে ৮.৫৫ রুপি, যা স্থানীয় মুদ্রায় ১৪ টাকা। ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের এ প্রস্তাব মানতে না পেরে বিদ্যুৎ বিভাগ মূল্য নির্ধারণের জন্য পুনরায় প্রাক সমীক্ষা চালাতে এনটিপিসিকে অনুরোধ করে।
পরবর্তী প্রাক সমীক্ষা অনুযায়ী এ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে ব্যয় হবে নয় টাকা।
তবে পিডিবির চেয়ারম্যান চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ পেতে ব্যয় হবে পাঁচ থেকে সাত টাকা। পিডিবি চেয়ারম্যান বলেন, প্রকৃত দাম নির্ভর করবে কেন্দ্রটির যন্ত্রপাতির দাম, নির্মাণ ঠিকাদারের ব্যয়, ঋণের সুদের হার, কয়লার দাম ইত্যাদির উপর।
রামপাল কেন্দ্রের জন্য প্রতিবছর কয়লা লাগবে ৪৫ লাখ টনের মতো। ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এ কয়লা আমদানি করা হবে। পাশাপাশি চীনের কথাও ভাবা হচ্ছে। জানা গেছে, কয়লা কোথা থেকে আমদানি করা হবে তা নির্ধারণ করতেই কেবল সংশ্লিষ্ট কমিটির পেছনে সরকারের ব্যয় হচ্ছে প্রায় তিন কোটি টাকা।
তবে সূত্র জানায়, প্রকল্পের সর্বশেষ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে প্রতি টন কয়লার দাম ১০৫ মার্কিন ডলার ধরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ টাকা ৯০ পয়সা। আর প্রতি টন কয়লার দাম ১৪৫ ডলার ধরে নির্ধারণ করা হয়েছে আট টাকা ৮৫ পয়সা।
যদিও গত ডিসেম্ব^র মাসে দেশি প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে মোট এক হাজার ৮৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার তিনটি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের যে চুক্তি অনুস্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে বিদ্যুতের দাম পড়ছে অনেক কম। এর মধ্যে ৫২২ মেগাওয়াটের মাওয়া কেন্দ্রের প্রতি ইউনিটের দাম পড়ছে চার টাকা সাড়ে নয় পয়সা, খুলনা কেন্দ্রের তিন টাকা ৮৮ পয়সা এবং চট্টগ্রাম কেন্দ্রের তিন টাকা ৭৯ পয়সা। বর্তমানে দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বড়পুকুরিয়ায় উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম পড়ছে সাড়ে পাঁচ টাকার মতো।
দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের চেয়ে দেশীয় একক উদ্যোগ অনেক বেশি সাশ্রয়ী। বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞদের মতে, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যদি কয়লা আমদানি করা হয় তাহলে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম আরো বেশি পড়বে। আবার বিদেশি প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্ব থাকায় তাদের সঙ্গে লেনদেন হবে ডলারে। ডলারের বিপরীতে যেভাবে টাকার দাম পড়ছে তাতে খরচের হিসাব কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলা মুশকিল।
তাছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে মোট ব্যয়ের ৭০ ভাগ আসবে ঋণ থেকে। এ ঋণের সুদ কী পরিমাণ হবে তা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। আবার কয়লা আমদানিতে ব্যয় কত হবে তাও নির্ধারণ হয়নি। এসব চূড়ান্ত করার পর মূল্য নির্ধারণ করা হবে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে এ প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য তেমন একটা সুবিধার হবে না।
প্রত্যাখ্যাত এনটিপিসি কেন
ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কোম্পানি এনটিপিসির ওয়েবসাইট ও বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, ভারতের মধ্যপ্রদেশের নরসিংহপুর জেলার ঝিকলি ও তুমরা গ্রামে এনটিপিসি রামপাল কেন্দ্রের মতোই এক হাজার একর জমির উপর একটি ৬৬০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট তৈরির প্রস্তাব দেয়।
কিন্তু দেশটির পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এক্সপার্ট এপ্রাইজাল কমিটির (ইএসি) এক সভায় বলা হয়, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য নির্ধারিত স্থানটি মূলত কৃষিজমি প্রধান এবং এ বিষয়ে প্রকল্পের স্বপক্ষের লোকদের দেয়া তথ্য গ্রহণযোগ্য নয়।
কমিটির সভায় আরো জানানো হয়, শহরের এত কাছে এ রকম একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র কাঙ্খিত নয়। তাছাড়া, নর্দমা নদী থেকে প্রকল্পের জন্য ৩২ কিউসেক পানি টেনে নেয়াটাও বাস্তবসম্মত নয় বলেও ইএসি তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করে। জানা যায়, ওই প্রস্তাবিত কেন্দ্রের ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে সংরক্ষিত বন ছিল। ভারতীয় পরিবেশ আইনে কোনো সংরক্ষিত বনের ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র করা যাবে না।
অথচ বাংলাদেশে একই ধরনের ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি। সুন্দরবনের কোলের ভেতর গড়ে তোলা হচ্ছে কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কোনো রকম পরিবেশগত বিবেচনা ছাড়াই!
অথচ সুন্দরবন বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। টাকা দিয়ে এর মূল্য হিসাব করা যাবে না। তারপরও কেন তারা সুন্দরবনে যাচ্ছে। প্রয়োজনে ঢাকা উজাড় করে সুন্দরবন বাঁচাতে হবে। অথচ সরকার সুন্দরবন ধ্বংসের আয়োজন করছে।
এ চুক্তির সমস্যা হচ্ছে, প্রকল্পের অর্থ আসবে বিদেশি ঋণ থেকে ৭০ ভাগ
ভারত ১৫ ভাগ আর আমরা ১৫ ভাগ। আর ওই বিদেশি ৭০ ভাগ ঋণের সুদ টানা এবং ঋণ পরিশোধ করার দায় দায়িত্বও আমাদের। অর্থাৎ ভারতের বিনিয়োগ মাত্র ১৫ ভাগ। কিন্তু তারা মালিকানা পাচ্ছে ৫০ ভাগ। পুরো অর্ধেক।
তাছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পুরো ক্ষয়ক্ষতিটা যাবে আমাদের উপর দিয়ে। ভারত শুধু লাভের গুড়টুকু নিবে। কোনো দায় তাদের নিতে হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম কত হবে তার কোনো হিসাব নেই। মালিকানা অনুযায়ী ভারত কি পাবে বিদ্যুৎ নাকি টাকা? এটাও চুক্তিতে স্পষ্ট করা হয়নি। এ ধরনের অস্বচ্ছ ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকা- সরকারকে বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি। (ইনশাআল্লাহ চলবে)
(সূত্র : সুন্দরবনভিত্তিক বিষয়ক বিভিন্ন বই, কোর্ট রেফারেন্স, ইন্টারনেট সোর্স, বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও সাম্প্রতিক পত্র-পত্রিকা এবং সংবিধান)
–মুদহম্মদ ওয়ালীউর রহমান
প্রসঙ্গঃ আমেরিকায় ইহুদী প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ- ২
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩৪
চাঁদ দেখা এবং নতুন চন্দ্রতারিখ শুরু নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা- ১