আইএমএফ আর বিশ্বব্যাংক বর্তমান যামানায় ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর যথাযথ উত্তরসূরি

সংখ্যা: ২০৮তম সংখ্যা |

মুসলমানগণের চরম শত্রু ইহুদী লবিং নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত হওয়া ফরয-ওয়াজিব। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর বিরুদ্ধে দেশের ৯৭ ভাগ অধিবাসী মুসলমানগণের জন্য জিহাদ করা ফরয (১)

একথা এখন সূর্যের আলোর মতো স্পষ্ট, আইএমএফ বিশ্বব্যাংকের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পৃথিবীর বহু দেশে দাঙ্গা, সংঘাত, সহিংসতা, দারিদ্র্য, আর্থিক সংকট বেড়েছে। লুণ্ঠন, দুর্নীতি তো আছেই। দুর্নীতিবাজ শাসক, গোষ্ঠী, আমলা, কনসালট্যান্ট ছাড়া তাদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখাই সম্ভব নয়। ব্যবসায়ীরা তাদের অনেক কর্মসূচির সুফলভোগী ঠিকই, কিন্তু যেহেতু এসব সংস্থা শেষ পর্যন্ত বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থার প্রতিনিধি, তাই এক পর্যায়ে গিয়ে দেশী শিল্পোদ্যোক্তা, বিশেষত আত্মমর্যাদা আছে এরকম মানুষদের সঙ্গে তাদের সংঘাত অনিবার্য। এদের চাপে বিপর্যস্ত বহুদেশই এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বহু দেশেই যখন আইএমএফ ঘৃণিত, প্রত্যাখ্যাত সে সময় বাংলাদেশে তারা হাজির পিএসআই করতে। যা বাংলাদেশের ঘাড়ে দাসত্বের শৃঙ্খল পরানোর আরেক কর্মসূচি ছাড়া আর কিছু নয়। এদের দরকার মাথাশূন্য, মেরুদণ্ডহীন, ইজ্জতের বোধহীন একটি শাসকগোষ্ঠী, যারা তাদের সকল কথা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেবে, দাসত্বে ধন্য হবে। এসব চুক্তি সেটাই নিশ্চিত করতে চায়।

এইসব সংস্থার এরকম মিশন বছরে কতবার এ দেশে আসে সেটা বাংলাদেশের মানুষ সবসময় জানে না। আইএমএফ-এর অফিস যে বাংলাদেশ ব্যাংকে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি নির্ধারণে তাদের কী ভূমিকা সেটাও বাংলাদেশের মানুষের কাছে জানা নেই। বিশ্বব্যাংকের কত মিশন সারা বছর আসে আর তাদের এখানকার অফিস থেকে কর্মকর্তারা কতবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে বসে, কতবার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তাদের সামলাতে হিমশিম খেতে হয় আমলাদের; তা দেশের মানুষ জানে না। জোসেফ স্টিগলিজ নিজের বিশ্বব্যাংকে কাজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলেছিলেন, ‘গরীব’ দেশগুলোতে ‘বিদেশী সাহায্য’ যুক্ত প্রজেক্ট-এর কাগজপত্র আর নিয়ম-কানুন ঠিক করতে করতেই আমলাদের সময় চলে যায়, অন্য কাজ আর করবে কখন? এদের সব ‘উচ্চপর্যায়ের’ গোপন সভায় কী কী আলোচনা হয়, কী কী সিদ্ধান্ত হয় সেটা বাংলাদেশের মানুষ আজও জানে না। বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় যারা থাকে, যারা কনসালট্যান্ট বিশেষজ্ঞ তাদের মাধ্যমে জনগণ জানে যে, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ইত্যাদি সংস্থাগুলো বাংলাদেশের মানুষকে সাহায্য করবার জন্য সদা ব্যস্ত। তাদের সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশ চলতে পারে না। এসব সংস্থা হল ‘দাতা সংস্থা’! (নাঊযুবিল্লাহ!)

মূলত এরা দাতা তো নয়ই বরং এরা লুণ্ঠনকারী দস্যু সংস্থা। এরা গোটা দেশ ডাকাতী করার দল।

এসব সংস্থার গঠন, পরিচালনা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সবকিছু বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে যে, বিভিন্ন দুর্বল দেশে তাদের অর্থসংস্থান একদিকে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রগুলোর কৌশলগত প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যদিকে এই অর্থসংস্থান তাদের নিজেদের সাম্রাজ্যিক অস্তিত্বের জন্য, বহুজাতিক পুঁজির বিকাশের জন্য অপরিহার্য।

এই মুহূর্তে তাই বিশ্বের বিভিন্ন দুর্বল দেশ যদি আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি এ ধরনের সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ/অনুদান নেয়া বন্ধ করে দেয় তাহলে শরীরের ভেতর কাজ করা একটা ভাইরাস প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ যেমন ঝরঝরে হয়ে উঠে, এই দুর্বল দেশগুলোও সে রকম ঝরঝরে অবস্থা লাভ করবে।

অন্যদিকে এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে নেতৃত্বাধীন বিশ্বের মোড়ল দেশগুলোর, তাদের বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থাগুলোর, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামরিক আধিপত্যে ধ্বস নামবে।

