কুরআন শরীফে কাহিনীর বর্ণনা করা হয়েছে অনেক। কাহিনীর এই ব্যাপকতার কারণে কাফিররা মন্তব্য করেছিল, কল্পলোকের গল্পকাহিনী রূপে। কিন্তু আ’লীমুল হাকীম আল্লাহ্ পাক, হযরত ইউসুফ আলাইহিস্ সালাম-এর কাহিনী বর্ণনার পর বলেন, “নিশ্চয়ই এই কাহিনীতে রয়ে গেছে জ্ঞানীগণের জন্য উত্তম নসীহত।” এই আয়াত শরীফের তাফসীরে বলা হয়েছে- পরবর্তীদের জন্য পূর্ববর্তীদের ঘটনাবলী নসীহত স্বরূপ।
ফিরআউনের কাহিনী আমরা জানি। কেবল খোদাদ্রোহী রূপেই নয়; বরং খোদা দাবীকারী হিসেবেও সাধারণ মুসলিম মানসিকতায় ও চেতনায় ফিরআউনের প্রতি যে ঘৃণা ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এখনো বিরাজমান সে অনুপাতে মুঘল বাদশাহ আকবরের প্রতি মানুষের অনুভূতি কতটা শানিত? পাশাপাশি, বাদশাহ আকবরের আমলের উলামায়ে ‘ছূ’ আবুল ফজল, ফৈজী, হাজী ইব্রাহীম, মোল্লা মোবারক, আবদূন্নবী, মাখদুম উল মূলক, ইত্যাদির ঈমান বিক্রি সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি সে তুলনায় আজকের সমাজে বিরাজমান নব্য আবুল ফজল, ফৈজী, হাজী ইব্রাহীম, মোল্লা মুবারক ইত্যাদি সম্পর্কে আমরা কতটুকুই বা জানি?
বিশেষতঃ তাদের অল্প মূল্যে আয়াত শরীফ তথা স্বীয় ঈমান ও ইসলাম বিক্রির কথা কতটুকু উপলব্ধি করি? বাদশাহ্ আকবরের যুগের উলামায়ে ‘ছূ’দের দ্বীনে ইলাহীর মত তারাও যে আজকে অঘোষিতভাবে দ্বীনে জুমহুরী প্রচলন করে চলছে তাও বা আমরা ক’জনে অনুভব করি?
আজকের উলামায়ে ‘ছূ’দের প্রচলিত দ্বীনে জুমহুরীতে শুধু মৌলবাদ, হরতাল, লংমার্চ, ব্লাসফেমী, ছবি, টিভি, ভিসিআর, বেপর্দা, বেহায়া, নির্বাচন আর গণতন্ত্রই জায়িয হচ্ছেনা বরং দ্বীনে গণতন্ত্র তথা দ্বীনে জুমহুরীর নামে তারা সুদ-ঘুষ, নারী নেতৃত্বসহ সকল হারামকেই হালাল করে চলছে। যা মূলত বাদশাহ আকবরের উলামায়ে ‘ছূ’দের তুলনায় কোন অংশেই কম নয়; বরং অপেক্ষাকৃত বেশী। তবে যে কথাটি প্রনিধানযোগ্য যে, বাদশাহ আকবর ফিরআউনের তুলনায় কোন অংশে কম না বরং বেশী করলেও যেমন আকবরকে মানুষ ফিরআউনের মত ঘৃণা করেনা তেমনি আকবরের আমলের উলামায়ে ‘ছূ’দের যতটুকু জানে বা ঘৃণা করে আজকের উলামায়ে ‘ছূ’দের ততটুকুও চিনেনা বা বুঝেনা। প্রসঙ্গতঃ বাদশাহ আকবর যে ফিরআউনের চেয়েও বেশী দুরাচার ছিল তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র দেয়া গেলো-
আকবর নিজেকে ঈশ্বরের মত মনে করতেন এবং তিনি ভাবতেন, তিনি হচ্ছেন মনুষ্য আকারের দেবতা [দ্রঃ সেন্ট্রাল স্ট্রাকচার, পৃষ্ঠা ৫৯]। আর সেজন্যই আকবর একটি নতুন ‘বিদ্য়াতে’র সৃষ্টি করেন, যাকে বলা হতো ‘ঝারোকা দর্শন’। সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দরবারে জন সাধারণের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে সৌভাগ্যের সৃষ্টি করতেন! আরও পরিস্কার ভাষায় দিল্লীশ্বরকে জগদীশ্বর [?] মনে করে দেখতে আসতেন গরীব প্রজার দল। ঐতিহাসিক বাদাউনির মতে ওটা ছিল হিন্দু দর্শনের অনুকরণ। (দ্রঃ মুনতাখাবুত তাওয়ারিখঃ ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৩৬)
