(ধারাবাহিক)
এই লেখার ধারা সাধারণ মানুষের দিক। তাহাদের সুপ্ত অনুভুতিতে জাগরূক করিবার জন্য। তথাকথিত গণতন্ত্রের বেনিফিসিয়ারী কে বা কাহারা তাহা উপলব্ধি করিবার জন্য।
গণতন্ত্রে জনগণ নির্বাচন করে। কিন্তু এই নির্বাচন কি জনগণের? নাকি উহা সীমিত সংখ্যক রাজনীতিকদের পূঁজি প্রয়োগের ক্ষেত্র? সে প্রশ্ন এখন আর লুকাছাপার বিষয় নহে। গণতন্ত্রের প্রবক্তারা নির্বাচনকে তাহাদের ভাষায় সুষ্ঠ সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক হইবার জন্য অনেক ুপায় বাৎলাইয়া দিয়া থাকেন। কিন্তু তাহা ঐ পর্যন্তই। নিয়ম বাৎলানেওয়ালা, প্রয়োগকারী এবং প্রয়োগস্থল তথা জনগণও জানে যে আসলে সেইগুলিতে কিছুই হইবে না। বরং যাহা কিছু হইবে সবই হইবে অনিয়ম, অবাবস্থাপনা আর অন্যায়ের অনুশীলন। কিন্তু তাহারপরও জনগণ চুপ করিয়া আছে বা থাকে। ইহা যেন সেই গল্পেরই পুনরাবৃত্তি।
ভিন রাজ্য হইতে দুইজন ধুরন্ধর আসিয়া এইদেশীয় রাজাকে জানায় যে, তাহারা রাজাকে এমন পোশাক বানাইয়া দিতে সক্ষম, যাহার নজীর সারা বিশ্বে আর কোথাও নাই।
তাহারা আরো জানায় ইতিমধ্যে তাহারা আরো বহু রাজাকে বহু মূল্যবান পোশাক বানাইয়া দিয়াছে। কিন্তু অব্যক্ত ভাললাগার কারণে এদেশীয় রাজাকেই তাহারা সবচেয়ে মূল্যবান পোশাকটি তৈয়ার করিয়া দিতে মনস্থ: করিয়াছে। তবে হিার জন্য বহু মূল্যের নগদ অর্থ ছাড়াও সময় লাগিবে ঢের বেশি।
এইদেশীয় রাজা সানন্দে উহাদের প্রস্তাব মানিয়া লইলেন। উহাদের জন্য আলাদা বাসস্থান ও পোশাক তৈয়ারীর ঘর তৈয়ার হইল। খাজাঞ্চীখানা কুলিয়া দেওয়া হইল। যত ইচ্ছা অর্থ গ্রহণের অনুমতি দেয়া হইল। এদিকে প্রাপ্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার ইহারা যথারীতি করিতে লাগিল। বাহিরে চমক বজায় রাখিল, ইহারা সবচাইতে মূল্যবান সেই পোশাক বানাইবার জন্য বিশেষ ব্যস্ত। কিন্তু প্রজারা সময়ে সময়ে সেই ঘরে উঁকি ঝুকি মারিয়া দেখিত সেখান কোন কল নাই, সুতানেই। তাহার পরেও উক্ত ব্যক্তিদ্বয় বিশেষ ভঙ্গিমায় কি যেন বুননের কারিশমা দেখাইতেছে।
এইদিকে ইহারা খোদ মহারাজার একান্ত নেকভাজন হইয়া বিশেষ সুবিধা ভোগ করিতেছে। সুতরাং সেইরকম দক্ষ না হইলে কি তিনি ইহাদের নিয়োগ করিবেন?
