হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা কোন ভুল বা গুনাহ করেছিলেন কি?

সংখ্যা: ২১৯তম সংখ্যা |

মুহম্মদ মুহিউদ্দীন

পলাশ, নরসিংদী

সুওয়াল : পবিত্র ১০ই মুহররম আশূরা শরীফ উপলক্ষে অনেকে আলোচনা করতে যেয়ে হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের সম্পর্কে এলোমেলো বক্তব্য দিয়ে থাকে। যেমন তারা বলে থাকে, সাইয়্যিদুনা হযরত আদম আলাইহিস সালাম তিনি গন্দম খেয়ে ভুল করেছেন কিংবা একটি গুনাহ করেছেন। সত্যিই কি হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা কোন ভুল বা গুনাহ করেছিলেন?

জাওয়াব :  আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত উনাদের আক্বীদা হলো, কোন হযরত নবী-রসূল আলাইহিস সালাম উনারা কখনো ভুল করেননি। ইচ্ছাকৃত তো নয়ই, অনিচ্ছাকৃতও নয়। অর্থাৎ হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা কোন ভুলই করেননি। (শরহে আক্বাইদে নছফী, ফিক্বহে আকবর, তাকমীলুল ঈমান, আক্বাইদে হাক্কাহ)

অর্থাৎ সকল হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা ছিলেন মহান আল্লাহ পাক উনার খাছ ও মনোনীত বান্দাগণ উনাদের অন্তর্ভুক্ত। উনারা প্রত্যেকেই ছিলেন পবিত্র ওহী মুবারক উনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পবিত্র কুরআন শরীফ উনার একাধিক স্থানে ইরশাদ  মুবারক হয়েছে-

نوحى اليهم

অর্থ : “আমি উনাদের (হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের) প্রতি পবিত্র ওহী মুবারক করতাম।” (পবিত্র সূরা ইউসূফ শরীফ উনার পবিত্র ১০৯ আয়াত শরীফ, পবিত্র সূরা নহল শরীফ উনার পবিত্র ৪৩ আয়াত শরীফ, পবিত্র সূরা আম্বিয়া শরীফ উনার ৭ আয়াত শরীফ)

অর্থাৎ হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের যাবতীয় কার্যাবলীই পবিত্র ওহী মুবারক উনার দ্বারা (মহান আল্লাহ পাক উনার নির্দেশ মুতাবিক) পরিচালিত হতো। যার পরিপ্রেক্ষিতে আক্বাইদের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে-

الانبياء عليهم السلام كلهم معصومون

অর্থ  : “সকল হযরত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম উনারা মা’ছূম বা নিষ্পাপ।” (শরহে আক্বাইদে নছফী)

আরও উল্লেখ রয়েছে যে-

الانبياء عليهم السلام كلهم منزهون عن الصغائر والكبائر والكفر والقبائح

অর্থ : “সকল হযরত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম উনারা ছগীরা, কবীরা, কুফরী এবং অপছন্দনীয় কাজ হতেও পবিত্র।” (আল ফিক্বহুল আকবার লি ইমাম আ’যম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি)

অতএব, যারা হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের ভুল সম্পর্কে বলে থাকে, আক্বাইদ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই তারা তা বলে থাকে। যেমন তারা বলে থাকে যে, হযরত আদম আলাইহিস সালাম তিনি গন্দম খেয়ে ভুল করেছিলেন। নাঊযুবিল্লাহ!

মূলত তাদের একথা সঠিক নয়। প্রকৃত ঘটনা হলো, মহান আল্লাহ পাক তিনি যখন হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনাকে ও হযরত হাওওয়া আলাইহাস সালাম উনাদেরকে আদেশ মুবারক করেছিলেন যে-

لا تقربا هذه الشجرة

অর্থ : “আপনারা এই (গন্দমের) গাছের নিকটবর্তী হবেন না।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৫)

তখন উনারা মহান আল্লাহ পাক উনার এ আদেশ অনুযায়ী সে গাছের নিকটবর্তী হননি। বরং উক্ত গাছের অনুরূপ বিপরীত দিকের অন্য একটি গাছ দেখিয়ে ইবলিস শয়তান এসে হযরত হাওওয়া আলাইহাস সালাম উনাকে মিথ্যা কছম খেয়ে বলেছিল যে, আপনারা যদি এ গাছের ফল খান, তবে আপনারা ফেরেশতা হয়ে যাবেন অথবা স্থায়ীভাবে বেহেশতে বসবাস করতে পারবেন। কোন কোন বর্ণনা মোতাবেক, তখন হযরত হাওওয়া আলাইহাস সালাম তিনি সে গাছ হতে ফল এনে শরবত বানিয়ে হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনাকে খাইয়েছিলেন। অপর বর্ণনায়, ফল কেটে খাইয়েছিলেন। এ ঘটনা হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার অজান্তেই সংঘটিত হয়েছিল। সুতরাং যা অজান্তে সংঘটিত হয়, তা কি করে ভুল বা অপরাধ হতে পারে? বাস্তবিক তা কখনই ভুল  হতে পারেনা। (সমূহ তাফসীরের কিতাব)

