(ক)
লিখতে বিলম্ব করলেও একটি দিক তাতে ভালো করে প্রকাশ পেয়েছে। ধর্মব্যবসায়ী, রাজাকাররা কি করে মিথ্যার ফানুস তৈরি করে বেঁচে যায় তার কারণ উদঘাটিত হয়েছে। গত ৬ই মে-২০০৮ ঈসায়ী তারিখে ‘আমাদের সময়’ নামক দৈনিকে পত্রস্থ হয়, “জিবরাইলের শত্রু বলা আর হাফেজ্জীকে যুদ্ধাপরাধী বলা সমান অপরাধী।” এ চরম বেয়াদবী, ধৃষ্টতা ও মহা কুফরীমূলক বক্তব্যটির বক্তা হচ্ছে- বায়তুল মুকাররম মসজিদের ভারপ্রাপ্ত খতীব মুহম্মদ নুরুদ্দীন।
আশ্চর্য! গত ৫ই মে-২০০৮ ঈসায়ী তারিখে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে খতীবের এ বক্তব্য প্রদানের পর ৯ই মে-২০০৮ ঈসায়ী একটা জুমুয়াও পার হয়ে গেল। কিন্তু নির্বিকার, নীরব, নিশ্চুপ থাকল সাধারণ মানুষ, সাধারণ মুসলমান, এমনকি মুক্তিযোদ্ধা সমাজ।
মূলতঃ এরূপ নির্বিকার আর নিষ্ক্রিয় থাকার কারণেই ধর্মব্যবসায়ীদের শেকড় এত গভীরে প্রোথিত হয়েছে। তারা ডাল-পালা বিস্তার করে আজকের এত শক্ত অবস্থানে বিরাজ করছে। রাজাকাররা শুধু পূনর্বাসিতই হয়নি, শুধু তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকাই উড়েনি, স্বাধীন দেশে তারা শুধু মন্ত্রীত্বের স্বাদই ভোগ করেনি পাশাপাশি তারা আজ দ্বিধাহীনচিত্তে স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি সেজেছে। মুক্তিযোদ্ধা দাবি করার মত দুঃসাহস দেখাতে পারছে।
এক্ষেত্রে বায়তুল মুকাররমের ভারপ্রাপ্ত খতীব নুরুদ্দীন গং কতৃর্ক হাফেজ্জীকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক বলা, তাকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য উৎসাহদাতা হিসেবে ঘোষণা করা- সাক্ষাত ও বড় এবং নিকৃষ্ট উদাহরণ।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক হাজার ৫৯৭ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি। এর মধ্যে আছে ৩৬৯ জন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা, ৮৫২ জন রাজাকার, ৬৪ জন আলবাদর, ৭৮ জন বিহারি দালাল, ১০৬ জন রাজনৈতিক দালাল ও শান্তি কমিটির ১২৮ জন সদস্য।
কমিটি জানিয়েছে, এই তালিকা পূর্ণাঙ্গ নয়, অচিরেই প্রমাণসহ আরও ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করা হবে। সব মিলিয়ে তারা একটি বই প্রকাশ করবে। কমিটি এই তালিকা সরকার, নির্বাচন কমিশনকেও দেবে। নির্বাচন কমিশন আগামী নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ করতে দেবে না বলেও আশা করছে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি। অনুষ্ঠানে একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতার শিকার চার নারীও উপস্থিত ছিলেন।
কমিটির আহবায়ক ডা. এম হাসান সাংবাদিকদের জানান, তারা ১৭ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধ নিয়ে কাজ করে আসছেন। ১৯৯৯ সাল থেকে ১৩ জন গবেষক সারাদেশ ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তৎকালীন সেনাবাহিনীর নানা দলীল পর্যালোচনা করেছেন এবং তৃণমূল থেকে প্রমাণ যোগাড় করেই এসব যুদ্ধাপরাধীকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তদ্প্রেক্ষিতেই হাফেজ্জীর নাম এসেছে।
কিন্তু ভারপ্রাপ্ত খতীব কাযযাব নুরুদ্দীন গং সে দলীল প্রমাণ খণ্ডাতে না পেরে আবার ধর্মের আশ্রয় নিয়ে মিথ্যা বিবৃতি দিয়ে নিজেদের আত্মরক্ষা কূটকৌশলের অবতারণা করল। হযরত জীবরীল আলাইহিস্ সালাম-এর মত ঈমানী অঙ্গ ও স্পর্শকাতর বিষয়কে তারা হাফেজ্জীর সাথে যুক্ত করল।
ধোয়া দেখলেই আগুন বোঝা যায়। আকলমন্দকে লিয়ে ইশারাহি কাফি হ্যায়।
হাফেজ্জী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যোগ বিবৃতি দিয়েছেন, কোন সভা করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, যোগাযোগ ছিল এরূপ একটি বিষয়েও কী … খতীব নুরুদ্দীন গং কোন প্রমাণ দেখাতে পারবে?
