সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সংখ্যা: ১৮৯তম সংখ্যা | বিভাগ:

মুহম্মদ মুশফিকুর রহমান

ঝাউতলা স্টেশন রোড, চট্রগ্রাম।

 সুওয়াল: চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত রেযাখানীদের অখ্যাত মাসিক মুখপত্র ডিসেম্বর-জানুয়ারি /২০০৬ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে একটি মাসিক পত্রিকার কথা উল্লেখ করে “আল ফিকহু আলা মাযাহিবিল আরবায়া, আল জাওহারাতুন নাইয়ারাহ্ ও রদ্দুল মুহ্তার” কিতাবের বরাত দিয়ে বলেছে, “আযানের মৌখিক জাওয়াব দেওয়া মুস্তাহাব”…।

এখন আমার সুওয়াল হল- তারা “আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া সম্পর্কে যে সকল কিতাবের ইবারত উল্লেখ করেছে তা কতুটুকু গ্রহণযোগ্য?

 জাওয়াব: আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া সম্পর্কে রেযাখানীদের অখ্যাত মাসিক মুখপত্রের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং স্ববিরোধী, ভুল ও অশুদ্ধ হয়েছে এবং ছহীহ হাদীছ শরীফ ও হানাফী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য বিশ্বখ্যাত অনুসরণীয় ফিক্বাহ ও ফতওয়ার  কিতাবসমূহে বর্ণিত তারজীহ্ বা প্রাধান্যপ্রাপ্ত তথা মুখতার বা গ্রহণযোগ্য মতের সম্পূর্ণ খিলাফ হয়েছে। কারণ আমাদের হানাফী মাযহাব মতে আযান শ্রবণকারী সকলের জন্যই আযানের জাওয়াব মৌখিকভাবে দেয়া ওয়াজিব। আর এই আযানের মৌখিক জাওয়াব না দিলে সে ওয়াজিব তরককারী হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে নাফরমানের অন্তর্ভুক্ত হবে।

সুতরাং মুয়ায্যিনের আযান শুনে আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব এবং এর উপরই ফতওয়া। হানাফীদের জন্য এর বিপরীত মত পোষণ করা জিহালতী ও গুমরাহী।

রেযাখানী মৌলভী ছাহেবরা “আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া মুস্তাহাব বলে জিহালতী ও গুমরাহীর পরিচয় দিয়েছে এবং কিতাবের নাম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়েছে। নিম্নে পর্যায়ক্রমে তাদের প্রতিটি দলীলের খ-নসহ সঠিক ও গ্রহণযোগ্য ফতওয়া উল্লেখ করা হচ্ছে-

(ধারাবাহিক)

রেযাখানীদের বক্তব্য খণ্ডন

উল্লেখ্য, রেযাখানীরা আযানের জাওয়াব দেয়া মুস্তাহাব বলে তাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে দলীল উল্লেখ করে বলেছে, “সুতরাং ইমাম ইবনে আবেদীন শামী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর গবেষণা মতে আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া মুস্তাহাব।”

এর জাওয়াবে প্রথমতঃ বলতে হয় যে, হযরত ইমাম ইবনে আবেদীন শামী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ব্যক্তিগত গবেষণা মতের উপর ফতওয়া নয়। বরং ফতওয়া হলো আমাদের হানাফী মাযহাবের ইমাম, ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মতের উপর।

যেমন, “মুয়াত্তা ইমাম মালিক” কিতাবের ২৩ পৃষ্ঠায় ৪ নম্বর হাশিয়ায় উল্লেখ আছে।

قوله فقولوا مثل ما يقول اى وجوبا عند ابى حنيفة وندبا عند الشافعى.

