‘ইরাক যুদ্ধ বিরোধী’ তথাকথিত মহাসমাবেশ ও প্রসঙ্গ কথা

সংখ্যা: ১১৬তম সংখ্যা | বিভাগ:

          সময়টা আখিরী যামানা। চারদিকে লৌকিকতা। ভিতরে আন্তসারশূন্যতা। রূহানীয়ত আর খুলূছিয়ত হীনতা। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, আখিরী যামানার মসজিদগুলো বিশাল, সুদৃশ্য, আড়ম্বরপূর্ণ অট্টালিকা হবে কিন্তু সেগুলো খুলূছিয়ত যুক্ত ইবাদত থেকে বঞ্চিত থাকবে। আখিরী যামানার সবক্ষেত্রেই, বিষয়েই এ রূহানীয়ত আর খুলূছিয়তের অভাব। এমনকি ঐতিহ্যগতভাবে যারা রূহানীয়তের দাবীদার ছিলেন প্রতিভাত হয়, তাদের অন্তরও মরে গেছে। রূহানীয়তের পরিবর্তে লৌকিকতা আর হুযূগে মাতাল মনোবৃত্তিই তাদের আবেষ্টন করে ফেলেছে।       গত ৬ মার্চ ইরাক যুদ্ধ বিরোধী তথা কথিত মহাসমাবেশে তাদের আহ্বান, সার্বিক তৎপরতা তাই প্রমাণ করেছে। পত্র-পত্রিকায় খুব ঢালাওভাবে প্রচার করে তথাকথিত খেলাফত মজলিস, ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামী ছাত্র পরিষদ, জমিয়াতুল মোদাররেছীন, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ইত্যাদির পাশাপাশি তথাকথিত পীর ছাহেবরাও উক্ত মহাসমাবেশের পক্ষে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তারা হৃদয়ঙ্গম করলেন না যে, কি উদ্দেশ্যে এই মহাসমাবেশ? কি তার বক্তব্য এবং কেমন তার কার্যক্রম? আর কিইবা তার পরিণতি? ফলতঃ যা হবার তাই হয়েছে। তথাকথিত মহাসমাবেশে কেবল কিছু লোকেরই সমাবেশ হয়েছে। কিন্তু তার দ্বারা ইসলামী জজ্বা, ঈমানী চেতনা তথা জিহাদী প্রেরণার বিস্তার হয়নি আদৌ। বরং উল্টো বিবিধ হারাম কাজের প্রেক্ষিতে ইসলামী মূল্যবোধের অবমূল্যায়ন হয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলো-

নিয়ত-ই-যার গলদ

প্রায় সমস্ত হাদীস শরীফের কিতাবে প্রথম যে হাদীস শরীফটি উল্লেখ করা হয় তাহলো, “নিশ্চয়ই কর্মের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” আর তথাকথিত এই মহাসমাবেশের নিয়ত সম্পর্কে গত ২০শে মার্চ তারিখে একটি দৈনিকে মন্তব্য করা হয়, “সারাবিশ্বের লাখ লাখ শান্তিকামী মানুষের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে এই প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে।” (দৈনিক ইনকিলাব)

এখানে বিবেচ্য বিষয় যে, খোদ লন্ডনে বিশ লক্ষাধিক,  রোমে ত্রিশ লাখ, নিয়ইউর্কে এক লাখ লোকের, সিডনীতে আড়াই লাখ লোকসহ সারাবিশ্বের ছয় শতাধিক শহরে লাখ লাখ লোকের যে সমাবেশ হয়েছে তারই অনুসরণে তারা এই মহাসমাবেশ করতে অনুপ্রাণিত হয়েছে।