ইসলামে যদিও এক আল্লাহ্ ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে সিজদা করা মোটেই চলেনা তবুও তার দরবারে ‘জমিন বুসি’ অর্থাৎ সম্রাটের সামনে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে সিজদা বা প্রণিপাত করে সম্মান জানানোর ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। [দ্রঃ আইন-ই-আকবী প্রথম খন্ডের ১০ পৃষ্ঠা; দি কালচারাল আস্পেক্ট অব মুসলিম ইন ইন্ডিয়াঃ এস. এম জাফর, পৃষ্ঠা ২০-২৯] এছাড়াও আকবরের পরিকল্পনা ছিল আরো সুদূর প্রসারী।] হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় থেকে প্রতি শুক্রবার জুমুয়ার নামাযের পূর্বে যে আরবী খুৎবাহ্ হতো তা বাতিল করে আকবরের গুণগান সম্বলিত কবিতা পাঠ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই কবিতার রচয়িতা ছিল ফৈজী। ঠিক হয়েছিল যে, আকবর নিজে সেটা পাঠ করে শুনাবে বিরাট জনতাকে আর সকলে সমস্বরে ‘আল্লাহু আকবর’ (আকবরই আল্লাহ) বলে সাবাস দেবে এবং সেই সঙ্গে আকবর তার নতুন ‘দ্বীনে ইলাহী’ ধর্মে দীক্ষিত হতে আদেশ দিবে। আকবর সালাম দেয়ার প্রথা বিলোপ করে তার পরিবর্তে ‘আল্লাহু আকবর’ বলার নিয়ম চালু করেছিলেন। তার উত্তরে ‘জাল্লা জালালুহু’ বলা হতো। অর্থাৎ এর দ্বারাও আকবরই বড় বা আকবরই আল্লাহ্ এই ভাবই ফুটিয়ে তোলা হত। কিন্তু এরপরেও হিন্দু প্রজাগণ তার কাছে নিবেদন করলো, ‘সম্রাট, আপনার কাজকর্ম দেখে সমস্ত হিন্দুই আপনার উপরে সন্তুষ্ট। তাই শ্রদ্ধায় হিন্দুরা আপনাকে দিল্লিশ্বর ও জগদীশ্বর বলে। কিন্তু আপনি সালাম তুলে দিয়ে ‘আল্লাহ’ শব্দ ব্যবহার করলেন কেন? আপনি এটাও তুলে দিন।’ তখন আকবর হিন্দু প্রজাবর্গকে নিশ্চিন্ত করতে বললেন, মুসলমানদের জন্য আমিই স্বয়ং আল্লাহ হয়ে প্রকাশিত হয়েছি অর্থাৎ ‘আল্লাহু আকবর’ মানে আকবরই আল্লাহ। তার অনুগত হিন্দু প্রজাগণ আবার অভিযোগ করল ‘আল্লাহ’ শব্দটা হিন্দু বিরোধী; অতএব ওটাকে তুলেই দিন। আকবর তাই করলেন। সারা দেশে ঘোষণা করে দিলেন, আজ থেকে ‘সালাম’ বা ‘আল্লাহ্-এর’ পরিবর্তে ‘আদাব’ শব্দ ব্যবহার করতে হবে।
আকবর ইসলামের নিয়ম কানুন বর্জন করার আদেশই শুধু দিতেন না; প্রকাশ্যে ইসলামের নিন্দাও করতেন। বলতেন, ‘আরবদেশের ফকীররা ইসলামের সৃষ্টি করেছে।’ ইসলাম সম্বন্ধীয় আরবী বইপত্র পড়া নিষেধ ছিল, তবে চিকিৎসা বিষয়ক ও অনৈসলামিক পুস্তকাদি পড়ার অনুমতি ছিল।
