মুহম্মদ দেলোয়ার হুসাইন
অসৎ আনন্দের চেয়ে পবিত্র বেদনা অনেক মহৎ। এ লাইনটির সাথে April fool-এর কি সম্পর্ক তা আমরা একটু বিশ্লেষণ করলেই বুঝতে পারবো। আশা করি আমরা সবাই জানি যে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।
মেরুদণ্ড কি? কি কাজে লাগে? না থাকলে কি হয় তা আমরা একটু চিন্তা ফিকির করলেই বুঝতে পারবো। ধরুন একজন লোকের যদি মেরুদণ্ড ঠিক না থাকে তাহলে সে কখনও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। যদি তার মেরুদণ্ড ঠিক করার জন্য অন্য প্রাণীর। মনে করুন বানরের মেরুদণ্ড সংযোগ করানো হয়, তবে কি সেটা কাজে আসবে? তেমনি শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হলেও কোন শিক্ষা হবে প্রকৃত মেরুদণ্ড? একজন ইংরেজ লেখক লিখেছেন, If you teach your children three Rs (of reading, writing, arithmetic) and leave the fourth R (of religion) you will get a fifth R (of rascallty) অর্থাৎ আপনি যদি আপনার সন্তানকে Reading. Writing, Arithmetlc এ তিনটি R শিক্ষা দেন এবং চতুর্থ R তথা Religion কে বাদ দেন তবে আপনি অবশ্যই পাবেন পঞ্চম R যা হচ্ছে Rascalit অর্থাৎ বদমায়েশী।
মূল কথায় এবার আসা যাক। প্রতি বৎসর ১লা এপ্রিল ইযরধফ তমমফ পালন করে আনন্দ উপভোগ করে থাকে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিস আদালতে। গ্রামে-গঞ্জে একে অপরকে ঠকিয়ে আনন্দ পায়। অনেক সময় কর্মচারীরা বড় অফিসারের সাথেও কৌতুক করে থাকে। এমন অনেকেই আছেন যাদের সামনে একান্ত দরকার না হলে সাধারণতঃ দেখা করা যায় না কিন্তু ইযরধফ তমমফ। এর দিনে দেখা যায় তাদের সাথেও কেউ কেউ একটু রসিকতা করে বা করার চেষ্টা করে। তাই স্বাভাবতঃই প্রশ্ন জাগে এভাবে রসিকতার বা আনন্দ উপভোগের জন্য তারা এপ্রিল মাসের ১লা দিনকে বেছে নিয়েছে কেন? নিশ্চয়ই এর পিছনে অতীতের এমন কোন ঘটনা আছে যা তাদেরকে এ আনন্দের উদ্দীপনা দিচ্ছে। আর সেই প্রকৃত ঘটনাটাই তুলে ধরার জন্যই আমার এ লেখা।
গল্পে পড়েছি কোন এক বাদলা দিনের অপরাহ্নে ছেলেরা দলবেঁধে পুকুরে বেঙদের ঢিল ছুঁড়ে আনন্দ উপভোগ করছিল। বেঙের দল প্রতিবাদ করে বলেছিল ঢিল ছোঁড়া তোমাদের খেলা হলেও আমাদের জন্য উহা মৃত্যুর কারণ। April fool-এর ঘটনাটি ইতিহাসের দৃষ্টিতে আলোচনা করলেও দেখা যাবে যে, তা সকলের জন্যে আনন্দদায়ক নয়। বিশেষ করে মুসলমানদের জন্যে অত্যন্ত লজ্জাস্কর ও পিড়াদায়ক ব্যাপার।
প্রকৃতির অমোঘ বিধানে কোন রাজ শক্তিই কোন দেশে চিরস্থায়ী হতে পারে না, তা যতবড় শক্তিশালী ও পরাক্রমশালীই হোকনা কেন। ইউরোপের গথ শঅসকগণও তাই পারেনি তাদের শোষনমূলক নীতি দীর্ঘদিন ইউরোপে টিকিয়ে রাখতে। ৭১২ সালে দামেস্কের উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদের সময় স্পেনবাসীর আমন্ত্রনে তারেক বিন মুসা গোপনে মুসলিম বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমান ও খৃষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে চলতে থাকে ভুল বুঝাবুঝি ও শত্রুতা। এতদসত্ত্বেও গথদের অলস গরিমায় যে উপদ্বীপ মৃত ও অনুর্বর হয়ে পড়েছিল, পরিশ্রমী ও সাহসী মুসলিম শাসক স্পর্শে তা উদ্ভাবনশীল, জ্ঞানালোকিত, শিক্ষা ও সভ্যতার লীলাভূমিতে পরিণত হয়, জন্ম হয় আধুনিক ইউরোপের। মুসলমানগণ সুদীর্ঘ প্রায় সাড়ে সাতশত বৎসর এখানে কৃতিত্বের সাথে রাজত্ব করেন। তাদের শাসনে ইউরোপ উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করলেও খৃষ্টানগণ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তারা ভিতরে ভিতরে গুমরে মরছিল আর চিন্তা করছিল কিভাবে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটানো যায় এ উপমহাদেশ থেকে। খৃষ্টান জগতে আশার আলো উদিত হয় ১৪৬৯ সালে দুই মুয়ালিম বিরোধী খৃষ্টান শক্তি আরাগানের ফার্ডিনান্ড ও কাস্টাইলের ইসাবেলার বিবাহ বন্ধনে খৃষ্টান জোট সৃষ্টির মাধ্যমে। এ খৃষ্টান জোট প্রথমেই মুসলিম সভ্যতা নিশ্চিহ্ন করার দৃঢ় সংকল্প নেয়। এ সংকল্পের ফলশ্রুতিতে মুসলিম সুলতান বোয়াবলিদের দূর্বলতার কারণে এক অকস্মাৎ আক্রমনাত্মক অভিযানের দ্বারা গ্রানাদা রাজ্যের প্রবেশদ্বার বিখ্যাত মুসলিম দূর্গ আল- হামরার পতন ঘটায়। খৃষ্টানগণ মুসলিম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। অসংখ্য অসহায় বালক-বালিকা, বৃদ্ধ-শিশু ও নারীর রক্তে শানিত কৃপান রঞ্জিত করে পরম তুষ্টি লাভ করে ফার্ডিনান্ড ও ইসাবেলা দম্পতি। আল-হামারা দূর্গের পতনের সুদীর্ঘ দশ বছর পরে ফার্ডিনান্ড গ্রানাদা রাজ্য তাদের হাতে সমর্পনের নির্দেশ দেন মুসলিম সুলতানকে। অপমানজনক এ আদেশ মুসলিম সুলতান প্রত্যাখ্যান করেন। এতে চল্লিশ হাজার পদাতিক ও দশ হাজার অশ্বারোহী খৃষ্টান সেনার আক্রমনে শেষ বিখ্যাত মুসলিম সেনাপতি মুসা বিন গাজান ও উনার বাহিনী পরাজিত হন।
বিজয়ী ফার্ডিনান্ড দম্পতি পরাজিত মুসলিম সৈন্যদের সন্ধির টোপে আবদ্ধ করে তাদেরকে অস্ত্রমুক্ত করেন। কিন্তু তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন সেনাপতি মুসা এ সন্ধিকে মরন টোপ বুঝতে পেরে সন্ধি শর্তে আবদ্ধ না হওয়ার জন্য স্বপক্ষীয় সেনাদল ও জনগণকে এক তেজস্বীনি ভাষনে ভয়াবহ ভবিষ্যত পরিণতির ইঙ্গিত দান করেন। কিন্তু তার অবশ্যম্ভাবী পতনের আশংকায় মুসলমানগণ তার এ গুরুত্বপূর্ণ ভাষনের কোন মর্যাদা দেয়নি। তাই তিনি উপায়ন্তর না দেখে এলাভিরা তোরন দিয়ে অশ্বারোহনে নগর ত্যগের সময় ওত পেতে থাকা দশজন খৃষ্টান অশ্বারোহীর দ্বারা বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে যুদ্ধ করতে করতে তাদের কয়েকজনকে হতাহত করেন এবং নিজেও মারাত্মকভাবে আহত হন। অবশেষে শত্রু হাতে বন্দী হওয়ার চেয়ে শেনিল নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে চিরশান্তি লাভের পথ বেছে নেন। সেনাপতি মুসা বিন নুসাইরের শৌর্যে ৭১২ সালে স্পেনে যে মুসলিম রাজ্যের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত হয়, তারই শোচনীয় পরাজয় ঘটে সাতশত আশি বছর পরে ১৪৯২ সালে একই নামে মুসার জীবন অবসানে।
ধর্মের আবরনে আচ্ছাদিত ফার্ডিনান্ড দম্পতি মুসলমানদের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি ভঙ্গ করে গোপনে ইসলাম ধর্ম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। শত্রু বেষ্টনে আবদ্ধ মুসলমানগণ বৃথা উত্তেজিত হয়ে অত্যাচারের ষ্টীম রোলারে নিস্পেসিত হয়। ফার্ডিনান্ড আদেশ জারি করে মসজিদগুলোকে নিরাপদ ঘোষণা করে। এ আদেশে আরো বলা হয় যে, যারা মসজিদে আশ্রয় নেবে তারা নিরাপদ থাকবে। অসংখ্য স্পেনীয় মুসলমান সরল বিশ্বাসে মসজিদগুলোতে আশ্রয় গ্রহণ করে শত্রু খোয়ারে আবদ্ধ হয়। শত্রুর দল মসজিদগুলিকে তালাবদ্ধ করে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয় অবশিষ্ট স্পেনীয় মুসলমানদের। আর বাইরে থেকে তারা উল্লাস ভরে কৌতুক করে সমস্বরে Fool! Fool!! বলে চিৎকারে মেতে ওঠে। দিনটি ছিল ১লা এপ্রিল ১৪৯২ সাল। অদ্যবধি খৃষ্টানগণ তাদের সেই বিজয়ের স্মরণে পালন করে April Fool!
খৃষ্টান জগতে দিনটি উদ্দীপনাপূর্ণ হলেও মুসলমানদের জন্য বেদনাদায়ক। কেননা মুসলমানদেরই হাতে গড়ে উঠা একটি সভ্যতা সমূলে উৎখাত হয়ে ভেসে যায় মুসলমানদেরই বুকের তাজা রক্ত স্রোতে। দীর্ঘদিনের লালিত একটি সভ্যতার সমাধি ঘটে এই দিনে।
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০