উল্লেখ্য, বিশ্বের কথিত অপরাপর লোকদের প্রায় অধিকাংশই ছিলো খ্রীষ্টান তথা তথাকথিত মানবতাবাদী। আর তাদের দ্বারাই মহাসমাবেশের প্রবক্তরা প্রভাবিত হয়েছে। নিজস্ব ইসলামী মূল্যবোধ বা ঈমানী চেতনার দায়বদ্ধতার কথা তাদের ভাষায় নেই। উল্লেখ্য, একজন কাফির খাবার খায়। আর একজন মুসলমানও খাবার খান। কিন্তু এ দু’জনের খাবার গ্রহণকে কি এক বলা যায়? মূলতঃ কখনও তা এক ভাবে মিলিয়ে ফেলা যায়না। একজন মুসলমান আল্লাহ্ পাক-এর ইবাদতের জন্য, সুন্নত হিসেবে সুন্নতী তরীক্বায় খাবার খান। পক্ষান্তরে কাফির আল্লাহ্ পাক-এর নাম না নিয়ে জবাই করা প্রাণী তথা হারাম প্রাণীর খাবার বাম হাতে আমোদ-স্ফূর্তির জন্য খেয়ে থাকে। তেমনি কাফিররাও শান্তিকামী হতে পারে। কিন্তু তাদের শান্তি কামনা আর মুসলমানদের শান্তি কামনা বা তার প্রক্রিয়া এক হতে পারে না। যেমন, অনেক কাফির মহিলারা সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে ইরাক যুদ্ধের বিপক্ষে শান্তির পক্ষে নিজেদেরকে নিয়োগ করেছে। সুতরাং যদি বলা হয় যে, বিশ্বের অপরাপর শান্তিকামী মানুষের পক্ষে সংহতি প্রকাশ করে এই তথাকথিত মহাসমাবেশ তাহলে এই বিবস্ত্র হওয়ার প্রক্রিয়ার সাথেও একাত্মতা প্রকাশ করা হয়। সুতরাং আগ্রাসন প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির এই বক্তব্য “সারাবিশ্বের লাখ লাখ শান্তিকামী মানুষের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে এই প্রতিবাদ” এই বক্তব্য অবশ্যই ইসলামের দৃষ্টিতে ঘোর আপত্তিকর।

বরং বাঞ্ছিত ছিলো, “ইসলামের নির্দেশ মানতে, মুসলমানদের হক্ব আদায় করতে এই প্রতিবাদী মহাসমাবেশ” তা ব্যক্ত করা। যেমন, কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়োনা বরং একত্রিত হয়ে আল্লাহ্ পাক-এর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর।” হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “সমস্ত মুসলিম ভাই ভাই। সমস্ত মুসলমান একটি দেহের ন্যায়। দেহের একাংশে আঘাত লাগলে যেমন তা দেহের অন্যত্র সংক্রমিত হয় তেমনি কোন মুসলমান আক্রান্ত হলে তা অন্য মুসলমানকেও আক্রান্ত করে।”

মূলতঃ এরূপ অনেক অনেক আয়াত শরীফ ও হাদীস শরীফ রয়েছে। কিন্তু নামধারী সকল মাওলানা, মুফতী, খতীব আর তথাকথিত শাইখুল হাদীস ছাহেবদের সক্রিয় তৎপরতা থাকলেও কারো নজরে বিষয়টি আসেনি, কারো সমঝে-আক্বলে তা ধরেনি। কারো হৃদয়পটে তা উদিত হয়নি। কারণ মূলতঃ সেই রূহানীয়ত, খুলূছিয়তহীনতা, লোক দেখানো প্রবণতা।

ফলতঃ নেকীর পরিবর্তে বদ্ আক্বীদা ও আমলের দ্বারা শেষ হয়েছে তাদের এই তথাকথিত মহাসমাবেশ।