অর্থ: “আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ করেছেন, “যখন তোমরা আযান শুনবে, তখন মুয়ায্যিন যেরূপ বলে তোমরাও অনুরূপ বল।” অর্থাৎ এই হাদীছ শরীফ-এর ভিত্তিতে আমাদের হানাফী মাযহাবের ইমাম, ইমামে আ’যম হযরত আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট মৌখিকভাবে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব। আর শাফিয়ী মাযহাবে মুস্তাহাব।

দ্বিতীয়তঃ বলতে হয় যে, ইমাম ইবনে আবেদীন শামী রহমতুল্লাহি আলাইহি “রদ্দুল মুহ্তার” কিতাবের ১ম খণ্ডে ৩৯৯ পৃষ্ঠায়, ইমাম জাফর ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর লিখিত ‘শরহু মা’য়ানীল আছার’ কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে একখানা فعلى (ফে’লী) হাদীছ শরীফ উল্লেখ করে বলেন যে,

فهذا رسول الله صلى الله عليه وسلم قال غير ما قال المنادى فدل أن الامر للا ستحاب.

এই হাদীছ শরীফখানা প্রমাণ করে যে, মুয়ায্যিন যা বলেছেন তার বিপরীত রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন। সুতরাং এই হাদীছ শরীফখানা দালালত করে যে, (امر) আমর মুস্তাহাব অর্থ প্রদান করে। কাজেই আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া মুস্তাহাব।

এর জবাবে বলতে হয় যে, ইমাম ইবনে আবেদীন শামী রহমতুল্লাহি আলাইহি “রদ্দুল মুহতার” কিতাবের ১ম খণ্ডে ৩৯৯ পৃষ্ঠায় হযরত ইমাম আবূ জাফর ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর লিখিত ‘শরহু মায়ানীল আছার’ কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে যে হাদীছ শরীফখানা উল্লেখ করেছেন তা হলো فعلى (ফে’লী) হাদীছ শরীফ।

আর আমরা আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব বলে যে হাদীছ শরীফখানা উল্লেখ করেছি তা হচ্ছে قولى (ক্বওলী) হাদীছ শরীফ। সুতরাং فعلى (ফে’লী) এবং قولى (ক্বওলী) হাদীছ শরীফ-এর মধ্যে ইখতিলাফ দেখা দিলে قولى (ক্বওলী) হাদীছ শরীফই ترجيح বা প্রাধান্য পাবে। সে হিসেবে قولى (ক্বওলী) হাদীছ শরীফ মুতাবিক আযানের মৌখিক জওয়াব দেয়া ওয়াজিব।

যেমন, হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত আছে, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

اذا سمعتم المؤذن فقولوا مثل ما يقول

অর্থ: “যখন তোমরা মুয়ায্যিনের আযান শুনবে তখন মুয়ায্যিন যা বলে তোমরাও তাই বল।” (বুখারী শরীফ ১ম খ- ৮৬ পৃষ্ঠা, মুসলিম শরীফ ১ম খ- ১৬৬ পৃষ্ঠা, তিরমিযী শরীফ ১ম খ- ২৯ পৃষ্ঠা, আবূ দাউদ শরীফ ১ম খ- ৯৩ পৃষ্ঠা, ইবনে মাজাহ শরীফ ৫৩ পৃষ্ঠা)

উপরে বর্ণিত এই قولى (ক্বওলী) হাদীছ শরীফ-এর মধ্যে قولوا শব্দটি امر (আমর) এর ছিগাহ, যা দ্বারা সুষ্পষ্টভাবেই ওয়াজিব প্রমাণিত হয়।

যেমন, এ প্রসঙ্গে “মুয়াত্তা ইমাম মুহম্মদ” কিতাবের ৮৫ পৃষ্ঠার ৪নম্বর হাশিয়ায় উল্লেখ আছে,

قوله فقولوا استبدل به على وجوب اجابة المؤذن …. وبه قال الحنيفة.

অর্থ: হাদীছ শরীফের ইবারতে উল্লিখিত فقولوا শব্দটির ভিত্তিতে দলীল গ্রহণ করা হয়েছে যে, মৌখিকভাবে মুয়ায্যিনের আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব। …..