এর মেছালস্বরূপ উল্লেখ করা যায়- সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম উনার শাহাদাত মুবারক উনার ঘটনা। তিনি যে শাহাদাত মুবারক বরণ করেছিলেন, এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। উনাকে পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার শত্রুরা শহীদ করার জন্য একে একে পাঁচবার বিষ পান করায়। কিন্তু মহান আল্লাহ পাক উনার রহমতে তিনি প্রত্যেকবারই বেঁচে যান। ষষ্ঠবার উনাকে শহীদ করার জন্য উনার পানির কলসি মুবারক, যে কলসি মুবারক উনার মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখতেন, (যেন তার ভিতর কিছু ফেলা না যায়,) সেই কাপড় মুবারক উনার উপর শত্রুরা মারাত্মক হিরক চূর্ণ বিষ উনার অজান্তে মিশিয়ে দিয়েছিল। তিনি গভীর রাত্রিতে হিরক চূর্ণ বিষ মিশ্রিত পানি কলসি মুবারক থেকে ঢেলে পান করেন, যার ফলশ্রুতিতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। যা উনার অজান্তেই সংঘটিত হয়েছিল। (সিররুশ শাহাদাতাইন, শুহাদায়ে কারবালা, সীরতে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন আলাইহিমাস সালাম)

এখন প্রশ্ন উঠে, ইসলামী শরীয়ত উনার দৃষ্টিতে উনার শাহাদাতকে আত্মহত্যা বলতে হবে, না ভুল করার কারণে বিছাল শরীফ লাভ করেছেন, তা বলতে হবে?

মূলত উপরোক্ত দুটির কোনটিই বলা যাবেনা। যদি কেউ কোন একটিও বলে, তবে সে মিথ্যা তোহমত দেয়ার গুনাহে গুনাহগার হবে; যা কুফরীর শামিল হবে। তদ্রুপ হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার ঘটনাও। যা উনার অজান্তে সংঘটিত হয়েছে।

অনুরূপ অন্যান্য হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের ঘটনাও। মানুষ সঠিক ইতিহাস না জানার কারণে এবং পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের সঠিক ব্যাখ্যা না বুঝার কারণে, হযরত নবী আলাইহিমুস্ সালাম উনাদের শানে বেয়াদবিমূলক, কুফরী কথাবার্তা বলে থাকে।

পঞ্চম হিজরী শতাব্দীর মুজাদ্দিদ হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাযযালী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার আল মুরশিদুল আমীন কিতাবে উল্লেখ করেন, “একবার মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র হুজরা শরীফ-এ বসা ছিলেন। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি এসে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে সাক্ষাৎ করার অনুমতি চাইলেন। এ সংবাদ উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম তিনি নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট পৌঁছালেন। তখন নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন যে, সে ব্যক্তিকে অপেক্ষা করতে বলুন। একথা বলে নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পাগড়ি মুবারক, কোর্তা মুবারক ইত্যাদি গোছগাছ করে নিলেন। এমনকি পবিত্র হুজরা শরীফ থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে পানির গামলাতে নিজের চেহারা মুবারক দেখে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। তা দেখে উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম তিনি বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনিও কি এরূপ করেন?

তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, কিরূপ করি? উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম তিনি বললেন, এরূপ পরিপাটি। এর জবাবে নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমরা মহান আল্লাহ পাক উনার নবী। আমাদের কোন কাজ কারো অপছন্দ হলে, সে ঈমানহারা হয়ে যাবে।”

অতএব, হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা যে কতটুকু অপছন্দনীয় কাজ থেকে বেঁচে থাকতেন, এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত ঘটনা তারই প্রমাণ। তাহলে কি করে এ কথা বলা যেতে পারে বা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে যে, হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা ভুল-ত্রুটি করেছিলেন? বস্তুত এরূপ আক্বীদা পোষণ করা সম্পূর্ণই কুফরী।

তদ্রুপ হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের সম্পর্কে ও উনাদের শানের খিলাফ কোন অর্থ গ্রহণ করা যাবেনা বরং এমন অর্থ ব্যবহার বা গ্রহণ করতে হবে, যাতে উনাদের শান-মান মুবারক সমুন্নত থাকে।

অতএব, কোন লোকের জন্যেই হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের শান মুবারক উনার বিন্দুমাত্র খিলাফ কথাবার্তা বলা যাবেনা। কেউ যদি বলে থাকে, তাহলে তা হবে সম্পূর্ণ নাজায়িয, হারাম ও কুফরী। এ ধরনের কুফরী আক্বীদা থেকে বেঁচে থাকা সমস্ত মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরয।