ভারতের কাছে দেশের স্বার্থ বিলিয়ে দেবার নিকৃষ্টতম উদাহরণ রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। আইন ভেঙ্গে, সংবিধান ভেঙ্গে, জনগণকে ধোঁকা দিয়ে তৈরি হচ্ছে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। মাত্র ১৫ ভাগ বিনিয়োগ করে ভারত মালিকানা পাবে ৫০ ভাগ। আর ধ্বংস হবে এদেশের সুন্দরবন। এদেশের অর্থনীতি। এ ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র রুখে দেয়ার দায়িত্ব জনগণের (২)

সংখ্যা: ২২৭তম সংখ্যা | বিভাগ:

 (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আইন ভাঙছে সরকার :

জানা গেছে, এ বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে পানিভাগ ভরাট, কার্বন নির্গমন, বন ক্ষতিগ্রস্তকরণ, বিশ্ব ঐতিহ্যের ধারক বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্তকরণসহ দেশি-বিদেশি মোট পাঁচটি আইন বা কনভেনশন লঙ্ঘন করতে হচ্ছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার পানিবায়ু পরিবর্তনের শিকার হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নিচ্ছে। উন্নত বিশ্ব কার্বন নির্গমনের দায় হিসেবে বাংলাদেশকে অর্থ দিলেও এ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকার নিজেই বিপুল পরিমাণ কার্বন নির্গমনের পথে এগুচ্ছে। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত পানিবায়ু তহবিলের উপর আঘাত বয়ে আনতে পারে।

সরকারি যুক্তি :

পরিবেশবিদদের নানা আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সরকারপক্ষ মনে করছে, রামপালই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য উপযুক্ত জায়গা।

এনটিপিসির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান এএসএম আলমগীর কবীর জানায়, প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা পরিবেশগত সমস্যার কিছু দেখছি না। পরিবেশ দূষণ ও প্রতিবেশ যাতে নষ্ট না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি আমরা পেয়েছি।

চুক্তি অনুষ্ঠানে পিডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সবচেয়ে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। এতে সালফারের পরিমাণ কম থাকবে, পরিবেশ দূষণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।

এ কেন্দ্রে আমদানিনির্ভর বিটুমিনাস কয়লা ব্যবহার করা হবে, যাতে সালফার ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড কম থাকবে। সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, যাতে উচ্চ দক্ষতা ও কম কয়লা ব্যবহার হবে। বর্তমানে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় সাবক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি এর চেয়ে অনেক উন্নতমানের।

সরকারি বক্তব্যের ফাঁক :

সুন্দরবনের পাশে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সরকারপক্ষ প্রধানত তিনটি যুক্তি দাঁড় করিয়েছে। প্রথমত বলা হচ্ছে, পরিবেশগত কোনো ক্ষতি হবে না, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আব্দুস সাত্তার জানায়, ‘সুন্দরবনে যদি এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয় তাহলে বিশ্বের অন্যতম প্রধান এই ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হতে সময় লাগবে না। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার পরিবেশ দূষণকারী কার্বন ও মিথেন উৎপাদনের জন্য উন্নত বিশ্বকে দায়ী করছে। এ অবস্থায় নিজেরাই আবার প্রকৃতির ঐশ্বর্যম-িত বন ধ্বংস করার প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। যা সব দিক থেকে আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হবে।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মনোয়ার ইসলাম জানায়, ‘পরিবেশগত ছাড়পত্র এখনো দেয়া হয়নি। শুধু লোকেশন ক্লিয়ারেন্স (অবস্থানগত ছাড়পত্র) দেয়া হয়েছে। কেবলমাত্র পরিবেশগত প্রভাব যাচাই (ইআইএ)  সম্পন্ন হলে তারপর পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়া হবে। যদি ইআইএ দেখে অধিদপ্তর যথাযথ মনে না করে তবে ছাড়পত্র দেয়া হবে না।’

