মহান আল্লাহ্ পাক-এর অশেষ রহমতে গত সাত কিস্তি ধরে এই কলাম ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে। বাদশাহ্ আকবরের আমলে উলামায়ে “ছূ”রা যেমন রাজ অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য, রাজ ক্ষমতার শরীকদার থাকার জন্য বিস্ময়করভাবে হারামকে হালাল আর হালালকে হারাম করেছিলো, দ্বীন ইসলামকে বিক্রি করে, ঈমান বিক্রি করে দুনিয়া হাছিল করেছিলো তেমনি আজকের তথাকথিত শাইখুল হাদীস, মুফতী, মাওলানারাও ক্ষমতার মোহে, দুনিয়াবী ফায়দার লোভে কুরআন-সুন্নাহ্য় বিবৃত স্পষ্ট হারামকে হালাল করছে।
বাদশাহ্ আকবরের আমলের উলামায়ে “ছূ”রা করেছিলো দ্বীনে ইলাহী। আর বর্তমান যামানার উলামায়ে “ছূ”রা করছে দ্বীনে জুমহুরী। শরাব খাওয়া জায়িয, গো-হত্যা নিষেধ, পূজা করা জায়িয এগুলো ছিলো দ্বীনে ইলাহীর কায়েদা-কানুন। আর বর্তমান উলামায়ে “ছূ” প্রবর্তিত দ্বীনে জুমহুরীর কায়েদা-কানুন হচ্ছে, ছবি তোলা, নারী নেতৃত্ব সমর্থন করা, পর্দা প্রথা অস্বীকার করা, হরতাল করা, লংমার্চ করা, কুশপুত্তলিকা দাহ্ করা, ব্লাসফেমী, মৌলবাদ সমর্থন করা, ইসলামের নামে গণতন্ত্র তথা নির্বাচন করা ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রসঙ্গতঃ এ লিখার বিগত চতুর্থ কিস্তিতে মন্তব্য করা হয়েছিলো, “পাঠক! উপরে বর্ণিত সংক্ষিপ্ত উদাহরণ ও তথ্য পেশের পর আজকে আমরা গভীর দুঃখবোধের সাথে গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছি যে, বাদশাহ্ আকবরের আমলের মোল্লা মোবারক নাগরী ও তার দু পুত্র আবুল ফজল ও ফৈজী; যারা তাদের জীবদ্দশায় এক সময় তাদের ইলমের জন্য খুবই খ্যাত ছিল, ছূফী মনোবৃত্তিরও ছিল। যারা পীড়া-পীড়ি করা সত্ত্বেও সামান্য হাদিয়া গ্রহণ করত না, তারাই পরবর্তীতে এমনভাবে পদস্খলিত হয় যে, বাদশাহ আকবরের মত খোদাদ্রোহীর কাছ থেকে অর্থ লাভের মোহে আকবরের দ্বীনে ইলাহীর মত চরম ইসলাম বিরোধী ও বিদ্বেষী ধর্মমতকে তারা সমর্থন করে ও সক্রিয় তৎপরতা চালায়।”
ঠিক তদ্রুপ বলতে হয় যে, আজকের দ্বীনে জুমহুরী প্রবক্তাদের প্রতিভু তথাকথিত শাইখুল হাদীস নিজের হাতে পর্দা সম্পর্কে কিতাব রচনা করে, ছবি তোলা, পদপ্রার্থী হওয়া তথা নির্বাচন করা হারাম সে সম্পর্কে হাদীস শরীফের বঙ্গানুবাদ করে নিজেই আবার একসাথে মহিলা নেত্রীর সাথে ইফতার করে, পাশাপাশি চেয়ারে বসে বৈঠকের পর বৈঠক করে, একই গাড়ীতে পাশাপাশি চলাফেরা করে দাইয়্যূস ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে।
