বিশেষ কলাম: আসমাউর রিজাল, জারাহ ওয়াত তা’দীল, উছুলে হাদীছ শরীফ উনার অপব্যাখ্যা করে অসংখ্য ছহীহ হাদীছ শরীফ উনাদেরকে জাল বলছে ওহাবী সালাফীরা

সংখ্যা: ২৬৬তম সংখ্যা | বিভাগ:

বর্তমান সময়ে ইহুদী ফান্ড দ্বারা পরিচালিত ওহাবী, সালাফী, লা’মাযহাবী ফেরকার লোকেরা সমাজে ইচ্ছামত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাকে জাল, মওজু, দ্বয়ীফ বলে অপপ্রচার করছে। নাউযুবিল্লাহ! তাদের মতবাদের বিপক্ষে মনে হলেই সেটাকে তারা জাল বলছে। আর এ জন্য তারা উছুলে হাদীছ শরীফ উনার বিভিন্ন অপব্যাখ্যার আশ্রয়ও গ্রহন করতে কার্পণ্য করছে না। শত শত বছর ধরে উম্মত যে হাদীছ শরীফ উনার উপর আমল করে আসছে কেউ কোন আপত্তি করে নাই অথচ হাল যামানায় এসব ওহাবীরা হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে জাল! জাল! বলে চিৎকার শুরু করেছে।

তাদের ধারণা পবিত্র বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ ছাড়া পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার অন্যান্য কিতাবে অনেক জাল বর্ণনা রয়ে গেছে। নাউযুবিল্লাহ! তাদের জানা দরকার একজন মুহাদ্দিছ যখন উনার কিতাবে পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন তিনি সবসময় সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন যাতে কিতাব খানা নির্ভরযোগ্য ও বিশুদ্ধ থাকে। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বর্ণিত আছে, ‘খলীফা হারুনুর রশিদ (১৪৮-১৯৩ হিজরী) উনার দরবারে একজন মুরতাদকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিলো সে বদকার তখন বললো-

أَيْنَ أَنْتَ مِنْ أَلْفِ حَدِيْثٍ وَضَعْتُهَا؟

আমাকে মেরে ফেলবেন ভালো কথা, কিন্তু যে এক হাজার জাল হাদীছ লোক সমাজে ছড়িয়ে দিয়েছি সেগুলো কি করবেন? তখন খলীফা হারুনুর রশিদ বললেন-

فَأَيْنَ أَنْتَ يَا عَدُوَّ اللهِ مِنْ أَبِي إِسْحَاقَ الفَزَارِيِّ، وَابْنِ الـمُبَارَكِ يَتَخَلَّلاَنِهَا، فَيُخْرِجَانِهَا حَرفاً حَرفاً

হে মহান আল্লাহ পাক উনার দুশমন! আমাদের নিকট হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত আবু ইসহাক ফাযারী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা কি জন্য আছেন? উনারা প্রতিটি জাল শব্দকে ছাকনী দিয়ে  ছেঁকে বেছে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবেন। সুবহানাল্লাহ! (সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৬/৭১, মা’রিফাতু উলুমিল হাদীছ ৩৬ পৃষ্ঠা)

এ ঘটনা থেকেই বোঝা গেলো পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ইমামগন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে যাচাই বাছাই করে অনুপ্রবেশকৃত মিথ্যা বর্ণনা কর্তন করে বিশুদ্ধ বর্ণনা আমাদের জন্য কিতাব আকারে সাজিয়ে রেখে গেছেন, এবং কিতাবের ভূমিকায় লিখে গেছেন এই কিতাবে কোন মওজু বর্ণনা নেই। এরপরও সনদ নিয়ে আলোচনা হয়েছে, বিচার বিশ্লেষণ হয়েছে, গবেষণা হয়েছে। আর তার উদ্দেশ্য সর্ম্পকেও মুহাদ্দিছীনে কিরামগন স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন-

