কাহিনীটি সংকলিত হয়েছে ‘মাকতুবাত শরীফে।’ আফজালুল আউলিয়া হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তা বর্ণনা করেছেন। একবার এক ওলী আল্লাহ্ দেখতে পেলেন যে, ইবলিস খুবই আরাম করে ঘুমাচ্ছে। তা দেখে তিনি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে ইবলিস, তুই এভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে ঘুমাচ্ছিস? তুই না চব্বিশ ঘন্টা ব্যস্ত থাকিস মানুষকে কু-কাজে লিপ্ত করাতে? এভাবে ঘুমানো তো তোর আদত নয়?” জবাবে ইবলিস বললো, “জামানার নামধারী আলিমরাই আমাকে এ সুযোগ করে দিয়েছে।” উক্ত ওলী আল্লাহ্ আরো আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “সেটা কিভাবে?” জবাবে ইবলিস বললো, “নামধারী আলিমরা যেভাবে হারামকে হালাল করছে তাতে আমাকে আর হারাম কাজে ওয়াস্ওয়াসা দিতে হয়না। বরং নামধারী আলিমদের গোমরাহীর কারণে মানুষ এখন ইসলামের নামে হারাম কাজগুলোকে জায়িয মনে করেই করছে।” অর্থাৎ আমার(ইবলিসের) কারণে আগে মানুষ হারামকে হারাম জেনেই করত এবং ভিতরে ভিতরে অনুশোচনার তীব্রতায় দগ্ধ হত, পারলে তওবা করত। কিন্তু এখন নামধারী আলিমরা ‘হারামকে হালাল ফতওয়া’ দেয়ার কারণে মানুষ এখন হারামকে হালাল মনে করেই করে। সুতরাং তাদের অন্তরে তওবা করার কথাও আর উদয় হয়না। নামধারী আলিম তথা উলামায়ে “ছূ”রা তাই আমার চেয়ে বেশী কাজ করছে। তাদের দ্বারাই হারাম হালালের ছূরতে ব্যাপক প্রসার লাভ করছে। আমাকে তাই কিছু করতে হয়না বলেই আমি এভাবে ঘুমাচ্ছি।” ‘মাকতুবাত শরীফে’ উল্লিখিত ঘটনাটি প্রতীকি হলেও বর্তমানে এর বাস্তবতা বড়ই প্রখর। আজকে নামধারী আলিমরা ‘ছবি’ তুলছে। পেপার-পত্রিকায়, টিভি-ভিডিওতে অহরহ দেখা যায় তাদের ছবি। অর্থাৎ ‘ছবি’ তোলা, দেখা জায়িয সেটাই তাদের আমলের দ্বারা প্রতিভাত হয়। অথচ মাসিক আল বাইয়্যিনাতে শতাধিক হাদীস শরীফের প্রত্যক্ষ বিবরণসহ ৩৫৩টি দলীল দিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে যে, “ছবি তোলা, দেখা, আঁকা, রাখা সবই হারাম।”
আর এ হারামের কুফল যে কত মারাত্মক ও সর্বগ্রাসী তা তাদের দিলে যদি মোহর না পড়ত তবে তারা বুঝতে পারত। সারাদেশে আজকে তিন কোটিরও বেশী টিভি দর্শক। বত্রিশটি পে-চ্যানেল সহ ফ্রি টু এয়ার চ্যানেল রয়েছে শতাধিক। জানা গেছে, এদেশে নেশান ওয়াইড কমিউনিকেশন ও ট্রান্সলিংক ১৯৯৪ সাল থেকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ডিশ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বাংলাদেশে বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে অপসংস্কৃতির সয়লাব ঘটায়।
অল্প সংখ্যক চ্যানেল, অপারেটর ও গ্রাহকের মাধ্যমে এই ব্যবসা শুরু করলেও তা এখন ফুলে-ফেঁপে সারা দেশে এ ধরণের ডিশ অপারেটরের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ হাজারে দাঁড়িয়েছে। নেশান ওয়াইড বর্তমানে উনত্রিশটি এবং ট্রান্সলিংক তিনটি স্যাটেলাইট পে চ্যানেল বাংলাদেশে প্রদর্শনের জন্য ভারত থেকে পরিবেশকের ডিলারশীপ নিয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে স্যাটেলাইট চ্যানেল নিয়ন্ত্রণে কোন আইন বা নীতিমালা না থাকায় চ্যানেলের ডিষ্ট্রিবিউটররা অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ভারতে পাচার করছে।
