সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সংখ্যা: ১৮৭তম সংখ্যা | বিভাগ:

মুহম্মদ মুশফিকুর রহমান

ঝাউতলা স্টেশন রোড, চট্রগ্রাম

 সুওয়াল: চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত রেযাখানীদের অখ্যাত মাসিক মুখপত্র ডিসেম্বর-জানুয়ারি /২০০৬ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে একটি মাসিক পত্রিকার কথা উল্লেখ করে “আল ফিকহু আলা মাযাহিবিল আরবায়া, আল জাওহারাতুন নাইয়ারাহ্ ও রদ্দুল মুখতার” কিতাবের বরাত দিয়ে বলেছে, “আযানের মৌখিক জাওয়াব দেওয়া মুস্তাহাব”…।

এখন আমার সুওয়াল হল- তারা “আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া সম্পর্কে যে সকল কিতাবের ইবারত উল্লেখ করেছে তা কতুটুকু গ্রহণযোগ্য?

 জাওয়াব:ঃ আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া সম্পর্কে রেযাখানীদের অখ্যাত মাসিক মুখপত্রের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং স্ববিরোধী, ভুল ও অশুদ্ধ হয়েছে এবং ছহীহ হাদীছ শরীফ ও হানাফী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য বিশ্বখ্যাত অনুসরণীয় ফিক্বাহ ও ফতওয়ার  কিতাবসমূহে বর্ণিত তারজীহ্ বা প্রাধান্যপ্রাপ্ত তথা মুখতার বা গ্রহণযোগ্য মতের সম্পূর্ণ খিলাফ হয়েছে। কারণ আমাদের হানাফী মাযহাব মতে আযান শ্রবণকারীর সকলের জন্যই আযানের জাওয়াব মৌখিকভাবে দেয়া ওয়াজিব। আর এই আযানের মৌখিক জাওয়াব না দিলে সে ওয়াজিব তরককারী হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে নাফরমানের অন্তর্ভুক্ত হবে।

সুতরাং মুয়ায্যিনের আযান শুনে আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব এবং এর উপরই ফতওয়া। হানাফীদের জন্য এর বিপরীত মত পোষণ করা জিহালতী ও গুমরাহী বৈ কিছুই নয়।

রেযাখানী মৌলভী ছাহেবরা “আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া মুস্তাহাব বলে জিহালতী ও গুমরাহীর পরিচয় দিয়েছে এবং কিতাবের নাম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়েছে। নিম্নে পর্যায়ক্রমে তাদের প্রতিটি দলীলের খ-নসহ সঠিক ও গ্রহণযোগ্য ফতওয়া উল্লেখ করা হচ্ছে-

(ধারাবাহিক)

রেযাখানী মুখপত্রে প্রদত্ত “হাশিয়ায়ে রদ্দুল মুহ্তার” কিতাবের বক্তব্য পর্যালোচনা-

উল্লেখ্য, রেযাখানীরা “আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া মুস্তাহাব বলে “হাশিয়ায়ে রদ্দুল মুহ্তার” কিতাব থেকে ইমাম ইবনে আবেদীন শামী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর বরাত দিয়ে যে ইবারতখানা উল্লেখ করেছে, তা নিম্নে হুবহু উল্লেখ করা হলো।

যেমন- রেযাখানীরা তাদের দলীল হিসেবে উল্লেখ করেছে যে, ইমাম ইবনে আবেদীন শামী রহমতুল্লাহি আলাইহি এ প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা করে বলেন,

(وقال  الحلوانى ندبا) اى قال الحلوانى ان الاجابة باللسان مندوبة والواجبة هى الاجابة بالقدم.

অর্থাৎ, ইমাম হালওয়ানী বলেন, আযানের মৌখি জাওয়াব দেয়া মুস্তাহাব। আর আযানের জাওয়াবে জামাতে উপস্থিত হওয়া হলো ওয়াজিব।

এর জবাবে বলতে হয় যে, রেযাখানীরা আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া মুস্তাহাব বলে “হাশিয়ায়ে রদ্দুল মুহ্তার” কিতাব থেকে ইমাম ইবনে আবেদীন শামী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর বরাত দিয়ে যে ইবারতখানা উল্লেখ করেছে, উক্ত ইবারতের প্রথম বন্ধনীর শুরুতেই তারা ইবারত কারচুপি করেছে। যেমন রেযাখানীরা বলেছে,

(وقال الحلوانى ندبا)

অথচ ইমাম ইবনে আবেদীন শামী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর “হাশিয়ায়ে রদ্দুল মুহ্তার” কিতাবের মূল ইবারত হলো-

(قوله وقال الحلوانى ندبا الخ)

দ্বিতীয়তঃ রেযাখানীরা আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া মুস্তাহাব বলে “হাশিয়ায়ে রদ্দুল মুহ্তার” কিতাব থেকে ইমাম আবেদীন শামী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর বরাত দিয়ে যে ইবারতখানা উল্লেখ করেছে, উক্ত ইবারতের পরবর্তী ইবারতগুলো রেযাখানীরা কারচুপি করে উল্লেখ করেনি।

কারণ রেযাখানীদের কারচুপি করা পরবর্তী ইবারতেই উল্লেখ আছে যে, হালওয়ানীর বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ হালওয়ানীর বক্তব্য الاجابة بالقدم (আল ইজাবাতু বিলকুদুম) এর মাধ্যমে অর্থাৎ জামায়াতে নামায আদায় করার জন্য মসজিদে উপস্থিতির মাধ্যমে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব এটা মুশকিল। কেননা قدم বা উপস্থিতির মাধ্যমে অর্থাৎ জামায়াতে নামায আদায় করার জন্য মসজিদে উপস্থিতির (গমণের) মাধ্যমে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব হলে প্রথম ওয়াক্তেই মসজিদে উপস্থিতির মাধ্যমে ওয়াজিব আদায় করা তার উপর লাযিম হয়ে যায়। আর আযানের পূর্ব থেকেই মসজিদে উপস্থিত থাকলে নামায ব্যতীত, আযানের জাওয়াব দেয়ার জন্য মসজিদে গমন করা যে ওয়াজিব তা নিরর্থক হয়ে যায়।

যেমন, রেযাখানীদের কারচুপি করা পরবর্তী ইবারতগুলো হলো-

قال فى النهر: وقوله بوجوب الاجابة بالقدم مشكل, لأنه يلزم عليه وجوب الأداء فى اول الوقت وفى المسجد اذلا معنى لايجاب الذهاب دون الصلاة.

অর্থ: “নাহরুল ফায়িক” কিতাবে উল্লেখ আছে, নিশ্চয়ই হালাওয়ানীর বক্তব্য কুদুম বা উপস্থিতির মাধ্যমে অর্থাৎ জামায়াতে নামায আদায় করার জন্য মসজিদে উপস্থিতির মাধ্যমে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব এটা মুশকিল। কেননা জামায়াতে নামায আদায় করার জন্য মসজিদে উপস্থিতির (গমনের) মাধ্যমে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব হলে প্রথম ওয়াক্তেই মসজিদে উপস্থিতির মাধ্যমে ওয়াজিব আদায় করা তার উপর লাযিম হয়ে যায়। আর আযানের পূর্ব থেকেই মসজিদে উপস্থিত থাকলে নামায ব্যতীত, আযানের জাওয়াব দেয়ার জন্য মসজিদে গমন করা নির্থক। (কেনা সে তো আযানের পূর্ব থেকেই মসজিদে উপস্থিত)

(হাশিয়ায়ে রদ্দুল মুহ্তার ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৯৬)

এছাড়াও হালওয়ানীর উক্ত বক্তব্য যে গ্রহণযোগ্য নয় তা বাহরুর রায়িক কিতাবেও উল্লেখ আছে-

যেমন, “বাহ্রুর রায়িক” কিতাবের ২৫৯ পৃষ্ঠার হাশিয়ায়ে উল্লেখ আছে-

واعلم ان قول الحلوانى بوجوب الاجابة بالقدم مشكل لانه يلزم عليه وجوب الاداء فى اول الوقت وفى المسجد اذلا معنى لايجاب الذهاب دون الصلاة.