আর হাদীছ শরীফ-এর ইবারতে উল্লিখিত فقولوا শব্দটির ভিত্তিতে দলীল গ্রহণ করে হানাফীগণ বলেন, মৌখিকভাবে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব।

তৃতীয়তঃ “রদ্দুল মুহ্তার” কিতাবের ১ম খণ্ডে ৩৯৯ পৃষ্ঠায় যে فعلى (ফে’লী) হাদীছ শরীফখানা উল্লেখ আছে তা হযরত ইমাম আবূ জাফর ত্বহাবী রহমতুল্লাহি বর্ণনা করেছেন।

অথচ আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া যে ওয়াজিব এটা হযরত ইমাম আবূ জাফর ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকেও বর্ণিত আছে।

যেমন- “ফতহুল বারী” কিতাবের ২য় খণ্ডে ৯৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

استدل به على وجوب اجابة المؤذن حكاه الطحاوى عن قوم من السلف

অর্থ: “হাদীছ শরীফ-এর ইবারতে উল্লেখিত فقولوا শব্দটির ভিত্তিতে দলীল গ্রহণ করা হয়েছে যে, মৌখিকভাবে মুয়াযযিনের আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব। এটা হযরত ইমাম আবূ জাফর ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি, সলফে-ছালিহীন রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের এক জামায়াত থেকে বর্ণনা করেছেন।

সুতরাং হযরত ইমাম আবূ জাফর ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর বর্ণনা থেকে এটাই প্রমাণিত হলো যে, আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব।

চতুর্থত: রেযাখানীরা বলেছে, “আর এটা অধিকাংশ ইমাম ও ফক্বীহগণের অভিমত বলে মত পোষণ করেন।”

এর জাওয়াবে বলতে হয় যে, রেযাখানীদের উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই মিথ্যা ও দলীলবিহীন। কারণ এটা যে অধিকাংশ ইমাম ও ফক্বীহগণের অভিমত, এ ধরনের কোন বক্তব্য, কোন বর্ণনা হযরত ইমাম ইবনে আবেদীন শামী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর “রদ্দুল মুহতার” কিতাবের ১ম খণ্ডে ৩৯৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ নেই।

পঞ্চমত: যেখানে আমাদের হানাফী মাযহাবের ইমাম, ইমামে আ’যম হযরত আবু হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম আবু ইউসুফ রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়াকে ওয়াজিব বলেছেন। সেক্ষেত্রে অন্যান্য ইমামগণের মুস্তাহাব অভিমত গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।”

যেমন, “উমদাতুল ক্বারী” কিতাবের ৫ম খণ্ডে ১২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

ينبغى لمن سمع الاذان ان يقول كما يقول المؤذن حتى يفرغ من اذانه وهو مذهب اهل الظاهر ايضا وقال الثورى وابو حنيفة وابو يوسف ومحمد واحمد فى الاصح.

অর্থ: “যে ব্যক্তি মুয়ায্যিনের আযান শুনবে তার জন্য মুয়ায্যিনের অনুরূপ মৌখিক জাওয়াব দেয়া উচিত অর্থাৎ ওয়াজিব। এমনকি মুয়ায্যিন যতক্ষণ পর্যন্ত তার আযান থেকে ফারেগ না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আযান শ্রোতা মুয়ায্যিনের আযানের অনুরূপ মৌখিক জাওয়াব দিবে এটা আযান শ্রোতার উপর ওয়াজিব। আর এটাই আহলে জাহিরের মত। অনুরূপ ইমামে আযম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম আবূ ইউসুফ রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত সুফিয়ান ছাওরী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং হযরত ইমাম আহমদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর الاصح বা অধিক ছহীহ মতে আযান শ্রোতাদের জন্য মুয়ায্যিনের আযানের অনুরূপ মৌখিক জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব।

খন্দকার সেলিম আহমদ

পাহাড় কাঞ্চনপুর, টাঙ্গাইল

সুওয়াল: হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে, মাসিক আল বাইয়্যিনাত-অক্টোবর ২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রদত্ত “মীলাদ-ক্বিয়াম” সম্পর্কিত বক্তব্যের সমালোচনা করতে গিয়ে  এবং একই বিষয়ে এপ্রিল-২০০৫ ঈসায়ী ও মে-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় এছাড়াও মাসিক মদীনা পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে একই ধরনের জাওয়াব দেয়া হয়েছে।

