সম্মানিত মাহে রমাদ্বান শরীফ ও পবিত্র ঈদ উপলক্ষে এখন রাজধানীতে বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষের আনাগোনা অনেক বেশি। এতে যানজট বাড়ছে আরো মারাত্মকভাবে। কিন্তু যানজট নিরসনে সরকারের সমন্বিত কোনো পদক্ষেপই নেই। যেন হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যায় করে কিছু ফ্লাইওভার নির্মাণ করেই সরকারের আত্মতৃপ্তি। অথচ এই ফ্লাইওভার এখন গলার কাটা।
ফ্লাইওভার যাত্রাবাড়ীর বিষফোঁড়া। রাজধানীর যানজট হ্রাসের বিশেষ অনুষঙ্গ হিসেবে নির্মিত এ ফ্লাইওভারের নিচের সড়ক সংস্কার না হওয়ায় অসহনীয় ধুলাবালি এ এলাকার বাসিন্দাকে ফেলেছে মহাসঙ্কটে। এছাড়া কমেনি যানজটও। এলাকার অন্যান্য সমস্যার মধ্যে রয়েছে এলোমেলো ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, যানজট, প্রধান সড়কের উপর পণ্য বেচাকেনা ও যেখানে সেখানে হোটেলের উচ্ছিষ্ট ও আবর্জনা। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের আসা-যাওয়ার অনিয়ম তো রয়েছেই, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী ও বিভিন্ন পথচারী।
বকশি বাজারের সামনে থেকে ফ্লাইওভারে উঠে নিমেষেই পেরিয়ে যাওয়া যায় যাত্রাবাড়ি। রাজধানীতে জ্যাম লেগে থাকা প্রধান মোড়গুলো পেরিয়ে মনে হয় যে, খুব দ্রুতই এগিয়ে গেলাম। কিন্তু ফ্লাইওভার ছেড়ে যেই না ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নামে গাড়ি, তখনই আবারো সেই জ্যাম।
শুধু ফ্লাইওভার থেকে নেমে আসার পথেই নয়, রাজধানীতে প্রবেশের আগে ফ্লাইওভারে উঠতে গিয়েও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় যাত্রীদের। এছাড়া যেসব যানবাহন ফ্লাইওভারে না উঠে নিচ দিয়ে সায়েদাবাদের দিকে যেতে চায় এসব গাড়ির অনিয়ন্ত্রিত চলাচলও জ্যামের সৃষ্টি করে চলেছে। নিচ দিয়ে যেসব গাড়ি চলাচল করে সেগুলো ফ্লাইওভারের মুখ বন্ধ করে রাখে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঠিক ব্যবস্থাপনা ও তদারকির অভাবে ফ্লাইওভারগুলোর পূর্ণাঙ্গ সুবিধা পাচ্ছেন না নাগরিকরা।
ঢাকার মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের প্রতিটি পয়েন্ট ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। এছাড়া রাজধানীর কুড়িল ফ্লাইওভার ও মহাখালী ফ্লাইওভারের পরিস্থিতিও একই।
হানিফ ফ্লাইওভার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ি এলাকায় এসে রাস্তায় মিশেছে। তার ২০০ গজের মধ্যে রাস্তার দুই পাশ জুড়ে বাজার ও রিকশা স্ট্যান্ড। এছাড়া রয়েছে লোকাল বাস থামার স্ট্যান্ড। এই বাজার আর লোকাল বাসের যত্রতত্র থেমে যাত্রী উঠানামার কারণে সৃষ্টি হয় জ্যামের। এই যে শুরু হয় তা চলতে থাকে। এরপর শনির আখড়া, কাঁচপুর ব্রিজ সবখানেই থেমে থেমে জ্যামের শিকার হতে হয় দূরপাল্লার যাত্রীদের।
অন্যদিকে যাত্রাবাড়ি থেকে ফ্লাইওভারের আরেকটি অংশ ডেমরা সড়কের কাজলায় এসে রাস্তার সঙ্গে মিশেছে। সেখানেও একই চিত্র। রাস্তার দুই দিকে ছোট ছোট দোকান, রিকশা ও সিএনজি অটোরিকশার স্ট্যান্ড, লোকাল বাসের থেমে থেমে যাত্রী তোলা তো আছেই। ফ্লাইওভার থেকে যানবাহনের যে স্রোত স্বাভাবিক গতিতে নামে তা মূল রাস্তায় নেমেই হোঁচট খায়।
এমন চিত্র দেখা যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রায়েরবাগ এলাকায়ও। দূরপাল্লার বাসগুলো ফ্লাইওভার থেকে নেমেই থমকে দাঁড়াচ্ছে লোকাল বাসগুলোর এলোমেলো দাঁড়িয়ে থাকার জন্য। স্থানীয়রা জানায়, এই জ্যাম সবসময় লেগেই আছে। দূরপাল্লার বাসযাত্রীরা মন্তব্য করে যে, ফ্লাইওভার হওয়ায় আমরা খুব খুশি ছিলাম যে ঢাকার জ্যাম সহজেই পেরিয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু ফ্লাইওভারটুকুই শুধু পেরুনো এরপর সেই জ্যাম। লাভ হলো কি?
