হযরত ইমাম আ’যম আবু হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে সে যামানার বিশ্বাস দাড়িয়েছিলো যে, “তিনি সবকিছু জানেন।” আসলে কাউকে সে রকম ইল্ম সত্যিই যে আল্লাহ্ পাক দিতে পারেন সে কথাটিই আমার অনুভূত হলো সম্প্রতি শরীয়তপুরে অনুষ্ঠিত আওলার্দু রসূল, ঢাকা রাজারবাগ শরীফের হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর ওয়াজ শরীফ দ্বারা। রাজারবাগ শরীফের হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর কাছে সুওয়াল পেশ করা হয়েছিলো, “তাঞ্জানিয়ার কথিত সেই ছেলে সম্পকের্, যার বয়স চার; কিন্তু সে কুরআনে হাফিয। সারা দুনিয়ায় যার সি.ডি ব্যাপকভাবে চলছে, ভি.ডি.ও ক্যাসেট পাওয়া যাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই ছেলেটির হাক্বীক্বত কি?” এটাই ছিল সুওয়ালের মূল জিজ্ঞাসা।
প্রসঙ্গতঃ ছেলেটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি কম্পিউটার দ্বারা কুরআন শরীফ নির্ভুল প্রমাণিত বলে যে প্রচারণা রয়েছে সে বিষয়েও সারগর্ভ বক্তব্য রাখলেন। বললেন, মূলতঃ এর দ্বারা কুরআন শরীফ তথা আল্লাহ্ পাক-এর কথার চেয়ে কম্পিউটারের কথার গুরুত্ব বেশী দেয়া হয়েছে।
অথচ আল আমীন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি চৌদ্দশত বছর পূর্বেই ওহী নাযিল হয়েছে, “এটা সেই কিতাব, যাতে কোন সন্দেহ নেই।” (সূরা বাক্বারা/২)
সুতরাং কম্পিউটার অথবা তার চেয়ে অত্যাধুনিক যন্ত্র যদি কুরআন শরীফকে স্বীকার করে অথবা নাই করে, তাতে কিছুই আসে যায়না। বরং এখানে মনে রাখা কর্তব্য যে, কম্পিউটার অথবা যে কোন যন্ত্রেরই নিজস্ব কোন বুদ্ধি নেই। নিজস্ব কোন সৃজনশীলতা নেই। এ যন্ত্রের স্রষ্টা অন্য কোন যন্ত্র নয়, এর নেই কোন আবেগ, নেই কোন অনুভূতি। এর ভিতরে যে মেকানিজম বা সিষ্টেম বা প্রোগ্রাম ঢুকানো থাকে সে সেভাবেই জবাব দেয়। অর্থাৎ কম্পিউটারের প্রোগ্রামারই প্রধান। আর বর্তমানে ঐসব মানুষই এ প্রযুক্তিকে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রন করছে, যাদের ধর্ম ও আমলের কারণে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন, “তারা পশুর ন্যায়, বরং তারা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট।” (সূরা আ’রাফ/১৭৯)
স্মর্তব্য, আজকে মুসলমানদেরকে সাময়িকভাবে মুগ্ধ করার জন্য কম্পিউটার থেকে কুরআন শরীফ সত্য ও সঠিক এবং মানব রচিত নয় শীর্ষক আউটপুট বা তথ্য বের করা হয়েছে কিন্তু হতে পারে মুসলমানেরা যখন এরকমভাবে কম্পিউটারের কথায় বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে আশ্বস্ত হয়ে যাবে, তখন তারা আবার কম্পিউটারে নিজেদের ষড়যন্ত্রমূলক ইনপুটের মাধ্যমে অপর এক আউটপুট বা তথ্য বের করবে, যাতে ব্যক্ত হবে যে, কুরআন শরীফে অনেক ভুল রয়েছে এবং কুরআন শরীফ মনগড়া, বানানো বা মানব রচিত ইত্যাদি ইত্যাদি। (নাউযুবিল্লাহ্)