তাদের বক্তব্যগুলোর মধ্যে যে বিষয়গুলো আমার নিকট সন্দেহজনক তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

যেমন, এপ্রিল-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে বলা হয়েছে, “আমাদের দেশে প্রচলিত মীলাদ ও ক্বিয়াম ইসলামী শরীয়ত পরিপন্থী যা সম্পূর্ণভাবে মাকরূহে তাহরীমী। আইম্মায়ে মুজতাহিদীন কারো থেকে এই প্রচলিত মীলাদ ও ক্বিয়াম প্রমাণিত নয়। তাছাড়া মীলাদ ও ক্বিয়াম সম্পর্কে কোন প্রকার হাদীছও বর্ণিত নেই। ….”

এখন আমাদের সুওয়াল হলো, প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম সম্পর্কিত তাদের উল্লিখিত বক্তব্য কতটুকু দলীলসম্মত? কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াব: প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম সম্পর্কে হাটহাজারী মাদরাসার অখ্যাত মাসিক পত্রিকার জিজ্ঞাসার সমাধানে এবং অপর একটি পত্রিকার প্রশ্নোত্তর বিভাগে যা বলা হয়েছে তা শুদ্ধ তো হয়ইনি, বরং সম্পূর্ণই মিথ্যা, ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন এবং অনুসরণীয় ইমাম-মুজতাহিদ ও ফক্বীহগণের সর্বজনমান্য ও স্বীকৃত বিশ্ব বিখ্যাত ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাবসমূহের বক্তব্যের বিপরীত ও বিরুদ্ধমত। যা ইতঃপূর্বে আমাদের “মাসিক আল বাইয়্যনাত শরীফ”-এর অনেক সংখ্যায় খ-ন করে সঠিক ও দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হয়েছে। আর “মাসিক আল বাইয়্যিনাত শীরফ”-এর জাওয়াবকে খ-ন করা হাটহাজারী মৌলভী সাহেবদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হয়নি, হবেও না ইনশাআল্লাহ।

এরপরেও হাটহাজারীর মৌলভী সাহেব এবং তাদের সকল সমজাতীয়রা বার বার মীলাদ-ক্বিয়াম সম্পর্কে বিনা তাহক্বীকে ও বিনা দলীলে উক্ত ভুলেরই পূনরাবৃত্তি করে যাচ্ছে।

(ধারাবাহিক)

যেমন, উল্লিখিত প্রথম বক্তব্যের প্রথমেই তারা বলেছে, “আমাদের দেশে প্রচলিত মীলাদ ও ক্বিয়াম ইসলামী শরীয়ত পরিপন্থী, যা সম্পূর্ণভাবে মাকরূহে তাহরীমী।”

এর জাওয়াবে বলতে হয় যে, তাদের উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই দলীলবিহীন, ডাহা মিথ্যা ও কুফরীমূলক হয়েছে। কারণ, “আমাদের দেশে প্রচলিত মীলাদ ও ক্বিয়াম ইসলামী শরীয়ত পরিপন্থী নয়। বরং শরীয়তসম্মত, যা সম্পূর্ণভাবে সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সুন্নতে ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম-এর অন্তর্ভুক্ত। কারণ মীলাদ-ক্বিয়াম স্বয়ং নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের যামানাতেই ছিল। তবে মীলাদ শরীফ-এর তরতীব হচ্ছে সুন্নতে উম্মত ও মুস্তাহসান।”

দ্বিতীয়তঃ উল্লিখিত বক্তব্যের শেষের অংশে তারা বলেছে, “তাছাড়া মীলাদ ও ক্বিয়াম সম্পর্কে কোন প্রকার হাদীসও বর্ণিত নেই।…”