অর্থ: “জেনে রাখুন! নিশ্চয়ই হালওয়ানীর বক্তব্য আল ইজাবাতু বিলকুদুম এর মাধ্যমে অর্থাৎ জামায়াতে নামায আদায় করার জন্য মসজিদে উপস্থিতির মাধ্যমে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব এটা মুশকিল। কেননা জামায়াতে নামায আদায় করার জন্য মসজিদে উপস্থিতির মাধ্যমে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব হলে প্রথম ওয়াক্তেই মসজিদে উপস্থিতির (গমনের) মাধ্যমে ওয়াজিব আদায় করা তার উপর লাযিম হয়ে যায়। আর আযানের পূর্ব থেকেই মসজিদে উপস্থিত থাকলে নামায ব্যতীত আযানের জাওয়াব দেয়ার জন্য মসজিদে গমন করা যে ওয়াজিব তা নিরর্থক হয়ে যায়।

অতএব, হালওয়ানীর উক্ত বক্তব্য থেকে এটাই প্রমাণিত হলো যে, হালওয়ানী যেহেতু আযানের জাওয়াবে قدم বা উপস্থিত হওয়াকেই ওয়াজিব বলেছে, সেহেতু হালওয়ানীর উক্ত বক্তব্যে আযানের জাওয়াবে প্রথম ওয়াক্তেই মসজিদে উপস্থিত হওয়া বা মসজিদে গমন করা ওয়াজিব। যা কখনই সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়তঃ হালওয়ানীর উক্ত বক্তব্যে এটাও প্রমাণিত হলো যে, আযানের পূর্ব থেকেই জামায়াতে নামায আদায় করার জন্য মসজিদে উপস্থিত থাকলে নামায ব্যতীত আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব তার উপর বর্তায় না। কেননা সে তো قدم বা উপস্থিত হয়েই আছে। যা সম্পূর্ণই হাদীছ শরীফ-এর খিলাফ হওয়ায় মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

সুতরাং আযানের জাওয়াবে قدم বা উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব হালওয়ানীর উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই ভুল ও অশুদ্ধ বলেই প্রমানিত হলো। কারণ হাদীছ শরীফে আযানের জাওয়াবে قدم বা উপস্থিত হওয়ার কথা বলা হয়নি। বরং হাদীছ শরীফ-এর মধ্যে قولوا শব্দটি উল্লেখ আছে।

যেমন, হাদীছ শরীফ-এর বর্ণিত আছে, আল্লাহ পাক-এর হাবীব, “হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

اذا سمعتم المؤذن فقولوا مثل ما يقول

অর্থ: “যখন তোমরা মুয়ায্যিনের আযান শুনবে তখন মুয়ায্যিন যা বলে তোমরাও তাই বল।” এই বর্ণিত হাদীছ শরীফের মধ্যে قولوا শব্দটি امر (আমর) এর ছিগাহ, যা দ্বারা সুষ্পষ্টভাবেই ওয়াজিব প্রমাণিত হয়।

যেমন, এ প্রসঙ্গে “মুয়াত্তা ইমাম মুহম্মদ” কিতাবের ৮৫ পৃষ্ঠার ৪নম্বর হাশিয়ায় উল্লেখ আছে,

قوله فقولوا استبدل به على وجوب اجابة المؤذن حكاه الطحاوى عن قوم من السلف وبه قال الحنيفة.

অর্থ: হাদীছ শরীফের ইবারতে উল্লিখিত فقولوا শব্দটির ভিত্তিতে দলীল গ্রহণ করা হয়েছে যে, মৌখিকভাবে মুয়ায্যিনের আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব। এটা ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি ছলফে-ছালিহীন রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের এক জামায়াত থেকেও বর্ণনা করেছেন। আর হাদীছ শরীফের ইবারতে উল্লিখিত فقولوا শব্দটির ভিত্তিতে দলীল গ্রহন করে হানাফীগণ বলেন, মৌখিকভাবে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব।

তৃতীয়তঃ বলতে হয় যে, মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব। রেযাখানীরা এটা গ্রহন না করে ইমাম হালওয়ানীর মতটি গ্রহণ করেছে। অথচ ইমাম হালওয়ানীর মতের উপর ফতওয়া নয় বরং ফতওয়া হলো আমাদের হানাফী মাযহাবের ইমাম, ইমামে আ’যম হযরত আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মতের উপর।

যেমন “মুয়াত্তা ইমাম মালিক” কিতাবের ২৩ পৃষ্ঠায় ৪ নম্বর হাশিয়ায় উল্লেখ আছে।

قوله فقولوا مثل ما يقول اى وجوبا عند ابى حنيفة وندبا عند الشافعى.

অর্থ: “আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ করেছেন, “যখন তোমরা আযান শুনবে, তখন মুয়াযযিন যেরূপ বলে তোমরাও অনুরূপ বল।”

অর্থাৎ এই হাদীছ শরীফের ভিত্তিতে আমাদের হানাফী মাযহাবের ইমাম, ইমামে আ’যম হযরত আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট মৌখিকভাবে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব আর শাফিয়ী মাযহাবে মুস্তাহাব।

চতুর্থতঃ বলতে হয় যে, রেযাখানীরা হালওয়ানীর বরাত দিয়ে বলেছে-

وقال الحلوانى ندبا

ইমাম হালওয়ানী বলেন, আযানের জাওয়াব দেয়া নুদব বা মুস্তাহাব।

অথচ ইমাম হালওয়ানীর উক্ত মতটি শাফিয়ী মাযহাবের মত। কারণ-

وندبا عند الشافعى

শাফিয়ী মাযহাবে আযানের জাওয়াব দেয়া নুদব বা মুস্তাহাব।

রেযাখানীদের জন্য আফসুস! কারণ তারা হানাফী মাযহাবের পরিচয় দিয়ে আমাদের হানাফী মাযহাবের ইমাম, ইমামে আ’যম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মতটি গ্রহণ না করে, ইমামে আযম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর উপর ইমাম হালওয়ানীকে প্রধান্য দিয়ে শাফিয়ী মাযহাবের মতটিকে গ্রহণ করে আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া মুস্তাহাব বলেছে।

অথচ আমাদের হানাফী মাযহাবে আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব। (চলবে)

খন্দকার সেলিম আহমদ

পাহাড় কাঞ্চনপুর, টাঙ্গাইল

সুওয়াল: হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে, মাসিক আল বাইয়্যিনাত-অক্টোবর ২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রদত্ত “মীলাদ-ক্বিয়াম” সম্পর্কিত বক্তব্যের সমালোচনা করতে গিয়ে  এবং একই বিষয়ে এপ্রিল-২০০৫ ঈসায়ী ও মে-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় এছাড়াও মাসিক মদীনা পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে একই ধরনের জবাব দেয়া হয়েছে।

তাদের বক্তব্যগুলোর মধ্যে যে বিষয়গুলো আমার নিকট সন্দেহজনক তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

যেমন, এপ্রিল-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে বলা হয়েছে, “আমাদের দেশে প্রচলিত মীলাদ ও ক্বিয়াম ইসলামী শরীয়ত পরিপন্থী, যা সম্পূর্ণভাবে মাকরূহে তাহরীমি। আইম্মায়ে মুজতাহিদীন কারো থেকে এই প্রচলিত মীলাদ ও ক্বিয়াম প্রমাণিত নয়। তাছাড়া মীলাদ ও ক্বিয়াম সম্পর্কে কোন প্রকার হাদীছও বর্ণিত নেই। ….”

এখন আমাদের সুওয়াল হলো, প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম সম্পর্কিত তাদের উল্লিখিত বক্তব্য কতটুকু দলীলসম্মত? কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াব: প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম সম্পর্কে হাটহাজারী মাদরাসার অখ্যাত মাসিক পত্রিকার জিজ্ঞাসার সমাধানে এবং অপর একটি পত্রিকার প্রশ্নোত্তর বিভাগে যা বলা হয়েছে তা শুদ্ধ তো হয়নি; বরং সম্পূর্ণই ডাহা মিথ্যা, ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন এবং অনুসরণীয় ইমাম-মুজতাহিদ ও ফক্বীহগণের সর্বজনমান্য ও স্বীকৃত বিশ্ব বিখ্যাত ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাবসমূহের বক্তব্যের বিপরীত ও বিরুদ্ধমত। যা ইতোপূর্বে আমাদের “মাসিক আল বাইয়্যনাত শরীফ”-এর অনেক সংখ্যায় খ-ন করে সঠিক ও দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হয়েছে। আর “মাসিক আল বাইয়্যিনাত শীরফ”-এর জাওয়াবকে খ-ন করা হাটহাজারী মৌলভী সাহেবদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হয়নি, হবেও না ইনশাআল্লাহ।

এরপরেও হাটহাজারীর মৌলভী সাহেব এবং তাদের সকল সমজাতীয়রা বার বার মীলাদ ক্বিয়াম সম্পর্কে বিনা তাহক্বীকে ও বিনা দলীলে উক্ত ভুলেরই পূনরাবৃত্তি করে যাচ্ছে।

(ধারাবাহিক)

যেমন, উল্লিখিত প্রথম বক্তব্যের প্রথমেই তারা বলেছে, “আমাদের দেশে প্রচলিত মীলাদ ও ক্বিয়াম ইসলামী শরীয়ত পরিপন্থী, যা সম্পূর্ণভাবে মাকরূহে তাহরীমি।”

এর জবাবে বলতে হয় যে, তাদের উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই দলীলবিহীন, ডাহা মিথ্যা ও কুফরীমূলক হয়েছে। কারণ, “আমাদের দেশে প্রচলিত মীলাদ ও ক্বিয়াম ইসলামী শরীয়ত পরিপন্থী নয়; বরং শরীয়তসম্মত, যা সম্পূর্ণভাবে সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সুন্নতে ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম-এর অন্তর্ভুক্ত। কারণ মীলাদ-ক্বিয়াম স্বয়ং নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের যামানাতেই ছিল। তবে মীলাদ শরীফ-এর বর্তমান তরতীব হচ্ছে সুন্নতে উম্মত ও মুস্তাহসান।”

