সব প্রশংসা মহান আল্লাহ পাক উনার জন্য। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি অফুরন্ত দরূদ ও সালাম।
ইসলামের পরিভাষায় বান্দা হিসেবে প্রত্যেককে দুটি হক্ব আদায় করতে হয়। একটি হলো ‘হক্কুল্লাহ্্’। যার অর্থ হলো- মহান আল্লাহ পাক উনার হক্ব। যথা- নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ও আনুষঙ্গিক ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত ইত্যাদি বিষয়। অপরটি হলো- ‘হক্কুল ইবাদ’ বা বান্দার হক্ব। অর্থাৎ কোন বান্দার প্রতি অপর বান্দার যে হক্ব রয়েছে তা যথাযথভাবে আদায় করা বা নষ্ট না করা। যেমন কোন দোকানির কাছ থেকে জিনিস কেনা বা কোন খাদ্য বিক্রেতার কাছ থেকে খাদ্য কেনা হলে সেক্ষেত্রে বিক্রেতা যদি তা যথাযথভাবে বিক্রি না করে অর্থাৎ যদি কোন ভেজাল বা পচা খাদ্য বা জিনিস বিক্রি করে বা মাপে কম দেয় তাহলে তাতেও হক্কুল ইবাদ বিশেষভাবে নষ্ট হয়। কারণ এতে যত বান্দা সে ভেজাল খাবার খাবে, তাতে তাদের মস্তিষ্ক, চোখ বা অন্য কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা গোটা দেহের যত ক্ষতি হবে এবং সে কারণে আরও যত ক্ষতি হবে সব ক্ষতির দায়ভার বর্তাবে ওই ভেজাল বিক্রেতার উপর। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ভেজাল বিরোধী মোবাইল কোর্ট ৪ বছর যাবৎ বন্ধ।
এদিকে ভেজাল পণ্যে সয়লাব সারাদেশ। এক দশক ধরে বাজারে যেসব ভোগ্যপণ্য বিক্রি হচ্ছে তার শতকরা ৫০ ভাগই ভেজাল। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের খাদ্যপণ্য যেমনÑ গম, ডাল, তেল, চিনি, লবণ, দুধ, কনডেন্সড মিল্ক, ঘি, মাখন, ফ্রুট জুস, ফ্রুট জেলি, সোডা পাউডার, সাগু, কর্ন ফ্লাওয়ার, রুটি, মিষ্টি, বিস্কুট প্রভৃতিতে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বিষাক্ত কেমিক্যাল ও ফুড কালার মেশানো হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রকাশিত স্বাস্থ্য বুলেটিন-২০১১ এ ভেজাল পণ্যের এ চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। মহাখালী জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের ফুড টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশ থেকে পাঠানো নমুনা পণ্য পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ভোগ্যপণ্যের প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ শতকরা ৪৮ ভাগই ভেজাল। ২০১০ সালে ভেজাল নমুনার শতকরা হার ছিল ৫২ ভাগ।
স্বাস্থ্য বুলেটিনে দেখা গেছে, ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ল্যাবরেটরিতে মোট ৫৩ হাজার ৪২টি খাদ্যপণ্যের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৫ হাজার ১৫৭টিই ভেজাল। ২০০১ সালে ৩ হাজার ২৮০টি নমুনার মধ্যে ১ হাজার ৫৮৮টি, ২০০২ সালে ৪ হাজার ৩শ’টির মধ্যে ২ হাজার ১৯০টি, ২০০৩ সালে ৫ হাজার ১২০টির মধ্যে ২ হাজার ৬০৫টি, ২০০৪ সালে ৪ হাজার ৪১৩টির মধ্যে ২ হাজার ১১৯টি, ২০০৫ সালে ৬ হাজার ৩৩৭টির মধ্যে ৩ হাজার ১৩৭টি, ২০০৬ সালে ২ হাজার ৭৭৯টির মধ্যে ১ হাজার ৩৭৪টি, ২০০৭ সালে ৫ হাজার ২৯৯টির মধ্যে ২ হাজার ৫০৪টি, ২০০৮ সালে ৮ হাজার ৪৩৪টির মধ্যে ৩ হাজার ৬৬৮টি, ২০০৯ সালে ৬ হাজার ৩৩৮টির মধ্যে ২ হাজার ৯৮২টি এবং ২০১০ সালে ৫ হাজার ৭৭৯টির মধ্যে ২ হাজার ৯৯০টির নমুনায় ভেজাল সনাক্ত হয়।
খাদ্য ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, মহাখালী ফুড টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে শুধু খাদ্যপণ্য পরীক্ষা করা হলেও বর্তমানে রাজধানীসহ সারাদেশে খাবার ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফলমূলÑ আম, আপেল, আনারস, কাঁঠাল, কমলা, কলা, আঙ্গুর, তরমুজ, ডালিম ও আতায় বিষাক্ত কেমিক্যাল ও ডায়িং কালার মিশিয়ে কৃত্রিম উপায়ে পাকানো হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, টমেটো, গাজর, লাউ, কচু, ফুলকপি, ঢেঁড়স, মুলা ও শালগমে কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে। মাছ তাজা রাখতে ফরমালিন দেয়া হচ্ছে। আজকাল মশলাতেও ভেজাল মিশিয়ে বিক্রি হচ্ছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে একদিকে কোন ল্যাবরেটরি এখনও গড়ে