كان الإسناد لئلا يدخل في الدين ما ليس منه، لا ليخرج ما ثبت من عمل أهل الإسناد

সনদ-তো এজন্য যে, শরীয়ত-বহির্ভূত জিনিস যেন সম্মানিত শরীয়ত উনার মধ্যে অনুপ্রবেশ না করে। ইমামগণ উনাদের মাধ্যমে প্রমাণিত জিনিসকে সম্মানিত শরীয়ত হতে বের করার জন্যে সনদ নয়।’ (আজভিবাহ ২৩৮)

হযরত ইবনে মুহাররায রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন-

على بن المدينى يقول ليس ينبغى لأحد ان يكذب بالحديث اذا جاءه عن النبى صلى الله عليه وان كان مرسلا فإن جماعة كانوا يدفعون حديث الزهرى قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من احتجم فى يوم السبت او الأربعاء فأصابه وضح فلا يلومن الا نفسه فكانوا يفعلونه فبلوا منهم عثمان البتى فأصابه الوضح ومنهم عبد الوارث يعنى ابن سعيد التنورى فأصابه الوضح ومنهم ابو داود فأصابه الوضح ومنهم عبد الرحمن فأصابه

অর্থ: আমি হযরত আলী বিন মাদিনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে বলতে শুনেছি যে, কারো জন্য উচিত নয় যে, সে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দিকে সম্বন্ধযুক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাকে অস্বীকার করবে বা মিথ্যা বলবে। হোক তা মুরসাল। একবার কতিপয় লোক ইমাম হযরত যুহরী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে বর্ণিত আরবিয়া বা বুধবারে শিংগা লাগানো সম্পর্কীয় পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাকে অস্বীকার করে আরবিয়া বা বুধবারে শিংগা লাগালে মারাত্মক মুছীবতে গ্রেপ্তার হয়। যাদের মধ্যে হযরত উসমান আল্ বাত্তী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত আব্দুল ওয়ারিস রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইবনে সা’দ তানবুরী রহতুল্লাহি আলাইহি, আবু সাইদ রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত আব্দুর রহমান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা প্রমুখ ছিলেন। (মা’রিফাতু রিজাল লি ইয়াহিয়া ইবনে মুঈন ২য় খন্ড ১৯০ পৃষ্ঠা)

আর এ বিষয়ে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে-

من حدث عني بحديث يرئ انه كذب فهو احد الكاذبين

অর্থ: যে ব্যক্তি আমার পক্ষ হতে পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণনা করলো এবং ধারনা পোষন করলো যে, তা মিথ্যা তাহলে সে মিথ্যাবাদীদের অন্যতম ব্যক্তি। (মুসলিম শরীফ ১/৭, উমদাতুল ক্বারী ৩/২৬৮, মিশকাত- কিতাবুল ইলম- প্রথম পরিচ্ছেদ- হাদীস ১৮৮)

সুতরাং বোঝা গেলো যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে নিসবত করে কেউ কিছু বর্ণনা করলে সেটা ওহাবীদের মত বিনা জ্ঞানে মওযু বা জাল বলে অস্বীকার করলে সে নিজেই মিথ্যাবাদী বলে প্রতিপন্ন হবে

সাইয়্যিদুল, মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

مَنْ حَدَّثَ بِحَدِيثٍ وَهُوَ يَرَى أَنَّهُ كَذِبٌ فَهُوَ أَحَدُ الْكَاذِبِينَ

অর্থ: “যে ব্যক্তি পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণনা করে (ছহীহ বিচার-বিশ্লেষনন ছাড়াই) অভিমত পোষণ করে যে, এই হাদীছ শরীফখানা মওজু বা মিথ্যা সে ব্যক্তি মিথ্যাবাদীদের অর্ন্তভূক্ত। (মুসনাদে আহমদ ৪/২৫৫: হাদীছ নং ১৮২৬৬, শরহুস সুন্নহ ১/২৬৬: হাদীছ ১২৩, মুসনাদে আবু যায়িদ ১/৩০৬: হাদীছ ২০৬৭শুয়াবুল ঈমান-মুকাদ্দিমা ১/৮৪, তাফসিরে ইবনে কাছীর ২/৩৬৬)

