তাহারা জনগণের কাছে ভোট চাহিয়াছিলেন। অন্যান্য রাজনীতিকদের ন্যায় শুধুমাত্র এম.পি-মন্ত্রী হইবার জন্য ভোট চাহেন নাই। বরং এম.পি হইতে পারিলে দেশকে ইসলামীকরণ করিবেন। ভোট চাহিবার কালে সেই কথাই তাহারা প্রচার করিয়াছিলেন। ধর্মপ্রাণদের অনেকের সেই প্রচারণাকে ছাপাইয়া যাওয়া কষ্টকর ছিলো। কারণ তাহারা ইসলামীকরণের দোহাই দিয়া এইকথাও ঘোষণা করিয়াছিলেন যে, “যাহারা তাহাদের ভোট দিবেনা, জাহান্নামের আযাব তাহাদের ছাড়িবে না।” জাহান্নামের ভয়ে হউক আর ইসলামীকরণের উৎসাহেই হউক তাহাদের এই প্রচারণা কিয়দংশে সফল হইয়াছে। তাহারা অনেকেই তাহাদের কথিত সংসদে গিয়া কথা বলিবার সুযোগ পাইয়াছেন এবং রীতিমত বলিয়াছেনও। কিন্তু নামকাওয়াস্তে যতটুকু ইসলামী কথা বলিয়াছেন, অনৈসলামী কথা শুনিয়াছেন তাহার চাইতে ঢের বেশী। কারণ গণতন্ত্রের তথা সংসদীয় গণতন্ত্রের ইহাই রীতি।
জনৈক নামধারী ইসলামী সাংসদের প্রশ্নের জবাবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী জবাব দিয়াছিলেন যে, দেশে বর্তমানে কয়েক শত বার ক্লাব, মদের দোকান ইত্যাদি রহিয়াছে। নামধারী ইসলামী সাংসদ কুরআন শরীফের আয়াতের কথা উল্লেখ করিয়া তাহা বন্ধ করিবার জন্য নামকাওয়াস্তে আবেদন করিয়াছিলেন। কিন্তু না, কুরআন শরীফের কথার মর্যাদা রক্ষা হয় নাই। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী উক্ত সাংসদকে শুনাইয়াছিলেন যে, ইহা গণতন্ত্র, গণতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী এইদেশে এইক্ষণে মদের দোকান, বার ক্লাব এইগুলি বন্ধ করা যাইবে না। উক্ত সাংসদগণ সেই কথা কেবল অত্যন্ত মনোযোগের সহিত শুনিয়াই ক্ষ্যান্ত রহেন নাই বরং তাহার পর হইতে তাহা পালন করিতেও চরম নিষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছিলেন।
তাই গত ৪ঠা মে যখন সরকার যমুনা ডিস্টিলারি কোম্পানীকে দেশের দ্বিতীয় মদ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানরূপে লাইসেন্স দেয় তখন এইসব ক্ষমতাসীন নামধারী ইসলামী সাংসদ তথা ইসলামী দলের লোকেরা কেহই টু শব্দ করে নাই। ইতিপূর্বে দেওয়া মন্ত্রীর সবক এবং জোট সরকারের চেয়ারপার্সনের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ই ছিলো তাহাদের এই নীরবতার কারণ।
কিন্তু ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়াছিলো জনগণের মাঝে। তাহাদের সেই প্রতিক্রিয়া পত্রিকার পাতায় পত্রস্থ হইয়াছিলো। কিন্তু কোন মাওলানা মন্ত্রী, মুফাস্সিরে কুরআন বা মুফতী সাংসদ অথবা শাইখুল হাদীস বা খতীবের জোরালো প্রতিবাদ লিপি পত্রিকার পাতায় পত্রস্থ হয় নাই। এমনকি কোন মঞ্চ হইতেও তাহাদের আওয়াজ উঠে নাই। সাধারণ মানুষ তাহাতে হতবাক হইয়াছিলো। তাহাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তাই ক্রমশঃই চাপা বিস্ফোরণের পর্যায়ে পৌঁছাইয়াছিল। বেকায়দাটা সরকার সম্যক উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলো। অবশেষে ১৩ই জুন সরকারী বিজ্ঞাপনে সরকার মদ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স বাতিল করিয়া দেয়। ইহার পরে ইসলামী নামধারী দলগুলির শুরু হয় স্বভাবজাত মুনাফিকী। ১৫ই জুন কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে খতীব ও জনৈক মুফতী সাংসদের অভিনন্দন পত্রস্থ হয়। অথচ ইহার আগে তাহাদের কোন প্রতিবাদ পত্রস্থ হয় নাই। অর্থাৎ ইহার আগে তাহারা কোন প্রতিবাদ করেন নাই। কিন্তু যখন অবস্থার প্রেক্ষিতে সরকার মদের লাইসেন্স বাতিল করিল তখন সরকারকে অভিনন্দনের নামে তাহারা ধর্মপ্রাণ দেশবাসীকে বুঝাইতে চাহিল যে, মদ বন্ধের আন্দোলনে তাহারাও সম্পৃক্ত। মূলতঃ তাহারা ইসলামী দাবী করিলেও যখন যেমন তখন তেমন সাজিতে বা নিজের রং বার বার পাল্টাইতে গিরগিটির চাইতে বেশী পারদর্শী।