পাশাপাশি ডিশ কালচার যে আজকের অব্যাহত খুন-রাহাজানি, সন্ত্রাস, নারী সম্ভ্রম হরণ, পরকীয়া, চরিত্রহীনতা, বেহায়াপনা আর অশ্লীলতার ব্যাপক প্রসারে দেশ জাতিকে ধ্বংস করে চলেছে তা এখন আর কেবল ধর্মীয় অনুভূতির আলোকে মূল্যায়ণের অপেক্ষা রাখেনা। বরং উদ্ভূত পরিস্থিতি এখন ধর্মীয় মুল্যবোধ থেকে গাফিল সাধারণ সামাজিক মানসিকতার চেতনায়ও আঘাত হেনেছে। গত ৪ঠা মে দৈনিক ইত্তেফাকে “ডিশ কালচারে বৃদ্ধি পাচ্ছে অপরাধ” শীর্ষক লিড নিউজে বলা হয়- “ডিশ কালচারের বিস্তৃতিত নতুন নতুন অপরাধসহ অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে কিশোর-তরুণরা অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠেছে। বিদেশী মারদাঙ্গা সিনেমা দেখে এসবের অনুসরণে নেমে যাচ্ছে শিশু-কিশোররা। বাসাবাড়ী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা এবং সমাজ জীবনে এর প্রভাব পড়ছে। অপরাধের ধরণ পরিবর্তনসহ নতুন নতুন অপরাধ বিশ্লেষণ করে সরকারী দলের নীতিনির্ধারক মহল এ মতে পৌঁছেছেন যে, ডিশ কালচার এক সর্বনাশা কালচার।” উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এক্ষেত্রে সরকারসহ সাধারণের অবস্থা হয়েছে সারা গায়ে খুজলি-পাঁচড়া যুক্ত ঐ ব্যক্তির মত। যেগুলোর যন্ত্রণায় সে যন্ত্রণাকাতর হয় অতঃপর বেদনা উপশমের জন্য সে চুলকায় আর চুলকায়। কিন্তু পরিণামে এই চুলকানির দ্বারা তা আরো বৃদ্ধি পায়।
মূলতঃ ডিশ, সিনেমা, টিভি এগুলো যে ভয়াবহ জিনিস সঙ্গত কারণে সব সরকারই তা বুঝতে পারে। গত ১৯ মে বর্তমান সরকারের তরফ থেকে পুরো না হলেও ১৩টা চ্যানেল বন্ধ করার ঘোষণাও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। একদিন না যেতেই পরদিন তার মধ্যে ১১টাই চালু করা হয়।
সঙ্গতকারণেই সরকারের এহেন কর্মকান্ডে কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। প্রথমতঃ সরকার ইচ্ছা করলে ডিশ কালচার এবং এ ধরণের সবকিছু বন্ধ করতে পারে। দ্বিতীয়তঃ ১৩টি চ্যানেল বন্ধের ব্যাপারে সরকার ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে চিহ্নিত করেছিল। অর্থাৎ ডিশ কালচার তথা টিভি-সিনেমা কালচার দ্বারা যে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ধর্মীয় আদর্শ ও আমলের খিলাফ কাজ হয় সরকারের পক্ষ থেকে সে সম্পর্কে স্বীকৃতিমূলক বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে।
তৃতীয়তঃ ডিশ কালচার তথা ছবি কালচারের দ্বারা ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষতি হওয়া সম্পর্কিত স্বীকৃতি দানের পরও একদিনের মাথায় পুনরায় চ্যানেলগুলো চালু করে দেয়ায় এটাই প্রতিভাত হয় যে সরকারের কাছে ধর্মীয় মূল্যবোধ তথা ইসলামী আদর্শ ও আমল আদৌ গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় নয়।