অথবা ইহাদের সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করিতে গিয়া শেষতক রাজা মহাশয়ের কোপানলে পড়িয়া স্বীয় জীবনটাই হারাইতে হয় কিনা সেই ভয়ে তটস্ত থাকিয়া কেউ কিছু বলিতে সাহস করিলনা। কিন্তু কবে সেই বর্ণিত পোশাক তৈয়ার হইবে তাহা নিয়া কৌতুহল ব্যক্ত হইতে লাগিল। ক্রমশঃই ইহা ঘণীভূত হইতে লাগিল। কারণ ইতিমধ্যে বছরখানিকেরও বেশী সময় পার হইয়া গিয়াছে। প্রজাদের অপেক্ষার প্রহরের বিলম্বের ঘনঘটা উক্ত ব্যক্তিদ্বয়ও আঁচ করিতে পারিল। অবশেষে তাহারা ঘোষণা দিল আগামী অমুক দিনে রাজা মহাশয়ের গায়ে সবচাইতে মূল্যবান পোশাকটি পরিধান করানো হইবে। নির্দিষ্ট দিনে খোদ রাজা সহ উজির-নাজির, পাত্র-মিত্র, প্রজাবৃন্দ সবাই উপস্থিত হইল। রাজামহাশয় পূর্ব হইতেই প্রজা সমভিব্যাহারে শোভাযাত্রার আয়োজন করিয়া রাখিয়াছিলেন। নির্দিষ্ট সময় উপস্থিত। অপেক্ষার চরম প্রহর। সেই মুহূর্তে ব্যক্তিদ্বয় আসিয়া বলিলেন, মহারাজ সবচাইতে দামী এই পোশাকের শেষ কাজঁটা সমাপন করিতে আর মাত্র কিছুক্ষণ বিলম্ব হইবে। রাজামহাশয় তাহাও হাসিমুখে বরণ করিলেন তবে পোশাকটা সবচাইতে সুন্দর ও সবচাইতে মূল্যবান যাহাতে হয় সেইদিকে কারিগরদ্বয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করিলে উহারা তাহাতে সম্মত হইয়া কিছুক্ষণ পরে আত্মতৃপ্তির হাসি হাসিয়া জানাইলো, ‘রাজামহাশয় পোশাক তৈয়ারী শেষ।’ এখনই আপনাকে সেই পোশাক পরিধান করিতে হইবে। তবে বিশেষ সাবধানতার সাথে। রাজামহাশয় দুরু দুরু বক্ষে তাহাতে সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন। কারিগরদ্বয়ের ব্যস্ততা বাড়িয়া গেল। তাহারা রাজা মহাশয়ের পোশাক খুলিয়া বিচিত্র ভঙ্গিমায় অনেক সময় ব্যয় করিয়া নূতন পোশাক পরিধান করাইবার কারিশমা দেখাইল। শেষতক রাজাকে সুধাইল, “মহারাজ! আমাদের এতদিনের শ্রম ও এত অর্থ ব্যয়ে এই পোশাক কেমন লাগিতেছে আপনার? ‘রাজামহাশয় নিজেও জানেন অনেক অর্থ ব্যয় হইয়াছে। অনেক সময় গিয়াছে। উজির-নাজির, পাত্র-মিত্র সবাই অধির আগ্রহে সামনে উপস্থিত। সুতরাং এখানে পোশাক ভাল না বলিলে রাজা মহাশয়ের মান যায়। তাই গায়ে কোন পোশাকের অস্তিত্ব টের না পাইলেও অন্তরের সন্দেহটা বদ্ধমূল করিয়াই রাজামহাশয় বাহিরে বলিলেন। “ভাল, খুব ভাল।” এদিকে রাজামহাশয় যখন একবার ভাল বলিয়া ফেলিয়াছেন সুতরাং উজীর-নাজির, পাত্র-মিত্র সবাই সমস্বরে বলিতে লাগিল সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে মূল্যবান, রাজাকে খুব মানাইয়াছে, চমৎকার দেখাইতেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। রাজা মহাশয় সন্দিগ্ধ মন লইয়াই বাহিরে আনন্দের চমক বজায় রাখিয়া শোভাযাত্রায় বাহির হইলেন। উজির-নাজির, পাত্র-মিত্রের পাশাপাশি প্রজাবৃন্দেরও একই সূর। শোভাযাত্রা যথারীতি আগাইয়া চলিল। শেষ প্রান্তে আসিয়া অপেক্ষাকৃত কম ভীড়ে একশিশু তাহার মায়ের কোলে বসিয়া রাজাকে দেখিয়া জোরে জোরে বলিয়া ফেলিল, ‘মা! মা!! দেখ, দেখ, রাজার গায়ে কোন কাপড় নাই।’ ছেলের কথায় মা বিষম খাইলেও মুহূর্তের মধ্যে কথাটি সবার বুকে গিয়াই বিধিল। একজন দুইজন করিয়া ক্রমশঃই বলাবলি হইতে লাগিল, সত্যিইতো রাজার গায়ে কোন কাপড় নাই। ইহার পরে বিচ্ছিন্নভাবে নয়, প্রায় সমবেতভাবেই আওয়াজ উঠিল রাজার গায়ে পোশাক নাই। রাজা মহাশয়ের এতক্ষণ চাপিয়া থাকা সন্দেহানুভূতিও তখন প্রকট আকার ধারণ করিল। সঙ্গে সঙ্গেই খুলিয়া রাখা পোশাক পড়িয়া রাজা মহাশয় ধুরন্ধর কারিগরদ্বয়কে ফাসিতে ঝুলাইলেন।
পাঠক! এই গল্পে যে বিষয়টি প্রনিধানযোগ্য তাহা হইল সহজ সরল সত্য আত্মনুভূতিটি ব্যক্তিগতভাবে প্রকাশ না করা। অপরে কি বলে, কি করে, সেইটাকেই সমর্থন করা, নিজের সত্য উপলদ্ধিকে আমল না দেওয়া।
