“মানুষ কি জানে না যে, আমি তাকে শুক্রানু হতে সৃষ্টি করেছি? কাজেই সে এখন (দুশমন সেজে) প্রকাশ্যে কিভাবে প্রতিবাদ করে?” (সূরা ইয়াছিন/৭৭) প্রাণের সৃষ্টি উদ্ঘাটনে মহান আল্লাহ্ পাক-এর এই বাণী অতীব প্রাচীন। অথচ বেশীদিন নয় মানুষ জানতে পেরেছে যে, পুরুষ দেহের জননকোষে যে শুক্রানু রয়েছে তা নারীদেহের গর্ভাশয়স্থ ডিম্বানুকে নিষিক্ত করলেই ভ্রুণ (Embryo) বা প্রাণের অস্তিত্ব প্রকাশিত হয়। এই ভ্রুণ মাতৃ উদরের নিরাপদ পরিবেশে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিপালিত হয় এবং পর্যায়ক্রমে মানব শিশুতে বিকাশ লাভ করে। নবজাতকটি কি কি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে তা নির্ধারিত হবে তার পিতার শুক্রাণু ও মাতার ডিম্বানুতে যে ক্রোমোজোম বা বৈশিষ্ট্য বহনকারী জ্বিনগুলো রয়েছে, তাদের সংমিশ্রণের একটি নিয়মতান্ত্রিক পন্থায়। প্রকৃতিগতভাবে পরিচালিত মহান আল্লাহ্ পাক-এর এই নিয়মে পরিপুষ্ট হয়ে মানব শিশু অর্জন করে তার পিতা ও মাতার সমন্বয়ে গঠিত একটি নতুন বৈশিষ্ট্য বহনকারী ক্রোমোজোম, যা তাকে দেয় স্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তিত্ব ও মৌলিকত্ব। মানব জন্মের এই চিরাচরিত রীতিতে ছন্দপতন ঘটিয়েছে প্রযুক্তি পাগল কিছু বিজ্ঞানী, যাকে তারা অভিহিত করেছে “মানব ক্লোনিং” হিসেবে। ক্লোন (Clone) শব্দের আভিধানিক অর্থ একই উৎস হতে উদ্ভাবিত কতগুলো প্রাণী যারা জ্বিনগত বিন্যাসে একেবারে অনুরূপ। মানব ক্লোনিং একটি জ্বিন প্রকৌশল (Genetic engineering) যেখানে পুরুষ বা নারীদেহের একটি দেহ কোষকে এমনই একটি অনিষিক্ত (Unfertilised) ডিম্বানুর সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় যেখান থেকে ডিম্বানুর নিউক্লিয়াস বা ক্রোমোজোম বহনকারী অঙ্গানুটি অপসারণ করে ফেলা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, যে কোষের উদ্ভব হয় তাতে বৈশিষ্ট্য বহনকারী ক্রোমোজোম হিসেবে থাকছে কেবলমাত্র পুরুষ বা নারীদেহ থেকে সংগৃহীত একক দেহকোষের নিউক্লিয়াসটি। অর্থাৎ ক্লোনিং-এ কোন নতুন বৈশিষ্ট্যের সংযোজন বা বিয়োজন কিংবা পরিবর্তন বা পরিবর্ধন ঘটছে না বরং পুরনো বৈশিষ্ট্যেরই পুনরাবৃত্তি ঘটানো হচ্ছে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট নতুন এক মানব ভ্রুণের জন্মদানের মাধ্যমে, যার বেড়ে উঠার জন্য প্রয়োজন একটি সঠিক পরিবেশ। বলাবাহুল্য, এই পরিবেশটি হচ্ছে মাতৃগর্ভ, যেখানে নিষিক্ত ভ্রুণটিকে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে মানব শিশুর বিকাশ ঘটানো সম্ভবপর হতে পারে। পরিণতিতে একজন মানুষের অবিকল আরেকটি মানুষ জন্মলাভ করবে।
