গত পর্বের আলোচনায় আমরা প্রমাণ পেয়েছিলাম, বাদশাহ্ আকবরের আমলের উলামায়ে “ছূ”দের বংশবদ তথা ক্বায়িম-মোক্বাম এ যুগে যথাযথভাবে বিরাজ করছে। রয়েছে মোল্লা মোবারক নাগরী, আবুল ফযল, মখদুম-উল-মূলক, মোল্লা শিরী, নামধারী পীর আমানউল্লাহ্ পানিপথি, কাজী আবদ-উশ-সামস, আর্ব্দু রহমান-এর উত্তরসূরী আজকের তথাকথিত জাতীয় খতীব, শাইখুল হদস, মুফতী কমিনী, মাহিউদ্দীন, ফুযুল গারীম, মাওলানা মন্ত্রী, ঐতিহ্যবাহী এক সিলসিলার পথবিচ্যূত হাদী ছাহেব। বাদশাহ্ আকবরের আমলের উলামায়ে “ছূ”রা করেছিলো দ্বীন-ই-ইলাহী আর আজকের উলামায়ে “ছূ”রা করছে দ্বীন-ই-জুমহুরী । উল্লেখ্য, বাদশাহ্ আকবরের আমলের উলামায়ে “ছূ”রা মাহযার নামা করেছিলো। তাতে আকবরের আমলের ছানা-ছিফত করেছিলো। আকবরের সমস্ত হারাম-কুফরী কাজ তথা দ্বীন-ই-ইলাহী তারা সমর্থন করেছিলো। এবং মাহ্যার নামার শেষে বলেছিলো, “… যেহেতু শাহানশাহ্ আকবর একজন অনন্য সাধারণ ন্যায় বিচারক ও অসীম ধৈর্য্যশক্তি সম্পন্ন মহাপুরুষ। সেহেতু যেসব ধর্মীয় বিধানে পূর্ববর্তী মুজতাহিদ ইমামগণ একমত হতে পারেনি সেসব ব্যাপারে অর্থনৈতিক উন্নতি ও পার্থিক সুবিধার প্রতি লক্ষ্য রেখে শাহানশাহ্ আকবর একটি দিককে প্রাধান্য দিলে অথবা নতুন কোন ফরমান জারী করলে অম্লান বদনে মেনে নেয়া এবং তদানুসারে আমল করা জনগণের অবশ্য কর্তব্যরূপে নির্ধারিত হবে আর তার বিরোধিতা করা দুনিয়া ও আখিরাতের বরবাদী ছাড়া কিছুই নয়।” অর্থাৎ দ্বীন ইসলাম সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে ও বিক্রি করে তৎকালীন উলামায়ে “ছূ”রা বাদশাহ্ আকবরের সাথে জোট বেধেছিলো। ঠিক তদ্রুপ এ যুগের উলামায়ে “ছূ”রা করেছে চার দলীয় ঐক্যজোট। এবং তাতে তারা লিখিতভাবে স্বাক্ষরও করেছে। একে তারা নাম দিয়েছে চার দলের যৌথ ঘোষণা তথা ইশতিহার। কিন্তু মানে-গুণে তা যেন ইসলামের দৃষ্টিতে বাদশাহ্ আকবরের ঘৃণ্য মাহযার নামাকেও হার মানিয়েছে। এটা এ অর্থে যে, বাদশাহ্ আকবরের মাহযার নামায় পুরোটা শক্ত কুফরী থাকলেও সেখানে ইসলামকে স্মরণ করা হয়েছে। সেখানে কুরআন শরীফের আয়াত শরীফ উল্লেখ করা হয়েছে, হাদীস শরীফ দেয়া হয়েছে। যদিও তার যথাযথ প্রয়োগ হয়নি এবং তা গ্রহণযোগ্যও নয়।
কিন্তু দ্বীন-ই-ইলাহীর আদলে আজকে যারা দ্বীন-ই-জুমহুরী করেছে তাদের যৌথ ঘোষণায় বাদশাহ্ আকবরের চেয়েও বেশী কুফরী তো রয়েছেই বরং আরো একটি দিকে বেশী ঘাটতি রয়েছে যে, তাতে কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফের কথা মোটেই নেই। চারদলীয় জোটের ইসলাম পন্থীরা এখনও জোর গলায় দাবী করে থাকে যে, ‘এবারের নির্বাচনে তারা (স্ব-ঘোষিত ইসলামপন্থীরা) চারদলীয় জোটের সাথে ছিলো বলেই তাদের বিজয় এত সুনিশ্চিত হয়েছে।’
এতদ্বপ্রেক্ষিতে পর্যবেক্ষক মহল যখন তাদের কাছে বর্তমান সরকারের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রযন্ত্রে অনৈসলামী কাজের ফিরিস্তি তলব করেন তখন আবার তারা সুর পাল্টে বলেন, ‘আমরা চার দলীয় জোটে আছি কিন্তু সরকারে নেই।’ অর্থাৎ এ কথা বলে তারা ইসলামপন্থী সাধারণ মানুষের কাছে তাদের নিজেদের ইসলামী খোলশটি ধরে রাখতে চায়। কিন্তু সেটা তাদের সাজানো ধোকা হতে পারে, ইনিয়ে-বিনিয়ে কথামালা হতে পারে কিন্তু ইসলামের মানদণ্ডে কি তাতে পার পাওয়া যায়?
