মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিন্তু ওই প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াবহ মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর দৃষ্টিপাত করা হয় না। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে খুন, সম্ভ্রমহরণসহ এ ধরনের অপরাধ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। কিন্তু মার্কিন কর্মকর্তাদের চোখে এসব ঘটনা যেন কোনো অপরাধই নয়।
২০১০ সালের ৫ই নভেম্বরের কথা। ওই দিন আমেরিকা প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে নিজের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্ট পেশ করে। এরপর কাউন্সিলে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয়। মানবাধিকার কাউন্সিলের ওই বৈঠকে উপস্থিত মার্কিন প্রতিনিধিরা নিজ দেশের বাইরে ও ভেতরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার পক্ষ থেকে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। এতদিন যে আমেরিকা বিশ্বের স্বাধীনচেতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দেশগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনা করতো, সেই আমেরিকাই সেদিন ওই বৈঠকে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে। স্বাধীনচেতা দেশগুলোর প্রতিনিধিরা এক এক করে আমেরিকার অপকর্মগুলো তুলে ধরতে শুরু করে।
আমেরিকা শুরু থেকেই জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের অস্তিত্বের বিরোধিতা করে এসেছে। ২০০৬ সালের মার্চে কাউন্সিলটি গঠনের সময় আমেরিকা এর বিপক্ষে ভোট দেয়। তবে আমেরিকাও শেষ পর্যন্ত ওই কাউন্সিলকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে এবং এরই ধারাবাহিকতায় এবার নিজের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্ট পেশ করেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের রিপোর্টও ওই বৈঠকে পেশ করা হয়। ওই রিপোর্টে আমেরিকার মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বের সরকারি-বেসরকারি ১০৩টি প্রতিষ্ঠানের মতামত ও সমালোচনা তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৭টিই মার্কিন প্রতিষ্ঠান। এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, আমেরিকার অভ্যন্তরও ব্যাপক মাত্রায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ কারণে এনজিওগুলো এসব ঘটনা ফাঁস করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে অভিযোগ করেছে। জাতিসংঘের নির্যাতন বিষয়ক বিশেষ দূত ম্যানফ্রেড নোয়াকের প্রতিবেদনেও বন্দিদের উপর নির্যাতন, পুলিশের সহিংস আচরণ, জাতিগত বৈষম্য এবং সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলমানদের অধিকার হরণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৫ই নভেম্বরের (২০১০ সালের) বৈঠকে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও সমালোচনা করে। ইরানের প্রতিনিধি দলের প্রধান মিসেস জাহরা এলাহিয়ান বলেন, আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ানদের অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। তিনি আদিবাসীদের বিষয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাব পুরোপুরি বাস্তবায়নের দাবি জানান। আজ যে ভূখ-টি আমেরিকা নামে পরিচিত তার মূল মালিক হচ্ছে রেড ইন্ডিয়ানরা। কিন্তু রেড ইন্ডিয়ানরা আজ নিজ দেশেই পরবাসীর মতো বাস করছে। সহিংসতাসহ নানা বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা মাত্র কয়েক লাখে নেমে এসেছে। এছাড়া আমেরিকার আরেকটি সংখ্যালঘু শ্রেণী হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ। বাহ্যত দাস প্রথাসহ বর্ণবাদী আইন বাতিল করা হলেও কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা থামেনি। কৃষ্ণাঙ্গদের গড় আয় শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে অন্তত দশগুণ কম এবং কারাগারগুলোতে কৃষ্ণাঙ্গ বন্দির সংখ্যাও শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