কাজেই সমঝদার মুসলমান হিসেবে যন্ত্রের বা অন্য কারো কথায় বিশ্বাস না করে মহান আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথার উপর বিশ্বাস করে আমল করাই মুসলমান ও দ্বীনদারের কাজ হবে। নতুবা বুঝতে হবে যে, তার ঈমানের মধ্যে গলতি রয়েছে এবং এরূপ ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ও গোমরাহীতে পতিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
এরপর কিছুদিন পূর্বে সুলতানুল হিন্দ, খাজায়ে খাজেগাঁ, হাবীবুল্লাহ হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন হাসান চিশ্তী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ছায়া বা অবয়ব যে তাঁর মাজার শরীফের উপর ভেসে উঠেছিল এবং এটা হাজার হাজার মানুষ অবলোকন করেছে বলে প্রচার করা হয়েছিলো এমনকি কম্পিউটার ওয়েব সাইটেও তা দেখা যাচ্ছে বলে যে প্রচার করা হয়েছিল সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এটাও মূলতঃ বিধর্মী তথা হিন্দুদের চক্রান্ত।”
তিনি বলেন যে, “অধুনা লেজার রশ্মি দিয়ে দূর থেকে অন্ধকারের মাঝে এরূপ আকৃতি তৈরী করা যায়। এটা এখন মুসলমানদের মাজার শরীফে বলা হচ্ছে, পরে বলা হবে, হিন্দুদের কৃষ্ণের মন্দিরে কৃষ্ণ ভেসে উঠেছে। সে বলেছে, হিন্দু ধর্মই ঠিক। মুসলমানদের ভারতে থাকতে দেয়া যাবেনা, সমস্ত মসজিদ ভেঙ্গে ফেলো ইত্যাদি ইত্যাদি।”
এরপর টুইন টাওয়ারে হামলার ব্যাপারে তিনি বলেন, “এটাকে যে ভিত্তিতে কুরআন শরীফের মু’জিযা বলা হচ্ছে তা ঠিক নয়। উল্লেখ্য, তারা প্রচার করছে যে, সূরা তওবার প্রথম থেকে ১০৯ নং আয়াত শরীফ পর্যন্ত হরফের সংখ্যা ২০০১; যা ঘটনার বছর। কিন্তু প্রথম থেকে ১০৯ নং আয়াত শরীফ পর্যন্ত সূরা তওবার হরফের সংখ্যা ২০০১ নয়। বরং প্রায় ৯ হাজারেরও বেশী। তদুপরি টুইন টাওয়ারকে যদি সূরা তওবায় উল্লিখিত অনুত্তম গৃহ বলা হয় তবে তার পাশাপাশি অবস্থিত উত্তম গৃহ কোনটি?” এর জবাবও তাদের কাছে নেই। অর্থাৎ এখানে গোজামিল দিয়ে যেভাবে মাহাত্ম ফুটানোর চেষ্টা করা হয়েছে তা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তাই তা ইসলাম সমর্থিত নয়।
এরপর তাঞ্জানিয়ার সেই ছেলের প্রসঙ্গে তিনি শরীয়তের উছূল বর্ণনা করেন, যার ছোহবতের দ্বারা, যার সমর্থন দ্বারা, যার প্রচারণা দ্বারা মানুষ হারাম কাজে লিপ্ত হয় সে ব্যক্তি মূলত না-হক্ব। যেমন মানুষ সি.আই.এ. এর এজেন্ট, মুনাফিক, মিথ্যাবাদী ওসামা আর মোল্লা ওমরের ছবি নিয়ে ঘুরেছে, তাদের মূর্তি নিয়ে মিছিল করেছে, হাজারো ক্যালেন্ডার, পোষ্টার ইত্যাদি ছাপিয়েছে। অথচ ছবি তোলা, মূর্তি তৈরী করা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণই না-হক্ব।
কিন্তু ওসামা আর মোল্লা ওমরের ক্ষেত্রে তাদের প্রচারণা করতে গিয়ে মানুষ সে হারাম কাজেই মশগুল হয়ে পড়েছে! আর তাতে ওসামা বা মোল্লা ওমর কেউই আপত্তি করেনি, নিষেধ বাণী প্রচার করেনি। একইভাবে তাঞ্জানিয়ার সেই ছেলেটির ক্ষেত্রেও একই কথা, তার হাজার হাজার ছবি তোলা হয়েছে, ভি.ডি.ও, সি.ডি বিক্রি করা হচ্ছে, মানুষ নেকীর ছূরতে রোযার মাসেও হারাম কাজে মশগুল হয়েছে।