তথাকথিত মহাসমাবেশের আহ্বান ও বক্তব্য

আল্লাহ্ পাক ইরশাদ ফরমান, “আপনাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট হননি, বিপথগামীও হননি এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেননা বরং কুরআন শরীফ ওহী যা প্রত্যাদেশ হয়।”      আল্লাহ্ পাক আরো ইরশাদ করেন, “হে মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! নিশ্চয়ই আপনি ওহী ব্যতীত কোন কথা বলেননি।” কাজেই মুসলমানদের প্রতিটি কথা হতে হবে কুরআন-সুন্নাহ্ সমর্থক। কিন্তু তথাকথিত মহাসমাবেশের প্রাক্কালে তারা যে আহ্বান করেছেন তথা সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন বা ঘোষণা পাঠ করেছেন তা মোটেও কুরআন-সুন্নাহ্র সমর্থক নয়। যেমন, সমাবেশের প্রাক্কালে তারা আহ্বান করেছেন, “যুদ্ধ সমাধান নয় সমস্যা বাড়িয়ে দিবে।” (দৈনিক সংগ্রাম-২০ ফেব্রুয়ারী/’০৩) এবং কমিটির প্রধান কো-কনভেনর আর্ব্দু রউফ ছাহেবের বক্তব্য ছিলো, “মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখা প্রয়োজন। যুদ্ধে কোন সমাধান হবে না। বরং যুদ্ধ পৃথিবীকে নানা সমস্যায় জর্জরিত করে তুলবে। মানবিক দিক বিবেচনা করে দলমতের উচিৎ যুদ্ধকে প্রতিহত করা। তিনি আরো বলেন, ধ্বংস ও ষড়যন্ত্রের পথ রুদ্ধ হোক, শান্তির পায়রা উড়ুক সারাবিশ্বে। শান্তির শত ফুল প্রস্ফুটিত হোক এবং মানবতা উজ্জীবিত হোক। বিবেকের বাণী চারিদিকে প্রসারিত হোক। বিচারপতি আব্দুর রউফ বলেন, ‘যুদ্ধ মানবসভ্যতা রক্ষা করতে পারেনা। আমরা বারুদের গন্ধ চাইনা, যুদ্ধকে ঘৃণা করি। যুদ্ধকে যে কোন মূল্যে রুখতে হবে। যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বিশ্বে শান্তি আনতে হবে।’ (দৈনিক ইত্তেফাক-৭ মার্চ/’০৩) কমিটির অপর কো-কনভেনর অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘গোটা বিশ্ব আজ মহাসংকটে। বিশ্বের শান্তির বিরুদ্ধে, মানবতা ও ন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং সভ্যতার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে এই সংকট সৃষ্টি করেছে। এ মুহূর্তে বিশ্বের শত কোটি মানুষ যুদ্ধের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ও সোচ্চার। তিনি বলেন, মানুষ চায় যুদ্ধ নিপাত যাক। ওআইসি সহ আন্তর্জাতিক জোট সংগঠন ও সংস্থার প্রতি এই মর্মে আহ্বান জানান যে, যুদ্ধকে আমরা ঘৃণা করি। যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তি ফিরিয়ে আনুন।      উবায়দুল হক বলেন, ‘যুদ্ধের বিরুদ্ধে আজ বিশ্ব জেগেছে।’ (দৈনিক ইত্তেফাক-৭ মার্চ/’০৩)          উল্লেখ্য, তথাকথিত এই মহাসমাবেশের দাবী যা ‘ঢাকা ঘোষণা’ বলে প্রচার করা হয়। তাতে বলা হয়, বিশ্ববাসী ইতোমধ্যেই বুশ ও ব্লেয়ারের যুদ্ধবাজনীতি প্রত্যাখান করেছে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে সর্বত্র প্রদর্শিত হচ্ছে প্রবল বিক্ষোভ। খোদ মার্কিন মুলূকেও শান্তিকামী লাখ জনতা আজ শামিল হয়েছে এই শান্তির মহামিছিলে। জাতিসংঘের মাধ্যমে সকল সমস্যার সমাধান কামনা করে বলা হয়, যুদ্ধ নয় শান্তি চাই।”

তথাকথিত মহাসমাবেশের বক্তব্য এবং গৃহীত ঢাকা ঘোষণার দ্বারা ইসলামী জজ্বা, ইসলামের প্রাণ জিহাদী চেতনা  অবলুপ্ত করার ছলনা

মূলতঃ উপরের তথাকথিত মহাসমাবেশের বক্তব্য আপাত মধুর হলেও তার সাথে ইসলামী আদর্শের সংঘাত বিদ্যমান। তথাকথিত মহাসমাবেশের নেতারা ও বক্তারা বিশ্বের অপরাপর তথাকথিত মানবতাবাদী ও কাফিরদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই মহাসমাবেশ করার ফলে এবং তাদের সূরেই আওয়াজ তোলার ফলে তারা বেমালুম বিস্মৃত হয়েছেন যে, কি তারা বলেছেন অথবা তাদের কথায় কি প্রকাশ পেয়েছে বা তার পরিণতি কি হতে পারে?