মূলতঃ মদের কারখানা বন্ধ নহে বরং মদ প্রসঙ্গে ইসলামের নামে রাজনীতির ফায়দা লুটাইতেই তাহারা বেশী আগ্রহী। তাই তাহাদের অভিনন্দনের কারণ জনগণের এখনো বোধগম্য নহে। কারণ দেশে এখনও কেরু এন্ড কোং নামে মদ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রহিয়াছে। রহিয়াছে সারা দেশে শত শত মদের দোকান, ক্লাব বার, হোটেল ইত্যাদি। ইহা ছাড়া বর্তমানে অনেক কোম্পানীর মদ আমদানীর লাইসেন্স রহিয়াছে। এইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হইলো- (১) ঢাকা ক্লাব, (২) চট্টগ্রাম ইনষ্টিটিউট, (৩) চট্টগ্রাম ক্লাব, (৪) হোটেল সায়মন, (৫) গুলশান ক্লাব, (৬) খুলনা ক্লাব, (৭) সিলেট ষ্টেশন ক্লাব, (৮) হোটেল জাকারিয়া, (৯) নারায়ণগঞ্জ ক্লাব, (১০) ব্রিটিশ এয়ার ক্লাব, (১১) বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, (১২) উত্তরা ক্লাব, (১৩) হোটেল লা ভিঞ্জি (১৪) রাওয়া ক্লাব, (১৫) গোল্ডেন ড্রামাস লিমিটেড। কাজেই এইসব প্রতিষ্ঠানের মদ আমদানী ও মদ ব্যবহারের বিরুদ্ধে ইসলামী রাজনীতিকদের কোন আওয়াজ নাই। অর্থাৎ যমুনা ডিস্টিলারির মদ কারখানা নিয়া তাহারা যাহা করিয়াছেন তাহা মূলতঃ ইসলাম ধর্মের খালিছ সেবক হিসাবে মদ বন্ধের জন্য নহে বরং মদ প্রসঙ্গে ইসলামের নামে রাজনীতির অনুশীলন মাত্র।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, ভোট রাজনীতির জন্য জোট সরকার বর্তমানে আপাতভাবে মদ বন্ধ করিলেও প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী উহাকে আটকাইয়া রাখা সম্ভব নহে। যাহা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী পূর্বেই তথাকথিত ইসলামী সাংসদকে শুনাইয়া দিয়াছিলেন। পাশাপাশি যমুনা ডিস্টিলারির ইতিহাস ঘাটিলেও এই সত্য জোরদারভাবে প্রতিভাত হয়।
যমুনা গ্রুপের একটি সহযোগ প্রতিষ্ঠান যমুনা ডিস্টিলারির মদ তৈরীর অনুমতির ইতিহাস
যমুনা গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ‘যমুনা ডিস্টিলারি’ একটি ইথাইল এ্যালকোহল উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৮ সালে এই এ্যালকোহল উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানটি তৎকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে মদ উৎপাদনের অনুমতি চাহিয়া আবেদন করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্পূর্ণ দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করিয়া যমুনা ডিস্টিলারির উৎপাদিত ইথাইল এ্যালকোহল হইতে আন্তর্জাতিক মানের মদ তৈরীর এই আবেদনটির কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেয়। সেই প্রেক্ষিতে উক্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ১২/৪/৯৯ তারিখে ভিন্ন দুইটি পত্রের মাধ্যমে উক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানটির প্রেক্ষাপট ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য অবহিত করিয়া শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতামত চায়। ইহার জবাবে ২০/৫/৯৯ তারিখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালককে জানায় যে, ‘‘আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন মদ উৎপাদনে তাহাদের কোন আপত্তি নাই’’। একইভাবে শিল্প মন্ত্রণালয়ও ৩১/৫/৯৯ তারিখে অধিদফতরকে জানায় যে, “শিল্পখাতটি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত রহিয়াছে এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর তাহাদের অনুসৃত নীতিমালা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারে’’। এই দুই মন্ত্রণালয়ের ইতিবাচক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক ৮/৭/২০০১ তারিখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যমুনা ডিস্টিলারিকে মদ উৎপাদনের অনুমতি প্রদানের সুপারিশ করে। এই সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৯/৭/২০০১ তারিখে প্রচলিত আইন অনুযায়ী যমুনা ডিস্টিলারিকে মদ তৈরীর লাইসেন্স প্রদানে অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ করে। সে নির্দেশ অনুযায়ী অধিদফতর ৪/৫/২০০২ তারিখে এক পত্রের মাধ্যমে যমুনা ডিস্টিলারিকে পূর্ণাঙ্গভাবে মদ তৈরীর অনুমতি প্রদান করে এবং রাজশাহী অফিসের অতিরিক্ত পরিচালককে মদ উৎপাদন, ব্লৌডিং, বোতলজাত ও বাজারজাত করার জন্য যমুনা ডিস্টিলারিকে লাইসেন্স প্রদানের নির্দেশ দেয়।
উপরোক্ত বিবরণ পাঠে উল্লেখ্য যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তথা বাংলাদেশ সংবিধানে কোথাও এমন কোন নীতিমালা লিপিবদ্ধ নাই যে দেশে মদ উৎপাদন, তৈরী করতে দেওয়া যাইবে না। বরং এই প্রসঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয় যাহা বলিয়াছে তাহা প্রণিধানযোগ্য যে, ‘‘শিল্পখাতটি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত রহিয়াছে এবং অধিদফতর তাহাদের অনুসৃত নীতিমালা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারে’’। এইখানে আরো উল্লেখ্য যে, যমুনা ডিস্টিলারির মদ উৎপাদনের সিংহভাগ প্রসেসিং হইয়াছে বিগত সরকারের আমলেই। কাজেই এই সরকার না থাকিলে অন্য সরকার অথবা এই সরকারও সুযোগ পাইলে যে কোন সময়ে লাইসেন্স দিয়াও দিতে পারে। কারণ গণতান্ত্রিক সরকারের বিবেচনা মতে ইহা একটি শিল্প খাত, বিনিয়োগের উন্মুক্ত খাত। কাজেই দেশীয়ভাবে না হইলে বিদেশ হইতে আমদানী বা চোরাইপথে তাহার যোগান হইতেছেই। সেইক্ষেত্রে দেশীয়ভাবে উৎপাদনের মাধ্যমেই আর্ন্তজাতিক মানের হোটেল তথা বিশেষ মহলে মদ বিক্রি করিয়া লাভবান হওয়া গণতান্ত্রিক সরকারের অর্থ আহরণের একটি বড় সুযোগ, গণতান্ত্রিক সরকার তাহা হাত ছাড়া করিবার নয়। যদিও কুরআন শরীফে কঠোর ভাষায় মদকে যতই হারাম ঘোষণা করা হউক না কেন, যেহেতু গণতন্ত্র আর ইসলাম কখনও এক নহে সুতরাং গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ কুরআন শরীফের কথায় কর্ণপাত করিবেনা ইহাই চরম সত্য কথা। অতএব, স্পষ্টই বলা যায় যে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সংসদীয় তথা প্রেসিডেন্টীয় রীতিতে কখনও ইসলামীকরণ সম্ভব নহে। কারণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ইহুদী-খ্রীষ্টানদের বিধান, উহার মধ্যে রহিয়াছে লা’নত। কাজেই এখনই চরম সময় এই লা’নতী গণতন্ত্র সম্পর্কে ভাবিবার।
-মুহম্মদ ওয়ালীউল্লাহ্, বাসাবো, ঢাকা।
“ফযলুর জিহালতীর জবাব” সত্যিই রাজারবাগীদের নিকট ‘দ্বীনে রেযাখানী’ নিরাপদ নয়
ছবিকে হালালকারী আজকের নামধারী আলিমরা মূলতঃ ‘মাকতুবাত শরীফে’ উল্লিখিত উলামায়ে “ছূ”দের উত্তরসূরী