উল্লেখ্য, সেই যৌথ ঘোষণায় প্রায় ৩০টি অনুচ্ছেদ থাকলেও কেবল মাত্র একটি সংক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদে ইসলামের কথা বলা হয়েছে। তাও সেখানে ইসলামের সাথে অন্য সব ধর্মকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। বলা হয়েছে, “যেহেতু সরকার ইসলামী মূল্যবোধ এবং সকল ধর্মবিশ্বাস আচার-আচরণ … উপর ক্রমাগত আঘাত হেনে চলছে।”
অর্থাৎ এখানে শুধু ইসলামের কথাই বলা হয়নি বরং হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, ইহুদী, শিখ সব ধর্মবিশ্বাস এবং আচার প্রথার কথাই তুলে ধরা হয়েছে এবং ইসলামকে তাদের কাতারে পর্যবসিত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, চরম অবিশ্বাস্য হলেও চার দলীয় জোটের ঘোষণায় ইসলামের কথা বলতে এতটুকুই উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে দ্বীনে গণতন্ত্র তথা দ্বীন-ই-জুমহুরী ও তার সমার্থক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে শ’য়েরও বেশী। আর সে প্রেক্ষাপটে এই আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়েছে চারদলীয় জোট করা হয়েছে তাতে ইসলামের উপর যে আঘাত আসছে, হাজার হাজার অনৈসলামিক আইন চালু আছে, বেপর্দা, বেহায়াপনা, সুদভিত্তিক অর্থনীতি, পাশ্চাত্য ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা, রেডিও, টেলিভিশন, ভিডিও, সিডি ইত্যাদিতে দেশ ছেয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে কোন অনুচ্ছেদ ছিলনা। কেবল কলেবর বৃদ্ধির জন্য তা এখানে উল্লেখ করা হলো না। পাশাপাশি চারদলীয় জোট ক্ষমতায় গেলে কি করবে সে ফিরিস্তির মাঝেও ইসলামের কোন গন্ধ ছিলোনা। পাঠকের আদালতে নিম্নে তা পেশ করা হলো- “……. সেহেতু আজ সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, কৃষিজীবী, প্রকৌশলী, শিক্ষক, আলেম-উলামা, ডাক্তার, আইনজীবী, ছাত্র-যুবক, শ্রমিক, মহিলা, সংস্কৃতিসেবী ও অন্যান্য সকল শ্রেণীর জনসাধারণের একটিমাত্র দাবি। আর তা হলো, বর্তমান সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগ করে সাংবিধানিক নিয়ম মুতাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সর্বাগ্রে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। আমাদের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জাতীয় অর্থনীতি আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত রক্ষার এটাই আজ একমাত্র শান্তিপূর্ণ সাংবিধানিক পথ।
একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে এসে আমরা এক বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ন্যূনতম পর্যায়ের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতি গঠন প্রক্রিয়াকে সমুন্নত রেখে জাতীয় স্বার্থরক্ষা করে আমাদের বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় শামিল হতে হবে। তাই আমাদের চার দলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এই যে, যথাসত্ত্বর ব্যাপক ঐক্যের ভিত্তিতে একটি দেশপ্রেমিক ও সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল শক্তিশালী সরকার গঠন করে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। এই ভবিষ্যত সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার। সংবিধানের এই মূলনীতি সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন কঠোর হস্তে দুর্নীতি দমন, প্রশাসনিক শৃঙ্খলার পুনরুদ্ধার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা, বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল, শিক্ষার মান ও পরিবেশ পুনরুদ্ধার, প্রকৃত অর্থে সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সহনশীলতা প্রতিষ্ঠা, রেডিও-টেলিভিশনের স্বাধীনতা প্রদান, দেশীয় শিল্পের বিকাশ ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, সর্বক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক মান ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, মানব সম্পদ উন্নয়ন, সংবিধান সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের মূলনীতিগুলোর বাস্তবায়ন ও সুরক্ষা, কৃষক-শ্রমিকের ভাগ্যোন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচন, বিপুল বেকার যুব সমাজের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান, মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রেখে সকল জনগণের সঞ্চয় ও জীবন মানের সুরক্ষা, নারী সমাজের অধিকার, মর্যাদা ও ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া এবং শিশুদের সুন্দরতম জীবন বিকাশের সুযোগ নিশ্চিতকরণ, জাতীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণ, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও বহুমুখী শক্তি সঞ্চয়, প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার ও সুনিয়ন্ত্রণ, সংবিধানের মূলনীতি পরিপন্থী সকল আইন সংশোধন, সর্বসম্প্রদায়ের নাগরিকের জন্য আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা বিধান এবং জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ গতিশীল পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা।
আমাদের সমগ্র জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধ। আমাদের অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনের জয় হবেই, ইনশাআল্লাহ্। …….”
উল্লেখ্য, উল্লিখিত প্রস্তাবনা পাঠ করলে আর ভারতের বিজেপি কংগ্রেস, ইংল্যান্ডের লেবার পার্টি, টোরিদল, আমেরিকার ইহুদী-নাছারাদের ডেমোক্রোট বা রিপাবলিকিশন তথা পৃথিবীর বিধর্মীদের রাজনৈতিক দলসমূহের প্রস্তাবনা পাঠ করলে কোন পার্থক্য লক্ষ্য করার অবকাশ নেই। অথচ দেশের ইসলামপন্থীরা ইসলামের কথাই এতদিন যাবত সাধারণ মুসলমানদের কাছে বলে আসছে, ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়ন করার কথা বলেই তারা ইসলামী রাজনৈতিক দল তথা ইসলামী রাজনীতিক হিসেবে নিজেদের