দ্বিতীয়তঃ উল্লিখিত বক্তব্যের শেষের অংশে তারা বলেছে, “তাছাড়া মীলাদ ও ক্বিয়াম সম্পর্কে কোন প্রকার হাদীসও বর্ণিত নেই ….।”

এর জাওয়াবে বলতে হয় যে, তাদের এ বক্তব্যও ডাহা মিথ্যা ও কুফরীমূলক হয়েছে। কারণ, তাদের এ বক্তব্যে এটাই প্রমাণিত হয় যে, তারা হাদীছ শরীফকে অস্বীকার করেছে। অথচ হাদীছ শরীফে মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়ামের অনেক প্রমাণ রয়েছে। যা আমরা দলীলসহ প্রমাণ করে দিয়েছি।

দ্বিতীয়তঃ ক্বিয়াম সম্পর্কেও অনেক হাদীছ শরীফ বর্ণিত আছে। শুধু তাই নয় স্বয়ং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্বিয়াম করার জন্য সরাসরি নির্দেশও দিয়েছেন।

যেমন ক্বিয়াম القيام শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে-

قیام کرنا.کھڑا ہونا অর্থাৎ ক্বিয়াম করা বা দাঁড়ানো। (কামূস আল মুহীত, তাজুল উরুস, লিসানুল আরব, মিছবাহুল লুগাত, আল মুনজিদ)

আর ক্বিয়াম শব্দের ইস্তেলাহী বা পরিভাষিক অর্থ হচ্ছে, আখিরী রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি “সালাম’ পাঠকালে তা’যীমার্থে ও মুহব্বতে ক্বিয়াম করা বা দাঁড়ানো । এছাড়াও মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে আলিম-উলামা, পীর-মাশায়িখ, উস্তাদ, পিতা-মাতা, দ্বীনি নেতৃস্থানীয় সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে ক্বিয়াম করা বা দাঁড়ানো সুন্নত।

প্রসঙ্গ হাদীছ শরীফ-এ আরো ইরশাদ হয়েছে,

حدثنا محمد بن هلال رحمة الله عليه انه سمع اباه يحدث قال قال ابو هريرة رضى الله تعالى عنه وهو يحدثنا كان النبى صلى الله عليه وسلم يجلس معنا فى المسجد يحدثنا فاذا قام قمنا حتى نراه قد دخل بعض بيوت ازواجه.

অর্থ: “হযরত মুহম্মদ ইবনে হিলাল রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর পিতাকে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেছেন হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আমাদের কাছে বর্ণনা করেন যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সাথে মসজিদে বসে আলোচনা করার পর যখন (হুজরা শরীফ-এ) যাওয়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়াতেন তখন আমরাও দাঁড়ানোর মত দাঁড়িয়ে যেতাম (অর্থাৎ আমরাও আদবরে সাথে দাঁড়িয়ে যেতাম) এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি উনার কোন আহ্লিয়ার ঘরে প্রবেশ না করতেন ততক্ষণ আমরা দাঁড়িয়ে থাকতাম।” (আবূ দাউদ শরীফ, নাসাঈ  শরীফ)

হাদীছ শরীফ-এ আরো ইরশাদ হয়েছে,

عن محمد بن هلال رحمة الله عليه ابيه ان النبى صلى الله عليه وسلم كان اذا خرج قمنا له حتى بدخل بيته اخرجه البزار ورجاله ثفات.

অর্থ: “হরত মুহম্মদ বিন হিলাল রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় পিতা হতে বর্ণনা করেন যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হুজরা শরীফ হতে বের হতেন, তখন আমরা দাঁড়িয়ে যেতাম এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি স্বীয় হুজরা শরীফ-এ প্রবেশ না করতেন। (আমরা দাঁড়িয়ে থাকতাম) এ হাদীছ শরীফখানা বায্যার বর্ণন করেছেন, যার রাবী অত্যন্ত শক্তিশালী।’ (বায্যার, মাজমাউস্ যাওয়ায়িদ, ফিক্বহুস্ সুনানে ওয়াল আছার)

বুখারী শরীফ-এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ “র্ইশাদুস্ সারী” কিতাবের ৯ম খ-ের ১৫৫ পৃষ্ঠায় ছহীহ্ সনদে “হযরত উসামা ইবনে শারীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন,

قمنا الى النبى صلى الله عليه وسلم فقبلنا يده.

অর্থ: “আমরা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তা’যীম-এর জন্যে দাঁড়িয়ে উনার হাত মুবারক চুম্বন দিলাম।”

হাদীছ শরীফ-এ আরো ইরশাদ হয়েছে, হযরত কা’ব ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তয়ালা আনহু-এর তওবা কবুল হয়েছে বলে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ঘোষণা দিলেন তখন তিনি মসজিদে নববীতে ছুটে আসলেন। হযরত তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে স্বাগত জানাবার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে গেলেন।

এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে,

قال كعب رضى الله تعالى عنه حتى دخلت المسجد فاذا رسول الله صلى الله عليه وسلم جالس حوله الناس فقام الى طلحة بن عبيد الله يهرول حتى صافحنى وهنانى.

অর্থ: “হযরত কা’ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, অবশেষে আমি মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলাম তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ছাহাবায়ে কিরামগণ কর্তৃক বেষ্টিত অবস্থায় বসা ছিলেন। তন্মধ্য হতে হযরত তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং দ্রুত বেগে এসে আমার সাথে মুছাফাহা করলেন ও আমাকে ধন্যবাদ জানালেন।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)

উক্ত হাদীছ শরীফ-এর ব্যাখ্যায় বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিশ্বখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ “শরহুন নববী আলাল মুসলিম” কিতাবের ২য় খণ্ডের ৩৫২ পৃষ্ঠায় লিখেন।

فيه استحباب مصافحة القادم والقيام لاكرام والهرولة الى لقائه بشاشة به وفرحا.

অর্থ: “উল্লিখিত হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আগন্তুকের সম্মানে ক্বিয়াম করা, তাঁর সাথে মুছাফাহা করা এবং খুশি প্রকাশ করে তাঁর দিকে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া মুস্তাহাব-সুন্নত।”

এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফ-এ আরো উল্লেখ আছে,

اخبرنا عمرو بن يحيى رحمة الله عليه قال سمعت ابى يحدث عن ابيه قال كنا نجلس على باب عبد الله بن مسعودرضى الله تعالى عنه قبل صلاة الغداة فاذا خرج مشينا معه الى المسجد فجائنا ابى موسى الاشعرى رضى الله تعالى عنه فقال اخرج اليكم ابوعبد الرحمن بعد قلنا لا فجلس معنا حتى خرج فلما خرج قمنا اليه جميعا.

অর্থ: “হযরত আমর ইবনে ইয়াহয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, তিনি তাঁর পিতার বরাত দিয়ে বলেন যে, আমরা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর দরজার সামনে ফযরের নামাযের পূর্বে অপেক্ষা করছিলাম। তিনি বেরিয়ে আসলেন আমরা উনার সাথে মসজিদে আসলাম অতঃপর হযরত আবু মূসা আশয়ারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এসে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের পরে হযরত আব্দুর রহমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর পিতা বের হয়েছেন কি? আমরা জবাব দিলাম- না। আসেন নাই। তাই তিনিও আমাদের সাথে বসে পড়লেন। যখন তিনি (হযরত আব্দুর রহমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর পিতা) বের হয়ে আসলেন আমরা সকলেই উনার সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলাম বা ক্বিয়াম করলাম।” (সুনানুদ দারিমী)

কারো সম্মানে ক্বিয়াম করা সুন্নত হওয়ার ব্যাপারে হাদীছ শরীফ-এ আরো উল্লেখ আছে যে,

عن سليم بن حنظلة قال اتينا ابى بن كعب لنتحدث اليه فلما قام قمنا.