বরং বিপরীতভাবে অনেক প্রমাণ দেখানো যাবে যে, হাফেজ্জীর সঙ্গী-সাথীরা ছিল কট্টর রাজাকার ও কুখ্যাত খুনি।
হাফেজ্জীর পীরভাই কিশোরগঞ্জের কুখ্যাত আতাহার আলীর নাম এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
মূলতঃ আতাহার আলী আর হাফেজ্জী ছিল একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। দু’জনেই ছিল থানভীর খলীফা। দু’জনেই একই মানসিকতার। দুজনেই আত্মার আত্মীয়।
সুতরাং কুখ্যাত রাজাকার খুনি আতাহার আলীর কু-কীর্তি ও যুদ্ধাপরাধই এমনিতেই প্রমাণ করে যে, আসলে হাফেজ্জীও ছিল মারাত্মক যুদ্ধাপরাধী ঘরানার লোক।
বিষয়টির প্রমাণ যে খুব কষ্টকর তাও কিন্তু নয়। বরং ছড়ানো ছিটানো প্রমাণ বহু।
প্রসঙ্গতঃ এমনি এক প্রমাণ পত্রস্থ হয়েছেঃ “হাফেজ্জী স্মারক গ্রন্থে।” হাফেজ্জী পরিষদ কতৃর্ক প্রকাশিত ঐ হাফেজ্জী স্মারক গ্রন্থের ৭১০-৭১১ পৃষ্ঠায় হাফেজ্জী ও আতাহার আলী ভক্ত জামেয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ এর নায়েবে মুহতামিম মাওলানা আবুল ফাতাহ মোহাম্মদ ইয়াহ্ইয়ার লিখনীতে প্রকাশ পেয়েছে:
“হাফিজ্জী হুযূরের নাম শুনে শুনেই আমি অন্তরে শ্রদ্ধা পোষণ করতাম। স্কুল জীবনের শিক্ষা বর্জন করে মাদরাসায় পদার্পন করে আমি ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টা করি। সেজন্য দেশের বড় বড় মনীষীর সান্নিধ্যে সময় কাটানো বলতে গেলে আমার সে সময়ে নেশায় পরিণত হয়েছিল। জীবনের শুরুতেই হযরত থানভী (রহঃ) এর স্বনামধন্য মুজায হযরত মাওলানা আতাহার আলী (রহঃ) এর সান্নিধ্যে তাঁর একান্ত খাদেম হিসেবে দীর্ঘ এক দেড় বৎসর অতিবাহিত করার সুযোগ হয়। ঢাকায় আসার পর হযরত হাফেজ্জী হুযূরের সান্নিধ্যে কিছুদিন কাটাবার আকাঙ্খায় কামরাঙ্গীরচরে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করি।
এরপর তাঁর সাক্ষাত লাভের আশায় অনেকবার কামরাঙ্গীরচর যাওয়া হয়েছে। কিন্তু কোন না কোন কারণে আর দেখা করার সৌভাগ্য হয়নি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। যেহেতু পাকিস্তান একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আবেগের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; এ কারণে এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ পকিস্তানের মাঝ দিয়ে তাদের সেই আবেগের বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখত। যদিও এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে ১৯৪৭-১৯৭১ এই ২৪ বৎসরের দীর্ঘ সময় কেটে যায় এবং একটি সাধারণ রাষ্ট্র হিসেবেই পাকিস্তান সময় অতিবাহিত করতে থাকে, কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের স্বপ্নে বিভোর মানুষের সেই স্বপ্নের রেশ তবুও কাটেনি।