অপর এক বর্ণনায় এসেছে-

بَلِّغُوا عَنِّي وَلَوْ آيَةً وَحَدِّثُوا عَنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ ، وَلاَ حَرَجَ ، وَمَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ

অর্থ: আমার পক্ষ হতে লোকদের নিকট পৌঁছাতে থাক, যদিও তা একটি মাত্র বাক্য হয়। আর বণী ইসরাঈল হতে শোনা কথা বর্ণনা করতে পারো, তাতে কোন দোষ নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে আমার প্রতি মিথ্যারোপ করে সে যেন তার স্থান জাহান্নামে করে নেয়। (বুখারী শরীফ ৩৪৬১, তিরমিযী শরীফ ২৬৬৯, মুসনাদে আহমদ ৬৮৮৮, মুসনাদে বাযযার ৮৭৬৩, মু’জামুল কবীর তাবরানী ১৫২৫, সুনানে দারিমী ৫৪২)

এ পবিত্র হাদীছ শরীফখানা থেকে বোঝা গেলো যে, বণী ইসরাঈল বা ইহুদী সম্প্রদায়ও যদি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিসবত নিয়ে কিছু বলে তা অস্বীকার করা যাবে না বরং কেউ যদি মিথ্যা ঘটনা বানিয়ে নিয়ে আসে তার শাস্তির জন্য জাহান্নাম রয়েছে। তাই ওহাবীদের প্ররোচনায় কোন পবিত্র হাদীছ শরীফ দেখলেই তার বিরোধিতা করা যাবেনা, বরং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত উনার উলামায়ে কিরাম কি ফায়ছালা দিয়েছেন , কোন আমল চলে আসছে সেটার উপর লক্ষ্য রাখতে হবে।

ইলমে হাদীছ শরীফ উনাকে মূলত দ্ইুভাগে ভাগ করে আলোচনা করা হয়। ১) রিওয়াহ সংশ্লিষ্ট ইলিম যা সনদ অবিচ্ছিন্ন ও বিচ্ছিন্ন সনদে বর্ণনা, রাবীদের অবস্থা, স্মরনশক্তি, যোগ্যতা ইত্যাদি ২) দিরায়াহ বা নিয়ম কানুন মূলনীতি ভাবার্থ ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট ইলিম।

হাফিযে হাদীছ হযরত জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কিতাব “তাদরীবুর রাবীতে” বর্ণিত আছে, ইলমে হাদীছ শরীফ উনার ৭৩ টা শাখা আছে। প্রত্যেকটা শাখায় রয়েছে আরো অসংখ্য প্রকারভেদ। আর ইমাম হযরত ইবনে হিব্বান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি দ্বয়ীফ সনদের প্রকারভেদই করেছেন ৪৯ প্রকার। সূতরাং এই শাস্ত্র কতটা ব্যাপক আর জটিল সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর উছুলে হাদীছ শরীফ উনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে জারাহ এবং তা’দীল সংশ্লিষ্ট জ্ঞান, যা অনেক সুক্ষ্ম ও স্পর্শকাতর। জারাহ (جرح) হচ্ছে রবীর সমালোচনা করা, দোষ প্রকাশ করা, ত্রুটি অন্বেষন করা। আর তা’দীল (تعديل) হচ্ছে প্রশংসা করা, নির্ভরযোগ্যতা প্রকাশ করা, বিশ্বস্ততার প্রমাণ দেয়া ইত্যাদি। বক্ষ্যমান আলোচনায় জারাহ ওয়াত তা’দীল সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষন ও সেই সাথে ওহাবী সালাফীরা যেভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে ধোঁকাবাজী করে তার নমুনা ও সেই ধোঁকাবাজীর রহস্য উন্মোচন করা হবে ইনাশআল্লাহ।