বিশ্বের অনেক দেশেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমেরিকা নিজ দেশের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। গোপন বন্দিশিবির নির্মাণ ইস্যু নিয়েও মানবাধিকার কাউন্সিলের বৈঠকে ব্যাপক কথা হয়েছে। কারণ এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কেবল আমেরিকাই ঘটাচ্ছে। জেনেভায় জাতিসংঘ দপ্তরে নিযুক্ত রুশ প্রতিনিধি এ বিষয়ে বলেছে, গোপন কারাগারগুলোসহ বাগরাম ও গুয়ান্তানামো কারাগারে বন্দি নির্যাতনের বিষয়ে আমেরিকা গ্রহণযোগ্য ও সঠিক তদন্ত চালাবে বলে রাশিয়া আশা করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ গুয়ান্তানামো বন্দিশিবির পুরোপুরি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ওই বন্দিশিবির গুটিয়ে ফেলা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে। মার্কিন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে বন্দি নির্যাতনের অসংখ্য ছবি ও ভিডিও এখনও ইন্টারনেটে রয়েছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন মাধ্যমে তা প্রকাশিত হবার পর আমেরিকার মানবাধিকারের রক্ষক হবার দাবির অসারতা এখন সবার কাছেই স্পষ্ট। এরপরও আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন বিষয়ক উপদেষ্টা হ্যারল্ড কুহ নির্লজ্জের মতো দাবি করে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র কারো উপর নির্যাতন চালায়নি এবং কারো উপর নির্যাতন চালাবেও না।
এ অবস্থায় জাতিসংঘের নির্যাতন বিষয়ক বিশেষ দূত ম্যানফ্রেড নোয়াক, অনুসন্ধানী ওয়েব সাইট উইকিলিকসের তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে ওয়াশিংটনকে বন্দি নির্যাতনের বিষয়ে তদন্ত করার এবং এ বিষয়ে প্রতিবেদন পেশ করার আহ্বান জানিয়েছে। উইকিলিকস তথ্য-প্রমাণ উল্লেখ করে বলেছে, ২০০৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইরাকে প্রায় দুই লাখ ৮৫ হাজার ইরাকি নিহত হয়েছে এবং এর মধ্যে ৬৩ শতাংশই হলো বেসামরিক। ওয়েবসাইটটি ইরাকি বন্দিদের ওপর নির্যাতনের কিছু বিবরণও তুলে ধরেছে।
আমেরিকা প্রতি বছর অন্যান্য দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে। বিভিন্ন দেশে ফাঁসির ঘটনাগুলোকেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরে আমেরিকা। কিন্তু খোদ আমেরিকাতেও ফাঁসি দেয়া হয় এবং সম্প্রতি মানসিক প্রতিবন্ধি এক মহিলাকেও ফাঁসি দেয়া হয়েছে। এ কারণে মানবাধিকার কাউন্সিলের বৈঠকে বক্তারা শিশু অধিকার, নারী অধিকার ও শরণার্থী অধিকার কনভেনশন মেনে চলতে এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সদস্য হতে আমেরিকার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিচারের সম্মুখীন হতে পারে এই ভয়ে আমেরিকা আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতেরও সদস্য হয়নি।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের নানা অপরাধের ঘটনা বিশ্লেষণের পর সবার কাছে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, আমেরিকা অন্যান্য দেশের বিষয়ে যে মানবাধিকার রিপোর্ট পেশ করে তা এক ধরনের রাজনৈতিক কৌতুক ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে বেশি রেকর্ডের অধিকারী দেশ আমেরিকা। ফলে অন্যের মানবাধিকার ইস্যুতে কথা বলার কেনো অধিকার তার নেই।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিক দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনও কোনো অংশে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে পিছিয়ে নেই। ব্রিটেনের পারিবারিক সহিংসতার উপর গবেষণাকারী একজন সমাজবিজ্ঞানী বলেছে, দেশটির অসংখ্য নারী তাদের স্বামীদের হাতে নির্যাতিত হলেও সে খবর কেউ রাখছে না। অনেক অভিবাসী নারী তাদের উপর নির্যাতনের খবর ঘুনাক্ষরেও প্রকাশ করে না, কারণ তাতে করে তাদেরকে ব্রিটেন থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে। ব্রিটেনে যে শুধু অভিবাসী ও অব্রিটিশ নারীরা সম্ভ্রমহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয় তা নয়। এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ৪ ব্রিটিশ নারীর একজন তার পুরুষ সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ব্রিটেনে প্রতি সপ্তাহে ২ জন নারী খুন হচ্ছে এবং শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে খুনের সময় হতভাগ্য নারীর শিশুসন্তান খুনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে। ইংল্যান্ডের লাইচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ৫ ব্রিটিশ নারীর একজন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে সম্ভ্রমহানির শিকার হয়েছে। (ইনশাআল্লাহ চলবে)
-মুহম্মদ জিসান আরীফ
প্রসঙ্গঃ আমেরিকায় ইহুদী প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ- ২
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩৪
চাঁদ দেখা এবং নতুন চন্দ্রতারিখ শুরু নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা- ১