অথচ এই আকবরই তাঁর সভাসদগণের উদ্দেশ্যে বলে, প্রাচীন কালের হিন্দু মুনি-ঋষীদের হিন্দী ভাষায় রচিত বেদ-পুরাণ গুলো নির্ভুল জ্ঞানের ভান্ডার। এই সমস্ত গ্রন্থই হিন্দুয়ানী আকায়িদ ও ইবাদতের ভিত্তি। সুতরাং এসব গ্রন্থের ফারসী তরজমা প্রকাশ করতে পারলে আমাদের ইহকাল ও পরকালে সুখ-শান্তি অর্জিত হবে। কুরআনুল হাক্বীমকেও তিনি অস্বীকার করেন। আকবর আরও প্রচার করে, “ওহী বা প্রত্যাদেশ বলে কোন কিছুই নেই। কোন বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি এটা বিশ্বাস করতে পারে না। এটা বেদুইন সর্দারের মনগড়া কথা।” (নাউযুবিল্লাহ)
এছাড়া আকবর মুহম্মদ, মোস্তফা, আহমাদ, ইত্যাদি নাম ধারণ নিষিদ্ধ করে দেয়। “বিস্মিল্লহির রাহমানীর রাহীমের” পরিবর্তে “আল্লাহু আকবর” প্রবর্তন করে। সিজদা প্রথা চালু করে। মদ বিক্রি জায়িয করে। বাঘ-ভাল্লুক খাওয়া হালাল করে। পুরুষের জন্য স্বর্ণ ও রেশমী কাপড় ব্যবহার জায়িয করে। মৃতদেহ পূর্বমুখী করে দাফন করার প্রথা চালু করে। গরুকে মা বলার নির্দেশ করে। অগ্নি পূজার প্রবর্তন করে। গো-মহিষ ভোজন নিষিদ্ধ করে। নামায নিষিদ্ধ করে।
পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতিভাত হয় যে হিন্দু এবং খ্রীষ্টান ঐতিহাসিকগণ যদিও আকবরকে মহামতি আকবর বলে অভিহিত করে থাকে কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে সে কোন মতেই ফিরআউনের চেয়ে কম নয়। সে কেবল খোদা তায়ালা বা তাঁর পেয়ারা রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিরুদ্ধে বলেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, এমনকি নিজে মুজাদ্দিদ, রসূল দাবী করেও ক্ষ্যান্ত হয়নি, ফিরআউনের মত খোদ খোদা দাবী করতেও ছাড়েনি। কিন্তু কথা হল, শুধু সে যুগেরই সাধারণ মানুষ নয় আজকেও অনেকে উপলব্ধি করতে পারছেনা যে আকবর আর ফিরআউনের মাঝে তফাৎ নেই আদৌ।
মূলতঃ ফিরআউনকে আল্লাহ্ পাক পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বিধায়ই মানুষ তার সম্পর্কে এত সহজে অবহিত হতে পেরেছে; কিন্তু একই আলোকে যদি তারা আকবর সম্পর্কেও চিন্তা করত তবে আকবরকে ফিরআউনের সমগোত্রীয় বলেই অনুভব করতে পারত। আবার আকবরের আমলের ওলামায়ে ‘ছূ’দের সম্পর্কেও মানুষ এযাবৎ যতটুকুইবা বুঝতে পেরেছে বর্তমানদের সম্পর্কে তাও বুঝতে পারছেনা। বর্তমান উলামায়ে ‘ছূ’রা ইসলামী রাজনীতির নামে যেভাবে গণতন্ত্র বা জুমহুরী করছে এবং এই গণতন্ত্রের রীতির জন্য বা দ্বীনে গণতন্ত্র তথা দ্বীনে জুমহুরীর নামে যেভাবে হারামকে হালাল করছে আর হালালকে হারাম করছে তা বাদশাহ আকবর ও তার চেলা উলামায়ে ‘ছূ’দের প্রবর্তিত দ্বীনে ইলাহীর চেয়ে কোন ভাবেই কম নয়। এখন প্রয়োজন শুধু ফিকির করা। এজন্য হাদীস শরীফে এসেছে, “কিছুক্ষণ সময় ফিকির করা। ষাট বছর নফল ইবাদতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।”
-মুহম্মদ কাওছার জামান, ঢাকা।
ইল্মে আক্বলিয়ার দৈন্য এবং বিলায়েতের অনুপস্থিতির কারণে প্রকৃত আলিমে দ্বীন তৈরী হচ্ছে না