অর্থঃ- “হযরত সুলাইম ইবনে হানযালাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা হযরত উবাই ইবনে কা’ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিকট হাদীছ শরীফ শিখতে আসতাম, যখন তিনি দাঁড়াতেন আমরাও দাঁড়িয়ে যেতাম।” (সুনানুদ দারিমী)

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটাই প্রামণিত হলো যে, প্রচলিত মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম সম্পর্কিত হাটহাজারীর মৌলভী সাহেব এবং তাদের সকল সমজাতীয়দের বক্তব্য ডাহা মিথ্যা ও দলীলবিহীন বলে প্রমাণিত হলো। কারণ আমাদের দেশে প্রচলিত মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম সম্পর্কে সরাসরি অনেক হাদীছ শরীফ বর্ণিত আছে। যা দলীলসহ ছাবিত করা হলো। (চলবে)

মুহম্মদ সেলিনা আক্তার

বাবুরহাট, চাঁদপুর

সুওয়াল: মাসিক মদীনা নভেম্বর/২০০৮ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে বলা হয়েছে, “পাগড়ী পরে নামায আদায় করলে প্রতি রাকায়াতের বিনিময়ে সত্তর গুণের কথা সরাসরি হাদীছ শরীফে আছে কিনা তা আমার জানা নেই।”

এখন আমার সুওয়াল হলো- পাগড়ী পরে নামায আদায় করলে প্রতি রাকায়াতের বিনিময়ে সত্তর রাকায়াতের ছওয়াব পাওয়া যায়। ইহা সরাসরি হাদীছ শরীফে আছে কি না তা দলীল-আদিল্লাহসহ জানিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব: পাগড়ী পরে নামায আদায় করলে প্রতি রাকায়াতের বিনিময়ে সত্তর রাকায়াতের ছওয়াব পাওয়া যায়। ইহা যে সরাসরি হাদীছ শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত, তা মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীনের পক্ষে জানা না থাকাটাই স্বাভবিক। কারণ সে তো হাদীছ শরীফ নিয়ে থাকে না। বরং সে হাদীছ শরীফের খিলাফ সর্বদা হারাম কাজেই মশগুল থাকে। যেমন, হারাম ছবি তুলে, বেপর্দা হয়, বেগানা মহিলার সাথে ইফতার করে, বেগানা মহিলার পাশে বসে ছবি তুলে, তন্ত্র-মন্ত্র করে, ভোট, নির্বাচন করে। সুতরাং যারা এ ধরনের হারাম  কাজে মশগুল থাকে তারা হাদীছ শরীফের বিষয় জানবে কি করে?

পাগড়ী পরে নামায আদায় করলে প্রতি রাকায়াতের বিনিময়ে সত্তর রাকায়াতের ছওয়াব পাওয়া যায়। ইহা যে সরাসরি হাদীছ শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত আছে। এ সম্পর্কে দলীল-আদিল্লাহ নিম্নে প্রদত্ত হলো-

যেমন “কাশফুল খফা ওয়া মুযীলুল ইলবাস” কিতাবের ২য় খণ্ডের ৬৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

عن جابر رضى الله تعالى عنه ركعتان بعمامة افضل من سبعين من غيرها.

    অর্থ: “হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, পাগড়ী পরে দু’রাকায়াত নামায পাগড়ী ছাড়া সত্তর রাকায়াত নামায থেকে উত্তম”।

মিশকাত শরীফের বিখ্যাত ও মশহুর শরাহ “মিরকাত শরীফ” কিতাবের ২য় খণ্ডের ২৯৩ পৃষ্ঠায় হাদীছ শরীফের কিতাব “দাইলামী শরীফের” বরাত দিয়ে হাদীছ শরীফখানা মারফু হিসেবে উল্লেখ করেছে।

اورده الديلمى من حديث ابن عمر رضى الله تعالى عنه مرفوعا صلاة بعمامة تعدل بخمس وعشرين صلاة جمعة بعمامة تعدل سبعين جمعة.

  অর্থ: “হযরত দাইলামী রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে মারফু হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেন যে, পাগড়ীসহ এক ওয়াক্ত নামায, পাগড়ী ছাড়া পঁচিশ ওয়াক্ত নামাযের সমপরিমাণ ছওয়াব পাওয়া যায়।” আর পাগড়ীসহ একটি জুমুয়া, পাগড়ী ছাড়া সত্তরটি জুমুয়া আদায়ের সমপরিমাণ ছওয়াব পাওয়া যায়।”

উক্ত কিতাবে আরো উল্লেখ আছে,

ومن حديث انس رضى الله تعالى عنه مرفوعا الصلوة فى العمامة بعشر.

   অর্থ: “হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে মারফু হাদীছ শরীফ বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, পাগড়ী পরে নামায আদায় করলে দশগুণ ছওয়াব লাভ হয়।”

“মিরকাত শরীফ” কিতাবের ৮ম খণ্ডের ২৫০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

وروى ابن عساكر عن ابن عمر رضى الله تعالى عنه مرفوعا صلاة تطوع او فريضة بعمامة تعدل خمسا وعشرين صلاة بلا عمامة وجمعة بعمامة تعدل سبعين جمعة بلا عمامة فهذا كله يدل على فضيلة العمامة مطلقا.

  অর্থ: “হযরত ইবনে আসাকির রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে মারফু হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেন যে, পাগড়ী পরে ফরয অথবা নফল নামায আদায় করলে, পাগড়ী ছাড়া পঁচিশ গুণ ফরয অথবা নফল নামাযের সমান ছওয়াব পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে পাগড়ীসহ একটি জুমুয়া আদায় করলে পাগড়ী ছাড়া সত্তরটি জুমুয়া আদায় করার সমপরিমাণ ছওয়াব পাওয়া যায়। সাধারণতঃ এটা দ্বারা পাগড়ী পরিধানের ফযীলতের দলীল সাব্যস্ত হয়।”

“তুহফাতুল আহওয়াযী” কিতাবের ৫ম খণ্ডের ৪১৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

رواه ابن عساكر والديلمى عن ابن عمر مرفوعا. صلاة تطوع او فريضة بعمامة تعدل خمسا وعشرين صلاة بلا بعمامة وجمعة بعمامة تعدل سبعين جمعة بلا عمامة.

অর্থ: “হযরত ইবনে আসাকির ও হযরত দাইলামী রহমতুল্লাহি আলাইহিমা, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা হতে মারফু হাদীছ  শরীফ বর্ণনা করেন যে, পাগড়ী পরে ফরয অথবা নফল নামায আদায় করলে, পাগড়ী ছাড়া পঁচিশগুণ ফরয অথবা নফল নামাযের সমান ছওয়াব পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে পাগড়ীসহ একটি জুমুয়া আদায় করলে, পাগড়ী ছাড়া সত্তরটি জুমুয়া আদায় করার সমপরিমাণ ছওয়াব পাওয়া যায়।”

“হিদায়াতুল ইবাদ” কিতাবের ৬৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

فى الحديث جمعة بعمامة افضل من سبعين صلاة بلا عمامة.

  অর্থ: “হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে, পাগড়ীসহ এক জুমুয়ার নামায পাগড়ী ছাড়া সত্তর জুমুয়ার নামায অপেক্ষা উত্তম।”

“মিরকাত শরীফ” কিতাবের ২য় খণ্ডের২২৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

وروى انه عليه السلام قال صلاة بعمامة افضل سبعين صلاة بغير عمامة كذا نقله ابن حجر.

  অর্থ:  হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে, নিশ্চয়ই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, পাগড়ী পরে নামায আদায় করলে পাগড়ী ছাড়া সত্তর গুণ নামাযের থেকে উত্তম। অনুরূপ বর্ণনা হযরত ইবনে হাজার আসকালানী রহমতুল্লাহি আলাইহিও বর্ণনা করেছেন।”

এছাড়াও হাদীছ শরীফের বিখ্যাত শরাহ গ্রন্থগুলোতে উল্লেখ আছে যে, পাগড়ী পরিধান করে এক রাকায়াত নামায আদায় করলে সত্তর রাকায়াত নামাযের ফযীলতের কথা উল্লেখ আছে।

যেমন “শামায়িলুত্ তিরমিযী” কিতাবের ৮ পৃষ্ঠার হাশিয়ায় উল্লেখ আছে,

ان ركعتين مع العمامة افضل من سبعين ركعة بدونها.

 অর্থ: “নিশ্চয়ই পাগড়ী পরিধান করে দু’রাকায়াত নামায আদায় করা, পাগড়ী ছাড়া সত্তর রাকায়াত নামায আদায় করার চেয়ে অধিক ফযীলতপূর্ণ।”

“তিরমিযী শরীফ” নামক কিতাবের ১ম খণ্ডের ২০৭ পৃষ্ঠার হাশিয়ায় উল্লেখ আছে,

بداں کہ پوشیدن عمامہ سنت ست واجادیث بسیار در فضل ان وارد شدہ وامدہ است کہ دو رکعت بعمامہ بہتر ست از ہفتاد رکعت بے عمامہ.

 অর্থ: “পাগড়ী মাথায় বেঁধে রাখা সুন্নত। অনেক হাদীছ শরীফে এর ফযীলত আলোচিত হয়েছে। যেমন, পাগড়ীসহ দু’রাকায়াত নামায পাগড়ী ছাড়া সত্তর রাকায়াত নামাযের চেয়ে উত্তম।”

“মিরায়াতুল্ মানাজীহ্” কিতাবের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ১০৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

بغیر عمامہ کی ۸۰  نمازیں اور عمامہ سے ایک نماز برابر ہے.