পাঠক! গত চতুর্থ কিস্তিতেও আমরা দেখেছি ৩৬, বাংলাবাজার ২য় তলা ঢাকা-১১০০ থেকে ডিসেম্বর ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত তথাকথিত শাইখুল হাদীস মাওলানা আজিজুল হক লিখিত “আল কুরআনের দৃষ্টিতে মহিলাদের পর্দা” শীর্ষক বইয়ে উক্ত তথাকথিত শাইখুল হাদীস কি জোরালোভাবে পর্দার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, “সারকথা, যেসব স্ত্রীলোকরা ভণ্ড, নামধারী পীর-ফকীরদের (তথা শাইখুল হদসের) সামনে আসেন তারা কঠিন গুণাহে লিপ্ত। আর এ জাতীয় পীর-ফকীর (তথা শাইখুল হদস আজিজুল হক) কস্মিনকালেও দ্বীনদার হতে পারেন না। বরং এরা স্পষ্ট ভণ্ড ও ফাসিক। কাজেই কোন অবস্থাতেই এদের মুরীদ হওয়া জায়িয হবেনা। দুর্ভাগ্যবশতঃ যদি কেউ এদের খপ্পরে পড়ে মুরীদ হয়ে গিয়ে থাকে তাদের জন্য আবশ্যক হবে, এদের (বর্তমান শাইখুল হদসের) বাইয়াত ছেড়ে দিয়ে হক্কানী ও দ্বীনদার আলিম বা পীর-মুর্শীদের শরণাপন্ন হওয়া।”(পৃষ্ঠা ৭৮, ৭৯)
কিন্তু হতাশার বিষয় হলেও সত্য যে, শাইখুল হদসের প্রিয় ছাত্ররা শাইখুল হদসের এরূপ শক্ত নির্দেশ মানতে আদৌ গা করছেনা। উল্টো ২৭ ও ২৮শে মার্চ তার হতভাগা ছাত্ররা তার দরসে বুখারীর পঞ্চাশ বছর পূর্তি পালনের কথা বলছে। অথচ তথাকথিত শাইখুল হাদীসের কিতাবের ভাষ্য অনুযায়ী সে এবং তার সমগোত্রীয় মুফতী, মাওলানারা স্পষ্ট ভণ্ড, ফাসিকরূপে প্রতিভাত। আর তার বক্তব্য মুতাবিক এরূপ ভণ্ড, ফাসিকদের আনুগত্যতা ছেড়ে দেয়া ফরজ, অনুসরণ করা হারাম।
প্রসঙ্গতঃ আরো উল্লেখ্য যে, গত ১৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তথাকথিত শাইখুল হাদীস ছাহেব তার সমগোত্রীয় মুফতী, মাওলানা নিকটতম আসনে বসে বর্তমান মহিলা প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতে দু’ঘন্টা আলাপচারিতা করেন।
এখানে অন্য সব বিষয় বাদ দিয়ে এই দেখা-সাক্ষাৎ কতটুকু নিন্দনীয় তা তথাকথিত শাইখুল হাদীসের অবুঝ ভক্তদের বিলম্বিত বোধোদয়ের জন্য হলেও তার রচিত “আল কুরআনের দৃষ্টিতে মহিলাদের পর্দা” শীর্ষক বই থেকে তুলে ধরা হলো –
হাদীসের আলোকে চোখের পর্দা
হযরত বুরায়দা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, “হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে বললেন, হে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! হঠাৎ একবার দেখার পর পুনরায় দেখবেন না। কেননা, আপনার জন্য প্রথম বারের অনুমতি রয়েছে এবং দ্বিতীয়বারের অনুমতি নেই।” (আহমদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, দারিমী। (আল কুরআনের দৃষ্টিতে মহিলাদের পর্দা/৭৩-৭৪ পৃষ্ঠা)
উল্লেখ্য, যেখানে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর মত ব্যক্তিত্ব হঠাৎ একবারের বেশী দু’বার দৃষ্টির অনুমতি পেলেন না সেখানে তথাকথিত শাইখুল হাদীসকে দু’বার নয় দু’ঘন্টায় দু’শরও বেশী এবং সব হিসেবে দু’লাখেরও বেশী তাকানোর অনুমতি ও ওয়াস্ওয়াসা কে দেয়? তা যে মূলতঃ ইসলামের দুশমন, শয়তান ছাড়া আর কেউ নয় সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