তাছাড়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য যারা আন্দোলন করেছিলেন, রক্ত দিয়েছিলেন, ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, স্বাভাবিক কারণেই তারা পাকিস্তান ভেঙে ফেলার কথা ভাবতেই পারতেন না। এ কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে তাদের বিরাট একটি অংশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শরীক হতে পারেননি।
তাছাড়া তিন দিকে ভারত বেষ্টিত এই ছোট ভূ-খণ্ডটি ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কতটা ভারতীয় আগ্রাসন মুক্ত থাকতে পারবে এটিও একটি বিরাট প্রশ্ন হয়ে তাদের সামনে দেখা দিয়েছিল।
এসব কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই শ্রেণীর মানুষ স্বতঃ¯ফূর্তভাবে অবদান রাখতে আগ্রহী হননি।”
বলার অপেক্ষা রাখে না, হাফেজ্জীও শুধু এই মানসিকতার লোকই ছিল না বরং ছিল এ মানসিকতার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। অর্থাৎ তার সঙ্গী আতাহার আলীর মতই মহাযুদ্ধাপরাধী।
(খ)
নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মকে কিরূপ ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, ধর্মের কত নিকৃষ্ট অপব্যাখ্যা করতে পারে কাযযাব ভারপ্রাপ্ত খতীব নুরুদ্দীন-এর কু-বচন তথা কুফরী কথায় তার শক্ত ও সাক্ষাৎ প্রমাণ মিলেছে।
বলাবাহুল্য, ফেরেশ্তাদের রসূল, রূহুল কুদুস হযরত জিবরীল আলাইহিস্ সালামকে কোন বান্দার সাথে তুলনা দিয়ে এ যাবৎ কোন মুসলমান কোন কথা বলেন নি।
কিন্তু কাযযাব ভারপ্রাপ্ত খতীব সেরূপ কথাই বললো। তবে অতীতেও কাফিররাই হযরত জিবরীল আলাইহিস্ সালাম-এর নামে বেয়াদবী করতো, অবমাননাকর বক্তব্য দিতো, কুৎসা রটনা করতো। হাফেজ্জীর মতো ব্যক্তির সাথে তুলনা দিয়ে মূলতঃ কাযযাব খতীব অতীতের কাফিরদের মতোই হযরত জিবরীল আলাইহিস্ সালাম-এর অবমাননা তথা কুফরী করেছে।
উল্লেখ্য, নিজের ফতওয়া অনুযায়ী হাফেজ্জী অনেক হারাম করেছেন। হারামকে হালাল বলে কুফরী কাজ করেছে।
হাফেজ্জী নিজে স্বীকার করেছে, সে গীবত করেছে। সে এক সময় বলেছে, ছবি তোলা হারাম তারপর নিজেই ছবি তুলেছে। গণতন্ত্র করা হারাম তারপর নিজেই তা করেছে।
পক্ষান্তরে হযরত জিবরীল আলাইহিস্ সালাম ছগীরা কবীরা সকল প্রকার পাপ হতে মুক্ত। তাঁর সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ পাক আয়াত শরীফ পর্যন্ত নাযিল করেছেন। আল্লাহ পাক বলেন, “যারা আল্লাহ পাক-এর এবং তাঁর ফেরেশ্তাগণের এবং তাঁর রসূলগণের এবং হযরত জিবরীল আলাইহিস্ সালাম ও হযরত মীকাইল আলাইহিস্ সালাম-এর শত্রু নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক সেই সকল কাফিরদেরও শত্রু।”
উল্লেখ্য, কুরআন শরীফ-এর শব্দ হিসেবে হযরত জিবরীল আলাইহিস্ সালাম-এর নাম মুবারক উচ্চারণ করলে ৫০টি নেকি হবে। কিন্তু হাফেজ্জীর মত যুদ্ধাপরাধী ও হারামকে হালালকারীর নাম উচ্চারণ করলে কি আদৌ কোন নেকি হবে?