  অর্থ: পাগড়ী ছাড়া সত্তর রাকায়াত নামাযের ছওয়াব পাগড়ীসহ এক রাকায়াত নামাযের সমপরিমাণ ছওয়াবতুল্য।”

  অতএব, উপরোক্ত দলীলভিত্তিক আলোচনা থেকে এটাই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, পাগড়ী পরে নামায আদায় করলে প্রতি রাকায়াতের বিনিময়ে সত্তর রাকায়াতের ছওয়াব পাওয়া যায়, ইহা যে সরাসরি হাদীছ শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত তা হাদীছ শরীফ তথা শরীয়তের খিলাফ হরদম আমলকারী মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীনের পক্ষে জানা না থাকাটাই স্বাভাবিক।

সুতরাং, যারা হরদম শরীয়তের খিলাফ তথা হারাম ও কুফরী কাজে মশগুল, তাদের কাছে কোন মাসয়ালা জিজ্ঞেস করা বা জানার জন্য প্রশ্ন করা শরীয়তে জায়িয নেই।

[বিঃ দ্রঃ  পাগড়ী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ৮৩তম সংখ্যা থেকে ৯৬তম সংখ্যার ফতওয়া বিভাগ পাঠ করুন। সেখানে প্রায় ১৫০০ দলীল-আদিল্লাহ্ দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছে যে, পাগড়ী পরিধান করা দায়িমী সুন্নত এবং পাগড়ী পরে নামায আদায় করলে প্রতি রাকায়াতের বিনিময়ে সত্তর রাকায়াতের ছওয়াব পাওয়া যায়, ইহা সরাসরি হাদীছ শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত আছে। ]

মুসাম্মত সানজিদা আক্তার

সভানেত্রী- ছাত্রী আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত

মুহম্মদপুর, ঢাকা।

সুওয়াল: অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম এপ্রিল/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-জবাব বিভাগে নিম্নোক্ত ১২৪৭ নম্বর জিজ্ঞাসার জবাব ছাপা হয়।

জিজ্ঞাসা: ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী ও আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন যে, রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার মৃত্যুর পর পূর্ব দেশগুলির মধ্য হতে কোন একটি দেশ থেকে আমার উম্মতের ভিতর হতে একটি দল বের হবে। এই দলের সদস্যগণ হবে অশিক্ষিত ও মূর্খ এদের মধ্যে কোন শিক্ষিত লোক গেলে সেও হয়ে যাবে মূর্খের মত তাদের বক্তৃতা হবে বহু বহু গুণের ফযীলতের। তাদের মত বক্তৃতা বা বয়ান কারো হবে না। …… তারা কুরআনের উপর আমল কিম্বা কুরআন প্রতিষ্ঠার একটু চেষ্টাও করবে না কখনো। উক্ত অখ্যাত পত্রিকা হাদীছ শরীফ ছহীহ স্বীকার করলেও মন্তব্য করেছে যে, প্রচলিত তাবলীগের কার্যক্রম পুরোপুরি শরীয়তসম্মত। ইসলাম পরিপন্থী কোন কিছু এতে নেই।

উক্ত অখ্যাত পত্রিকার উল্লিখিত “জিজ্ঞাসা-জবাবের” প্রেক্ষিতে আমার সুওয়াল বা জানার বিষয় হলো-

…. (৪) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের পৃষ্ঠপোষকতায় বা পরিচালনায় যারা রয়েছে তারা সকলেই হক্কানী আলিম, তাদের এ দাবি কতটুকু সঠিক? আসলে হক্কানী আলিমের সংজ্ঞা বা পরিচিতি কি?

কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে উল্লিখিত সুওয়ালগুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াব: প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে উক্ত অখ্যাত পত্রিকার জবাব শুদ্ধ হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন হয়েছে।

তাই নিম্নে সুওয়ালে বর্ণিত বিষয়গুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হলো-

ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে প্রশ্নে উল্লিখিত

অখ্যাত পত্রিকার অপব্যাখ্যা ও মিথ্যাচারিতার খ-নমূলক জবাব (৪)

প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে অখ্যাত পত্রিকার ‘জিজ্ঞাসার জবাবের প্রেক্ষিতে আপনার চতুর্থ সুওয়াল হলো-

(৪) “প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগের পৃষ্ঠপোষকতায় বা পরিচালনায় যারা রয়েছে তারা সকলেই হক্কানী আলিম, তাদের এ দাবি কতটুকু সঠিক? আসলে হক্কানী আলিমের সংজ্ঞা বা পরিচিতি কি?

আপনার উক্ত সুওয়ালের প্রেক্ষিতে বলতে হয় যে, প্রচলিত ছয় উছূলীদের উক্ত দাবি সম্পূর্ণই অবান্তর, মিথ্যা ও দলীলবিহীন। কারণ গত দুই সংখ্যায় প্রদত্ত হক্কানী আলিমের সংজ্ঞা বা পরিচিতিমূলক আলোচনা দ্বারা অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, হক্কানী আলিম বা সত্যিকার নায়িবে নবী তিনিই (১) যিনি ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত অনুযায়ী আক্বীদা পোষণ করেন, (২) ইলমে ফিক্বাহ অর্জন করার সাথে সাথে একজন হক্কানী শায়খ বা মুর্শিদ-এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করে তাছাউফ চর্চা করতঃ অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহভীতি বা তাক্বওয়া অর্জন করেছেন, (৩) অর্জিত ইলম অনুযায়ী পরিপূর্ণ আমল করেন, (৪) সুন্নতের পূর্ণ  পায়রবী করেন, (৫) হারাম-নাজায়িয ও শরীয়তবিরোধী কাজে লিপ্ত হননা। কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর দৃষ্টিতে তাঁরাই আলিম বা নায়িবে নবী।

অথচ প্রচলিত ছয় উছূলীদের কথিত আলিমদের মধ্যে উল্লিখিত গুণাবলীসমূহের কোনটাই বিদ্যমান নেই। আমরা যদি উল্লিখিত পাঁচটি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করি তবে বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।

হক্কানী আলিম হওয়ার জন্য দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে-

২. ইলমে ফিক্বাহ অর্জন করার সাথে সাথে একজন হক্কানী শায়খ বা মুর্শিদ-এর নিকট বাইয়াত হয়ে ইলমে তাছাউফ চর্চা করতঃ অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহভীতি বা তাক্বওয়া অর্জন করা।

অথচ ছয় উছূলীরা ইলমে ফিক্বাহ যৎসামান্য শিক্ষা করলেও ইলমে তাছাউফ মোটেও শিক্ষা করেনা বরং ইলমে তাছাউফ ও পীর মাশায়িখ সম্পর্কে এলোমেলো কথা বলে থাকে। অথচ ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে ইলমে তাছাউফ অর্জন করা, হক্কানী মুর্শিদ বা শায়খ-এর নিকট বাইয়াত হওয়া, ছোহবত ইখতিয়ার করা, ক্বলবী যিকির করা প্রত্যেকটাই ফরযে আইন। নিম্নে এ সম্পর্কে দলীল-আদিল্লাসহ আলোচনা করা হলো।

পূর্ব প্রকাশিতের পর

গত কয়েক সংখ্যার আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, অন্তর পরিশুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ইলমে তাছাউফ অর্জন করতে হলে এবং দায়িমী বা সার্বক্ষণিকভাবে আল্লাহ পাক-এর যিকিরে মশগুল থাকার জন্য বা হুযূরী ক্বল্ব অর্জন করতঃ অন্ততঃপক্ষে বেলায়েতে আম হাছিল করতে হলে, অবশ্যই একজন কামিল মুর্শিদ বা শায়খ-এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করতে হবে। কারণ মুর্শিদ বা শায়খ-এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করা ব্যতীত ইল্মে তাছাউফ অর্জন করার মাধ্যমে অন্তর পরিশুদ্ধ করতঃ হুযূরী হাছিল করা বা বেলায়েতে আম হাছিল করা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। তাই একজন কামিল পীর বা মুর্শিদ-এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করা ফরয।

কামিল মুর্শিদ বা শায়খ-এর আলামত

ইল্মে তাছাউফ অর্জন করার মাধ্যমে অন্তর পরিশুদ্ধ করতঃ ইখলাছ হাছিল করার জন্য পীর বা শায়খ-এর নিকট বাইয়াত হওয়া যেরূপ ফরয, তদ্রুপ বাইয়াত হওয়ার পূর্বে যাচাই-বাছাই বা পূর্ণ তাহ্ক্বীক করাও ফরয। অর্থাৎ যাঁর নিকট বাইয়াত হবে, তিনি হক্কানী পীর কিনা তা ভালরূপে যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে। কেননা হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

فانظروا عمن تأخذون دينكم

অর্থ: “তোমরা কিরূপ লোক থেকে তোমাদের দ্বীন (ইল্ম বা নছীহত) গ্রহণ করছো, তা ভালরূপে লক্ষ্য করো।” (মুসলিম, তিরমিযী, মিশকাত, শরহে নববী, মায়ারেফুস্ সুনান, মিরকাত, লুময়াত আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তা’লীকুছ ছবীহ্, মুজাহেরে হক্ব)

অর্থাৎ যে মুর্শিদ বা শায়খ-এর নিকট বাইয়াত হবে, তাঁর আক্বীদা পরিপূর্ণভাবে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা মোতাবেক ও আমল সম্পূর্ণভাবে সুন্নত অনুযায়ী হতে হবে। অর্থাৎ সুন্নতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম, পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণকারী হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর আক্বীদা ও আমল, সীরত ও ছূরত সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াস সম্মত হতে হবে। তবেই তিনি হক্কানী পীর বা শায়খ।