আসমাউর রিজালসমূহের কিতাব থেকে নফসানিয়াত অনুযায়ী বক্তব্য উল্লেখ করে ওহাবী সালাফীরা যেভাবে মানুষকে ধোঁকা দেয়:

برد بن سنان وثقه ابن معين ، والنساءي ، وضعفه ابن المديني قال ابو حاتم : ليس بالمتين. وقال مرة: كان صدوقا قدرياوقال ابو زرعة : لا بأس به وقال ابو داود، يرمي بلقدر

অর্থ: হযরত বুরাদ ইবনে সিনান রহমতুল্লাহি আলাইহি। উনার সর্ম্পকে ইমাম ইবনে মুঈন ও হযরত নাসাঈ  রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা বলেন, তিনি ছিক্বাহ। হযরত ইবনে মাদীনী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, তিনি দুর্বল। হযরত আবু হাতিম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, মজবুত নন । হযরত মুররা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, তিনি সত্যবাদী এবং শক্তিশালী। ইমাম আবু যুরআ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, উনার কোন সমস্যা নাই। ইমাম আবু দাউদ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, দূরে নিক্ষেপ করতে হবে। (মিযানুল ইতিদাল ২/১১: রাবী নং ১১৪৭)

হযরত বুরাদ ইবনে সিনান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ব্যাপারে হযরত ইবনে মুঈন রহমতুল্লাহি আলাইহি ও ইমাম নাসাঈ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা দুজন উনাকে ছিক্বাহ বলেছেন। অপরদিকে হযরত ইবনে মাদীনী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, দুর্বল। অর্থাৎ কেউ জারাহ করেছেন, আবার কেই তা’দীল করেছেন। এখানে মতপার্থক্য দেখা গেলো।

بشير بن ثابت وثقه ابن حبان وقال ابو حاتم  مجهول

অর্থ: হযরত বশির ইবনে সাবিত রহমতুল্লাহি আলাইহি। হযরত ইবনে হিব্বান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনাকে ছিক্বাহ বলেছেন। হযরত ইমাম আবু হাতিম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেছেন ‘মাজহুল’ বা অপরিচিত। (মিযানুল ইতিদাল ২/২৪: রাবী নং ১১৮৯)

এখানেও আমারা দুজন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার রিজাল বিশারদের মধ্যে ইখতেলাফ দেখতে পেলাম। একজনের কাছে হযরত বশির ইবনে ছাবিত রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ছিক্বাহ বা বিশ্বস্ত আবার অন্য একজন ইমামের কাছে সেই রাবীই মজহুল বা অপরিচিত।

بشير بن المهاجر وثقه ابن معين وغيره وقال النسائى  ليس به باس وقال احمد: منكر الحديث يجيء بالعجب وقال ابو حاتم: لا يحتج به وقال ابن عدي  فيه بعض الضعف

অর্থ: হযরত বশির ইবনে মুহাজির রহমতুল্লাহি আলাইহি। হযরত ইবনে মুঈন রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ও অন্য ইমামগন উনারা ছিক্বাহ বলেছেন। হযরত ইমাম নাসায়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, উনার মধ্যে কোন সমস্যা নেই। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, আশ্চর্যজনক ভাবে মুনকার বর্ণনা করেন। আবু হাতিম রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, উনার সম্পর্কে আপত্তি নেই। হযরত ইবনে আদী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, উনার সামান্য দুর্বলতা আছে। (মিযানুল ইতিদাল ২/৪৩: ১২৪৫)

এখানে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ও হযরত আদী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা দুজন এই রাবী সর্ম্পকে জারাহ করেছেন। অন্যরা তা’দীল বা প্রশংসা করেছেন।

بكر بن بكار قال النسائى ليس بثقة وقال ابو معين  ليس بشىء وقال ابو عاصم النبيل ثقة وقال ابن حبان ثقة، ربما يخطىء. وقال ابو حاتم ليس بالقوى