বরং তার নামকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করলে আল্লাহ পাক-এর আরশ কাঁপবে।
কারণ হাদীছ শরীফ-এ রয়েছে যে, “ফাসিকের প্রশংসা করলে আল্লাহ পাক-এর আরশ কাঁপে।”
আর হাফেজ্জীর রাজনৈতিক মতবাদকে সমর্থন করলে হাফেজ্জীর আদর্শ অনুযায়ীই কুফরী হবে।
প্রসঙ্গতঃ হাফেজ্জী যে গীবত করেছে তা তার জবানীতেই উল্লেখ রয়েছে মাও: মাহমুদুল হাছান তার সাক্ষ্য দিয়ে বর্ণনা করেনÑ
“আরেকবার পাকিস্তানে আরেকটি ঘটনা ঘটল। তখন তার এবং আমারও আত্মীয় এক মাওলানা ছাহেবের ওখানে ভিন্ন ভিন্নভাবে আমরা গিয়ে উঠলাম। উভয়েই হজ্জে যাব। তিনি আমাকে তখন চিনতেন। সেখানে আমাদের যাত্রা বিরতি ঘটেছে। সেখানে থাকা অবস্থায় মেযবান মাওলানা ছাহেবের মাধ্যমে আঁচ করতে পারলাম, হুজুর কোন কারণে আমার ব্যাপারে অপ্রসন্ন। তাঁর সঙ্গে সফরসঙ্গী কয়েকজন ছিলেন, যাদের কেউ হয়ত সরলপ্রাণ হুজুরের কান ভারী করে থাকবেন। বিষয়টি আমাকে অস্থির করল না। এরই মধ্যে একদিন কোন এক নামাযের পর উক্ত মাওলানা ছাহেবের মসজিদের হুজরায় ঢুকেছি। সঙ্গে আরো বেশ কয়েকজন। বলা যেতে পারে ছোট-খাটো একটি মজমা। এ রকম সময়েই হযরত হাফেজ্জী এলেন এবং সরাসরি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘মাওলানা! এদিক সেদিকের কথা শুনে আপনার সম্পর্কে আমার যবান থেকে কিছু গীবত হয়ে গেছে।” (সূত্র: হাফেজ্জী স্মারক গ্রন্থ পৃ: ৩৯৩)
আরো উল্লেখ্য যে, হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে যে, কৌতুক করেও মিথ্যা বলতে নেই। কিন্তু হাফেজ্জী সে কৌতুক করে মিথ্যাও বলেছে তার সাক্ষ্য তার ছেলে হামীদুল্লাহই বলেছে। সে তার স্মৃতিচারণে বলেছে,
“এরপর মসজিদে এক সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কোন দিন ফজরের পূর্বে রাস্তায় চলতে থাকা অবস্থায় আমার ভিতরে ঘুমের ভাব দেখলে ঘুমের ভাব দূর করার জন্য রসিকতা করে আমার ঘাড়ে আস্তে করে একটা-দুটো চিমটি দিয়ে বলতেন- পিঁপড়া কামড় দিল নাকি?” (সূত্র: হাফেজ্জী স্মারক গ্রন্থ পৃ: নং- ৫৫৬)
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নিজে চিমটি কেটে মুখে পিঁপড়া কামড় দিল নাকি বলা স্পষ্টতঃ মিথ্যার শামিল।
উল্লেখ্য, হাফেজ্জীর কার্যকাল শুধু বিগত শতকের। পক্ষান্তরে ফেরেশ্তা ও মানব-সন্তানের জন্য হযরত জিবরীল আলাইহিস্ সালাম-এর অবদান মানব-সৃষ্টির লক্ষ লক্ষ বছর আগ থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত। কাজেই সে মহিমান্বিত হযরত জিবরীল আলাইহিস্ সালামকে শত্রু বলা আর হাফেজ্জীকে যুদ্ধাপরাধী বলা সমান কথা বলে তথাকথিত ভারপ্রাপ্ত খতীব যে কুফরী করে বায়তুল মুকাররমে বয়ান রাখার ও জুমুয়ার নামায পড়ানোর অধিকার হারিয়েছেন তা ঈমান রক্ষার তাগিদেই মুছল্লীদেরকে সমবেতভাবে বলতে হবে। এ কাযযাব খতীবকে হঠাতে হবে।
