কুরআন শরীফ-এ সূরা যিলযালে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, যখন পৃথিবী তার কম্পনে কম্পিত হবে। এ আয়াত শরীফ-এ প্রথম শিঙ্গা ফুকায় পূর্বেকার ভূমিকম্পন না দ্বিতীয় ফুৎকারের পরবর্তী ভূ-কম্পন বোঝানো হয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও আসল সর্বগ্রাসী যে একটা অকল্পনীয় ও মারাত্মক ভূমিকম্প হবে সে বিষয়ে কোন মতভেদ নেই।
এ মর্মে ভূমিকম্পকে কিয়ামতের আলামত বলা যায়।
এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে- হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কিয়ামত সংগঠিত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত ইলম উঠে না যাবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প না হবে, সময় সঙ্কুচিত না হবে, ফিতনা প্রকাশনা পাবে, অধিক পরিমাণে হত্যা না হবে। (বুখারী শরীফ)
প্রসঙ্গত এবারে রাত পোহালেই সবাই যখন পবিত্র ঈদ-উল ফিতর পালনের জন্য উন্মূখ, ঠিক তখনই পর পর দুটি ভূমিকম্প সবার মনেও আতঙ্ক এনে দেয়। রোযা রাখার পর ক্লান্তি ও অবসাদে অনেকে ঘুমিয়েও পড়েছিলেন বা ঘুমোতে যাচ্ছিলেন তারাও হকচকিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে বেরিয়ে পড়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। সেদিন শুক্রবার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে কেনা-কাটায় ব্যস্ত মানুষও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কম্পন থেমে যায়।
ঈদের আগের রাতে (১০ সেপ্টেম্বর) রাত ১০টা ৪০ মিনিটে প্রথম একটা মৃদু কম্পন। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৪.৪। ঘণ্টাখানেক পর রাত সাড়ে ১১টার দিকে আবার আরও একটি ঝাঁকুনি। কম্পনটি ছিল ৪.৮ মাত্রার। শনিবার বেলা ১টা ২ মিনিটের কম্পনটির মাত্রা ছিল ৫.২ এবং এটির উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের আসাম রাজ্যে। রংপুর বিভাগসহ দেশের আরও কিছু জেলায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে তার মাত্রা ছিল ৫.২। ঈদের পরের দিন রোববার সকালের দিকেও বিভিন্ন জায়গায় ভূকম্পন অনুভূত হয়।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী গত ১০ সেপ্টেম্বর রাত ১০টা ৪০ মিনিট থেকে ১২ সেপ্টেম্বর রোববার সকাল পর্যন্ত ৬ থেকে ৯টি মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প প্রায় সারাদেশেই অনুভূত হয়। প্রথম কম্পনটির উৎপত্তিস্থল ছিল চাঁদপুরে। আর দ্বিতীয়টির উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার ৭১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ জেলার মধ্যবর্তী স্থানে।
মুন্সীগঞ্জ জেলার চরাঞ্চলের চিতলিয়া বাজারে ভূমিকম্পের কারণে ব্রিজ থেকে পড়ে গিয়ে দুব্যক্তির পায়ের হাড় ভেঙে যায়। আর কোন হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে নারায়ণগঞ্জে দুটি বহুতল ভবন এবং চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের দুটি মেঝেতে ফাটল ধরে। এছাড়া, ফরিদগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি পাকা দালানের দেয়াল ও ফ্লোর ফেটে যায়।
গোপালগঞ্জের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের পূর্ব পাশের একটি অংশে ফাটল ধরে। প্লাস্টারও খসে পড়ে। ওই সময় রোগী ও তাদের স্বজনরা ভয়ে হাসপাতালের বাইরে চলে আসে।
রাজধানীর শান্তিনগরের একটি ভবনেও ফাটল ধরেছে বলে জানা গেছে। পর পর তিনদিনে প্রায় সারাদেশে দফায় দফায় ভূকম্পনে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
গত ২০০৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাত ২টা ৫১ মিনিটে রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার ভূমিকম্পনও দেশের মানুষের মধ্যে ভয়ানক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। ২০০৮ সালের ২৬ জুলাই শনিবার দিবাগত মধ্যরাতে ও ২৮ জুলাই সোমবার ভোররাতে দুটি মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প দেশের মানুষের মধ্যে প্রচ- আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। দুদিনের ব্যবধানে পর পর দুটি ভূমিকম্পকে অনেকেই ভয়াবহ এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস বলেই মনে করেছিলেন। এবার পর পর তিনদিনের সিরিজ ভূমিকম্পের কবলে পড়ার পর অত্যন্ত যুক্তিযুক্তভাবেই বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রকৃতি হয়ত এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়েরই আগাম সঙ্কেত প্রদান করেছে। ভূমিকম্পের কম্পনে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে আতঙ্কিত হলেও সময় পেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রভাব আমাদের মন থেকে মুছে যায়। আমরা সব ভুলে যাই।
প্রচ-ভাবে কম্পিত হলেও আমরা তেমন শঙ্কিত হই বলে মনে হয় না। ভূমিকম্প পরবর্তী অবস্থা ব্যবস্থাপনায় কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও আমরা দৃঢ়ভাবে ভাবি না। ভূমিকম্প এমনই এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা বলে কয়ে আসে না। ঝড়-তুফান-বন্যা ঠেকাতে না পারলেও এগুলো থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটা সুযোগ থাকে। পূর্বাভাস পাওয়ার কোন সুযোগ নেই বলে সর্বনাশা সর্বগ্রাসী ভূমিকম্পের সংহার থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন উপায় থাকে না।