এর জাওয়াবে বলতে হয় যে, তাদের এ বক্তব্যও ডাহা মিথ্যা ও কুফরীমূলক হয়েছে। কারণ, তাদের এ বক্তব্যে এটাই প্রমানিত হয় যে, তারা “হাদীছ শরীফকে অস্বীকার করেছে।” অথচ “হাদীছ শরীফে মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়ামের অনেক প্রমাণ রয়েছে।” যা আমরা দলীলসহ প্রমাণ করে দিয়েছি।

দ্বিতীয়তঃ ক্বিয়াম সম্পর্কেও অনেক হাদীছ শরীফ বর্ণিত আছে। শুধু তাই নয় স্বয়ং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই ক্বিয়াম করেছেন এবং ক্বিয়াম করার জন্য সরাসরি নির্দেশও দিয়েছেন।

যেমন ক্বিয়াম القيام শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে-قیام کرنا.کھڑا ہونا অর্থাৎ ক্বিয়াম করা বা দাঁড়ানো। (কামূস আল মুহীত, তাজুল উরুস, লিসানুল আরব, মিছবাহুল লুগাত, আল মুনজিদ)

আর ক্বিয়াম শব্দের ইস্তেলাহী বা পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে, আখিরী রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি ‘সালাম’ পাঠকালে ত’যীমার্থে ও মুহব্বতে ক্বিয়াম করা বা দাঁড়ানো ।

এছাড়াও মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে আলিম-উলামা, পীর-মাশয়িখ, উস্তাদ, পিতা-মাতা, দ্বীনি নেতৃস্থানীয় সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে ক্বিয়াম করা বা দাঁড়ানো সুন্নত।

এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত মুহাদ্দিছ ও ব্যাখ্যাকার হযরত ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কিতাব “আল আযকার” কিতাবের ২২৯ পৃষ্ঠায় লিখেন-

واما اكرام الداخل بالقيام فالذى نختاره انه مستحب لمن كان فيه فضيلة ظاهرة من علم او صلاح او شرف او ولاية مصحوبة بصياته او له ولادة او رحم مع سن ونحو ذالك ويكون هذا القيام للبر والاكرام والاحترام لا للرياء الاعظام وعلى هذا الذى اخترناه استمر عمل السلف والخلف.

অর্থ: “প্রবেশকারী বা আগমনকারীর সম্মানার্থে ক্বিয়াম করা বা দাঁড়ানোকে আমরা মুস্তাহাব সুন্নত হিসেবে গ্রহণ করেছি। কারণ আগমনকারী ইলম্, যোগ্যতা, সামাজিকভাবে মর্যাদাবান, সন্তান বা বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয় ইত্যাদির কারণে সম্মান পাওয়ার উপযুক্ত। তাই আগমনকারীর জন্য যে ক্বিয়াম করা হয় তা শুধুমাত্র সম্মান বা তা’যীমার্থেই করা হয়। রিয়া বা বড়ত্ব প্রকাশের জন্য নয়। পূর্ববর্তী পরবর্তী সকল ছলফে-ছালিহীণ রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণই আমাদের এ মতানুযায়ী আমল করেছেন।”

বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিছ আল্লামা হযরত মুল্লা আলী ক্বারী আল হানাফী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ “মিরকাত শরহে মিশকাত” কিতাবের ৪র্থ খণ্ডে ৫৮ পৃষ্ঠায় লিখেন,

وفيه ايماء الى ندب القيام لتعظيم الفضلاء والكبراء

অর্থ: উল্লিখিত হাদীছ শরীফে এটাই বুঝানো হয়েছে যে, শ্রদ্ধেয় ও মর্যাদাবান ব্যক্তিদের প্রতি তা’যীম বা সম্মান প্রদর্শনার্থে ক্বিয়াম করা বা দাঁড়ানো মুস্তাহাব সুন্নত।

উপরোক্ত দলীলভিত্তিক বিস্তারিত আলোচনা দ্বারা এটাই ছাবিত হয় যে, কারো মুহব্বতে তা’যীম বা সম্মানার্থে ক্বিয়াম করা বা দাঁড়ানো সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সুন্নতে ছাহাবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম।