স্মরণযোগ্য যে, যিনি হক্কানী শায়খ বা মুর্শিদ হবেন, তাঁকে অবশ্যই আলিম হতে হবে। অর্থাৎ ইল্মে ফিক্বাহ্ ও ইল্মে তাছাউফ-এর অধিকারী হতে হবে এবং সে অনুযায়ী আমলও থাকতে হবে।

অনেকেই মনে করে থাকে যে, টাইটেল বা দাওরা পাস করলে বা তৎসম্পর্কিত সার্টিফিকেট লাভ করলেই তাকে আলিম বলে। আবার কারো কারো ধারণা জালালাইন ও মিশকাত শরীফ পড়তে পারলেই সে আলিম বা কামিল পীর। মূলতঃ এ ধারণা বা বক্তব্য সম্পূর্ণই শুদ্ধ ও কুরআন-সুন্নাহ্ অনুযায়ী নয়।

কারণ শরীয়তের কোথাও আলিম হওয়ার জন্য টাইটেল/ দাওরা পাস করাকে বা সার্টিফিকেট লাভ করাকে এবং শুধুমাত্র উক্ত কিতাবদ্বয় পড়তে সক্ষম হওয়াকে শর্ত করা হয়নি। বরং শরীয়তের দৃষ্টিতে আলিম ঐ ব্যক্তিই যিনি ইল্মে ফিক্বাহ ও ইল্মে তাছাউফের অধিকারী এবং আল্লাহ পাককে ভয় করেন ও ইল্ম অনুযায়ী আমল করেন।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালাম পাক-এ ইরশাদ করেন,

انما يخشى الله من عباده العلماء

অর্থ: “নিশ্চয় আল্লাহ পাক-এর বান্দাদের মধ্য হতে শুধুমাত্র আলিমগণই আল্লাহ পাককে ভয় করেন।” (সূরা ফাতির-২৮)

এ আয়াত শরীফের তাফসীর জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, হাম্বলী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ও ইমাম, ইমামুল আইম্মাহ, শায়খুল মুহাদ্দিসীন, হযরত আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহিকে। তিনি এ আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় বলেন, “যাঁর ভিতর যত বেশি খোদাভীতি রয়েছে তিনি ততবড় আলিম।”

উক্ত আয়াত শরীফ-এর ব্যাখ্যায় বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে খোলাছায়” উল্লেখ আছে যে,

   العلماء سے اصطلاحی عالم یعنی کتابیں پرہ لینے والے مراد نہیں بلکہ کبریائے ذات وعظمت صفات کو نور ایمان شمع عرفان سے دیکہنے والے اسلئے کہ اصحاب رسول صلے اللہ علیہ وسلم و ارباب ولایت وقبول سبکے سب علماء کتابی نہ تہی  گو اونکا علم نافع اعلی درجے کاتھا.

অর্থ: উক্ত আয়াত শরীফে علماء শব্দ দ্বারা কিতাবসমূহ পাঠকারী তথা দাওরা বা টাইটেল পাসকারীদেরকে বুঝানো হয় নাই। বরং কুরআন শরীফে বর্ণিত “আলিম” তাঁরাই, যাঁরা মহান আল্লাহ পাক-এর মহিমাময় জাত ও অসীম গৌরবময় ছিফাতসমূহকে ঈমান ও মা’রিফতের নূরের আলোকে অবলোকন করেছেন। কেননা সাইয়্যিদুল মুরসালীন ইমামুল মুরসালীন, হুযূর  পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রিয়তম ছাহাবী আজমাঈন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ ও (পূর্ববর্তী) বেলায়েতপ্রাপ্ত ও মকবুল ওলীআল্লাহ্গণ কিতাবী তথা দাওরা বা টাইটেল পাস আলিম ছিলেন না। তথাপিও তাঁরা সর্বোচ্চ স্তরের উপকারী ইল্মের অধিকারী ছিলেন। অর্থাৎ তাঁরাই কুরআন শরীফে বর্ণিত প্রকৃত আলিম ছিলেন।           উল্লিখিত আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত আলিম, ইমামুল মুফাস্সিরীন হযরত ইবনে কাছীর রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর প্রসিদ্ধ “তাফসীরে ইবনে কাছীরে” উল্লেখ করেন,

عن ابن مسعود رضى الله تعالى عنه قال ليس العلم عن كثرة الحديث ولكن العلم عن كثرة الخشية وقال احمد بن صالح المصرى عن ابن وهاب عن مالك قال ان العلم ليس لكثرة الرواية وانما العلم نور يجعله الله تعالى فى القلب.

অর্থ: “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, যে ব্যক্তি অধিক হাদীছ জানে সে ব্যক্তি আলিম নয়। বরং যাঁর মধ্যে আল্লাহভীতি অধিক সে ব্যক্তিই আলিম। আর আহ্মদ বিন ছালেহ মিছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, অধিক রেওয়ায়েত শিক্ষা করলেই আলিম হওয়া যায়না। মূলতঃ ইল্ম হচ্ছে নূর বা জ্যোতি স্বরূপ। আল্লাহ পাক তা মানুষের অন্তকরণে দান করেন।”        উক্ত “তাফসীরে ইবনে কাছীরে” উল্লিখিত আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় আরো উল্লেখ আছে যে,

قال سفيان الثورى … العلماء ثلاثة عالم بالله وعالم بامر الله وعالم بالله ليس بعالم بامرالله وعالم بامرالله ليس بعالم بالله. فالعالم بامرالله وبامرالله الذى يخشى الله تعالى ويعلم الحدود والفرائض.

অর্থ: হযরত ইমাম সুফিয়ান ছাওরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আলিমগণ তিন ভাগে বিভক্ত। (১) আলিম বিল্লাহ অর্থাৎ যারা শুধু আল্লাহ পাককেই জানে। কিন্তু তাঁর হুকুম-আহকাম সম্পর্কে অজ্ঞ। (২) আলিম বিআমরিল্লাহ। অর্থাৎ যারা শুধু হুকুম-আহকাম সম্পর্কে জানে। কিন্তু আল্লাহ পাক সম্পর্কে অজ্ঞ বা আল্লাহভীতি নেই। (৩) আলিম বিল্লাহ ওয়া বিআমরিল্লাহ। অর্থাৎ যাঁরা আল্লাহ্ পাক ও তাঁর শরীয়তের হুকুম-আহ্কাম ও ফারায়েজ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত এবং আল্লাহ পাককে ভয় করেন। (তাঁরাই হাক্বীক্বী বা প্রকৃত আলিম।)

আর হাক্বীক্বী আলিম সম্পর্কে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর  পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-

العلماء ورثة الانبياء وان الانبياء لم يورثوا دينارا ولا درهما وانما ورثوا العلم.

অর্থ: “নিশ্চয় আলিমগণ নবী আলাইহিমুস্ সালামগণের ওয়ারিছ। আর নিশ্চয় নবী আলাইহিমুস্ সালামগণ কোন দীনার-দিরহাম রেখে যাননি। বরং ইল্ম রেখে গেছেন।” (তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ্, আহ্মদ, মিশকাত, মায়ারেফুস্ সুনান, উরফুশ শাযী, বজলুল মাযহুদ, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ত্বীবী, তা’লীকুছ ছবীহ্, মুযাহিরে হক্ব)

উল্লেখ্য যে, নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণ ওয়ারিছ স্বত্ব হিসেবে দু’প্রকার ইল্ম রেখে গেছেন। অর্থাৎ ইল্মে ফিক্বাহ ও ইল্মে তাছাউফ। যে প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

العلم علمان فعلم فى القلب فذلك العلم النافع وعلم على اللسان فذلك حجة الله عز وجل على ابن ادم

অর্থ: “ইল্ম দু’প্রকার। (১) ক্বল্বী ইল্ম (ইল্মে তাছাউফ) যা উপকারী ইল্ম, (২) জবানী ইল্ম (ইল্মে ফিক্বাহ্) যা আল্লাহ্ পাক-এর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য দলীল স্বরূপ।” (দারিমী, বায়হাক্বী, দায়লামী, তারগীব ওয়াত তারহীব, তারীখ, আব্দুল বার, মিশকাত, মিরকাত, লুময়াত আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ত্বীবী, তা’লীকুছ ছবীহ্, মুযাহিরে হক্ব)

উপরোক্ত হাদীছ শরীফ দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হলো যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর  পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়ারিছ স্বত্ব হিসেবে ইল্মে ফিক্বাহ্ ও ইল্মে তাছাউফ উভয়টিই রেখে গেছেন। কাজেই যে ব্যক্তি উভয়টিই শিক্ষা করলো, সে ব্যক্তিই নায়িবে রসূল বা হাক্বীক্বী আলিম। (চলবে)

নায়েক মির্জা মুহম্মদ আনোয়ারুল হক

ঢাকা সেনানিবাস, ঢাকা।

সুওয়াল:  হানাফী মাযহাবে-

(১) নামাযের মুছল্লায় দাঁড়িয়ে অর্থাৎ জায়নামাযে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়ে এবং নামাযের নিয়ত করে থাকে।

(২) ইমামের পিছনে মুক্তাদী সূরা ফাতিহাসহ কোন সূরা পাঠ করেনা।

(৩) জামায়াতে নামায আদায়কালে টাখনুর সাথে টাখনু বা গায়ের সাথে গা বা কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ায়।

(৪) ‘আমীন’ চুপে চুপে বলে।

(৫) রুকু-সিজদায় যাওয়ার ও উঠার সময় হাত উত্তোলন করেনা।

(৬) ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে হাত তুলে মুনাজাত করে।

(৭) তিন রাকায়াত বিতির নামায দু’বৈঠকে আদায় করে এবং তৃতীয় রাকায়াতে সূরা-ক্বিরায়াত শেষে দু’য়া কুনূত পড়ে।

(৮) ইক্বামত আযানের মতোই তবে ইক্বামতে লফ্য বা শব্দগুলো যেরূপ জোড়া জোড়া তদ্রুপ ইক্বামতেও, তবে ইক্বামত আযান অপেক্ষা কিছুটা নিম্নস্বরে পড়ে এবং দু’বার ক্বদক্বামাতিছ্ ছলাহ বলে।

(৯) তারাবীহ্র নামায বিশ রাকায়াত পড়ে।

(১০) ঈদের নামায অতিরিক্ত ছয় তাকবীরের সাথে আদায় করে।

(১১) জুমুয়ার ছানী বা দ্বিতীয় আযানের পর ইমাম জুমুয়ার খুৎবা দেন।

(১২) উন্নতমানের আটার মূল্যে ছদক্বাতুল ফিতর আদায় করে ইত্যাদি।

কিন্তু লা-মাযহাবীরা উল্লিখিত মাসয়ালার বিপরীত আমল করে। আর ধারণা করে যে, হানাফী মাযহাবে হয়ত মাসয়ালাগুলোর কোন দলীল-প্রমাণ নেই।

অতএব, দয়া করে মাসয়ালাগুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব: বিগত সংখ্যাগুলোতে অত্র সুওয়ালের জাওয়াবে মাযহাব মানা ফরয এবং মাযহাব অস্বীকার করা বা মাযহাবের বিরোধিতা করা কুফরী সে ফতওয়া সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনার পাশাপাশি হানাফী মাযহাবের ইমাম, ইমামে আ’যম হযরত আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত হানাফী মাযহাব সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে। আর ১৬১তম সংখ্যা থেকে উল্লেখিত মাসয়ালাগুলোর ধারাবাহিক জাওয়াব পেশ করা হচ্ছে-

(১১) জুমুয়ার ছানী বা দ্বিতীয় আযানের পর ইমাম জুমুয়ার খুৎবা দেন।

এর জাওয়াব হলো: আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, হানাফী মাযহাবের ইমাম, ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি হাদীছ শরীফ-এর হাকিম ছিলেন। অর্থাৎ তিনি সমস্ত হাদীছ শরীফ সম্পর্কে ইলম রাখতেন। যার কারণে উনার প্রতিটি মাসয়ালার স্বপক্ষে হাদীছ শরীফ থেকে দলীল-আদিল্লাহ রয়েছে।

অতএব, হানাফী মাযহাবে জুমুয়ার ছানী বা দ্বিতীয় আযানের পর ইমাম জুমুয়ার খুৎবা দেন এ সম্পর্কে হাদীছ শরীফ থেকেই দলীল রয়েছে। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে-

عن السائب بن يزيد رضى الله تعالى عنه قال كان الاذان على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم وابى بكر رضى الله تعالى عنه وعمر رضى الله تعالى عنه اذا خرج الامام واذا اقيمت الصلاة فلما كان عثمان رضى الله تعالى عنه زاد النداء.

অর্থ: হযরত সায়িব ইবনে ইয়াযীদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত আবু বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত উমর ইবনে খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর সময় একটিমাত্র আযানের প্রচলন ছিল। (আর সেটা ছিল) যখন ইমাম (খুৎবা দানের উদ্দেশ্যে) হুজরা হতে বের হতেন, এর পর নামাযের ইক্বামত দেয়া হতো, অতঃপর হযরত উছমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু (খিলাফতে আসীন হবার পর) ‘যাওরা’ নামক স্থানে তৃতীয় আযান বৃদ্ধি করেন। (উল্লেখ্য, হাদীছ শরীফ-এর রাবীগণ ইক্বামতকেও আযান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাই হযরত উছমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর আযানকে তৃতীয় আযান বলেছেন) ইমাম তিরমিযী রহমতুল্লাহি আলাইহি  এ হাদীছ শরীফকে হাসান ছহীহ বলেছেন।

শব্দের সামান্য তারতম্যে ইমাম বুখারী, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম নাসায়ী, ইমাম বায়হাকী, ইমাম ইবনে মাজাহ রহমতুল্লাহি আলাইহিম  উক্ত হাদীছখানা স্ব স্ব কিতাবে উল্লেখ করেছেন।

অর্থাৎ হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়ে একটিমাত্র আযানের প্রচলন ছিল, হযরত উছমান যুন নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অবস্থার পরিবর্তনের কারণে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের পরামর্শক্রমে মসজিদের বাইরে আরেকটি আযানের ব্যবস্থা এবং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়কার আযানকে (যা দরজায় দেয়া হতো) মসজিদের ভিতরে ইমামের সম্মুখে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। তখন হতে আজ পর্যন্ত এ নিয়মেই জুমুয়ার আযান দেয়ার রীতি চলে আসছে।

সুতরাং, খুলাফায়ে রাশিদীন বা ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের উদ্ভাবিত কোন বিষয় অনুসরণ করা আমাদের জন্য সর্বতোভাবেই ওয়াজিব যেমনিভাবে হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ করা ওয়াজিব। কারণ হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

عليكم بسنتى وسنة الخلفاء الراشدين المهدين.

অর্থ: “তোমরা আমার সুন্নত ও আমার হিদায়েতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীন-এর (উদ্ভাবিত) সুন্নাতকে আঁকড়িয়ে ধরো।”

প্রমাণিত হলো যে, জুমুয়ার ছানী আযানের প্রচলন ও তা মসজিদের ভিতরে দেয়া সুন্নতে ছাহাবার অন্তর্ভুক্ত এবং এটা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত।

যেমন কিতাবে উল্লেখ রয়েছে-

الاذان الثالث هو الاول وجودا اذا كانت مشروعيته باجتهاد عثمان رضى الله تعالى عنه وموافقه سائر الصحابة له بالسكوت وعدم الانكار فصار اجماعا.

অর্থ: তৃতীয় আযান এটাই মূলতঃ প্রথম আযান, (তৃতীয় এ জন্য বলা হয় যে, ইক্বামতকেও আযান বলা হয়) যা হযরত উছমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর ইজতিহাদের দ্বারা সাব্যস্ত করা হয়। (যখন হযরত উছমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু দ্বিতীয় আরেকটি আযানের প্রচলন করেন) তখন সমস্ত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণই এটা জ্ঞাত ছিলেন এবং সকলেই নিশ্চুপ ছিলেন। কেউ এটা অস্বীকার না করার কারণে এর উপর ইজমায়ে আযীমত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

সুতরাং, উক্ত ইজমার উপর আমল করা প্রত্যেক মু’মিন-মুসলমানের উপর ওয়াজিব। যে ব্যক্তি উক্ত ইজমাকে অস্বীকার করল, সে মূলতঃ কুফরী করল। এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ করা হয়-

فيكون الا جماع حجة يكفر جاحده كالكتاب والسنة

‘ইজমায়ে আযীমত কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর মতই একটি অকাট্য দলীল। যে সেটাকে অস্বীকার করল, মূলতঃ সে কুফরী করল।’

জুময়ার ছানী আযান মসজিদের ভিতরে ইমামের সম্মুখে মিম্বরের নিকটে দেয়ার

অকাট্য দলীলসমূহ:

وقد كان الاذان فى عهد النبى صلى الله عليه وسلم فى الجمعة كسائر الاذان فى مؤذن واحد. اذا جلس على المنبر. وكذالك كان يفعل عمر رضى الله تعالى عنه ثم زاد عثمان رضى الله تعالى عنه اذانا ثانيا على الزوراء كثر الناس بالمدينة بين يدى الامام تحت المنبر.

অর্থ: সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় থেকে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর খিলাফতকাল পর্যন্ত জুমুয়ার নামাযে অন্যান্য নামাযের আযানের ন্যায় একটিমাত্র আযানই প্রচলিত ছিল। অতঃপর হযরত উছমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মদীনা শরীফে অবস্থিত ‘যাওরা’ নামক স্থানে দ্বিতীয় আরেকটি আযান (বর্তমানের প্রথম আযান) বৃদ্ধি করেন। এবং প্রথম আযানটি (বর্তমানের দ্বিতীয় আযান) মিম্বরের নিকটে ইমামের সম্মুখে দেয়া শুরু করেন। (তাফসীরে আহকামুল কুরআন, ৫ম জিঃ, পৃঃ ৬০)

وقد كان الاذان على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم كما فى سائر الصلواة يؤذن واحد اذا جلس النبى صلى الله عليه وسلم على المنبر وكذالك كان يفعل ابو بكر رضى الله تعالى عنه وعمر رضى الله تعالى عنه. ثم زاد عثمان رضى الله تعالى عنه اذانا ثانيا يؤذنون بمدينة السلام وبعد اذان المنار بين يدى الامام تحت المنبر.

