সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, বাহাত্তরের সংবিধান পুনর্বহাল না হলে হরতালের হুমকি দিয়েছেন বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত প্রশ্ন উঠে, আসলে কী তারা নিজেদের থেকেই একথা বলেছেন? না কী তাদেরকে কেউ প্রভাবিত অথবা প্রলুব্ধ করে বলিয়েছে? প্রশ্নটা সঙ্গত এবং সঠিক এ জন্যে যে, এতবড় একটা কথা তারা হঠাৎ করে বললেন কেন? এতবড় একটা সংক্ষোভ তারা অন্তরে পোষণ করছেন বিগত ৩৩ অথবা ২৩ বছরে তার কোনো নিদর্শন জাহির হলো না কেন? সত্যিই সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের অন্তরে যদি এত ঘনীভূত অনুভব থাকতো; তাহলে এতদিন তারা এ সত্য চুপিয়ে রাখলেন কেন? স্বৈরশাসনের চাবুক অথবা অপশাসনের রক্তচক্ষু তো তাদের পরওয়া করার কথা নয়। হানাদার বাহিনীর তাজা বুলেটকে তারা ভয় করেননি। ’৭১-এর সে অমিততেজা অনুভব থেকে কী তারা বিচ্যুত হয়েছিলেন? সে বিচ্যুতি কি তাদেরকে এতদিন অন্তরের কথা ব্যক্ত করতে অন্তরায় তৈরি করেছিল? যদি সে বিচ্যুতিকে স্বীকার করতে হয়; তাহলে আজকেও যে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম আদর্শগত, ধারণাগত এবং এদেশের জনমতের প্রকৃত অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে ’৭২-এর সংবিধান পক্ষে কথা বলছেন না, তা কী করে বলা যায়?
’৭২-এর সংবিধান পুনর্বহাল প্রশ্নে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মূলত রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ শরীফ বাতিল ও ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্দৃষ্টির কথা ব্যক্ত করেছেন। তারা প্রশ্ন করেছেন, রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কী? তাদের প্রশ্নের জবাব কী তাদের কাছে নেই? তারা কী স্মরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন? অথবা স্বীকার করতে নিমরাজী হবেন? যে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনই ছিল ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। আর ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের একদফা একদাবি যে ছিল- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এ ঐতিহ্যবাহী ও গগনবিদারী শ্লোগান কী তাদেরকে মনে করিয়ে দিতে হবে? সেক্ষেত্রে এ বিস্মৃতি কী সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম হিসেবে তাদের এতদিনের মূল্যায়ন অব্যাহত রাখার কোনো অবকাশ রাখে?
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম কী ১০ই এপ্রিল ১৯৭১, গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন? সেখানে কোথাও কী ধর্মনিরপেক্ষতার কথা লেখা আছে?
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম কী ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন না? অথচ বঙ্গবন্ধু ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের গণমতের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে ’৭০-এর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন- “কুরআন শরীফ-সুন্নাহ শরীফ বিরোধী কোনো আইন পাস হবে না।”
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম কী ধর্মব্যবসায়ীদের ব্যাখ্যার মাঝেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চান? তারা কী “হে ঈমানদারগণ তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর।”- এ রকম শত-সহ¯্র আয়াত শরীফ অস্বীকার করতে চান? কুরআন শরীফ-সুন্নাহ শরীফ শরীফ-এ ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়েছে এবং ইসলামকে পরিপূর্ণ দ্বীন বলে আখ্যা দিয়ে একমাত্র ইসলামকে মুসলমানদের জন্য পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা বলা হয়েছে।
এ রকম শত-সহ¯্র আয়াত শরীফকে যারা অস্বীকার করতে চান, তারা কী নিজেরা মুসলমান হিসেবে থাকতে চান না? একজন মুসলমান তো, বিসমিল্লাহ শরীফ, ইসলাম বা সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাক ও উনার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ‘টু’ শব্দ করতে পারেন না। কিন্তু যারা এখন এত বড় বড় বিরোধী কথা বলছেন- তারা কী ফিরআউন, নমরূদ, সাদ্দাদের কাহিনী ভুলে গেছেন?
না কী নিজেদের ফিরআউন, নমরূদ ও সাদ্দাদের চেয়েও বড় মনে করেন?
যদি তাই করে থাকেন তাহলে এখনও মুসলমান নামে বা পরিচয়ে আছেন কেন?
কেন নিজেদেরকে তারা খোদাদ্রোহী নাস্তিক ও মুরতাদ বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছেন না?
খোদাদ্রোহী হিসেবে পরিচিত হচ্ছেন না?