প্রলয়ঙ্করী কোন ভূমিকম্প আঘাত হানলে ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতার দিক থেকে ঢাকা মহানগরীকে সমগ্র বিশ্বে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বিশ্বের ভূমিকম্পপ্রবণ ২২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ইরান রয়েছে প্রথম স্থানে। ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি বহুতল ভবন নির্মিত হওয়ায় রাজধানী ঢাকাকেই এখন ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে ঢাকা শহরে বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানলে হাজার হাজার ভবন ধসে পড়ে এই নগরী এক বিশাল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো ঢাকা শহর এলাকায় ৩ লাখ ২৬ হাজার ভবনের ওপর এক সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে যে ৭ থেকে সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৭২ হাজার ভবন সম্পূর্ণভাবে ধসে পড়বে এবং আরও ৮৫ হাজার ভবন আংশিকভাবে ধসে পড়বে। তবে অনেকেই বলেন ৭ মাত্রা নয়, সাড়ে ৬ মাত্রার ভূমিকম্পেই রাজধানী ঢাকার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যেতে পারে। পুরনো ঢাকার অবস্থা কিরূপ ধারণ করতে পারে তা কল্পনা করাও কঠিন।
ঢাকায় সর্বশেষ ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়েছিল ১১৩ বছর আগে ১৮৯৭ সালে। হাজার মানুষের মৃত্যু ছাড়াও তৎকালীন ঢাকার বহু ঘরবাড়ি ও দালানকোঠার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। শোনা যায়, ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য ও দখলদার ব্রিটিশরা আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকদিন খোলা আকাশের নিচে কাটায়। শতাধিক আকাশচুম্বী বিশাল অট্টালিকাসহ হাজার হাজার বহুতল ভবনের বর্তমান ঢাকা মহানগরীর সঙ্গে তখনকার ঢাকার কোন তুলনাই চলে না। তখন নিশ্চয়ই পুরনো ঢাকা শহরে সর্বসাকুল্যে হাজারখানেক পাকা বাড়িই ছিল না। রাজধানী ঢাকায় কোন প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প হলে গ্যাস-বিদ্যুৎ বিস্ফোরণে আগুন লেগে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ও অন্যান্য বিপদ মিলে যে কি ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, তা আল্লাহ পাক গাফুরুর রহিম হিফাযত না করলে কী হবে তা বলা কল্পনাতীত।
ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার অভিযানের জন্য আরো ১৬৪ কোটি টাকার আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে একটি প্রকল্প তৈরি করেছে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত ৬৯ কোটি টাকার আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করেছে। হাইকোর্টের রায়ের নির্দেশনা মোতাবেক ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার অভিযানের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য সরকার একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে।
কিন্তু আসলে এসব যন্ত্রপাতি আর সবধরনের সতর্কতা, সচেতনতা অথবা সক্রিয় ব্যবস্থাপনা দ্বারা ভূমিকম্প নামী গযব থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। বরং এ গযব থেকে রক্ষা পেতে হলে সবাইকে হারাম ছবি, টিভি, সিনেমা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, উলঙ্গপনা, বিজাতীয় সংস্কৃতি, দুর্নীতি, সুদ-ঘুষ ইত্যাদি থেকে খাছ তওবা করে অনাগত কালের জন্য পরহিয হতে হবে। তাহলে ভূমিকম্পরূপী গযব হতে রক্ষা পাওয়া যাবে।
হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই আমার উম্মতগণের দুনিয়াতে শাস্তি হচ্ছে ভূমিকম্প, ফিতনা-ফ্যাসাদ ও হত্যা।” (তবারানী শরীফ)
তবে একটা ইতিবাচক দিকও আছে। যখন যমীনে খিলাফত নিকটবর্তী তখন ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়। একথা বলার অবকাশ রয়েছে যে মুজাদ্দিদে আ’যম উনার ওসীলায় অচিরেই যমীনে খিলাফত কায়িম হবে। সেক্ষেত্রে হাদীছ শরীফ মোতাবিক ভূমিকম্প একটা বড় নিদর্শন। কারণ ভূমিকম্পে একদিকে যেমন বেশির ভাগ বদ লোক মারা যাবে। তেমনি জীবিতরাও বর্তমান অনৈসলামিক মানসিকতা থেকে ফিরে ইসলামিক মনোবৃত্তিই গ্রহণ করবে। তাই হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “যখন খিলাফতের প্রত্যাশা করবে তখন পবিত্র ভূমিতে অনুসন্ধান করবে। তবে ভূমিকম্প, কঠিন বালা-মূছীবত এবং কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়”। (আহমদ, আবু দাউদ শরীফ)
-মুহম্মদ আলম মৃধা
চাঁদ দেখা এবং নতুন চন্দ্রতারিখ শুরু নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা-১৬
চাঁদ দেখা এবং নতুন চন্দ্রতারিখ শুরু নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা-১৬
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৪৭