গত ২৮শে মাহে যিলহজ্জ/১৪৩০, ২রা পৌষ/১৪১৬ বাংলা, বুধবার ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস পালিত হয়েছে।
৫৬ হাজার বর্গমাইল এদেশের আকাশে ৩৮ বছর পূর্বের এদিনটিতে প্রথম উঠেছিলো এক স্বাধীন, সমুজ্জ্বল, অত্যুজ্জ্বল অন্যরকম সূর্য।
১৯৭১-এর এদিনে যে সূর্যের উদয় হয়েছিলো তা ছিলো বাঙালির বিজয়ের সূর্য।
এদিন তাই এ ভূখণ্ডের বাঙালি জনগোষ্ঠীর হাজার বছরের ইতিহাসের মহান গৌরবময় দিন।
পঁচিশে মার্চ কালো রাত্রিতে শুরু হওয়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যাযজ্ঞ আর নৃশংসতার দীর্ঘ নয়টি মাসে রক্তস্নাত পথে পাড়ি দিয়ে ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর চার পাঁচ লাখ ধর্ষিতা মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিলো অমূল্য এই স্বাধীনতা।
১৯৭১ সালের এই দিনেই আজকের পৌষেরই এক পড়ন্ত বিকেলে স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিলো বীর বাঙালি। ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রস্তুত হয়েছিলো মঞ্চ। পাশের ঢাকা ক্লাব থেকে তাৎক্ষণিকভাবে আনা হয়েছিলো একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার। পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক জোন-বি এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বে ৯১ হাজার ৫৪৯ জন হানাদার সেনা ভারতীয় মিত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জ্যাকবের তৈরি করা আত্মসমর্পণ দলীলে বিকেল চারটা ৩১ মিনিটে সই করে।
১৯৭১ সালের এই দিনে অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তান বাহিনী দালিলিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এই দিন থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অনক রক্ত, অনেক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
তাই আনন্দ উৎসব এবং শোক-শ্রদ্ধার এক অভূতপূর্ব সম্মিলনে দেশের সর্বত্রই সেদিন পালিত হয়েছে ৩৯তম বিজয় দিবস, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৩৮তম বার্ষিকী।
তবে আনন্দঘন এই দিনেও শহীদ পরিবারের সদস্যদের বুকের ভেতর থামেনি রক্তক্ষরণ। স্বজন হত্যার বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে আজ তারা অনেকটাই ক্লান্ত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি। গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি পাকিস্তান। বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন দেশে এখনো অবহেলিত, অপমানিত। অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীরা প্রকাশ্যে রাজনীতি করে, মন্ত্রী হয়। গেল নির্বাচনেও মনোনয়ন পেয়েছিলো ২৫ যুদ্ধাপরাধী।
বলাবাহুল্য, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যে গোষ্ঠী নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিলো তাদের যথোপযুক্ত বিচার না হওয়ার কারণে আমাদের সামজিক জীবনে ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের এই দিনে এক রাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিলো। সাড়ে তিন দশকেরও অধিক সময় পাড়ি দেয়ার পর এর কতটা পূরণ হয়েছে আজ সেই হিসাব নেয়ার দিন।
আজ আমাদের অনুভবে অন্তরের অন্তঃস্থিত প্রগাঢ় প্রশ্নের জোরদার বহিঃপ্রকাশ দরকার যে, আমাদের রক্তের, গর্বের মাতৃভূমি-
* কেন এখনো বিশ্বের অনুন্নতশীল দেশের সারিতে?
* কেন অমিত সম্ভাবনার দেশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পরও দেশের অন্তত এক-চতুর্থাংশ মানুষের দিনে দু’বেলা পেট ভরে খাওয়া জোটে না?
* কেন হাজার হাজার কোটি টাকার সাহায্যের পরও সিডরে, আইলা ক্ষতিগ্রস্তদের এখনো ঘরবাড়ি হয় হলো না?