(গ)
মানুষ তার সঙ্গীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে- একথা হাফেজ্জী সাহেবও তার হায়াতকালে বহু বলেছেন। সে আঙ্গিকে হাফেজ্জী ছাহেব রাজাকার ঘরানার লোক ছিলেন কিনা? তার সঙ্গী সাথীদের ইতিহাস নির্ণয়েই তা প্রমাণিত ও প্রতিভাত হয়।
বিশেষ করে কিশোরগঞ্জের কুখ্যাত রাজাকার প্রায় তিন হাজার লোকের খুনি আতাহার আলীর সাথে হাফেজ্জীর সম্পৃক্ততা ও সখ্যতা এক্ষেত্রে উল্লেখ্য।
আর হাফেজ্জীর সাথে আতাহার আলীর যোগসাজশের প্রমাণ রয়েছে তাদের ঘরানার বহুজনের জবানীতে, লিখনীতে।
এমনকি এ ব্যাপারে খোদ আতাহার আলীর পুত্র আনোয়ার শাহ লিখেন, “আমার আব্বাজান হযরত মাওলানা আতাহার আলী (রহঃ) এবং হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ) ছিলেন পীর ভাই। উভয়েই ছিলেন হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী (রহঃ) এর মুরীদ ও খলীফা।
তাদের পরস্পরের মাঝে সম্পর্কও ছিল অত্যন্ত গভীর ও আকর্ষণীয়। অতি আপন মানুষের মত তারা পরস্পরের প্রতি ইহতেরাম পোষণ করতেন। আব্বাজান যে আসনে বা যে বিছানায় বসতেন আদব ও ইহতেরাম বশতঃ তিনি সেখানে বসা থেকে বিরত থাকতেন। অপরদিকে তার ত্বাকওয়া ও বুযুগীর্র প্রতি আব্বাজান (রহঃ) থাকতেন শ্রদ্ধাশীল।” (সূত্র- হাফেজ্জীর স্মারক গ্রন্থ, পৃ: ৩৯৬)
সুতরাং প্রশ্ন দাঁড়ায়, আতাহার আলী যদি কুখ্যাত রাজাকার হতে পারে তাহলে হাফেজ্জী কি করে তা থেকে বাদ হতে পারে?
(ঘ)
মূলতঃ বাংলাদেশে প্রায় পুরো দেওবন্দী গ্রুপই ছিল রাজাকার ঘরানার লোক। আর হাফেজ্জী ও আতাহার আলী ছিল তাদের মুরব্বী। আতাহার আলীর পার্টিগত কাজেও যে হাফেজ্জীর যোগসাজশ ছিল সে ব্যাপারে সাবেক খতীব উবায়দুল হক লিখেন, “বিশেষভাবে হযরত মাওলানা আতহার আলী (রহঃ) যখন নেযামে ইসলামের আন্দোলন নিয়ে পরামর্শ সভা ডাকতেন তখন এইসব মজলিস ও মাহফিল সাধারণত লালবাগ মাদরাসার অফিসে অনুষ্ঠিত হত। এই সব মজলিসে কোন কোন সময় হাফেজ্জী হুজুরও উপস্থিত হতেন। কিন্তু কখনো কোন কথা বলতে আমি তাঁকে দেখিনি। মাথা নত করে নীরবে আল্লাহর যিকিরে রত থাকতেন এবং অন্যান্য মুরব্বীগণ রাজনৈতিক ব্যাপারে যে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন তাতে আন্তরিক সমর্থন জ্ঞাপন করতেন।” ….
তখন কেউ কেউ হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ) এর কাছে অভিযোগ করে বলেন যে, “আপনি এতদিন রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন, এখন হঠাৎ করে রাজনীতির মাঠে কেন পদার্পন করলেন?”