ওঠেনি। তেমনি এগুলো মনিটরিং করার জন্যও নিয়মিত ও শক্তিশালী কোনো বাহিনী গড়ে উঠেনি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ভেজাল ভোগ্যপণ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের লাগামহীন অপকর্মের কারণে নগদ টাকায় ভোগ্যপণ্য কিনে ক্রেতারা অজান্তেই অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছেন। বিশেষ করে রাস্তাঘাটে খোলামেলা অবস্থায় যেসব খাবার বিক্রি হয় সেগুলোতে মারাত্মক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকে। ভেজাল খাবার খেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ পেটের বিভিন্ন ধরনের পীড়ায় আক্রান্ত হলেও কেমিক্যাল ও ফুড কালার নিয়মিত খাওয়ার ফলে দীর্ঘমেয়াদে হƒদরোগ, হজম ও খাদ্যনালির সমস্যাসহ কিডনি ও ক্যান্সারের মতো ভয়াল ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।
মূলত ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্রের অপতৎপরতা রোধে সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় কোন উদ্যোগ নেই। কালেভদ্রে ভেজালবিরোধী অভিযানে ভেজাল মিশ্রণকারীরা গ্রেফতার হয়। কঠিন আইন না থাকায় আইনের ফাঁক গলিয়ে জামিনে বের হয়ে আবার তারা ভেজাল মিশ্রণের কাজে নেমে পড়ে। ভেজাল বাণিজ্য রোধে সরকারিভাবে কঠোর আইন প্রণয়ন, ব্যবসায়ীদের নৈতিক মানসিকতা সৃষ্টি ও সর্বোপরি মানুষের মধ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টি প্রয়োজন।
ফুড টেস্টিং ল্যাবরেটরির কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন সময় তারা নিজেরাও বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির ঘি ও বাজারের মিষ্টি পরীক্ষা করে দেখেছেন শতকরা ৯০ ভাগই ভেজাল। তারা জানান, মাছে ফরমালিন ও ফলমূলে হরহামেশা কার্বাইড, ইথাইলিন, ইথ্রিল মেশানো হচ্ছে।
প্রসঙ্গত আমরা মনে করি যে, শুধু আইনের বল প্রয়োগেই এ ভেজাল প্রবণতা রোধ করা যাবে না। কারণ মানুষের তৈরি আইনের গোলকধাঁধায় মানুষ সহজেই পার পেয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় হলো- মানুষের সৃষ্টিকর্তা, খালিক্ব ও মালিক আল্লাহ পাক উনার প্রতি অনুগত হওয়া ও উনার ভয় লালন করা এবং এ সম্পর্কিত মূল্যবোধ ও চেতনা জাগ্রত করা।
হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “সবচেয়ে গরীব কে? অতঃপর তিনি বলেন, সবচেয়ে গরীব ওই ব্যক্তি- যে ক্বিয়ামতের দিনে পাহাড় পরিমাণ নেকি নিয়ে উঠবে। মানুষ মনে করবে সে নিশ্চিত জান্নাতী। কিন্তু এরপর তার একের পর এক পাওনাদাররা আসবে। যাদের হক্ব সে নষ্ট করেছে। তখন তার নেকি দ্বারা তাদের সে হক্ব আদায় করা হবে। এরপরও বাকি থেকে যাবে। তখন পাওনাদারদের গুনাহ তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। কিছুক্ষণ পূর্বে যে ব্যক্তি ছিল নিশ্চিত জান্নাতী এখন সে ব্যক্তি হয়ে পড়বে নিশ্চিত জাহান্নামী।” হাদীছ শরীফ-এ এ ব্যক্তিকেই সবচেয়ে গরীব বলা হয়েছে।
মূলত আজকের যুগে ধর্মব্যবসায়ী তথা উলামায়ে ‘সূ’দের প্রাদুর্ভাব থাকায় এহেন ইসলামী চেতনা কারো মাঝে নেই বললেই চলে। বরং উলামায়ে ‘সূ’রাও যেভাবে অসততায় আর দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়েছে তা দেখেই ভেজালকারী ও দুর্নীতিবাজরা আরও সাহসী ও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তার পরিণতিতেই সারাদেশব্যাপী এত ভেজাল আর দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে।
এক্ষেত্রে যামানার ইমাম ও মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদে আ’যম, রাজারবাগ শরীফ-এর হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম উনার নেক ছোহবতে শামিল হওয়া সবার জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। তাহলে শরীরী খাদ্যের ভেজাল প্রবণতা ও প্রক্রিয়াই শুধু দূর হবে না পাশাপাশি অন্তরের ভেজালও দূর হবে তথা বিশুদ্ধ রূহানী খাদ্যের প্রাচুর্যে রূহানী স্বাস্থ্যও সমৃদ্ধ হবে। মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদের সবাইকে সে মহান নিয়ামত নছীব করুন। (আমীন)
-মুহম্মদ ওয়ালীউল্লাহ
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০