মূলতঃ তথাকথিত মহাসমাবেশের বক্তাদের কক্তে এই সূরই ধ্বনিত হয়েছে যে, ‘যুদ্ধ সভ্যতা ধ্বংস করে, যুদ্ধ মানবতা বিধ্বংসী।’ বলাবাহুল্য, এই দৃষ্টিভঙ্গি, এই প্রচারণা অনুযায়ী ইসলামের দৃষ্টিতে যা জিহাদ বলে গণ্য তাও এই কথিত যুদ্ধের পর্যায়েই পড়ে। সুতরাং ঢালাওভাবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে বলে, যুদ্ধকে মানবতা বিরোধী বলে কি মূলতঃ জিহাদের পথই রুদ্ধ করে দেয়া হলোনা? অথচ জিহাদ করা আল্লাহ্ পাক-এর আদেশ। আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন, “আর তোমরা জিহাদ কর আল্লাহ্র ওয়াস্তে তাদের সাথে, যারা যুদ্ধ করে তোমাদের সাথে।” (সূরা বাক্বারা/১৯০) “তোমাদের উপর জিহাদ ফরয করা হয়েছে অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়।” (সূরা বাক্বারা/২১৬)  “আল্লাহ্ পাক-এর পথে জিহাদ কর এবং জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ পাক সবকিছু জানেন।”(সূরা বাক্বারা ২৪৪) “তোমাদের কি ধারণা, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ আল্লাহ্ পাক এখনও দেখেননি তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদ করেছে এবং কারা ধৈর্য্যশীল।” (সূরা আলে ইমরান/১৪২) “কাজেই আল্লাহ্ পাক-এর কাছে যারা পার্থিব জীবনকে আখিরাতের পরিবর্তে বিক্রি করে দেয় তাদের জিহাদ করাই কর্তব্য।” (সূরা আন্ নিসা/৭৪)         আর হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি যেই জিহাদে বের হব প্রত্যেক মু’মিনই সেই জিহাদে অংশগ্রহণে উদগ্রীব হয়ে পড়বে। …… নতুবা আমি শপথ করে বলছি, জিহাদযাত্রী প্রত্যেক দলের সঙ্গেই আমি যাত্রা করতাম। আমি ঐ মহান আল্লাহ্ পাক-এর শপথ করে বলছি, যার হাতে আমার প্রাণ। আমার আন্তরিক বাসনা আল্লাহ্ পাক-এর রাস্তায় শহীদ হই। অতঃপর জীবিত হয়ে আসি এবং পুনরায় শহীদ হই। অতঃপর জীবিত হয়ে আসি এবং পুনরায় শহীদ হই। অতঃপর জীবিত হয়ে আসি এবং শহীদ হই।” (বুখারী শরীফ)         মূলতঃ ইসলামী খিলাফতের জন্য জিহাদ কখনও অবরুদ্ধ হবার নয়। ইসলামী বিধান মতে যদি ইরাকেই খিলাফত কায়িম হয় এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্র-শস্ত্রে সমৃদ্ধ হয় তবে তার জন্য ওয়াজিব হয়ে যাবে এই কর্মসূচী নেয়া। (১) পার্শ্ববর্তী বিধর্মী রাষ্ট্রকে হয় মুসলমান হয়ে যাওয়া, (২) নতুবা জিজিয়া কর দেয়ার জন্য বাধ্য করা, (৩) নতুবা জিহাদ করার আহ্বান করা।

কাজেই তথাকথিত মহাসমাবেশে বক্তারা এবং দেশের তামাম নামধারী ইসলামী নেতারা যেরূপ ঢালাওভাবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে বললেন, তাতে করে যে তারা মূলতঃ ইসলামের জিহাদের পথই অস্বীকার করে বসলেন সে বিষয়ে তাদের অন্তরে এতটুকুও কি অনুভূতি জেগে উঠতে পারলো না? মূলতঃ রূহানীয়ত আর খুলূছিয়তহীনতার শেষ স্তরের শেষ স্তরে পৌঁছে মারা গেছে তাদের অন্তর।