অথচ তার বুযুর্গী তুলে ধরার জন্য গাউসুল আ’যম, সাইয়্যিদুল আউলিয়া, দাস্তগীর হযরত বড়পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর উদাহরণ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু গাউসুল আ’যম, সাইয়্যিদুল আউলিয়া, হযরত বড়পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ইতিহাস কি বলে? হযরত বড়পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি জন্মের দিনও মায়ের বুকের দুধ পান না করে কেবল নিজের বিলায়েতই প্রকাশ করলেন না; পাশাপাশি মেঘাচ্ছন্ন আকাশে চাঁদ না দেখার জন্য মানুষ যখন দিশেহারা ছিলো তখন তাঁর দুধ পান না করার দ্বারাই মানুষ রোযার মত ফরয আদায় করতে পারল, রোযার দিনে পানাহার করার মত হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকল। এরূপে যাঁর দ্বারা মানুষ হারাম থেকে বেঁচে হালালের দিকে ধাবিত হয় মূলতঃ তিনিই ওলী আল্লাহ্। এজন্য বলা হয়, “ওলী ওলীই যদিওবা তিনি শিশু হয়ে থাকুন না কেন।”
যদি তাই হয়ে থাকে তবে তাঞ্জানিয়ার সেই ছেলের জন্য এটা কি করে সম্ভব যে, সে ছবি উঠাতে দিবে? সে যদি খ্রীষ্টান হওয়ার জন্য তার মায়ের দুধ পান করা থেকে বিরত থাকতে পারে এবং তার পরিবারকে মুসলমান হওয়ার জন্য বলতে পারে, তবে এটা কি করে সম্ভব যে ছবি তোলার মত হারাম কাজের বিরুদ্ধে বলবেনা, তাকে নিয়ে যে সি.ডি, ভি.সি.ডি ইত্যাদি করা হচ্ছে এবং বিশ্বে তা প্রচার করা হচ্ছে এরকম ব্যাপক হারাম কাজের বিরুদ্ধে সে বলবে না, ছবি তোলার মত হারাম কাজ সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করবেনা?
তদুপরি আরো অনেক বছর আগে তার বয়স ছিল চার। আর এখনও বলা হচ্ছে চার। এছাড়া তার যে সি.ডি, ভি.ডি.ও বাজারে চলছে তার মূল উৎস কেউই স্বীকার করেনি। অথচ এটা দিয়ে যদিও ব্যাপকভাবে ভি.ডি.ও, সি.ডি ব্যবসা চলছে; মূলতঃ এর মধ্যে রয়েছে সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর হাত। কাজেই মুসলমানকে কোন কিছু শুনলেই তাতে ঝাঁপিয়ে পড়লে চলবেনা। বরং কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে তাকে যাচাই করতে হবে। হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে, “দাজ্জাল যমীনে চল্লিশ দিন কুফরী মত প্রচার করবে। তার মধ্যে প্রথম দিন হবে এক বৎসরের সমান।” অর্থাৎ দাজ্জাল সূর্যকে আটকে রাখবে, মুর্দাকে জিন্দা করবে। তার ডান হাতে বেহেশ্ত থাকবে আর বাম হাতে দোযখ থাকবে। প্রকৃতপক্ষে তার বেহেশ্ত হবে দোযখ আর দোযখ- বেহেশ্ত হবে। উল্লেখ্য, শয়তান আর সব কিছুই করতে পারে আকাশে উড়তে পারে, আগুনে স্থির থাকতে পারে, পানিতে হাঁটতে পারে কিন্তু একটি জিনিস পারেনা তা হলো, সুন্নত পালন তথা সঠিক ইসলাম অনুসরণ।
কাজেই অলৌকিক কিছু দেখলেই ওলী আল্লাহ্ হয়না। যতক্ষণ পর্যন্ত সে কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস অনুযায়ী হক্ব বলে সাব্যস্ত না হবে।” সত্যিই, ইমামুল আইম্মা, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদুয্ যামান, আওলার্দু রসূল, হাবীবুল্লাহ্ ঢাকা রাজারবাগ শরীফের হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর এ ওয়াজ শরীফ বর্তমান সময়ের মুসলমানদের জন্য ঈমানের দিশারী। সত্যিই অভূতপূর্ব তাঁর ওয়াজ শরীফ। সত্যিই তিনি যামানার মুজাদ্দিদ। (সুবহানাল্লাহ্)
-মুহম্মদ মাহবুবুর রহমান।