অর্থ: হযরত বকর ইবনে বকর রহমতুল্লাহি আলাইহি। ইমাম হযরত নাসাঈ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, তিনি ছিক্বাহ নন। হযরত ইবনে মুঈন রহমতুল্লাহি আলাইহি, তার ব্যাপারে কোন আপত্তি নাই। হযরত আবু আছিম আন নাবিল রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, বিশ্বস্ত। হযরত ইবনে হিব্বান রহমতুল্লাহি তিনি বলেন, ছিক্বাহ, সম্ভবত তিনি তা নন। ইমাম আবু হাতিম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, তিনি শক্তিশালী নন। (মিযানুল ইতিদাল ২/৫৮-৫৯: ১২৭৭)

এখানেও ইমাম উনাদের জারাহ ও তা’দীল নিয়ে মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে। কেউ ছিক্বাহ বলেছেন, কেউ শক্তিশালী নন বলেছেন।

حريث بن السائب البصرى وثقه ابن معين وقال ابو حاتم: ما به باس وقال زكريا الساجي : ضعيف

অর্থ: হযরত হারিছ বিন সায়িব আল বাছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি। হযরত ইবনে মুঈন রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনাকে ছিক্বাহ বলেছেন। হযরত আবু হাতিম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, সমস্যাযুক্ত। হযরত যাকারিয়া আস সাজী তিনি বলেন, তিনি দ্বয়ীফ বা দুর্বল। (মিযানুল ইতিদাল ২/২১৭: ১৭৯০)

উক্ত রাবী সর্ম্পকেও ইমামগণ উনাদের পক্ষে বিপক্ষে মত রয়েছে। এরকম ভাবে তাহযিবুল কামাল, তাহযীবুত তাহযীব, তাকরীবুত তাহযীব সহ অনেক আসমাউর রিজাল উনার কিতাবে মতপার্থক্য বর্ণিত আছে। এখানে দেখানোর যে বিষয় সেটা হলো, কোন একজন রাবী সর্ম্পকে একেক ইমাম উনার একেক মতামত থাকে কেউ জারাহ করেন, কেউ তা’দীল। ওহাবী সালাফীরা কোন হাদীছ শরীফ উনাকে মওজু অথবা দ্বয়ীফ প্রমাণ করতে শুধুমাত্র যে রাবী সর্ম্পকে জারাহ বা আপত্তি করা হয়েছে তার বর্ণনাটা পেশ করে। তারা বলে অমুক ইমাম এই রাবীকে জারাহ করেছে তাই এটা গ্রহনযোগ্য নয়, কিন্তু কেউ যে প্রশংসাও করেছেন সে কথা ভুলেও উল্লেখ করে না। আর সাধারন মানুষও যেহেতু উছুল জানে না সেই সাথে রিজালের কিতাব জীবনে চোখেও দেখেনি তাই তারাও সেটা মেনে নিয়ে গোমরাহ হয়। নাউযুবিল্লাহ!

কোনো রাবী সর্ম্পকে জারাহ করলেই কি সেই রাবী বাতিল হয়ে যান?

উল্লেখ্য যে, কোন রাবীকে প্রত্যাখ্যাত করতে হলে তার কারনও স্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে। রাবি নির্ভরযোগ্য নয় এটুকু বললেই হবে না। কেন গ্রহনযোগ্য নয় তার উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য কারন বলতে হবে। হযরত মুহাদ্দিছীনে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগন উছূল বর্ণনা করেছেন, ব্যাখ্যাহীন জারাহ গ্রহনযোগ্য নয়। মতভেদ, ভুলবশত মতপার্থক্য হতে পারে। কারো কারো কাছে একজন রাবী ছিক্বাহ অপর জনের কাছে ছিক্বাহ নয়। এ কারনে জারাহ করা হলে তার কারন উল্লেখ করা আবশ্যক।

হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার জীবনী মুবারকে একটা ঘটনা আছে যেটা উল্লেখ করলে বুঝতে সহজ হবে। উল্লেখ্য, একবার কোনো এক ব্যক্তি এক রাবীর ব্যাপারে জারাহ বা অভিযোগ করলো। তখন হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, জারাহ করার কারন কি? সে ব্যক্তি বললেন, আমি তাকে দাঁড়িয়ে পেশাব করতে দেখেছি। এতে তার কাপড়ে নাপাক লেগে যাওয়া স্বাভাবিক। আর সে নাপাক কাপড়ে নামায পড়ে থাকে, এ অবস্থায় তার আদালত বা দ্বীনদারী রইলো কিভাবে? হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, তুমি কি তাকে সেই কাপড়ে নামায পড়তে দেখেছো? সে বললো, না। হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, এধরনের জারাহ সম্পূর্ণ বাতিল। আর ঐ ব্যক্তিতো কোন ওজরের জন্যও দাঁড়িয়ে পেশাব করতে পারে। (আল কিফায়া ১০৮ পৃষ্ঠা)

আর এ কারনে বিখ্যাত মুহাদ্দিছ ইবনে কাছীর রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন-

قال الحافظ ابن كثير:” بخلاف الجرح فإنه لا يقبل إلا مفسراً لاختلاف الناس فى الأسباب الـمفسقة فقد يعتمد الجارح شيئاً مفسقاً فيضعفه، ولا يكون كذلك فى نفس الأمر أو عند غيره، فلهذا اشترط بيان السبب فى الجرح

অর্থ: হাফিয ইবনে কাছীর রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, ব্যাখ্যাহীন জারাহ গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা ফাসিক সাব্যস্তকারী কারন সমূহের ক্ষেত্রে বহুজনের বহুমত রয়েছে। অনেক সময় একজন জারাহকারী একটা বিষয়কে ফাসিক সাব্যস্তকারী কারন মনে করে। অথচ বাস্তবে তা সেরকম নয়। এ কারনে জারাহ-এর বেলায় সকলের ঐক্যমতে কারন দর্শানো আবশ্যক। (শরহে ইখতিছারু উলুমিল হাদীছ ১ খন্ড ২৪৭ পৃষ্ঠা)

কোনো জারাহই গ্রহন করা হবে না যতক্ষন না তার কারন বর্ণনা করা হবে। কেননা অনেক সময় জারাহকারী এমন বিষয়কেও জারাহর কারন মনে করেন যা মূলত জারাহ করার মত দোষ নয়। (শরহে মুকাদ্দিমায়ে ইবনে সালাহ ১ খন্ড ১৪০ পৃষ্ঠা)

কোনো একজন রাবীর ব্যাপারে কোন ইমাম প্রশংসা করেছে, তখন সে রাবীর ব্যাপারে ব্যাখ্যাহীন জারাহ গ্রহনযোগ্য নয়। হাফিযে হাদীছ ইবনে হাজার আসকালানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, যে রাবীকে কোন একজন ইমামও ছিক্বাহ বলেছেন সে রাবীর ব্যাপারে কেউ জারাহ করলে তা গ্রহণ করা হবে না, যতক্ষন না সে তার কারণ ব্যাখ্যা করে। (তাদরীবুর রাবী)

কোন রাবীর আদালত ও নির্ভরযোগ্যতা সাবস্ত্য হওয়ার পর তার ব্যাপারে কোন জারাহ ততক্ষণ পর্যন্ত গৃহীত হবে না যতক্ষণ না এর সুস্পষ্ট কারণ ব্যাখ্যা করা হবে। (ফতহুল মুগীছ ১৩০ পৃষ্ঠা)

বিভিন্ন জন বিভিন্ন অবস্থান থেকে জারাহ করেছেন, যেমন এ বিষয়ে হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, কেউ কেউ ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে জারাহ করেছেন, আবার কেউ কেউ প্রতিদ্বন্দিতামূলক মনোভাব থেকে জারাহ করেছেন, কেউ কেউ নিজের চাইতে বড় ব্যক্তিকে জারাহ করেছেন। এর সবই অগ্রহণযোগ্য। (মুকাদ্দিমায়ে ফতহুল বারী ৪৪৬ পৃষ্ঠা)

