মায়ানমারের রাখাইন (মূলত আরাকান) রাজ্যে যালিম বর্বও বর্মী সেনা নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলিমদের অবস্থা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণে এসেছে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধি দলে রয়েছে মিয়ানমারের নাগরিক উইন ম্রা ও আই লুইন এবং লেবানিজ নাগরিক ঘাসান সালামে। প্রতিনিধি দলটি ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি কক্সবাজার পরিদর্শনের পর আগামীকাল ৩১ জানুয়ারি তারা ঢাকায় কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবে। এ কমিশন চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করবে বলেও জানা গেছে।
উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরে মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর চলছে সেদেশের বর্বর যালিম সামরিক জান্তার অবর্ণনীয় ও অমানুষিক নির্যাতন। রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে নানারকম বর্বর পদ্ধতিতে শহীদ করে উল্লাস করছে মিয়ানমারের বর্বর অসভ্য জংলী সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধ রাখাইন (মগ) সন্ত্রাসীরা। প্রকাশ্যে কুপিয়ে বা জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মুসলিম হত্যার ঘটনা ঘটছে দেশটিতে। এ পর্যন্ত প্রায় শত শত রোহিঙ্গাকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছে দেশটির যালিম বর্বর জংলী সেনা ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধ রাখাইন (মগ) সন্ত্রাসীরা। এ নিয়ে নতুন করে শুরু হওয়া সহিংসতায় ৬০০ জন রোহিঙ্গা মুসলিম শহীদ হয়েছেন বলে মায়ানমারের বর্বর কর্তৃপক্ষ সরকারিভাবে স্বীকার করেছে। বেসরকারি একটি সংস্থার মতে, এর প্রকৃত সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়া গত আড়াই মাসে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম গৃহহীন হয়েছে। মুসলিম অধ্যুষিত আকিয়াবের ২২টি গ্রামে এবারের সহিংসতায় মুসলমানদের হাজার হাজার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমারের যালিম বর্বর অসভ্য সরকারের নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হলেও মিয়ানমার সরকার এই নির্যাতনের বিষয়ে যথেষ্ট মিথ্যাচার করছে। কোনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে রোহিঙ্গাদের এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। সেইসাথে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলোতে রোহিঙ্গাদের এই নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য কড়া ভাষায় নানা নিবন্ধ প্রতিদিন ছাপানো হচ্ছে। যদি আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমে কোনো এলাকার রোহিঙ্গাদের বিষয়ে লেখা হচ্ছে, তাহলে তৎক্ষণাত সেই এলাকায় মিয়ানমারের বর্বর সরকারের পক্ষ থেকে হানাদার বাহিনীর কর্মকর্তাদের পাঠানো হচ্ছে। পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের প্রতিবেশী আর পরিবারের সদস্যদেরকে ধরে এনে বেঁধে তাদের একটি বিবৃতিতে সই করতে বাধ্য করা হচ্ছে; যেখানে তারা প্রচারিত প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। সুচি সেসব মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করে, তার অধীনে কাজ করে যেসব কর্মকর্তা, তারা রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের খবরকে প্রতিদিন বানোয়াট বলে উড়িয়ে দিচ্ছে।
অং সান সূচির নেতৃত্বে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পর আশা করা গিয়েছিল, রোহিঙ্গাদের ন্যায্য ও নাগরিক অধিকার সুসংহত হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তার সময়ে এসে রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন আরো অধিকমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন সেনাবাহিনী ও অস্ত্রধারী হিংস্র উগ্রবাদী মগ বৌদ্ধরা রীতিমতো গণহত্যা চালাচ্ছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলো রোহিঙ্গাদের রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপের পরিবর্তে কেবল লিপ সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই নীরবতায় মিয়ানমারের যালিম বর্বর সরকার আস্কারা পেয়ে রোহিঙ্গাদের হত্যা, সম্ভ্রমহরণ ও উচ্ছেদ কার্যক্রম অবলীলায় চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরের জনগণ নিপীড়ন-নির্যাতন এবং হত্যার শিকার হলেও তারা নিজভূমে থেকে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তাদের অন্তত মাথা গোঁজার ঠাঁই রয়েছে। এর বিপরীতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য এ পৃথিবীতে কোনো ভূখ- নেই। তারা ভূখ-হীন মানুষ। কেউই তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। উল্টো প্রাণ ভয়ে পালিয়ে কোথাও আশ্রয় নিলে তাদের জঞ্জাল মনে করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্যাতনের বিষয়ে মালয়েশিয়ান সরকার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট নজিব রাজ্জাক রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে বলেছেন- ‘রোহিঙ্গা ইস্যু হলো ইসলামের অপমান। আমাদের ধৈর্যকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আমাদের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’ তিনি আরো বলেছেন- ‘মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ও নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন। সেই সাথে ওআইসিকে এই বিষয়ে কার্যকর হতে হবে।’
বলতে হয়, মালয়েশিয়ার সরকার ও প্রেসিডেন্টের রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও হতাশার বিষয় হলো যে, বিশ্বের অন্যান্য ৪০টি মুসলিম দেশের কোনো কার্যকরী তৎপরতা চোখে পড়ছে না। বিশ্বে মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ এবং মুসলিমদের অধিকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছে ওআইসি। সেইসাথে রয়েছে, আরব লীগ, ইউনাইটেড মুসলিম নেটওয়ার্ক, ডি-এইট’সহ অনেকগুলো প্রভাবশালী মুসলিম সংগঠন। কিন্তু ওআইসি’সহ সবগুলো সংগঠনই রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিষয়ে নিষ্ক্রিয়।
বলাবাহুল্য, রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নির্যাতনের প্রধান কারণ হচ্ছে জাতিগত বৈরিতা ও ধর্মীয় পরিচয়। শুধুমাত্র মুসলমান পরিচয়ের কারণে ওরা নিগৃহীত হচ্ছে, নির্বাসিত হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, “গোটা মুসলিম বিশ্ব এক দেহ, দেহের কোনো স্থান আক্রান্ত হলে অন্য স্থানেও তা সঞ্চারিত হবে।
সেক্ষেত্রে বিশ্বের প্রতিটি মুসলিম দেশের সরকারের জন্য ফরয হলো- শুধু রোহিঙ্গা মুসলিমদের পক্ষে যৎসামান্য ও লোকদেখানো কিছু চিড়ে ভেজানো বিবৃত্তি ও বক্তব্য না দিয়ে সত্যিকার অর্থে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্যাতন ও নিপীড়ন বন্ধে মায়ানমারের প্রতি চাপ প্রয়োগ করা। বাংলাদেশসহ সব মুসলিম দেশগুলো সোচ্চার হওয়া। এই হত্যা, নির্যাতন বন্ধে মিয়ানমারের উপর জাতিসংঘসহ বিশ্বের শক্তিধর মুসলিম দেশগুলোকে অবিলম্বে কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। আরব লীগ, ডি-এইট এবং ওআইসি’কে রোহিঙ্গা মুসলমানদের পক্ষে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নিজ ভূমিতে শান্তিতে বসবাসের সুযোগ করে দেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
-আল্লামা মুহম্মদ মাহবূবুল্লাহ, ঢাকা
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০