যেসব মুছল্লী দাঁড়িয়ে নামায পড়তে অক্ষম তারা কিভাবে নামায আদায় করবে?

সংখ্যা: ২১৯তম সংখ্যা |

মুহম্মদ এনায়েত হুসাইন

সদর, চাঁদপুর

সুওয়াল : যেসব মুছল্লী দাঁড়িয়ে নামায পড়তে অক্ষম তারা কিভাবে নামায আদায় করবে? বসে বা দাঁড়িয়ে কোনভাবেই নামায পড়তে না পারলে তার জন্য মসজিদে জামায়াতে নামায পড়া জরুরত আছে কিনা? সহজের অর্থ গ্রহণ করে বসে বা দাঁড়িয়ে নামায পড়তে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও চেয়ার বা টুলে নামায পড়া জায়িয কি-না?

জাওয়াব : অক্ষম ও অসুস্থ ব্যক্তি কিভাবে নামায আদায় করবে তা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ও ফিক্বাহর কিতাবসমূহের মধ্যে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

عن حضرت عمران بن حصين رضى الله تعالى عنه قال كانت بى بواسير فسألت النبى صلى الله عليه وسلم عن الصلوة فقال صل قائما فان لـم تستطع فقاعدا فان لـم تستطع فعلى جنب.

অর্থ : হযরত ইমরান ইবনে হুছাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, আমি অশ্ব রোগে আক্রান্ত ছিলাম। এজন্য আমি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে নামায আদায় করার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, “আপনি দাঁড়িয়ে নামায আদায় করবেন, যদি দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে না পারেন তাহলে বসে আদায় করবেন। যদি তাও না পারেন, তাহলে শুয়ে আদায় করবেন।” (বুখারী শরীফ)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরও বর্ণিত রয়েছে-

عن حضرت جابر رضى الله تعالى عنه فى صلوة الـمريض الـمومئ يصلى على وسادة صل على الارض ان استطعت و الا فاوم ايـماء واجل سجودك اخفض ركوعك

অর্থ : হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত রয়েছে, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এক অসুস্থ ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে দেখতে যান। তখন ওই ছাহাবী তিনি অসুস্থতার কারণে নামাযের মধ্যে একটি বালিশের উপর সিজদা করছিলেন। হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বালিশটি সরিয়ে ফেলেন এবং বলেন, “আপনি যদি সক্ষম হন তাহলে মাটির উপর নামায আদায় করবেন। তাতে সক্ষম না হলে ইশারায় নামায আদায় করবেন। আপনার সিজদাকে রুকুর চেয়ে একটু বেশি নিচু করবেন।” (বাযযার, বায়হাক্বী)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরও বর্ণিত রয়েছে-

انـما سنة الصلوة ان تنصب رجلك اليمنى وتثنى اليسرى

অর্থ : “নিশ্চয়ই নামাযের সুন্নত হলো যে, তোমার ডান পা খাড়া রাখবে এবং বাম পা বিছিয়ে রাখবে।” (বুখারী শরীফ)

উপরে বর্ণিত পবিত্র হাদীছ শরীফসমূহ উনাদের দ্বারা প্রতিভাত হয় যে, সাধারণভাবে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে হবে। দাঁড়াতে না পারলে বসে নামায আদায় করতে হবে। বসে আদায় করতে না পারলে শুয়ে নামায আদায় করতে হবে।

স্মরণীয় যে, নামাযে দাঁড়ানো বলতে কোন কিছুর মধ্যে ঠেস বা হেলান না দিয়ে স্বাভাবিকভাবে দাঁড়ানোকে বুঝানো হয়েছে। বসা বলতে নামাযে যেভাবে বসার নিয়ম; যমীনে বসা, অপরাগবশত চার জানু হয়েও বসতে পারে। একইভাবে শোয়া বলতে সাধারণভাবে পার্শ্বদেশে শোয়াকে বুঝনো হয়েছে।

উল্লেখ্য, নামাযে দাঁড়ানো, বসা ও শোয়া এ তিন অবস্থা দ্বারা সরাসরি যমীনের উপর দাঁড়িয়ে যমীনের উপর বসে এবং যমীনের উপর শুয়ে নামায আদায় করতে হবে। আর যমীন বলতে সরাসরি যমীন অথবা ঘরের মেঝে অথবা বিছানা হতে পারে। যেখানে স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে নামায আদায় করা যায়।

উল্লেখ্য, পবিত্র মসজিদে জামায়াতে নামায আদায় করার হুকুম ওই ব্যক্তির জন্য যে সুস্থ। আর যে অসুস্থ তার জন্য পবিত্র মসজিদ ও পবিত্র জামায়াত কোনটিরই হুকুম নেই। যেমন পবিত্র মসজিদে গিয়ে পবিত্র জামায়াতে নামায আদায় করার হুকুম নেই মুসাফির, মহিলা ও বালকের জন্য। তারা তাদের সুবিধা মতো নিজ ঘরে বা অবস্থানস্থলেই পবিত্র নামায আদায় করে নিবে। একইভাবে অসুস্থ ব্যক্তি তার সুবিধা অনুযায়ী নিজ ঘরে বা অবস্থানস্থলেই পবিত্র নামায আদায় করে নিবে।

স্মরণীয় যে, পবিত্র হাদীছ শরীফ এবং পবিত্র ফিক্বাহর কিতাবসমূহে পবিত্র নামাযে বসার যে তরতীব বা নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে, সে নিয়মে চেয়ার বা টুলে বসা অসম্ভব। কাজেই চেয়ার বা টুলে বসে পবিত্র নামায আদায় করলে পবিত্র নামাযে বসার যে পবিত্র সুন্নত রয়েছে তা বাদ হয়ে যায়।