* কেন খোদ রাজধানীর ফুটপাতে শুয়ে থাকে লাখ লাখ লোক।
* কেন কেবল রাজধানীতেই ৬০ লাখ লাঞ্ছিত বস্তিবাসীর বাস?
* কেন স্বাধীনতা উত্তর ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ তকমার পর আজও
চাল সিন্ডিকেট
তেল সিন্ডিকেট
চিনি সিন্ডিকেট
বহাল তবিয়তে থাকে?
* কেন এদেশে জামাত-জোট হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করতে পারে?
* কীভাবে স্বাধীন দেশে রাজাকাররা মন্ত্রীর পতাকা গাড়িতে উড়িয়ে ঘুরতে পারে?
* কেন বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে বিবৃত ‘দেশকে স্বাধীন করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’ বলার পরও ‘মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি ও চেতনা ছিলো ইসলাম’ সে কথা প্রতিফলিত হয় না?
* কেন আজ ইসলামের নামে ঘৃণিত রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের কেনার হাট বসাতে পারে?
* কেন আজ রাজাকার জামাতীরা মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের বৃত্তি প্রদানসহ বিভিন্ন প্রলোভনে প্ররোচিত করতে পারে?
প্রসঙ্গত আদালতের রায়ে মৃত্যুদ- কিংবা যাবজ্জীবন প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা মারা যাওয়ার পর রাষ্ট্রীয় সম্মান পাবে না। এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ১৪ ডিসেম্বর ২০০৯ ঈসায়ী তারিখে একটি আদেশ জারি করেছে। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চার খুনি তাদের বিরুদ্ধে দেয়া আদালতের রায় কার্যকর হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় সম্মান পাবে না।
তবে আমরা মনে করি শুধু এতটুকুতেই যথেষ্ট নয়। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজাকাররা স্বাধীনতার বিরোধিতা করে স্বাধীনতার কোনো সুফল পেতে পারে না।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা সংশ্লিষ্ট কোন সমাবেশই কেবল নয় বরং কোনো ধরনের কোনো সমাবেশের অনুমোদন তারা পেতে পারে না।
পাশাপাশি আমরা বলব ইসলামের আঙ্গিকেই স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারদের সমাধান হওয়া দরকার। হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, “পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে যে কেউ একটা বদ কাজ করলো পশ্চিম প্রাপ্ত থেকে যে কেউ তা সমর্থন করলো তার সমান গুনাহ তার হবে।”
আমরা তাই শুধু কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সন্তুষ্ট নই।
পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থনকারী সব রাজাকার তথা গোটা জামাতে মওদুদী এবং তাদের আদর্শে বিশ্বাসী ও সমর্থনকারী সব শিবির কর্মী এবং তাবৎ ধর্মব্যবসায়ীদেরও যথাযোগ্য বিচার চাই।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, আমেরিকার মত একটি খ্রিস্টান দেশ থেকে যদি তাদের রাজাকারদের উৎখাত করা হতে পারে তবে তা ৯৫ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশে তা হতে পারবে না কেন?
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৭৮২ সালে যেসব আমেরিকাবাসী ব্রিটেনের পক্ষ নিয়েছিলো স্বাধীনতার পর তাদের প্রত্যেককে আমেরিকা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো।
আমাদের দেশের রাজাকারদের মত ওদেরকে বলা হত ‘লয়েলিস্ট’। আমেরিকায় যদি কোন ‘লয়েলিস্ট’ না থাকতে পারে তবে আমাদের দেশে ইসলামের দৃষ্টিতে কোন মতেই কোন রাজাকার থাকতে পারে না।
সঙ্গতকারণেই আমরা স্পষ্ট ও বুলন্দ আওয়াজ এবং তীব্র উচ্চারণ করছি, ‘রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ চাই; ইসলামে রাজাকারের ঠাঁই নেই।’
-মুহম্মদ আশরাফুল মাহবুবে রব্বানী
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০