ورفعنا لك ذكرك.
অর্থ: আল্লাহ পাক বলেন, হে হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি আপনার সুমহান মর্যাদাকে সুউচ্চ করেছি। (সূরা ইনশিরাহ- ৪)
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নূরানী শরীর মুবারক-এর সকল মু’জিযাসমূহ সেই বরকতময় সুউচ্চ মর্যাদারই বহিঃপ্রকাশ।
হযরত ইমাম আবু নঈম রহমতুল্লাহি আলাইহি উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হতে বর্ণনা করেন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নূরানী চেহারা মুবারকের উপর নির্গত স্বেতবিন্দু মুবারক মোতির দানার মতো চকচেকে করতো। আর তাঁর খুশবু মেশকের চেয়েও বেশি ছিল।
নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিস্ময়কর মু’জিযা বা মুবারক গুণাবলীর মধ্যে দেহ মুবারক থেকে নির্গত পবিত্র সুরভি মুবারক ছিল অন্যতম। এমন বরকতময় গুণটি তাঁর সত্তাগত ছিলো। তিনি দেহ মুবারকে কোনরূপ সুগন্ধি ব্যবহার না করলেও দেহ মুবারক থেকে যে বরকতময় সুঘ্রাণ বের হতো, পৃথিবীর কোন সুঘ্রাণ তার সমতুল্য হতে পারে না।
সাইয়্যিদুনা হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, যত প্রকারের সুঘ্রাণ আছে চাই তা মেশক হোক বা আম্বর, আমি তার ঘ্রাণ গ্রহণ করেছি। কিন্তু নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্রতম দেহ মুবারকের সৌরভের সমতুল্য কিছুই হতে পারে না।
হযরত উতবা ইবনে ফারকাজ সালমী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর আহলিয়া হযরত উম্মে আসেম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বর্ণনা করেন, আমরা চার মহিলা হযরত উতবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর আহলিয়া ছিলাম। আর আমরা চার জন প্রত্যেকেই চেষ্টা করতাম কে কার চেয়ে বেশি খুশবু ব্যবহার করে হযরত উতবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিকটে যেতে পারি। এমন প্রয়াসে আমরা প্রত্যেকেই খুশবু খুব বেশি ব্যবহার করতাম। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার যে, আমাদের সকলের খুশবুই হযরত উতবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর দেহ মুবারকের খুশবুর কাছে ম্লান হয়ে যেতো।
আর হযরত উতবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর খুশবু ব্যবহারের অভ্যাস এরকম ছিলো যে, তিনি হাতে স্বাভাবিকভাবে একটু তেল মালিশ করে দাড়িতে মেখে নিতেন এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু তবুও দেখা যেত, তাঁর খুশবুই আমাদের সকলের খুশবুর উপর প্রবল হয়ে গেছে। এদিকে হযরত উতবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন বাইরে যেতেন, তখন লোকেরা বলাবলি করতো, আমরাও তো সুগন্ধি ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু হযরত উতবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর সুগন্ধির তুলনায় আমাদের খুশবু তেমন তেজস্কর নয়।
হযরত উম্মে আসেম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন, আমি একদিন আমার স্বামী হযরত উতবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে বললাম, আমরাতো সকলেই সুগন্ধি ব্যবহার করে তার সুঘ্রাণ ছড়াতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি, কিন্তু আমাদের খুশবু তো আপনার সুবাসের ধারে-কাছেও পৌঁছাতে পারে না। এর কারণ কি? তখন তিনি বললেন, নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবদ্দশায় অত্যধিক গরমের কারণে আমার সমস্ত শরীরে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল। (এর কারণে মনে হতো সমস্ত শরীরে যেন আগুন লেগে গেছে) এতে অস্থির হয়ে আমি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমতে হাজির হয়ে আমার অসুস্থতার অবস্থা বর্ণনা করলাম। তখন তিনি এর চিকিৎসা করে দিলেন। বললেন, “তোমার শরীরের কাপড় খুলে ফেলো।” আমি কাপড় খুলে তাঁর সামনে বসে গেলাম। নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় হস্ত মুবারক আমার গায়ের উপর বুলিয়ে দিলেন। পেট ও পিঠেও হাত বুলিয়ে দিলেন। সে সময় থেকেই আমার শরীরে এ সুগন্ধির সৃষ্টি। এই ঘটনা ইমাম তবারানী মুজা’ম নামক কিতাবে বর্ণনা করেছেন।
এক ছাহাবী তাঁর কন্যাকে বিয়ে দিয়ে স্বামীর ঘরে পাঠানোর সময় সুগন্ধি খোঁজাখুজি করছিলেন। কিন্তু কোনখানে যোগাড় করতে পারছিলেন না। অবশেষে ঐ ছাহাবী আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমতে হাজির হয়ে সমস্যার কথা বর্ণনা করলেন। তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে খুশবুর ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট তখন কোন খুশবু ছিলো না।
তিনি ঐ ছাহাবীকে বললেন, “একটি শিশি নিয়ে এসো।” লোকটি শিশি নিয়ে এলে তিনি নিজের শরীর মুবারক থেকে নির্গত ঘাম মুবারক দিয়ে শিশি ভরে দিয়ে বললেন, এই ঘাম মুবারক তোমার মেয়ের গায়ে মেখে দিও। ঐ শিশি থেকে নূরে মুজাস্্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম-এর পবিত্র ঘাম মুবারক নিয়ে যখন কন্যাটির গায়ে মেখে দেয়া হলো, তখন সমস্ত মদীনা মুনাওওয়ারা তার সুরভিতে সুরভিত হয়ে গেল। এর পর থেকে সে বাড়িটির নাম রাখা হয়েছিল ‘বাইতুল মুতিযীন’ বা আতর ভবন।
হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় গৃহের কুপে থুথু মুবারক ফেললেন। ফলে মদীনা শরীফে উক্ত কুপ মুবারকের পানির চেয়ে মিঠা অন্য কোন কুপের পানি ছিলনা। সুবহানাল্লাহ! (খাছায়িসুল কুবরা)
হযরত ওমায়রা বিনতে মাসউদ ও তাঁর ভগিনীগণ রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে বাইয়াত গ্রহণের জন্য আগমন করলেন। তাঁরা ছিলেন পাঁচজন। তাঁরা দেখলেন যে, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোশ্ত আহার করছেন। তিনি তাঁদের জন্যে গোশ্ত চিবিয়ে দিলেন, যা সকলেই অল্প অল্প করে খেলেন। এর উছীলায় তাদের সকলের মুখ থেকে ইন্তিকাল পর্যন্ত কোন দুর্গন্ধ বের হয়নি। সুবহানাল্লাহ! (তবারানী শরীফ, খাছায়িসুল কুবরা)
হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, একবার আমরা নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে ছফরে বের হলাম। পথিমধ্যে হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা-এর কান্নার আওয়াজ শুনা গেল। তাঁরা তাঁদের জননীর সঙ্গে ছিলেন। নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্রুত তাঁদের কাছে গেলেন এবং বললেন, কি হয়েছে! হযরত ফাতিমাতুয যাহরা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা বললেন, তাঁরা পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েছে। নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পানি আনতে বললেন, কিন্তু এক ফোটা পানিও পাওয়া গেল না। তিনি হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাকে বললেন, তাঁদের একজনকে আমার কাছে দিন। তিনি পর্দার পিছনে একজনকে দিয়ে দিলেন। নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, তখনো শিশুর কান্না বন্ধ হয়নি। এরপর নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় জিহ্বা মুবারক শিশুর মুখ মুবারকে দিয়ে দিলেন। শিশু চুষতে চুষতে কান্না থেমে গেল । দ্বিতীয় শিশুটিও একই অবস্থায় জিহ্বা মুবারক চুষতে চুষতে কান্না থেমে গেল অর্থাৎ কান্নার আওয়াজ আর শোনা গেল না। সুবহানাল্লাহ! (তবারানী শরীফ, খাছায়িসুল কুবরা)
হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের গৃহে আগমন করলেন এবং “কায়লুলা” করলেন। তাঁর শরীর মুবারক থেকে ঘাম মুবারক প্রবাহিত হতে লাগল। আমার জননী শিশি (ছোট বোতল) নিয়ে এলেন এবং ঘাম মুবারক মুছে তাতে ভরতে লাগলেন। নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চোখ মুবারক খুলে গেল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, হে উম্মে সুলাইম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা! কি করছেন? তিনি বললেন, এ মুবারক ঘাম সুগন্ধিরূপে আমরা ব্যবহার করি। কেননা, এটা অত্যন্ত সগন্ধি। সুবহনাল্লাহ!। (তবারানী শরীফ, খাছায়িসুল কুবরা)
হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বর্ণনা করেন, আমি সুতা কাটছিলাম এবং নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম না’লাইন (সেন্ডেল) মুবারক সেলাই করছিলেন। এমন সময় তাঁর কপাল মুবারক থেকে ঘাম মুবারক বের হতে লাগল। এ ঘাম মুবারক থেকে নূর বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। এতে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কি কারণে আশ্চর্য হয়ে গেলেন? আমি বললাম, আপনার কপাল মুবারকে ঘাম মুবারক থেকে নূর বিচ্ছুরিত হচ্ছে (এ কারণে আমি এরকম হয়েছি)। যদি কবি আবূ কবীর হুযালী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আপনাকে দেখতেন, তবে জানতে পারতেন যে, তাঁর সৌন্দর্য বর্ণনামূলক সব কবিতার প্রতীক স্বয়ং আপনিই। (নিম্নের ছন্দটি পাঠ করলেন) “যখন তুমি তাঁর (নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর) চেহারা মুবারকের অনুপম সৌন্দর্য্য অবলোকন করবে, তখন এমন উজ্জ্বল ও দেদীপ্যমান মনে হবে, যেমন ঘন-কালো মেঘমালার মধ্যে বিদ্যুৎ চমক।”
এই কবিতা শুনে নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত মুবারকে যা ছিল, রেখে দিলেন এবং আমার কপাল মুবারকে চুম্বন করে বললেন, হে আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা! আল্লাহ পাক (আপনাকে) উত্তম প্রতিদান দিন, আমার মনে পড়ে না যে, আমি কখনও এতটুকু আনন্দিত হয়েছি, যতটুকু আপনার কবিতা শুনে হয়েছি। সুবহানাল্লাহ! (খাছায়িসুল কুবরা)।
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে সাইয়্যিদুল মুরসালীন,ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম-এর ঘাম মুবারক এবং থুথু মুবারক সম্পর্কে সঠিক আক্বীদা এবং যথপোযুক্ত মর্যাদা প্রদান করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
হাফিযুল হাদীছ মাওলানা মুফতী মুহম্মদ ফযলুল হক্ব