বর্ণিত এই পদ্ধতিটির প্রাথমিক সাফল্য ঘোষিত হয়েছিলো গত ১৯৯৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারীতে। সেদিন ‘ডলি’ নামক একটি ক্লোন ভেড়ার জন্মদান সম্ভব হয়েছিলো স্কটল্যান্ডের Roslin lnstitute-এ ড. আয়ান উইলমাট এর গবেষণাগারে। ভেড়ার উপর প্রাথমিক সাফল্য স্বভাবতই বিজ্ঞানীদের উদ্বুদ্ধ করে এ পদ্ধতিকে মানব জ্বিনে প্রয়োগের ক্ষেত্রে। প্রশ্ন হচ্ছে, কতটুকু সম্ভাবনাময় বা সাফল্যজনক হবে এ গবেষণা? আপাতদৃষ্টিতে এ গবেষণা নিঃসন্তান দম্পতিদের সরাসরি কাজে আসবে বলে ধারণা করা হলেও চিন্তনীয় বিষয় হচ্ছে, কতটুকু ন্যায়সঙ্গত, বিবেকপ্রসূত বা গ্রহণযোগ্য হবে এই প্রযুক্তির প্রোডাক্ট অর্থাৎ ক্লোন করা মানব শিশু? এই প্রক্রিয়ায় যে শিশুটি জন্মলাভ করবে তাকে একটি ‘নবজাতক’ নয় বরং একটি উপজাত (by product) হিসেবে গণ্য করাই বোধ করি অধিক যুতসই হবে। এই ক্লোন মানবকে সবসময় তুলনা করা হবে সেই মানবের সঙ্গে যার দেহ কোষ থেকে এই ক্লোনের জন্ম দেয়া হয়েছিলো। এ ধরণের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি শিশুটিকে মানসিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল করে দেবার জন্য যথেষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, একজন কুস্তিগীর থেকে যে মানব শিশুটিকে ক্লোন করা হলো, তাকে কুস্তির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ এমন কোন শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হতে পারে। স্বভাবতই এ প্রক্রিয়ায় একটি ক্লোন শিশু ভারাক্রান্ত হতে পারে এই ভেবে যে, সে নিছকই একটি কপি (copy), মৌলিক (oniginal) কোন সত্ত্বা নয়। অর্থাৎ ক্লোন মানব প্রজন্ম একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ যা প্রকারান্তরে মনুষ্যত্বেরই অবমাননা। এই অবমাননা নারী-পুরুষের মানবিক অনুভূতির, তাদের প্রেম-ভালবাসার, যার ফল্গুধারায় ভুমিষ্ট হয়েছিলো মানব শিশু। যে প্রযুক্তি ভেড়ার উপর প্রয়োগ করে তথাকথিত সাফল্য পাওয়া গিয়েছিলো তা মানব জ্বিনের উপর প্রয়োগ হলে সমূহ ঝুঁকি বা ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েই যায়। উদাহরণস্বরূপ, বিজ্ঞানীরা ক্রোমোজোমে পরিবর্তন (Mutation) বা অন্যান্য জৈবিক ক্ষতির (Biological damage) আশংকা করেছেন যা ভ্রুণ বা মাতৃউদরে বেড়ে উঠা মানব শিশুকে অগ্রহণযোগ্য এক ভয়াবহ ক্ষতির মুখে ঠেলে দিতে পারে। বিবিসি অনলাইনের বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক ড. ডেভিড হাউসের মতে, ক্লোনের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা মহিলাদের সমূহ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। ধ্বংস করতে হবে ক্লোন করা বহু ভ্রুণ। কারণ দেখা গেছে, ক্লোন তৈরীর সময় সিংহভাগ ভ্রুণের সমস্যা হয়েছে। মারা গেছে বহু ভ্রুণ। অপরপক্ষে ক্লোন করা ভ্রুণ অস্বাভাবিক বড় হয়ে গিয়ে গর্ভাশয় ফেটে যাবার আশংকা হয়েছে। ঠিক যেমনভাবে ১৯৯৭ সালে ‘ডলি’ নামক ভেড়াটির ক্লোন করার আগে ২৭৬টি ভ্রুণ নষ্ট করতে হয়। গবেষণার জন্য মানব ক্লোন বা তার দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে (যেমন কিডনী, লিভার ইত্যাদি) চিকিৎসা ক্ষেত্রে (যেমন অঙ্গ প্রতিস্থাপন বা Organ transplantation) ব্যবহার করার উপযোগীতা সম্পর্কে অনেক গবেষক মত প্রকাশ করেছেন, যা কিনা ডাক্তারী পেশার code of ethics এর সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কারণ ক্লোন করা শিশুটিও একটি মানব সন্তান যাকে মানব ফ্যাক্টরী হিসেবে ব্যবহার করে তাকে বিকলাঙ্গ করার অধিকার নীতিগতভাবে অগ্রহণযোগ্য এবং ধৃষ্ঠতাপূর্ণ। ‘ডলির’ গবেষণার প্রধান গবেষক ড. উইলমাটও স্বীকার করেন, ক্লোনিং-এ অনেক অস্বাভাবিক ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। ডলি তার বয়সের তুলনায় অকালপক্ক হয়ে উঠছে। এ বছরের শুরুতে সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী ‘ভেড়াটি’ বিভিন্ন জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে যা তাকে অকাল মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আশংকা জাগে, ক্লোন করা মানব শিশুর জন্যও হয়তোবা অপেক্ষা করছে একই নিয়তি। মহান আল্লাহ্ পাক-এর যে রীতিতে মাতৃ উদরে একটি ভ্রুণ জন্মলাভ ও পরিপুষ্ট হয়ে বিকাশ লাভ করে অতঃপর মানব শিশুতে আত্মপ্রকাশ করে, সেই রীতির বাইরে অন্য কোন প্রক্রিয়ায় কোন প্রাণের জন্মদান অস্বাভাবিক ও অপ্রাকৃতিক তো বটেই বরং তা মানব জাতির ভাগ্য বুমেরাং হয়ে ভয়াবহ ঝুঁকি ও ক্ষতির মুখোমুখি করতে পারে। কাজেই এ সম্পর্কে এখন থেকেই গণসচেতনতা না গড়ে তুললে তা অবশ্যই হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে। তদুপরি ক্লোনিং বিশেষতঃ মানব-ক্লোনিং এর ধারণা, ইসলামের আলোকে কতটুকু জায়িয বা নাজায়িয সেটাও মুসলমানদের বিশেষভাবে জানার প্রয়োজন রয়েছে।
আমরা আশা করব যে, দ্বীন ইসলামের সবচেয়ে অগ্রসর, বস্তুনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য পত্রিকা মাসিক আল বাইয়্যিনাত যেন এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়। কারণ ইতিপূর্বে মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীয়তের দৃষ্টিতে ছবির সংজ্ঞা প্রণয়নে, ইনজেক্শন গ্রহণে রোযা ভঙ্গ হবে সে বিষয়ে, জিলাটিন যুক্ত ক্যাপসুল খাওয়া জায়িয হবে সে প্রসঙ্গে অত্যন্ত চমৎকার প্রজ্ঞা সম্পন্ন ফতওয়া দিয়েছে। কাজেই মানব ক্লোনিং সম্পর্কেও যদি ফতওয়া দিতে হয় তাহলে গ্রহণযোগ্য ও সারগর্ভ ফতওয়া মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর পক্ষেই দেয়া সম্ভব। আমরা সেদিকেই তাকিয়ে আছি।
-ডঃ মুহম্মদ মঞ্জুরুল করীম, এসিষ্ট্যান্ট প্রফেসর, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।