নিজেদের পূর্ববর্তীদের আদর্শ থেকে কতদূর পথভ্রষ্ট হয়েছে আজকের শাইখুল হদস।
মূলতঃ কথিত সকল জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত শুধু গত ১৩ মার্চের ছবিই নয় ইতোপূর্বে তথাকথিত জাতীয় দৈনিকসমূহ সহ অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় তথাকথিত শাইখুল হাদীস, মুফতী, মাওলানাদের খুব কাছাকাছি নারী নেত্রীত্বের সাথে চোখে চোখ রেখে দীর্ঘক্ষণ আলাপচারিতার খবর ছবিসহ ছাপা হয়েছে। আর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এসব ঘটনা ছাড়াও এখন তারা প্রায়ই এরূপ খোলামেলা বেপর্দা মিটিং করে থাকেন এবং উক্ত মহিলা নেত্রী ছাড়াও আরো অন্যান্য মহিলাদের সৌন্দর্য উপভোগ করে থাকেন। অথচ এরূপ বেপর্দা হওয়া তার মত ব্যক্তিত্বের পক্ষে কতদূর ধৃষ্টতা ও গোমরাহী তথা আক্ষেপজনক সে প্রসঙ্গে তথাকথিত এই শাইখুল হাদীস নিজেই তার রচিত আল কুরআনের দৃষ্টিতে মহিলাদের পর্দা শীর্ষক বইয়ে ৮১-৮২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, “হক্বপন্থী পীর-মুর্শিদগণ সর্বদা আল্লাহ্ পাক-এর ভয় এবং আখিরাতের চিন্তায় নিমগ্ন থাকেন। কোন মহিলা মুরীদের সাথে মুছাফা করা বা তার শরীর স্পর্শ করা বা নিজের শরীর স্পর্শ করতে দেয়া তো দূরের কথা নিজের সামনেও তাদের আসতে দেন না। বরং পর্দার আড়াল থেকে তা’লীম, তালকীন দিয়ে থাকেন। আমাদের সিলসিলার প্রসিদ্ধ বুযূর্গ হযরত মাওলানা খলীল ছাহেব মুহাজেরে মদনী রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন মহিলাদের বাইয়াত করতেন তখন মাঝে পর্দা থাকা সত্ত্বেও মহিলাদের দিকে পিঠ দিয়ে বসতেন এবং তা’লীম-তালক্বীন করতেন। একদা এভাবেই কোন এক এলাকাতে মহিলাদেরকে বাইয়াত করছিলেন তখন জনৈকা মহিলা আরজ করলেন যে, মাঝে যখন পর্দা রয়েছে তারপরেও অন্যদিকে ফিরে বসার প্রয়োজন কি? জবাবে তিনি বললেন, তোমরা কি করে বুঝলে আমার মুখ কোন দিকে রয়েছে বোঝা যায় যে, পর্দার আড়াল থেকেও উকি দিয়ে তোমরা আমাকে দেখে ফেল। এজন্যই আমি পর্দার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে থাকি। আমাদের আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত সিলসিলার আর এক বুযূর্গ সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, একবার জনৈকা বয়স্কা নারী তার অল্প বয়স্কা পুত্রকে নিয়ে কোন প্রয়োজনে তার খিদমতে হাজির হওয়ার প্রার্থনা করলেন। স্ত্রী লোকটি পূর্ব থেকেই তাঁর মুরীদ ছিলেন। কিন্তু তিনি তাকে খিদমতে হাজির হওয়ার অনুমতি না দিয়ে বলে পাঠালেন যে, বালেগ মুহরিম সাথে নিয়ে এসো, তারপর তোমার বক্তব্য শুনবো। এটাই হলো হকপন্থীদের আদর্শ এবং পর্দার প্রতি যতœ নেয়ার নিদর্শন।”