অবস্থান দাঁড় করিয়েছে। সেক্ষেত্রে চারদলীয় জোটের নামে এরূপ ঘোষণায় স্বাক্ষর করা মূলতঃ ইসলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করা। আর সেই প্রতারণা আরো শক্ত প্রতারণারূপে বিবেচ্য হচ্ছে যেহেতু তাদের কথিত চারদলীয় জোট সরকার এখন ক্ষমতায় কিন্তু জোট সরকারের কর্মসূচী ও গৃহীত পদক্ষেপ কোনটাতেই ইসলামের নাম নেই কিন্তু তারপরেও তারা বলে যাচ্ছে যে, তারা তথাকথিত ইসলামপন্থীরা ইসলামের কারণেই চার দলীয় জোটকে সমর্থন দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে।
মূলতঃ পৃথিবীর ইতিহাসে সৃষ্টির শুরু হতে এযাবতকালে এটাকেই উল্লেখ করতে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিথ্যা, ধোকা ও প্রতারণাপূর্ণ কথা।
আরো উল্লেখ্য যে, বর্তমান সরকারকে কথিত চারদলীয় জোটের তথাকথিত ইসলামী দল বা ইসলামপন্থী নীতিগতভাবে সরকারকে ইসলামীকরণ করার জন্য চাপ দিতে সম্পূর্ণরূপে অক্ষম। এবং ইসলামের নামে ভোট দিয়ে গঠিত বর্তমান তথাকথিত ইসলামপন্থী দলের সমর্থনে সরকারের কাছে স্বভাবতঃই ইসলাম প্রিয় সাধারণ মানুষ ইসলামী আবহ আশা করে। কিন্তু প্রশাসন, সামাজিক বলয় তথা জনজীবনের কোথাও সেরূপ কিছুই চোখে পড়ে না। দেশে সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, শরাব, জুয়া, টিভি, ভিসিআর, ডিস, বেপর্দা, বেশরা কোন কিছুরই আদৌ কমতি হয়নি। বরং খুন, রাহাজানি, নারীর সম্ভ্রম হরণ, সন্ত্রাস তথা যাবতীয় অনৈসলামিক আবহ আগের থেকে অপেক্ষাকৃত বেড়েছে। অবস্থা দৃষ্টে অসহায় মানুষের তাই মনের গভীর থেকে বেরিয়ে আসে ক্ষব্ধু প্রশ্ন; এ অবস্থা দেখার জন্য তো তারা ইসলামী দাবীকারী দলকে সমর্থন দেয়নি। তবে বর্তমান সরকারের সমাসীন ইসলামী দাবীকৃত দলের নেতৃত্ব ক্ষমতাসীন সরকারকে কেন চাপ দিচ্ছেনা? আসলে এ প্রশ্নটি সাধারণের কাছে যৌক্তিক হলেও প্রকৃতভাবে তা জোট সরকারের শরীক দাবীকৃত ইসলামী দলগুলোর জন্য মোটেই যৌক্তিক নয়। কারণ এ দলগুলো নির্বাচন পূর্বে যে চারদলীয় ঐক্যজোট করেছিলো সে ঐক্যজোটের ইশতিহারে কোন ক্ষেত্রেই ইসলামীকরণের কোন শর্ত ছিলোনা। যা ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ‘দৈনিক আল ইহ্সানে’ এক মন্তব্য প্রতিবেদনের শিরোনাম দেয়া হয়েছিলো, ‘চারদলীয় জোট; নিয়তই যার গলদ, আমল তার ছহীহ্ হয় কি করে?’ মূলতঃ চারদলীয় জোটের ইশতিহারে ইসলামী করণের কোন শর্ত তো ছিলইনা বরং এক্ষেত্রে যেসব পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা প্রচলিত দ্বীনে গণতন্ত্র তথা দ্বীনে জুমহুরীতে জায়িয হতে পারে কিন্তু ইসলামের পরিভাষায় তা সম্পূর্ণই কুফরী আগামী সংখ্যায় আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ্। সুতরাং যা বলতে হয় যে, বাদশাহ্ আকবরের আমলের উলামায়ে “ছূ”দের বর্তমান বংশধররা দ্বীন-ই-ইলাহীর আদলে ইসলামকে বিসর্জন দিয়ে ও বিকৃত করে দ্বীন-ই-ইসলামের পরিবর্তে বর্তমানে দ্বীন-ই-জুমহুরী প্রবর্তন করেছে। চারদলীয় ঐক্যজোটের ইশতিহারে তার প্রমাণ বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
-মুহম্মদ কাওছার জামান, ঢাকা।