ঈদের নামাযে অতিরিক্ত ছয় তকবীর বলা

সংখ্যা: ২১৯তম সংখ্যা |

মুহম্মদ রিদ্বওয়ানুর রহমান

ফেনী

সুওয়াল : মাসিক মদীনা জানুয়ারী ২০১২ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে বলা হয়েছে, “ঈদের নামাযে অতিরিক্ত তকবীর বলা সম্পর্কিত কোন মরফু হাদীস পাওয়া যায় না। অর্থাৎ নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যবানী মুবারক কোন বক্তব্য বা আমল সম্পর্কিত কোন হাদীছ নাই।”

এখন আমার সুওয়াল হলো- মাসিক মদীনার উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়েছে কি? আর সত্যিই কি “ঈদের নামাযে অতিরিক্ত ছয় তকবীর বলা সম্পর্কিত কোন মরফু হাদীছ পাওয়া যায় না। অর্থাৎ নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যবানী মুবারক থেকে কোন বক্তব্য বা আমল সম্পর্কিত কোন হাদীছ শরীফ নাই।”? সঠিক জাওয়াব জানিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব: “ঈদের নামাযে অতিরিক্ত ছয় তকবীর বলা  সম্পর্কে মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীন খানের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং ভুল ও অশুদ্ধ হয়েছে । কারণ “ঈদের নামাযে অতিরিক্ত ছয় তকবীর বলা সম্পর্কিত অনেক মরফু হাদীছ শরীফ পাওয়া যায়। অর্থাৎ নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যবান মুবারক থেকে মুবারক বক্তব্য বা মুবারক আমল সম্পর্কিত অনেক হাদীছ শরীফ বর্ণিত আছে।

যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ছহীহ কিতাব আবূ দাউদ শরীফ উনার প্রথম খ-ের ১৭০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত রয়েছে-

ان سعيد بن العاص رضى الله تعالى عنه سال ابا موسى الاشعرى وحذيفة  بن اليمان كيف كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يكبر فى الاضحى والفطر فقال ابو موسى كان يكبر اربعا تكبيره على الجنائز فقال حذيفة صدق فقال ابو موسى كذلك اكبر فى البصرة حيث كنت عليهم قال ابو عائشة الاموى  وانا حاضر سعيد  بن العاص.

অর্থঃ “হযরত সায়ীদ ইবনুল আস রদ্বিয়াল্লাহু তায়াল আনহু, হযরত আবু মূসা আশয়ারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হুযাইফা বিন ইয়ামান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ঈদুল আদ্বহা ও ঈদুল ফিত্রের নামাযে কত তাকবীর বলতেন? হযরত আবূ মূসা আশয়ারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, তিনি জানাযার নামাযের তাকবীরের মত প্রতি রাকায়াতে চার তাকবীর বলতেন। এটা শুনে হযরত হুযাইফা বিন ইয়ামান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, তিনি (হযরত আবূ মূসা আশয়ারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) সত্য বলেছেন। অতঃপর হযরত আবূ মূসা আশয়ারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, আমি অনুরূপ তাকবীর বলে ঈদের নামায আদায় করতাম যখন বছরা শহরের শাসক ছিলাম। হযরত আবূ আয়িশা উমুবী তিনি বলেন, (এ পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণনাকালে) আমি হযরত সায়ীদ ইবনুল আছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার নিকট উপস্থিত ছিলাম।”

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত রয়েছে-

عن بعض اصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم قال صلى بنا النبى صلى الله عليه وسلم يوم عيد فكبر اربعا واربعا ثم اقبل علينا بوجهه حين انصرف فقال لا تنسوا كتكبير الـجنائز واشار باصابعه  وقبض ابهامه.

অর্থঃ “হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের অনেকে বলেন যে, মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আমাদেরকে নিয়ে ঈদের নামায পড়লেন। তিনি (উক্ত নামাযে) চার চার বার তাকবীর বললেন অতঃপর নামায শেষে আমাদের দিকে ফিরে বললেন, তোমরা ভুলে যেওনা যে, ঈদের তাকবীর হচ্ছে জানাযার তাকবীরের অনুরূপ এবং তিনি স্বীয় বৃদ্ধাঙ্গুলী গুটিয়ে বাকী অঙ্গুলীসমূহ দ্বারা ইশারা করে জানিয়ে দিলেন।” (ইলাউস্ সুনান, ত্বহাবী শরীফ, কিতাবুয্ যিয়াদাত)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত রয়েছে-

عن علقمة والاسود قالا كان ابن مسعود رضى الله تعالى عنه جالسا وعنده حذيفة وابو موسى الاشعرى فسالـهم سعيد بن العاص عن التكبير فى صلاة العيد فقال حذيفة سل الاشعرى فقال الاشعرى سل عبد الله  فانه  اقدمنا  واعلمنا فساله  فقال ابن مسعود يكبر اربعا ثم يقرء ثم يكبر فيركع فيقوم الثانية فيقرء  ثم يكبر اربعا بعد القراءة.