আমাদের দেশে ২/৪টি ফাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ হলেই মনে করা হচ্ছে যানজট নিরসন হয়ে যাচ্ছে। যেখানে আমাদের দেশে ২/১টি ফ্লাইওভার নির্মাণের পরিকল্পনা হতে ধরে নির্মাণ পর্যন্ত ৩/৫/১০ বছর পর্যন্ত লেগে যায়, আর এই রাজধানী তো শুধু ২৬ কিলোমিটার/৫০ কিলোমিটার নয়। তাহলে এই রাজধানীকে যানজট নিরসন করতে হলে কতটি ফাইওভার কত বছরে নির্মাণ করা সম্ভব হবে? আর ওই ২৬ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হলেই যে ওই ২৬ কিলোমিটার যানজট থাকবে না, তার কি নিশ্চয়তা আছে? আর এত জন দুর্ভোগ, অর্থ ও সময় ব্যয়ে এতে কি যানজটের প্রকৃত সমাধান মিলবে?
অপরদিকে চট্টগ্রাম মহানগরীতে অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার নির্মাণ শেষে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে ৭ মাস আগে। কিন্তু সেই ফ্লাইওভার ব্যবহারে যানবাহন চালকদের আগ্রহ নেই মোটেও। সারা দিনে ফ্লাইওভারে সামান্য ক’টি জিপ, কার, অটোরিকশা দেখা গেলেও কোনো গণপরিবহন এটি ব্যবহার করছে না। ফ্লাইওভারের নিচে সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া সড়কে যানবাহনের চাপ বেড়ে যাওয়ায় মোহাম্মদপুর থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত যানজট আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। তাই প্রশ্ন উঠেছে এ ফ্লাইওভারের যৌক্তিকতা নিয়ে। এক দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ ফ্লাইওভার শুধু বহদ্দারহাট জংশন ক্রস করেছে। এটি কর্ণফুলী সেতু সংযোগ সড়কে যুক্ত করা হলেও কালুরঘাট শিল্পাঞ্চলের দিকে উঠানামার জন্য কোনো র্যাম রাখা হয়নি। ফলে চৌরাস্তার মোড়ে যানজট কমার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না ফ্লাইওভারটি। মূলত, এ জংশনে সামান্য দৈর্ঘ্যের দুটি ওভারফ্লাই নির্মিত হলে ক্রসিংয়ে আর ট্রাফিক সিগন্যালের প্রয়োজন হতো না। বহদ্দারহাট মসজিদ থেকে শুরু হয়ে সেতু সড়কে একটি এবং কালুরঘাট রোড থেকে পুলিশ বক্স অতিক্রম করে আরেকটি ওভারফ্লাই তৈরি করে দিলে এত দীর্ঘ ফ্লাইওভারের প্রয়োজনই হতো না। এখন ফ্লাইওভারটি মূলত সড়কের উপর আরেকটি সড়কে পরিণত হয়েছে। যে কারণে সচেতন সমাজ দাবি তুলেছে অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার নির্মাণের নামে সরকারি অর্থের অপচয় বন্ধের।
ঘণ্টায় ৫ হাজার যানবাহন চলাচল করলে গোল চক্করের প্রয়োজন হয়। সাড়ে আট হাজার থেকে ১০ হাজার যানবাহন চলাচল করলে প্রয়োজন হবে চ্যানেলাইজড জংশন। এর বেশি যান চলাচল করলে তখন ফ্লাইওভারের কথা চিন্তা করা যেতে পারে। কিন্তু সিডিএ’র সমীক্ষা অনুযায়ী বহদ্দারহাট মোড়ে প্রতি ঘণ্টায় যানবাহন চলাচল করে ২ হাজার ৭৯১টি, জিইসি মোড়ে ৪ হাজার ৯০৪টি ও মুরাদপুর মোড়ে ২ হাজার ৭৭০টি। নগরের কোনো জংশনে ফ্লাইওভার নির্মাণের মতো সমপরিমাণ যানবাহন চলাচল করে