তথাকথিত মহাসমাবেশের অন্যদিক তথা হারাম কাজের ফিরিস্তি

১. বেপর্দা আর বেশরার উন্মুক্ত আহ্বান

কবরস্থানে মহিলাদের যাওয়া মাকরূহ্ তাহ্রীমী তথা হারাম। আর মসজিদে মহিলাদের যাওয়াও মাকরূহ্ তাহ্রীমী। খলীফাতুল মুসলিমীন, হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা মসজিদে মহিলাদের গমন নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। আর গত ২রা মার্চ দৈনিক ইনকিলাবের মাধ্যমে জাতীয় মসজিদের তথাকথিত খতীব, শাইখুল হদস, নামধারী মুফতী, মাওলানার সমাহারে তথাকথিত নেতৃবৃন্দ আহ্বান জানান, “বক্তারা একই সূরে সূর মিলিয়ে নারী-পুরুষ, শিশু, ধর্ম, বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে সকল মহলকে সমাবেশে যোগদান করার আহব্বান জানিয়েছেন।” (দৈনিক ইনকিলাব) অর্থাৎ তারা প্রকাশ্যে ঢালাওভাবে তথাকথিত মহাসমাবেশের নামে বেপর্দা, বেশরা হওয়ার আহ্বান করলেন।

২. তারা মর্দে মুজাহিদ না বোবা শয়তান

মর্দে মুজাহিদ শব্দটা মুসলমানদের কাছে যেমন সম্মানজনক ও চেতনামণ্ডিত বোবা শয়তান শব্দটি তেমনি ঘৃণার।

৬ মার্চের মহাসমাবেশকে অনেকেই জিহাদের সাথে তুলনা করেছেন। জাতীয় মসজিদের তথাকথিত খতীব, শাইখুল হদস, নামধারী মাওলানা, মুফতী এমনকি ঐতিহ্যবাহী কয়েক সিলসিলার তথাকথিত পীর ছাহেব পর্যন্ত পত্র-পত্রিকায় বার বার বিবৃতি দিয়ে তথাকথিত এই মহাসমাবেশে হাজির হওয়া ফরয বলেছেন। তাকে ঈমানী ও রূহানী দায়িত্ব বলেছেন।

কিন্তু গত ৫ মার্চ দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠায় “৬ মার্চ মহাসমাবেশে যুদ্ধ বিরোধী সঙ্গীত পরিবেশন করবেন বরেণ্য শিল্পীরা” শীর্ষক খবরে বলা হয়, ‘আগামীকাল (৬ মাচর্) পল্টন ময়দানে যুদ্ধবিরোধী মহাসমাবেশে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন দেশের খ্যাতনামা তারকা সঙ্গীত শিল্পীরা। শান্তি সমাবেশে আয়োজিত ওপেন এয়ার কনসার্টে অংশ নিবেন চলচ্চিত্র ও নাট্যাঙ্গনের সুপারষ্টার এবং অভিনেতা অভিনেত্রীরা।

‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’ এই বুলন্দ আওয়াজ নিয়ে সূরের ঝংকারের মাধ্যমে শান্তিকামী দেশের কোটি কোটি মানুষকে জাগ্রত করতে দেশের সর্বস্তরের শিল্পী ও সকল সাংস্কৃতিক কর্মীরা আগামীকাল বিকেল ৩ টায় সমবেত হচ্ছেন পল্টন ময়দানে খোলা চত্ত্বরে আয়োজিত মহাসমাবেশে। এখানে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন খ্যাতিমান সঙ্গীত তারকা … বশীর আহমদ … বেবী নাজনীন। চলচ্চিত্র তারকাদের মধ্যে উপস্থিত থাকবেন ……। এই মহাসমাবেশে তারকাদের মিলনমেলায় সর্বস্তরের জনগণকে অংশগ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়।”