পাঠক! আমাদের কথাও তো তাই। আর বর্তমানে এই কথিত হক্বপন্থীদের নিদর্শন থেকে তথাকথিত শাইখুল হাদীস নিজেই কত দূরের গোমরাহ্, চরম ফাসিক ও উলামায়ে “ছূ”তে পর্যবসিত হয়েছে তা বিচারের ভার পাঠকের উপরেই রইল।
তথাকথিত শাইখুল হাদীস ওরফে শাইখুল হদসের যেসব ছাত্র বলেছেন যে, হাদীসে পর্দার কথা থাকলেও বর্তমান প্রয়োজনে শাইখুল হাদীসসহ মুফতী, মাওলানা পর্দা তরক করছেন’ তাদের জবাবে খোদ হদস তার রচিত “আল কুরআনের দৃষ্টিতে মহিলাদের পর্দা” বইয়ে বলেন-
“যারা এ ধরণের অজুহাত পেশ করেন তাদের উচিত মানবীয় নির্দেশ ও আল্লাহ্ পাক-এর নির্দেশের মধ্যে পার্থক্য উপলব্ধি করা। একজন মানুষের অনুরোধ বা নির্দেশ মানবীয় সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে নয়। এ প্রসঙ্গে হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, মানুষের কোন কাজ মাত্রই সঠিক কিংবা ভুল হতে পারে। কোন মানুষের কথা গ্রহণ অথবা প্রত্যাখান করার ব্যাপারে আপনি স্বাধীন কিন্তু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণীর ব্যাপারে এটি প্রযোজ্য নয়। অতএব, আমরা যখন মানুষের নির্দেশ নিয়ে কথা বলবো, তখন হেতু খুঁজে না পাওয়া কিংবা বিষয়টি বুঝে না আসা ইত্যাদি উক্তি করা দোষের কিছু নয়। তবে যদি কোন ঐশী নির্দেশ হয় এবং মহান আল্লাহ্ পাক প্রদত্ত পবিত্র কুরআন শরীফে উল্লেখ থাকে ও হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীস শরীফে বর্ণিত হয় তখন ‘আমার বুঝে আসেনা’ এ ধরণের উক্তি করার কোন অবকাশ নেই।” বিশেষ করে আল্লাহ্ পাক-এর নির্দেশ সংশোধন বা সমালোচনা করতে নিজেকে বিচার বিশ্লেষণ কারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ করা থেকে বিরত রাখ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক তাঁর পবিত্র কালাম পাকে ইরশাদ করেন, “আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করার কোন এখতিয়ার নেই যে, আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্যে পথ ভ্রষ্টতায় পতিত হয়।” (সূরা আহযাব/৩৬)
অর্থাৎ আজকের তথাকথিত শাইখুল হাদীস ছাহেব তার নিজস্ব জবানবন্দিতে পবিত্র কুরআন শরীফের আয়াত শরীফ ও হাদীস শরীফের স্পষ্ট নির্দেশের প্রেক্ষিতে একজন শেষ স্তরের গোমরাহ্, পথভ্রষ্ট ও চরম ফাসিক তথা খাছ উলামায়ে “ছূ”র অন্তর্ভুক্ত। তার আমল তাকে তথাকথিত শাইখুল হাদীসের তবকা থেকে বিচ্যুত করে, পর্যবসিত করেছে শাইখুল হদসে অর্থাৎ নাপাকির উস্তাদরূপে। আর তার দিল নাপাকের আধার বলেই দ্বীন ইসলাম বাদ দিয়ে সে করলে দ্বীনে জুমহুরী বা দ্বীনে গণতন্ত্র।
-মুহম্মদ কাওছার জামান।