আরো বর্ণিত আছে, দুইজন সমকালীন আলিম উনাদের পারস্পারিক জারাহ বা দোষারোপ গ্রহণযোগ্য হবে না, যতক্ষন না তার দলীল পেশ করা হবে। (ফতহুল মুগীছ ৪৮৪ পৃষ্ঠা)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার শেষে বা কোন রাবী উনার নামের পাশে শুধুমাত্র

هذا حديث ضعيف  فلان ضيعف فلان ليس بشى

(অমুক হাদীছ শরীফ দ্বয়ীফ, অমুক রাবী দ্বয়ীফ, অমুক অপরিচিত) লিখে দিলেই হবে না, বরং ব্যাখ্যা থাকতে হবে কোন কারনে জারাহ করা হলো।

হযরত আব্দুল হাই লাখনবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এ বিষয়ে বলেন, ব্যাখ্যাহীন জারাহ-এর চাইতে তা’দীলই অগ্রগণ্য। (যফারুল আমানী ২৮১ পৃষ্ঠা)

যেমন, হযরত ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কোনো কোনো পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাকে হযরত আবু রাযী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত আবু যুরআ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা বর্জন করেছেন। হযরত ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার উস্তাদ ইমাম যুহরী রহমতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে শুধু মু’তাজিলা বলেই ক্ষান্ত হননি বরং মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করতেও নিষেধ করেছেন। (সিয়ারু আলামীন নুবালা ২২/৪৫৬, তারীখে বাগদাদ ২/১৩)

ইমাম হযরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইমাম খলিক্বান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি জহমিয়া বলেছেন। (ওয়াফাতুল আইয়ান ২/৯১)

ইমামে আযম হযরত আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত ইবনে হিব্বান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা জারাহ করেছেন, ইমাম হযরত তিরমিযী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে ইবনে হাজম রহমতুল্লাহি আলাইহি মাজহুল বলেছেন। এমনিভাবে ইমাম হযরত মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে ইবনে যী’ব রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং ইমাম হযরত শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে ইবনে মঈন রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইবনে হিব্বান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে স্বয়ং তার ছাত্র জারাহ করেছেন। কিতাব খুলে এসব জারাহ দেখে কি ঐ সমস্ত পৃথিবী বিখ্যাত ইমাম ও মুহাদ্দিছ উনাদের বাদ দিয়ে দিতে হবে? তাহলে কি পৃথিবীতে ফিৎনা সৃষ্টি হবে না? কাফিররা এটাই চায় । তারা মুসলামান উনাদের মাঝে ইখতিলাফ সৃষ্টি করে উরারফব ধহফ ৎঁষব কায়িম করতে চায়। আর একারনে তারা ওহাবী সালাফীদেরকে এই কাজের জন্য নিয়োজিত করেছে।

মূলকথা হলো, জারাহ দেখেই কাউকে পরিত্যাগ করা যাবে না। এ বিষয়ে হযরত ইবনে জরীর রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বর্ণনা করেন-

ومن ثبتت عدالته لم يقبل فيه الجرح وما تسقط العدالة بالظن

অর্থ: সূতরাং যার আদালত ন্যায়পরায়নতা প্রমাণিত হয়েছে, তার বিষয়ে কারো জারাহ বা সমালোচনা গ্রহণনযোগ্য হবে না। শুধুমাত্র ধারণার উপর ভিত্তি করে তার আদালত বা ন্যায়পরায়নতা বিলুপ্ত হবে না। (মুকাদ্দিমায়ে ফতহুল বারী ১/৪২৯) (চলবে)

মুহম্মদ নূরুদ্দীন পলাশ