অর্থ: সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় জুমুয়ার পাঁচ ওয়াক্ত আযানের ন্যায় একটি মাত্র আযানই প্রচলিত ছিল। যা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরে বসার পর দেয়া হতো। অনুরূপভাবে হযরত আবু বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। অতঃপর হযরত উছমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মদীনা শরীফে দ্বিতীয় আরেকটি আযান বৃদ্ধি করেন এবং দ্বিতীয় আযানটি অর্থাৎ মিনারের আযানের পর ইমামের সম্মুখে মিম্বরের নিকট প্রথম আযান দেয়া শুরু করেন। (আহকামুল কুরআন লিল কুরতুবী ১৮ জিঃ পৃঃ ১০০) (চলবে)

মুহম্মদ রাশেদুল আবেদীন,

৮৪-৩৪, ১৬৯ স্ট্রিট, দ্বিতীয় তলা, জানাইকা

এনওয়াই, ১১৪৩২, ইউএসএ-২০৩৪

সুওয়াল: কোন নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম কিংবা কোন আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের ওসীলা দিয়ে দুয়া করা জায়িয কিনা?

আমাদের এখানে কতিপয় মাওলানা ফতওয়া দিয়েছেন যে, কোন নবী-রসূল, আওলিয়া তো দূরের কথা, স্বয়ং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওসীলা দিয়েও কোন দুয়া বা আরজি পেশ করা জায়িয নেই। (নাঊযুবিল্লাহ)

এখন আমাদের জানার বিষয় হলো, কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ এবং ইজমা-ক্বিয়াসে ওসীলা দিয়ে দুয়া করা জায়িয থাকলে তার দলীল-আদিল্লাহ পেশ করে আমাদের ঈমান-আমল হিফাযত করবেন বলে আশা রাখি।

জাওয়াব: হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম কিংবা কোন আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের ওসীলা দিয়ে দুয়া করা অবশ্যই জায়িয। শুধু জায়িযই নয় বরং দুয়া কবুল হওয়ার কারণও বটে। এমনকি তাঁদের অজুদ মুবারক, তাঁদের নাম মুবারক ও তাঁদের তবারুকসমূহও সৃষ্টিরাজির জন্যে মহান ওসীলা। এটা কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দ্বারা প্রমাণিত।

কাজেই, যারা বলবে, নবী-রসূল ও ওলী-আওলিয়ায়ে কিরামগণের ওসীলা দিয়ে দুয়া বা আরজি পেশ করা জায়িয নেই, তারা কাদিয়ানী অথবা তারা হাদীছ শরীফে বর্ণিত ৭২টি বাতিল ফিরক্বার কোন না কোন একটির অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ তারা ওহাবী, খারিজী, শিয়া, মু’তাজিলা, মুশাবিহা, মওদুদী, জামায়াতী, দেওবন্দী, তাবলীগী, সালাফী, লা-মাযহাবী ইত্যাদির অন্তর্ভুক্ত। তারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত নয়।

নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম ও আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণকে ওসীলা গ্রহণ করা প্রসঙ্গে কালামুল্লাহ শরীফের বহু আয়াত শরীফে এবং বহু হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে। যার বর্ণনা বিগত সংখ্যাগুলোর মধ্যে পেশ করা হয়েছে।

মূলতঃ হযরত ছাহাবা আজমাঈন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ এবং সমস্ত উম্মতের ইজমা বা ঐকমত্য এবং আক্বীদা হলো যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিইয়ীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমগ্র সৃষ্টির জন্য মহান ওসীলা এবং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তোফায়েলে ওলীগণও ওসীলা।

যারা নবী ও ওলীগণের ওসীলা গ্রহণকে অস্বীকার করে থাকে এরা দু’শ্রেণীতে বিভক্ত। এক শ্রেণী হচ্ছে, যারা ওসীলাকে একচ্ছত্রভাবে অস্বীকার করে থাকে।

আর কেউ কেউ রয়েছে যারা কেবল বিছালপ্রাপ্ত বুযুর্গগণের ওসীলাকে অস্বীকার করে। তবে জীবিত বুর্যুগগণের ওসীলাকে সমর্থন করে।

এবং এ উভয় শ্রেণী ওসীলা গ্রহণের উপর অর্থাৎ ওসীলার বিরুদ্ধে যেসব প্রশ্ন উপস্থাপন করে দলীল ও যুক্তি প্রদান করে থাকে সেসব প্রশ্নের খ-নমূলক জাওয়াব পেশ করা হলো।

৫. ওসীলা অস্বীকারকারীদের প্রশ্ন: আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-

ولاتصل على احد منهم مات ابدا ولا تقم على قبره.

অর্থ: ‘এদের মধ্যে কারো জানাযার নামায আপনি পড়াবেন না এবং তাদের কারো কবরের নিকট দাঁড়াবেন না।’ (সূরা তওবা-৮৪)

এ আয়াতে কারীমার শানে নুযূল সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে, হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উবাই বিন সুলূলের লাশকে স্বীয় জামা মুবারক পরিয়েছেন এবং তার জানাযার নামায পড়েছেন তখন এ আয়াত শরীফ অবতীর্ণ হয়। যার মধ্যে নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঐ সকল কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে। দেখুন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দুয়া, নামাযে জানাযা, জামা মুবারক পরানো কোনটিই উপকারে আসেনি। কারণ তার আমল খারাপ ছিল। কাজেই ‘ওসীলা’ ভিত্তিহীন। নাউযুবিল্লাহ।

এর জাওয়াবে বলতে হয়: ওসীলা অস্বীকারকারীদের উক্ত প্রশ্নের জাওয়াব তাদের পেশকৃত আয়াত শরীফেই বিদ্যমান রয়েছে।

যেমন আয়াত শরীফ-এর পরবর্তী অংশে ইরশাদ হয়েছে-

انهم كفروا بالله ورسوله وماتوا وهم فاسقون

অর্থ: ‘কারণ হলো, তারা আল্লাহ পাক ও উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কুফরী করেছে এবং এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। আর তারা ফাসিক তথা কাফিরের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা তওবা-৮৪)

অর্থাৎ উবাই বিন সুলূল যেহেতু সে জীবিত অবস্থায় মুনাফিক ছিল এবং কুফরীর উপর মৃত্যুবরণ করেছে এ কারণে তার জন্যে কোন ওসীলা উপকারে আসেনি।

মূলতঃ ওসীলা হলো ঈমানদারদের জন্য। কাফিরদের জন্য নয়। যেমন ঔষধ তা কেবল রোগীদের জন্য উপকারী। মৃত ব্যক্তির জন্য উপকারী নয়।

৬. ওসীলা অস্বীকারকারীদের প্রশ্ন: আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত সম্পর্কে বলেন-

يوم لا بيع فيه ولا خلة ولا شفاعة

অর্থ: ‘সেদিন (কিয়ামত দিবসে) না কোন ব্যবসা, না কোন বন্ধুত্ব আর না কোন সুপারিশ কাজে আসবে।’  (সূরা বাক্বারা-২৫৪)

আরো বলেন-

فما تنفعهم شفاعة الشافعين

অর্থ: ‘তাদের উপকারে আসবে না সুপারিশকারীদের সুপারিশ।’ (সূরা মুদ্দাছ্ছির-৪৮)

অর্থাৎ কিয়ামতের দিন সকল ওসীলা বিলীন হয়ে যাবে।

এর জাওয়াব হলো: এ সকল আয়াতে কারীমা কাফিরদের সাথে সম্পর্কিত। মুসলমানদের সাথে এগুলোর কোন সম্পর্ক নেই। এ কারণে উল্লিখিত আয়াতে কারীমাংশের অব্যবহিত পরেই আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-

والكافرون هم الظالمون

অর্থ: ‘কাফিররা তারাই অত্যাচারী।’ (সূরা বাক্বারা-২৫৪)। আর মুসলমানদের সম্পর্কে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-

الاخلاء يومئذ بعضهم لبعض عدو الا المتقين

অর্থ: ‘সেদিন (কিয়ামত দিবসে) সকল মিত্র শত্রুতে পরিণত হবে, পরহিযগার ব্যতীত।’ (সূরা যুখরূফ-৬৮)

আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন-

يوم لا ينفع مال ولا بنون. الا من اتى الله بقلب سليم

অর্থ: ঐ দিন সম্পদ ও সন্তান উপকারে আসবে না, তবে ঐ ব্যক্তি ব্যতীত যে আল্লাহ পাক-এর সমীপে সুস্থ বা পরিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে উপস্থিত হবে।’ (সূরা শুয়ারা-৮৮, ৮৯)

প্রতিভাত হলো, খালিছ মু’মিন মুত্তাকীগণের সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব কিয়ামতের দিনেও অটুট থাকবে এবং তাদের ধন-সম্পদ ও নেক সন্তান-সন্তুতিও তাদের ফায়দার কারণ হবে।

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