না। ফুটপাত, ট্রাফিক সিগন্যাল, লেইন মার্কিং, ট্রাফিক আইন প্রয়োগ ও ভবন নির্মাণ নিয়ন্ত্রণসহ ট্র্যাফিক ম্যানেজমেন্ট ছাড়া যতই সড়ক সম্প্রসারণ ও ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হোক যানজট নিরসন সম্ভব নয়। যানজট নিরসনে সাশ্রয়ী কাজগুলো না করে ফ্লাইওভার নির্মাণে চউক কেন এত উৎসাহী তা বোধগম্য নয়। ফ্লাইওভার নির্মাণের চার ভাগের এক ভাগ টাকা খরচ করে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যানজট নিরসন সম্ভব।
ফ্লাইওভার ঢাকার যানজট নিরসনেও কোনো উপযোগী সমাধান নয়। ফ্লাইওভার বা উড়াল সড়ক নির্মানের কারণে বেড়ে যাবে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা। ফলে যানজট আরো বাড়বে। এছাড়া অপরিকল্পিতভাবে সড়কের মাঝখানে ফ্লাইওভারগুলো তৈরি হওয়ায় ভবিষ্যতে গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। বিআরটিএর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিবছর গড়ে প্রাইভেট কারের সংখ্যা বাড়ছে ১৫ থেকে ২০ হাজার। যেখানে যাত্রীবাহী গণপরিবহণ বাড়ছে মাত্র ৫০০ থেকে ১ হাজার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাক্তিগত গাড়ি ব্যবহার কমিয়ে গণপরিবহন ব্যাবহার বাড়ানো না গেলে রাজধানীর যানজট নিরসন কোনভাবেই সম্ভব না। আর গণপরিবহন চলাচলের জন্য উড়াল সড়ক বা সেতু মানানসই নয়।
মেয়র হানিফ উড়াল সেতু চালুর পর এটির উপর দিয়ে খুব কমসংখ্যক গণপরিবহন চলাচল করছে। সেতুর নিচ দিয়ে আগের মতোই গাড়ি চলাচল করছে। সেখানে যানজট নিরসন হয়নি।
উড়াল সেতু নির্মাণে যানজট স্থানান্তর হয়ে থাকে মাত্র। যেমন মহাখালী উড়াল সেতু হওয়ার পর যানজট স্থানান্তরিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে এসে তীব্র রূপ নিয়েছে। বনানী উড়াল সেতু চালুর পর এখন যানজট স্থানান্তর হয়ে প্রকট রূপ নিয়েছে কাকলীতে।
মূলত, যানজট নিসনের সবচেয়ে প্রজ্ঞাপূর্ণ পন্থা হলো আগে যানজট কমানো। ঢাকা শহরে মাত্র ৩৬০ বর্গকিলোমিটার। অথচ এ সংক্ষিপ্ত আয়তনেই বাস করছে দেড় কোটিরও বেশি লোক। এক্ষেত্রে উচিত হবে এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে দেয়া। ঢাকার পাশাপাশি জেলা তথা মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর এসব জেলাগুলোতেও অফিস আদালত ছড়িয়ে দিতে হবে।
পাশাপাশি দেশের ৬৪টি জেলাতেই জনগণকে ছড়িয়ে দিতে হবে। এবং বিশেষতঃ যার যার জেলায়ই তাকে পোস্টিং দিতে হবে। তাতে করে রাজধানীর উপর এবং বিভাগীয় শহরগুলোর উপর চাপ কমবে। এবং বিশেষতঃ ফ্লাইওভার নির্মানে যে অর্থ ব্যায় হচ্ছে তার চেয়ে কম অর্থ ব্যয়েই জেলাগুলোকে সম্প্রসারিত করা যাবে। এতে করে অর্থও কম ব্যায় হবে যার প্রকৃত অর্থে যানজটও কমবে। এবং যানজট নিরসনের এটাই একমাত্র পন্থা।
-আল্লামা মুহম্মদ আরিফুর রহমান, শ্রীনগরী।
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০