পাঠক! আজকের গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে প্রতিটি মানুষই আত্মগত দিক হইতে জোরালোভাবে অনুভব করিতে সক্ষম যে, বর্তমান নির্বাচন ভিত্তিক গণতন্ত্র ইসলামের নামে জায়িয তো নহেই এমনকি সাধারণভাবেও তাহা গ্রহণযাগ্য নহে। বরং তাহা অক্টোপাসের করাল থাবা। গত ১৫-০২-০২ ঈঃ তারিখে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক এক সভায় বলিয়াছেন, এবারের নির্বাচনে মোট খরচ দশ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেন, প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেয়া সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা খরচ করলে মোট ব্যয় হতো ৩০ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে এ ব্যয়ের পরিমাণ দশ হাজার কোটি টাকা।
তিনি জানান, নির্বাচন-এখন কালো টাকার বিনিয়োগ এবং তা থেকে সহজেই অনেক বেশী রিটার্ন পেয়ে কালো টাকা বানানোর মওকায় পরিণত হয়েছে। দেশে প্রতিবছর ৫০ হাজার কোটি কালো টাকা তৈরী হচ্ছে এবং অধিকাংশ এমপি এর সঙ্গে জড়িত। তিনি আরো বলেন, দেশ আজ দু’ভাগে বিভক্ত। একদিকে ৫ লাখ ক্ষমতাধর দুর্র্বৃত্ত। অন্যদিকে ১২ কোটি ৭৫ লাখ সাধারণ মানুষ। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও সাধারণ মানুষকেই সকল দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বলা হয় দেশের ১৩ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে সরকারী হিসেবেই সাত কোটি মানুষ দ্রারিদ্রসীমার নিচে ছিল। সম্প্রতি তেল, গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে আরও এক কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্রসীমার নিচে চলে গেছে। পাঠক! ইহা শুধু বেসরকারীভাবে পরিবেশিত তথ্যই নহে। মাত্র কিছুদিন পূর্বেও সরকার দলীয় এক প্রভাবশালী মন্ত্রী মন্তব্য করিয়াছেন, এবারের নির্বাচনে যেভাবে কালো টাকা আর পেশী শক্তির অনুশীলন হয়েছে তাতে কোন ভদ্রলোক আর নির্বাচনে আসবে কিনা সন্দেহ।
পাঠক! উপরোক্ত দুই ধরণের তথ্য ও মন্তব্য হইতে ইহাই প্রতিভাত হয় যে, গণতান্ত্রিক নির্বাচন স্বচ্ছ নহে, এই নিয়মে ক্ষমতায় আরোহন পদ্ধতি সঠিক নহে। আর এ উপলব্ধি শীর্ষ পর্যায় তথা নির্বাচন কমিশন, নির্বাচক মন্ডলী, নির্বাচন আইন প্রণেতা, নির্বাচনে অংশ গ্রহণকারী রাজনৈতিক দল, নেতা-কর্মী তথা বর্তমানে সাধারণ জনগণ সবাই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিতেছে। কিন্তু তাহারপরেও মুখ খুলিতেছেনা কেহই। সবার অবস্থাই হইয়াছে গল্পের রাজা, উজির-নাজির, পাত্র-মিত্র আর প্রজাদের মত। সবাই স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছে যে, রাজার গায়ে পোশাক নাই। কিন্তু তাহারপরেও ক্রমাগতভাবে কেহই টু শব্দ করিতেছেনা। সেইহেতু সেই জনস্রোতে মিশিয়া পরের জনও চুপ মারিয়া রহিতেছে।
ঠিক গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তথৈবচ। আলাদা আলাদাভাবে সবাই অনুভব করিতেছে। কিন্তু সমবেত কক্ত মিলাইতেছেনা। অথচ তাহার জন্য কি দিক নির্দেশনার অভাব রহিয়াছে ইসলামে? হাদীস শরীফে কি ব্যক্ত হয় নাই- “যারা ক্ষমতা চায়, (নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পেতে চায়) তাদেরকে আমরা ক্ষমতা দেইনা। ক্ষমতা প্রার্থীর (নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতা প্রার্থী হয় তার) উপর লা’নত।” তাই বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, এখনই চরম সময় আসিয়াছে এই লা’নতী গণতন্ত্র সম্পর্কে সুস্থ মস্তিস্কে, সূক্ষ্মভাবে ভাবিবার। য (চলবে)
-মুহম্মদ ওয়ালীউল্লাহ্, বাসাবো, ঢাকা।