উল্লেখ্য, কুরআন-সুন্নাহ্য় গান-বাজনাকে বলা হয়েছে শয়তানের আযান। যেটা বদরের জিহাদে, উহুদের জিহাদে কাফিররা বহন করেছিলো। আর ঠিক সেই তরীক্বাই অনুসরণ করা হলো ইসলাম রক্ষার তথাকথিত মহাসমাবেশে। এবং যেটা সবচাইতে আক্ষেপজনিত কথা আশ্চর্য হলেও সত্য যে, এই যে দীর্ঘদিন ধরে যেসব খতীব, শাইখুল হাদীস, মুফতী, মাওলানা, পীর ছাহেবরা এই মহাসমাবেশে হাজির হওয়া ঈমানী-রূহানী দায়িত্ব বলে প্রচার করলেন তারা কেউ ইনকিলাবের প্রকাশিত এই সংবাদে মহাসমাবেশে বা তার আগে বা পরে বিন্দুমাত্র দ্বিরুক্তি প্রকাশ করলেন না; বরং চুপ করে সমর্থন করলেন। সেটা হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “যে কোন অন্যায় দেখে চুপ করে থাকে সে বোবা শয়তান।”

৩. তথাকথিত মহাসমাবেশে অবস্থান

উল্লেখ্য, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আহ্বানের ফলে, বিশেষতঃ নায়িকা, গায়িকা, সিনেমা তারকা ইত্যাদিকে বিশেষ আমন্ত্রণের ফলে তথাকথিত এই জিহাদের ময়দান হয়ে উঠে ব্যভিচারের উন্মুক্ত ময়দান।

৪. দৃষ্টি তাদের গায়রুল্লাহ্

মহাসমাবেশে বক্তারা ঈমানী শক্তির কথা উচ্চারণ করেননি। বরং তথাকথিত এই জনসমাবেশকে তারা বিরাট মনে করে বৈঠকেই বলেছেন, ‘এটম বোমের চেয়েও শক্তিশালী এই জনস্রোত। এবং এ দিয়েই আমেরিকাকে পর্যুদস্থ করা যাবে বলে তারা গর্বে স্ফীত হয়েছেন।’

অথচ আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন, “এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে সেখানে অল্প সংখ্যক লোক অধিক সংখ্যক লোকের উপর কামিয়াব হয়েছে।”

৫. কোথায় গেল খতীবের সেই কথা?

মূলতঃ সত্যিকার রূহানীয়ত হাছিল না করলে শুধু লৌকিকতা করলে যা হয়। স্মরণ করা যেতে পারে, এই খতীবই কিছুদিন আগে হুংকার দিয়ে বলেছিল যে, তার মতে মুসলমান শুধু থু থু নিক্ষেপ করলেই বুশ উড়ে যাবে। বলাবাহুল্য, এবার বুশের বিরুদ্ধেই সেই মহাসমাবেশ। কিন্তু সাক্ষাতে ধরা পড়ার ভয়ে খতীব এবার আর সেই থু থু নিক্ষেপের কথা বললেন না।

তথাকথিত ইসলামী দৈনিক ইনকিলাবের হাক্বীক্বত

৬. ছুফী নয়, দরবেশ নয়, ইনকিলাব  ভবনে চলচ্চিত্র তারকা সমাবেশ। ইনকিলাবের আকাশকে কোন্ তারকারা উজ্জ্বল করে? ইনকিলাব কোন্ তারকাদের সমাবেশে গৌরববোধ করে?

ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে বলে দাবী করে থাকে ইনকিলাব পত্রিকা। অথচ সাধারণ মুসলমানও যে ইসলামের দৃষ্টিতে- গায়িকা, নায়িকা, সিনেমা তারকাদেরকে কত নিকৃষ্ট ও কবীরা গুণাহ্র ধারক-বাহক হিসেবে অন্তর থেকে ঘৃণা অনুভব করেন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিন্তু ধরে ধরে তাদেরকে নিয়েই মজ্মা করেছে তথাকথিত ইসলামী দৈনিক, ‘ইনকিলাব’ তথাকথিত মহাসমাবেশের পূর্বে গত ৩রা মার্চ।