প্রচারণা চালানো হয় যে, এসব সংস্থা আমাদের উন্নয়নের জন্য সভা/সম্মেলন/ওয়ার্কশপ/গবেষণা/সফর করে যাচ্ছে, কিন্তু এসব সংস্থা অর্থসংস্থান করে তাদেরই নিজেদের তাগিদে, নিজেদের প্রয়োজনে। এই অর্থসংস্থান তারা যেভাবে যে শর্তে করে থাকে তাতে এই ঋণের টাকা তাদের অনেক পণ্য চড়া দামে বিক্রির ব্যবস্থা করে। আর এই টাকায় কর্মসংস্থান হয় ওইসব দেশের দড়িবাজ, অর্ধশিক্ষিত স্মার্ট কনসালট্যান্টদের। তারা আমাদের ঋণের টাকায় মাসে ১০/১৫/২০ লাখ টাকা বেতন নেয়, বছরে এক/দুই/তিনবার দেশে যায়, নানা সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে বেড়ায়।

এই কনসালট্যান্টদের একটি বিশ্বজোট এখন সচল, যাদের অস্তিত্ব, স্ফীতি নির্ভর করে তথাকথিত এই বিদেশী সাহায্য এর উপর। বাংলাদেশের মতো দেশে এসব কনসালট্যান্ট কিছু না জেনেও তাদের থেকে অনেক যোগ্য ব্যক্তির মাথার উপর ছড়ি ঘোরায়। সচিবালয়, মন্ত্রণালয়, দলিলপত্র সবকিছুই তাদের দখলে। অনেক কনসালট্যান্ট নিজের স্থায়ী জায়গা তৈরি করে দশকের পর দশক কখনো অর্থ কখনো খনিজ কখনো শিক্ষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে নানা প্রজেক্টে আটকে থাকে। এর থেকে লোভনীয় লাভজনক চাকরি তাদের জন্য আর কোথাও নেই। বাংলাদেশের সব মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বত্র আমাদের জনগণের ঋণের টাকায় এরকম অনেক কনসালট্যান্ট দেখা যাবে।

প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর কনসালট্যান্টদের পেছনে ঋণের/অনুদানের টাকায় শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ব্যয় হয়। বাকি টাকায় এখানে একটা সমর্থক ভিত্তি তৈরি হয়। এখানকার কিছু কনসালট্যান্ট, আমলা, মিডিয়া তার ওই টাকায় ক্ষুদ্র অংশের ভাগীদার হিসেবে কিছু আয়ের মুখ দেখে, এলিট হিসেবে দাঁড়ায় আর উঁচু গলায় ‘বিদেশী সাহায্য’ আমাদের কত দরকার সেই যুক্তি বিস্তার করতে থাকে কনসালট্যান্সি রিপোর্ট, সেমিনার কিংবা ফাইল নোটে। সবচাইতে বিপজ্জনক দিক হল এসব সংস্থার নীতিগত সংস্কারের দিক। ঋণের টাকা দিয়ে তারা নীতি ও প্রতিষ্ঠানে যা যা করে তার প্রভাব বোঝার জন্য আমাদের সামনে নদী, পানি সম্পদ, জ্বালানি সম্পদ, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, চিকিৎসা, পাট খাত আছে। শুধু পাট শিল্পে উন্নয়নের নামেই বাংলাদেশ ১,৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক থেকে। সেই টাকায় দেশ বিদেশ সফর, কনসালট্যান্সি করে অনেকেই লাভবান হয়েছে আর মূল কর্মসূচি পাট শিল্পে উৎপাদনশীলতা, দক্ষতা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বদলে ধস নেমেছে।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশ হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, সেগুলো দিয়ে নীতি প্রতিষ্ঠান কর্মসূচি যা পরিবর্তন/সংস্কার/উন্নয়ন হয়েছে তার ফলে গ্যাস ব্লকগুলো এখন বহুজাতিক কোম্পানির দখলে। তাদের কাছ থেকে গ্যাস কিনতে আমাদের এখন প্রতিবছর ১ হাজার কোটি টাকার লোকসান দিতে হয়। বিদ্যুৎ খাতে দেশীয় প্ল্যান্ট না বসিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে বিদ্যুৎ খাত তুলে দেয়ায় প্রতি বছর সেখানে লোকসান যাচ্ছে ১১০০ কোটি টাকারও বেশি। তার দায় মেটাতে তারা অবিরাম পরামর্শ দেয় গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়াতে। এইসব ‘উন্নয়ন সাহায্যের’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন, গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন, পানি সম্পদ উন্নয়ন, ব্যাংক সব ক্ষেত্রেই জাতীয় সক্ষমতা আর প্রতিষ্ঠান বিকশিত হবার বদলে প্রায় শেষ অবস্থা। এসব ‘দাতা সংস্থা’ এসব কাজই করে উন্নয়ন কর্মসূচি নাম দিয়ে, আর করে দারিদ্র্য বিমোচনের নামে। করতে পারে, কারণ এ দেশে দুর্নীতি, লুণ্ঠনের উপর দাঁড়ানো শাসক গোষ্ঠী তাদের কনিষ্ঠ অংশীদার, তাদের কেনা আমলা ও কনসালট্যান্টরা ভূমিকা পালন করে বিশ্বস্ত বাহিনীর। (ইনশাআল্লাহ চলবে)

-মুহম্মদ আরিফুর রহমান