উল্লেখ্য, বর্তমান সরকারে ইসলামী নামধারী অনেক রাজনৈতিক নেতা তথা আলিম উলামারাও রয়েছেন। রয়েছেন শাইখুল হাদীস, মুফতী, মুফাস্সিরে কুরআন উপাধীধারী ব্যক্তিরাও। কিন্তু তারাও সরকারের এহেন হঠকারীতা ও ইসলাম বিরোধী পদক্ষেপে আদৌ কোন ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। অর্থাৎ “পৃথিবীর এক প্রান্তে যদি কেউ কোন খারাপ কাজ করলো অপর প্রান্ত থেকে কেউ তা সমর্থন করলো বা প্রতিবাদের পরিবর্তে নীরব সম্মতি জানালো তাহলে সেও সে খারাপ কাজের অংশীদার হবে” এই হাদীস শরীফের মেছদাক অনুযায়ী তারাও সরকারের এই অনৈসলামী কাজের শরীক হয়েছেন। মূলতঃ বর্তমানে মানুষের ইসলাম বিমূখ মানসিকতা তথা আধুনিক নাগরিক মানসিকতার পিছনে একান্তভাবে কাজ করছে টিভি, ভিডিও, ডিশ ইত্যাদি। আর এসব কিছুর মূলেই হচ্ছে ছবি।
উল্লেখ্য, বুখারী শরীফের অনুবাদকৃত “ক্বিয়ামতের ময়দানে ঐ ব্যক্তির সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে যে ছবি তোলে বা আঁকে” এই হাদীস শরীফের আমল যদি করতেন অনুবাদকারী শাইখুল হাদীস ছাহেব তাহলে পেপার-পত্রিকায়, টিভিতে তার ছবি দেখা যেতনা। একইভাবে সমগোত্রীয় সব দাবীকৃত আলিমরাও যদি ছবির বিরুদ্ধে জোরদার ভূমিকা রাখতেন তাহলে টিভি, ভিসিআর, সিনেমা, ডিশ ইত্যাদির বিরুদ্ধেও মানুষের মনে ব্যাপক অনীহা ও ভীতি তৈরী হত। কারণ এসবের মূলই হচ্ছে ছবি। আর সে ছবিকে জায়িয করার কারণে মানুষ এখন আর টিভি, সিনেমাকে নাজায়িয মনে করতে পারছে না। তারপরেও ঈমানের রেখা যতটুকু অবশিষ্ট আছে তদপ্রেক্ষিতে তারা ব্যক্ত করছে যে, অশ্লীলতা যেগুলোতে থাকে সেগুলো না দেখা ভাল। কিন্তু মানুষের নফসানিয়ত বহ্নি শিখার মত। ক্রমশঃই তা বর্ধিষ্ণু হয়। প্রথমে ছবি জায়িয করলে পরে অশ্লীল ছবিও মানুষের নফস চাবে এবং তখন তা বন্ধ করা দূরূহ্ হবে। যেমনটি হয়েছে সাম্প্রতিক ক্ষেত্রে। কারণ হারাম থেকে হারামই তৈরী হয়। আর এক হারাম আর এক হারামের দিকে ধাবিত করে। তাই বলতে হয় যে, নামধারী আলিমদের ছবিকে জায়িয করার ফতওয়াই মূলত আজকে সিনেমা, টিভি, ডিশ ইত্যাদির ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে যা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা তথা ইসলাম বিমূখ মানসিকতার বিস্তার ঘটিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে বলতে হয়, সমাজের নামধারী আলিমরা তাদের এসব কাজের দ্বারা ‘মাকতুবাত শরীফের’ উল্লিখিত ঘটনার মেছদাক হয়েছে। হারাম ছবিকে হালাল করার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনার দ্বারা তারা সমাজের সর্বাংশে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, চরিত্রহীনতা তথা ইসলাম বিমূখ মানসিকতা ইত্যাদি ছড়িয়ে দেবার নেপথ্য নায়কে পর্যবসিত হয়েছে। তাতে ইবলিস বা শয়তান এখন নাক ডেকে ঘুমানোর অবকাশ পেয়েছে। অর্থাৎ শয়তানের ভূমিকা তারাই এখন জোরেসোরে পালন করছে। (আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্বনির রজীম।)
-মুহম্মদ ওয়ালীর্উ রহমান, ঢাকা।
“ফযলুর জিহালতীর জবাব” সত্যিই রাজারবাগীদের নিকট ‘দ্বীনে রেযাখানী’ নিরাপদ নয়