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

ما احدث قوم بدعة الا رفع مثلها

অর্থ : “যখনই কোন সম্প্রদায় একটি বিদয়াত সৃষ্টি করেছে, তখনই একটি পবিত্র সুন্নত বিলুপ্ত হয়েছে।” (মুসনাদে আহমদ, মিশকাত)

অতএব প্রমাণিত হলো যে, চেয়ার বা টুলে বসে পবিত্র নামায আদায় করার অর্থ হচ্ছে বিদয়াতের প্রচলন করা। আর পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের বিরোধী প্রত্যেকটি কথা বা কাজই হচ্ছে বিদয়াতের অন্তর্ভুক্ত। প্রত্যেক বিদয়াতই গুমরাহী এবং এর অনুসরণকারীরা গুমরাহ বা পথভ্রষ্ট ও জাহান্নামী।

কাজেই, পবিত্র মসজিদ হোক কিংবা নিজ ঘরে বা বাড়িতেই হোক যেখানে স্বাভাবিক বসার ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে চেয়ার বা টুলে বসে পবিত্র নামায আদায় করা স্পষ্ট বিদয়াত ও গুমরাহী এবং এর অনুসারী ও সমর্থনকারীরা বিদয়াতী ও গুমরাহ।

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

من وقر صاحب بدعة فقد اعان على هدم الاسلام

অর্থ : “যে ব্যক্তি কোন বিদয়াতীকে সম্মান দেখালো, নিশ্চয়ই সে দ্বীন ইসলাম উনাকে ধ্বংসের কাজে সাহায্য করলো।” নাউযুবিল্লাহ! (বায়হাক্বী, মিশকাত)

অতএব, যেসব মুছল্লীরা দাঁড়িয়ে পবিত্র নামায পড়তে অক্ষম তাদের উচিত চেয়ার বা টুলে না বসে পবিত্র নামাযে বসার তরতীব অনুযায়ী বসে পবিত্র নামায আদায় করা। এরূপ বসায় অক্ষম হলে চারজানু হয়ে বসে নামায আদায় করা। এরূপ বসাতেও অক্ষম হলে তাকে শুয়ে নামায আদায় করতে হবে। ঘর-বাড়িতে হোক অথবা পবিত্র মসজিদে হোক যারা বসে পবিত্র নামায আদায় করবে তাদেরকে উপরোক্ত দুই নিয়মের এক নিয়ম অনুযায়ী পবিত্র নামায আদায় করতে হবে। এর বিপরীত নিয়ম অনুযায়ী পবিত্র নামায আদায় করা সম্পূর্ণরূপে ইসলামী শরীয়ত উনার ও পবিত্র সুন্নত উনার খিলাফ।

সুতরাং, যেসব পবিত্র মসজিদে মুছল্লীরা চেয়ার বা টুলে পবিত্র নামায আদায় করে তাদের উচিত পবিত্র মসজিদ থেকে চেয়ার বা টুল সরিয়ে অন্যসব মুছল্লীদের মতো নামাযে বসার তরতীব অনুযায়ী বসে পবিত্র নামায আদায় করা। এরপরও মাসায়ালা না জানার কারণে কোন মুছল্লী যদি চেয়ার বা টুল সরাতে না চায় সেক্ষেত্রে মসজিদের ইমাম, খতীব ও কমিটির দায়িত্ব হবে পবিত্র মসজিদ থেকে চেয়ার, টুল সরানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কেননা চেয়ার বা টুলে বসে পবিত্র নামায পড়া ইসলামী শরীয়ত উনার বিরোধী কাজ। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে, “নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

من را منكم منكرا فليغيره بيده فان لـم يستطع فبلسانه فان لـم يستطع فبقلبه وذلك اضعف الايمان. وفى رواية ليس وراء ذلك من الايمان حبة خردل.

অর্থ : “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোন অন্যায় কাজ সংঘটিত হতে দেখে সে যেন তা হাত দ্বারা বাধা দেয়। যদি সে তা হাত দ্বারা বাধা দিতে না পারে তাহলে সে যেন যবান দ্বারা বাধা দেয়। যদি যবানের দ্বারাও বাধা দিতে না পারে তাহলে যেন অন্তরে তা ঘৃণা করে উক্ত অন্যায় কাজ থেকে দূরে সরে থাকে। আর এটা সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের পরিচয়।” অন্য হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে এসেছে, “এরপর ঈমানের আর সরিষা পরিমাণ অংশও অবশিষ্ট থাকে না।”

পবিত্র এ হাদীছ শরীফ উনার থেকে প্রতিভাত হলো যে, যারা ক্ষমতা থাকা সত্ত্বে অন্যায় কাজে বাধা দিবেনা তাদের সরিষা পরিমাণও ঈমান নেই।

প্রকাশ থাকে যে, পবিত্র নামায উনার ফরযসমূহ উনাদের মধ্যে একটি ফরয হচ্ছে ক্বিয়াম বা দাঁড়িয়ে নামায আদায় করা। কাজেই দাঁড়িয়ে পবিত্র নামায পড়তে সক্ষম হলে বসে পবিত্র নামায পড়লে শুদ্ধ হবে না। অনুরূপভাবে বসে পবিত্র নামায পড়তে সক্ষম হলে শুয়ে পবিত্র নামায পড়লে শুদ্ধ হবে না।