ইনকিলাব পত্রিকার ভাষায় “বিকেল তিনটার মধ্যেই ইনকিলাব ভবনের তৃতীয় তলা পরিণত হয় নক্ষত্রের মেলায়। তারায় তারায় পূর্ণ হয়ে উঠে মতবিনিময় সভাস্থল। আমাদের চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, টেলিভিশনের প্রিয় মানুষগুলোর আলাপচারিতায় ঝলমল করে উঠে পরিবেশ।

প্রিয় পাঠক! একেই বলে নরক গুলজার। ইসলামের পরিভাষায় যে রাস্তা দিয়ে একটা বেপর্দা মহিলা হেঁটে যায় সেখানে চল্লিশ দিন যাবৎ খোদার লা’নত পড়ে। আরো বলা হয়েছে, ফাসিককে সম্মান করলে আল্লাহ্ পাক-এর আরশ কাঁপে। মূলতঃ একথা ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক মাওলানা মান্নানই তার ওয়াজে অনেক বলেছেন।

সুতরাং এখন চলচ্চিত্র, সিনেমা, সঙ্গীত ইত্যাদির হোমরা-চোমরাদের নক্ষত্র বলে ভূষিত করে তাদের আগমনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে এবং তাদেরকে বরণ করার দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ইনকিলাব ওয়ালারা কোন পর্যায়ের ফাসিক ও ইসলামের নামে ব্যবসাকারী মুনাফিক দৈনিক।

৭. যে কথা কেউ বলেনি

তথাকথিত মহাসমাবেশে যে কথা কাঙ্খিত, বাঞ্ছিত ছিল যে, মুসলমানদের বর্তমান নিগৃহীত অবস্থা থেকে উদ্ধারের উপায় সম্বলিত, বিদায় হজ্বের বিবৃত মশহুর সেই হাদীস শরীফ “তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত লাঞ্ছিত হবেনা, বঞ্চিত হবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা কুরআন-সুন্নাহ ধরে থাকবে।” তার আলোকে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের অনৈসলামিক জীবন, সি.আই.এর এজেন্ট হিসেবে তার মুখোশ উন্মোচন তথা মুসলিম বিশ্ব ও নেতাদের কুরআন-সুন্নাহ থেকে দূরে সরে যাওয়া সে সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা; কিন্তু সে ব্যাপারে কেউ এক বিন্দু বলেনি। মূলতঃ কাফির-খ্রীষ্টানদের অনুসরণ করে শুধু লৌকিকতা করলে যা হয়।

অর্থাৎ তথাকথিত মহাসমাবেশের পৃষ্ঠপোষকরা তথাকথিত খতীব বা শাইখুল হদস তথা নামধারী, মুফতী, মাওলানা, পীর ছাহেবরা নিজেরাই কুরআন-সুন্নাহ্র পথ থেকে দূরে সরে গেছেন। সুতরাং তাদের নেতৃত্বে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত বর্তমান মুসলিম উম্মাহ্র ভোগান্তি বরং বাড়বেই। মূলতঃ তারা এবং তাদের আমল মুসলিম উম্মাহ্র জন্য গযব স্বরূপ। আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন, “যমীনে এবং পানিতে যেসব ফিৎনা-ফাসাদ ছড়িয়ে পড়ে তা মানুষের হাতের কামাই।” (সূরা রূম/৪১)

৮. শেষ পর্যন্ত তিনিও তামাশা করলেন

সিনেমা তারকাদের কথা বললে অনেক লোক আসবে সেজন্য তাদের সমাবেশ করা হয়েছে বলে জানা যায়। তারকারা যথারীতি বেপর্দা, বেহায়াভাবে তামাশা করেছে। কিন্তু সবচেয়ে হঠকারিতামূলক তামাশা করলেন তিনি। তথাকথিত মহাসমাবেশের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এত গলদ ক্রটি তথা নারী-পুরুষে একাকার যেন একটা ব্যভিচারের উন্মূক্ত ময়দান, বৃষ্টি বর্ষণের ন্যায় ক্যামেরার ফ্লাশ, ভিডিও, কুশ-পুত্তলিকা দাহ, বেগানা, বেহায়া মহিলাদের মঞ্চে উপস্থিতি, মাইকে গায়িকা, নায়িকাদের তথা মহিলাদের কণ্ঠসূর। এতসব হারাম কাজ করার পরও সিলেটের আল্লামা ছাহেব তথাকথিত মহাসমাবেশ শেষ করলেন আল্লাহ্ পাক-এর রহমত চেয়ে।