দ্বিতীয়ত বলা হচ্ছে, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি হচ্ছে সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে। ফলে এর দ্বারা সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। এখানে উল্লেখ্য, সুন্দরবনের মূল সীমানার বাইরে আরো ১০ কিলোমিটার এলাকা সরকার প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অর্থাৎ সুন্দরবনের মতো তার চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাও সংরক্ষিত বা বনেরই অংশ। সরকারি হিসেবে ধরা ১৪ কিলোমিটারের ভেতর এই প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন ১০ কিলোমিটার এলাকা রয়েছে। সরকারি হিসেবেই তাহলে প্রকল্পের স্থান হয় বন থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে। কিন্তু বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি ড. এমএ মতিন জানায়, ‘আমরা নিজেরা গিয়ে দেখেছি, এ প্রকল্প সুন্দরবন থেকে ৯.৫ কিলোমিটার দূরে। অর্থাৎ এটা সংরক্ষিত এলাকা বা বনের মধ্যেই পড়ছে।’ এ নিয়ে আদালতে রিটকারী আইনজীবী ড. জিয়াউর রহমানও জানায়, ‘এটা সুন্দরবনের মূল সীমানা থেকে মাত্র ৯.৫ কিলোমিটার দূরে। যা আসলে বনেরই অংশ।’

ড. জিয়াউর রহমান আরো জানায়, ‘আইন অনুযায়ী এখানে কোনো ধরনের শিল্প করার নিয়ম নেই। অথচ এখানেই গড়ে উঠছে সবচেয়ে বিপজ্জনক লাল ক্যাটাগরির শিল্প।’ উল্লেখ্য, পরিবেশ অধিদপ্তর দূষণের হার নির্দিষ্ট করতে সকল শিল্পকে সবুজ, হলুদ, লাল ক্যাটাগরিতে ভাগ করে চিহ্নিত করে।

অন্যদিকে বৈশ্বিক অবস্থান নির্ণয় পদ্ধতি বা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) ব্যবহার করে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, প্রস্তাবিত প্রকল্প সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকার মধ্যে পড়ে। জিপিএস কো অর্ডিনেট, এক্স : ৮৯.৬৯১৬০ এবং ওয়াই : ২২.৪২৭৭৫ নেয়া হয়েছে পশুর নদীর প্রান্ত থেকে যেখানে লাল ক্যাটাগরির এ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সীমানা শুরু। এই পয়েন্ট থেকে সুন্দরবনের দূরত্ব মাত্র ১.৩ মাইল বা ২.০৯ কিলোমিটার। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আরো ভেতর থেকে নেয়া আরেকটি হিসেব বলছে, বনের দূরত্ব সেখান থেকে মাত্র ১.৯ মাইল বা তিন কিলোমিটার।

শেষতক বলা হচ্ছে, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আধুনিক তথা সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশগত প্রভাব যাচাই (ইআইএ) কমিটির সদস্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন জানায়, ‘কি প্রযুক্তি ব্যবহার হবে এবং কি ধরনের কয়লা ব্যবহার হবে তা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করছে। উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য কত হবে সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হচ্ছে। এখনো অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি বলেই শুনেছি। সুতরাং কি প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। আর পরিবেশগত দিকটি নির্ভর করছে কোন প্রযুক্তি ব্যবহার হবে তার উপর। একটা আরেকটার সঙ্গে যুক্ত। এখনো কিছু বলার সময় আসেনি।’