অর্থঃ “হযরত আলক্বামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত আসওয়াদ আমিরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনারা বলেন, কোন এক স্থানে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বসা ছিলেন এবং উনার নিকট অবস্থান করছিলেন হযরত হুযাইফা বিন ইয়ামান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি এবং হযরত আবূ মূসা আশয়ারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি। অতঃপর উনাদেরকে হযরত সায়ীদ ইবনুল আছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ঈদের নামায উনার তাকবীর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। হযরত হুযাইফা বিন ইয়ামান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, আপনি (এ ব্যাপারে) হযরত আবূ মূসা আশয়ারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে জিজ্ঞাসা করুন। তখন হযরত আবূ মূসা আশয়ারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন যে, আপনি হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে জিজ্ঞাসা করুন। কারণ তিনি আমাদের চেয়ে (দ্বীন গ্রহণের ক্ষেত্রে) অগ্রগামী এবং (দ্বীন সম্পর্কে) বেশী জানেন। অতঃপর হযরত সায়ীদ ইবনুল আছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে জিজ্ঞাসা করলেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, তিনি (অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ঈদের নামাযের শুরুতে) চার বার তাকবীর বলতেন অতঃপর ক্বিরায়াত পাঠ করতেন অতঃপর তাকবীর বলে রুকুতে চলে যেতেন অতঃপর দ্বিতীয় রাকায়াতে দাঁড়িয়ে শুরুতে ক্বিরায়াত পাঠ করতেন অতঃপর ক্বিরায়াত পাঠের পর চার বার তাকবীর বলতেন।” (মুসনাদে আব্দুর রয্যাক্ব, ফিকহুস্ সুনান ওয়াল আছারুস্ সুনান)

ব্যাখ্যাঃ ছহীহ আবূ দাউদ শরীফ উনার প্রথম খণ্ডের ১৭০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হাদীছ শরীফ-এ

كان يكبر اربعا

অর্থাৎ, হুযূর পাক  ছল্লাল্লাহু আলাইহি  ওয়া সাল্লাম তিনি ঈদুল ফিত্র ও ঈদুল আদ্বহার নামাযে চার তাকবীর বলতেন’ এর ব্যাখ্যায় ছহীহ্ আবূ দাউদ শরীফ উনার নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ বযলুল মাজহুদসহ সকল ব্যাখ্যাগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে-

كان يكبر فى كل ركعة اربعا اى مع تكبيرة الاحرام فى الاولى وتكبيرة  الركوع  فى الثانية.

অর্থ: “মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি প্রত্যেক রাকায়াতে চার বার তাকবীর বলতেন। অর্থাৎ প্রথম রাকায়াতে তাকবীরে তাহরীমাসহ চার তাকবীর, দ্বিতীয় রাকায়াতে রুকুর তাকবীরসহ চার তাকবীর।”(বযলুল মাজহুদ ২য় খ- ২০৮ পৃষ্ঠা)

‘শরহুস্ সুন্নাহ্’ কিতাবে

باب تكبيرات صلاة العيد والقراءة فيها.  অধ্যায়ে বর্ণিত রয়েছে-

روى عن عبد الله بن مسعود انه يكبر فى الاولى ثلاثا قبل القراءة سوى تكبيرة الافتتاح وفى الركعة الثانية ثلاثا بعد القراءة سوى تكبيرة  الركوع.

অর্থঃ হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। নিশ্চয়ই তিনি ঈদের  নামাযে প্রথম রাকায়াতে ক্বিরায়াতের পূর্বে তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত  তিন তাকবীর এবং দ্বিতীয় রাকায়াতে ক্বিরায়াতের পর রুকুর তাকবীর ব্যতীত তিন তাকবীর বলতেন।

উপরোক্ত বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, ‘ঈদের নামায উনার মধ্যে যে অতিরিক্ত ছয় তাকবীর বলতে হয়, তা সরাসরি মারফু’ হাদীছ শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত। অর্থাৎ ঈদের নামায উনার মধ্যে যে ছয় তাকবীর বলতে হয় তা সরাসরি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক বক্তব্য বা মুবারক আমল সম্পর্কিত অনেক মারফু’ হাদীছ শরীফ বর্ণিত আছে। আর এ সকল ছহীহ্ ও হাসান হাদীছ শরীফ উনাদের ভিত্তিতেই হানাফী মাযহাব উনার মাসয়ালা ও আমল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ঈদের নামায ছয় তাকবীরের সাথে আদায় করা ওয়াজিব।

সুতরাং মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীন  যে বলেছে, “ঈদের নামাযে অতিরিক্ত ছয় তকবীর বলা সম্পর্কিত কোন মরফু হাদীস পাওয়া যায় না। অর্থাৎ নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যবানী মুবারক কোন বক্তব্য বা আমল সম্পর্কিত কোন হাদীছ নাই।” তার এ বক্তব্য  সম্পূর্ণ ভুল ও ডাহা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হলো।

মোটকথা, প্রথম রাকায়াতে তাকবীরে তাহরীমা এবং দ্বিতীয় রাকয়াতে রুকুর তাকবীর এ দুটি তাকবীর হচ্ছে নামাযের মধ্যকার তাকবীর। আর উভয় রাকয়াতে তিন+তিন=ছয় তাকবীর হচ্ছে ঈদের নামায উনার জন্য অতিরিক্ত তাকবীর।