অথচ তথাকথিত মহাসমাবেশের বক্তব্যে রহমতের কামনা করা হয়নি বরং কথিত জনস্রোতকেও বিশেষ মূল্যায়ন করা হয়েছে। তাই বলতে হয় কোন্ কাজে আল্লাহ্ পাক-এর রহমত নাযিল হয় আর কোন কাজে গযব আসে তা বোধ হয় তথাকথিত আল্লামা ছাহেব ঘন ঘন লন্ডনে যাবার ফলে খ্রীষ্টানদের চাকচিক্যে দুনিয়ার মোহে ভুলে গেছেন।

উল্লেখ্য, এতসব হারাম কাজের দ্বারা আল্লাহ্ পাক-এর রহমত কামনার অর্থ হলো যেসব হারাম কাজ হালাল বলা তথা হারাম কাজে রহমত পাওয়া যায় তা ব্যক্ত করা যা স্পষ্ট ও শক্ত কুফরী। আর কথিত আল্লামা ছাহেব তাই করলেন।

মূলতঃ আল্লাহ্ পাক-এর ভয় তথা খুলূছিয়ত নিয়ে নয় বরং দুনিয়ার মোহেই নামধারী আলিমরা ইসলামের নামে এসব লৌকিকতা পূর্ণ কাজ করে যাচ্ছেন। যে প্রসঙ্গে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, “মেজবান যেমন আহার করার আহবান করে, তেমনি অন্যান্য জাতি ও সম্প্রদায় তোমাদের ক্ষতি সাধনের জন্য আহবান করবে।”

জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! তখন কি আমরা সংখ্যায় কম হব?’ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, না, বরং তোমরা সংখ্যায় অধিক হবে। অথচ তোমরা স্রোতের মুখে ভেসে যাবে। আল্লাহ্ পাক দুশমনদের অন্তর হতে তোমাদের ভয়ভীতি দূর করে দিবেন। তিনি আরো বলেন, তোমাদের দুনিয়ার প্রতি মোহ এবং মৃত্যুচিন্তা না থাকার কারণেই এরূপ হবে।” (আবূ দাউদ)

মূলতঃ তাই হয়েছে, সাধারণ মানুষ তো বটেই;  নামধারী মাওলানা, মুফতী, তথাকথিত শাইখুল হাদীস, খতীব এমনকি পীর ছাহেব দাবীদারও পর্যন্ত দুনিয়ার মোহে নিজেদের অন্তরকে মৃত করার মত একের পর এক হারাম কাজ করে যাচ্ছে এবং ইসলামের লেবাছে থাকায় তারা ইসলামের নামেই এসব হারাম কাজ করছে। আর তথাকথিত এই মহাসমাবেশে তারই পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে।

-মুহম্মদ মাহবুবুর রহমান, ঢাকা

আকবরের আমলের উলামায়ে ‘ছূ’দের উত্তরাধিকারী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দ্বীন-ই-ইলাহীর আদলে দ্বীন-ই-জুমহুরী প্রচলনে তারা এক হয়েছে-৪

প্রসঙ্গঃ গণতন্ত্র; এখনই চরম সময়, বিষয়টি ভাবিবার- ১০

একটি অভূতপূর্ব ওয়াজ শরীফ এবং কম্পিউটারে কুরআন শরীফ, মাজার শরীফের উপরে ভাসমান দৃশ্য ও তাঞ্জানিয়ার সেই ছেলের কথা

প্রসঙ্গঃ দরসে বুখারীর পঞ্চদশ বছর পূর্তি নামধারী জাহিরী আলিমদের ডামাডোলের বিপরীতে মুজাদ্দিদুয্ যামানের পরিচয়

আকবরের আমলের উলামায়ে ‘ছূ’দের উত্তরাধিকারী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দ্বীন-ই-ইলাহীর আদলে দ্বীন-ই-জুমহুরী প্রচলনে তারা এক হয়েছে-৫