আর এসব খোদাদ্রোহী নাস্তিক মুরতাদের তো কোনো অধিকার নেই দেশের ৯৭ ভাগ মুসলমানের সংবিধান নিয়ে কোনো কথা বলার। মুসলমান নামে ও পরিচয়ে থাকবেন কিন্তু মুসলমান ও ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করবেন; এটা কী সুস্পষ্ট মুনাফিকী নয়? আর কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ শরীফ-এ যে মুনাফিকদেরই মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে- এটাও কী সবাই অবগত নয়?
কোনো মুসলমানের পক্ষে কী সম্ভব, যে পরকালে আল্লাহ পাক উনার সামনে দাঁড়াবে, কিন্তু দুনিয়াতে সামান্য রাজনৈতিক ও বিদেশী স্বার্থ রক্ষার জন্য আল্লাহ পাক উনার বিরুদ্ধাচরণ করবে? কোনো মুসলমানের পক্ষে কী সম্ভব? মৃত্যুভয় সম্পর্কে সচেতন থাকবেন না? অথবা পরকালের হিসাব দেয়া সম্পর্কে বেখবর বা বিদ্রোহী থাকবেন? নাঊযুবিল্লাহ!
বলাবাহুল্য, মুসলমানের প্রতিটি কাজে ও কথায় মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস প্রতিফলিত হতে হবে। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম কী ভুলে গেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের ভাষণ ৭ই মার্চের ভাষণের শেষ বাক্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এদেশের মানুষকে স্বাধীন করে ছাড়বো ‘ইনশাআল্লাহ’।’
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম কী জানেন ‘ইনশাআল্লাহ’ শব্দের অর্থ সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাক উনার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস। আজকে তারা যে কথা সংবিধানের প্রস্তাবনা, ৮, ও ৮ (১) (ক) ধারা থেকে উঠিয়ে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করতে চাচ্ছেন সে ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধী ‘ইনশাআল্লাহ’ বুলন্দ আওয়াজে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে বলেছিলেন? সে ইনশাআল্লাহকে সামনে রেখেই এদেশবাসী মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ৩০ লাখ লোক জীবন দিয়েছিল এবং ইনশাআল্লাহতে বিশ্বাসী ছিল বলেই তাদের শহীদ বলা হচ্ছে।
বলাবাহুল্য, রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’, ‘বিসমিল্লাহ’ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধী ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাক উনার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস’ এসব কথা এবং ‘শহীদ’ সমার্থক শব্দ। পক্ষান্তরে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচ- রকমের ‘শহীদ’ বিরোধী শব্দ।
বলাবাহুল্য, ৩০ লাখ শহীদের সাথে বেঈমানী করা যাবে না। রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’ ও ‘বিসমিল্লাহ’ এবং ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাক উনার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস’ বাদ দেয়া যাবে না। ধর্মনিরপেক্ষতা ঢোকানো যাবে না। সঙ্গতকারণেই সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের বিরোধী কথা গ্রহণ করা যাবে না। মূলত তাদের সে গ্রহণযোগ্যতা অথবা দায়বোধ আদৌ নেই। থাকলে দেশের অব্যাহত ক্ষুধা-দারিদ্র্য-যুলমের বিরুদ্ধে অনেক আগেই তারা তাদের কথিত হরতাল দিতেন এবং প্রচলিত ধারায় তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিতও হত। প্রতিভাত হচ্ছে তারা কাঙ্খিত ও বাঞ্ছিত আদর্শ বলয় থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নেতৃত্ব ও নির্দেশনা দিতে চরম ব্যর্থ হয়েছেন।
পাশাপাশি তারা প্রজ্ঞাহীন পরিচয় দিতেও অক্ষম হয়েছেন। তারা কী জানেন বঙ্গবন্ধু নিজেই ’৭২-এর সংবিধান অক্ষত রাখেননি? ’৭২-এর সংবিধানে তিনি ’৭৪-এর সংশোধনী এনেছিলেন। শুধু তাই নয় ’৭২-এর সংবিধান গ্রহণের ভাষণে তিনি আরো ভালো বিধান সংযোজনের আহবান করেছেন। এবং ’৭২-এর সংবিধানে কাঙ্খিত ভালো বিধান পাননি বলে আক্ষেপও করেছেন। তাহলে ’৭২-এর সংবিধানের পর বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাক উনার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস যে বঙ্গবন্ধুরই আদর্শ তা অনুভব করতে ব্যর্থ হওয়া কী বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের সাথে বেঈমানী করা নয়?
-মুহম্মদ তা’রীফুর রহমান
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০