তিনি তার উত্তরে বলেন, আমি যাদেরকে আমার মুরব্বী হিসেবে গণ্য করতাম তাঁরা মাঠে ময়দানে ইসলামী রাজনীতি নিয়ে সক্রিয় ছিলেন। আমি সর্বদা তাদের মৌন সমর্থন করে এসেছি। সক্রিয় পদক্ষেপের কোন প্রয়োজন মনে করিনি। এখন যেহেতু তারা দুনিয়া থেকে চলে গেছেন তখন আমি আর নীরব থাকতে পারি না। (সূত্র: হাফেজ্জীর স্মারক গ্রন্থ পৃ: ২৯৫)
বলার অপেক্ষা রাখে না, হাফেজ্জী যাদের মুরব্বী মেনে ছিলো তাদের মধ্যে মুখ্য ছিলো কুখ্যাত রাজাকার আতাহার আলী।
(ঙ)
এদিকে হাফেজ্জী রাজনীতিতে নামার পর তাকে পাকিস্তানি জুলুম, হত্যা, ব্যভিচার, লুটতরাজ ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে যা জবাব দেয় তাতেও তার গভীর রাজাকার মানসিকতা প্রতিপন্ন হয়। এ বিষয়ে মাও. সাইয়েদ আহমদ লিখেন, আরেকবার এক সাংবাদিক পাকিস্তানিদের জুলুম-অত্যাচার এবং এদের লুণ্ঠিত সম্পদের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি জবাব দিলেন, “পাকিস্তানি ভায়েরা আমাদের অনেক হক্ব খেয়েছে। যেদিন আমাদের বেশি জরুরত হবে সেদিন অবশ্যই আমরা সেগুলো পাবো।” (সূত্র: হাফেজ্জী স্মারক গ্রন্থ, ৩০৪ পৃষ্ঠা)
উল্লেখ্য, রাঁধুনীর জন্য ভাত একটা টিপলেই যেমন যথেষ্ট তেমনি পাকিস্তানিদের পক্ষে হাফেজ্জীর এমন নমনীয় ও শোভনীয় উত্তরই তার রাজাকার মানসিকতা অনুধাবনের জন্য যথেষ্ট।
লক্ষণীয়, হাফেজ্জী তার জবাবে ‘জালিম পাকিস্তানি’ বলে উল্লেখ করেনি। বরং ‘পাকিস্তানী ভাই’ বলে উল্লেখ করেছে। তার মনে তার ’৭১ এর দরদবোধ সে সময়ও তার ভেতরে কাজ করেছে।
তদুপরি হাফেজ্জীর বক্তব্যে প্রতিভাত হয় যে, জালিম পাকিস্তানিরা এদেশে যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, লুটতরাজ করেছে, মা-বোন-মেয়ের ইজ্জত লুটে নিয়েছে তা হলো এদেশে পাকিস্তানিদের হক্ব। (নাঊযুবিল্লাহ)
আর সেগুলো তেমন কিছু নয়। তাই হাফেজ্জী বলেছে যেদিন বেশি জরুরত হবে সেদিন অবশ্যই আমরা সেগুলো পাব।
তাহলে কি হাফেজ্জীর সাথে তখনও পাকিস্তানিদের গভীর ও নিবিড় যোগাযোগ ছিল? তা না হলে কি করে তিনি ফিরে পাওয়ার আশ্বাস দেন। আর ৩০ লাখ বাংলাদেশী শহীদ, প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ লাখ মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট, হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুণ্ঠন- এগুলোর প্রতিকারকে তিনি বেশি জরুরত মনে করেন না। তাহলে আরো কত লক্ষ বাংলাদেশীকে হত্যা করলে, আরো কত লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করলে আরো কত লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ লুণ্ঠন করলে হাফেজ্জী বেশি জরুরত মনে করতেন?
মূলতঃ হাফেজ্জীর দেয়া এ সাক্ষাতকারই প্রমাণ করে যে, সে আসলে শুধু সাধারণ যুদ্ধাপরাধীই নয় বরং দেওবন্দী যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক তথা মহা যুদ্ধাপরাধী। (নাঊযুবিল্লাহ)
– মুহম্মদ ওয়ালীউর রহমান
রাজাকারদের গডফাদার গোআযমের চুরি করা তত্ত্বাবধায়ক সরকার তত্ত্ব ও মইত্যা রাজাকারের গ্রেফতার প্রসঙ্গঃ