ড. ইজাজের বক্তব্য নির্দেশ করে এখনো অনেক বিষয় অমীমাংসিত। অর্থাৎ যে কোনো ধরনের প্রযুক্তি আসার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু যে প্রযুক্তিই আসুক তা কি পারবে সুন্দরবনকে বাঁচাতে? পাওয়ার সেলের প্রাক্তন মহাপরিচালক, প্রকৌশলী বিডি রহমতউল্লাহ বলে, ‘নিশ্চিতভাবে এ প্রকল্প বনকে ধ্বংস করবে। কয়লা এমন এক বস্তু, যেখান দিয়ে যাবে, যেখানে থাকবে, এটা দিয়ে যাই করা হোক এটা ক্ষতি ছাড়া আর কিছু করে না। এর কাজ হচ্ছে, বিষ উৎপাদন। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মানুষ ঝুঁকি নিচ্ছে ঠিকই তবে আমাদের মতো কোথাও এভাবে বনের মধ্যে গিয়ে বিষের কারখানা খোলা হচ্ছে না।’

সরকার তো বলছে আধুনিক প্রযুক্তি আনবে। এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সরকার কিসের আধুনিক প্রযুক্তির কথা বলে আমি বুঝি না। ভারতের কাছে তো কোনো আধুনিক প্রযুক্তি নেই। গত কোপেনহেগেন সম্মেলনে তো এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যই বিশ্ব নেতৃত্ব তাদের সতর্ক করেছিল। তাছাড়া ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করলে এ বন তারা এমনিতেই ধ্বংস করে ফেলবে। বন থেকে ভারতীয়দের বের করে আনতে হবে। নইলে প্রযুক্তি আসুক আর যাই আসুক, বন বাঁচবে না।’

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে যাতে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। বাস্তবে এটা খুবই বায়বীয় কথা। প্রযুক্তি তো মঙ্গলগ্রহ থেকে আসবে না। পৃথিবীতে এ যাবৎ কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের যত প্রযুক্তি এসেছে, তার সবই পরিবেশের কমবেশি ক্ষতি করে। ভারতের কাছে এমন কোনো প্রযুক্তি নেই, যা ব্যবহারে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। তুলনামূলক বিচারে ভারতের প্রযুক্তি জার্মানি বা উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষতিকর। এটা প্রমাণের জন্যে বিশেষজ্ঞ হবার প্রয়োজন নেই। এটা সর্বজনস্বীকৃত।

ভারত তার নিজের প্রযুক্তি ব্যবহার করেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করবে। ‘পরিবেশের ক্ষতি হবে না’ ‘এমনভাবে করা হবে যাতে কোনো ক্ষতি না হয়’- এসব অর্থহীন, অর্বাচীন কথা মানুষকে শুনতে হচ্ছে মন্ত্রী, আমলা এবং বিদেশি কোম্পানির কনসালটেন্ট ও চিহ্নিত কিছু বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে। যার সঙ্গে ‘সত্য’ এবং ‘বাস্তবতা’র কোনো সম্পর্ক নেই। পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না এমন কোনো প্রযুক্তি পৃথিবীর কোথাও নেই। আর পরিবেশের ক্ষতি হয় বলেই ভারতে এই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভারতে করলে পরিবেশের ক্ষতি হবে বাংলাদেশে করলে ক্ষতি হবে নাÑ বিষয়টি কি এমন! (সূত্র: সুন্দরবনভিত্তিক বিষয়ক বিভিন্ন বই, কোর্ট রেফারেন্স, ইন্টারনেট সোর্স, বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও সাম্প্রতিক পত্র-পত্রিকা এবং সংবিধান) (ইনশাআল্লাহ চলবে)

 -মুদহম্মদ ওয়ালীউর রহমান

প্রসঙ্গঃ আমেরিকায় ইহুদী প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ- ২

যুগের আবূ জাহিল, মুনাফিক ও দাজ্জালে কাযযাবদের বিরোধিতাই প্রমাণ করে যে, রাজারবাগ শরীফের হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী হক্ব। খারিজীপন্থী ওহাবীদের মিথা অপপ্রচারের দাঁতভাঙ্গা জবাব-৩৩

ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩৪

চাঁদ দেখা এবং নতুন চন্দ্রতারিখ শুরু নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা- ১

কোকাকোলা ও অন্যান্য কোমল পানীয় সম্পর্কে উন্মোচিত সত্য-১৮