উল্লেখ্য, মীলাদ শরীফে যে ক্বিয়াম করা হয় তা মুহ্ববত ও তা’যীমার্থেই করা হয়। সুতরাং মীলাদ শরীফের ক্বিয়ামও এ অর্থে সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত।

দ্বিতীয়তঃ কোন প্রকার সুসংবাদ বা শুভ সংবাদ শ্রবণ করতঃ দাড়িয়ে যাওয়া বা ক্বিয়াম করা সুন্নত।

এ প্রসঙ্গে হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর প্রসিদ্ধ “মুসনাদু আহমদ”-এ বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেন যে, “হযরত উছমান যুননূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিছাল মুবারক লাভ করার পর; হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন, এমনকি উনাদের কারো কারো অন্তরে নানা প্রকার চিন্তা-ফিকিরের উদ্রেক হতে লাগলো। তারমধ্যে আমিও একজন ছিলাম। এমনি অবস্থায় আমি এক দালানের ছায়াতলে বসে ছিলাম। হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সেখানে আসলেন এবং আমাকে সালাম দিলেন, কিন্তু আমি তা বুঝতে পারিনি। অতঃপর তিনি হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিকট তা জানালেন যে, আপনি শুনে আশ্চর্য হবেন যে, আমি হযরত উছমান যুননূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে সালাম দিলাম অথচ তিনি আমার সালামের জবাব দিলেন না। তখন উনারা উভয়েই আমার নিকট আসলেন এবং হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আপনার ভাই হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আপনাকে সালাম দিয়েছেন আপনি উনার সালামের জবাব দিলেন না কেন? আপনার এ অবস্থা হয়েছিল কেন? আমি জবাব দিলাম না এরূপ তো আমি করিনি।

হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আল্লাহ পাক-এর শপথ করে বলেন, হ্যাঁ অবশ্যই আপনি এরূপ করেছেন। তখন আমি বললাম: তবে আমি ব্যাপারটি উপলব্ধি করতে পারিনি যে, আপনি আমার দিক দিয়ে গিয়েছেন এবং আমাকে সালাম করেছেন। তখন হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন যে, হযরত উছমান যুননূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ঠিকই বলেছেন। তাহলে আপনাকে কি কি কোন বিষয় অভিভূত করে রেখেছিল? আমি বললাম: হ্যাঁ, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সে বিষয়টি কি? আমি বললাম, আল্লাহ পাক তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিছাল মুবারক দান করলেন অথচ আমি জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আমি এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছি। হযরত উছমান যুননূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-

فقمت اليه قلت له بابى انت وامى انت احق بها قال ابو بكر صديق رضى الله تعالى عنه قلت يا رسول الله صلى الله عليه وسلم ما نجاة هذا الامر فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم من قبل منى الكلمة التى عرضت على عمى فردها على فهى.

له نجاة (একথা শুনে) আমি হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর দিকে দাঁড়িয়ে গেলাম এবং বললাম আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক। নিশ্চয়ই আপনিই এ ব্যাপারে অধিকতর হক্বদার। হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করেছি, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! কিভাবে এ শাস্তি থেকে নাজাত পাওয়া যাবে? জাওয়াবে আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “আমার চাচা আবূ তালিবকে যে কালিমা শরীফ গ্রহন করতে বলেছিলাম যা তিনি গ্রহন করেননি, সে কালিমা শরীফ যে আন্তরিকভাবে বা খালিছভাবে গ্রহণ করবে। সেটাই হবে তার নাজাতের মাধ্যম।” (অনুরূপ বর্ণনা মিশকাত শরীফেও উল্লেখ রয়েছে)

উপরোক্ত হাদীছ শরীফ থেকে এটাই ছাবিত হলো যে, কোন প্রকার সুসংবাদ বা শুভ সংবাদ শুনে ক্বিয়াম করা বা দাঁড়িয়ে যাওয়া সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। আর আল্লাহ পাক-এর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিলাদত শরীফ বা আগমনের সংবাদ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুসংবাদ বা শুভ সংবাদ। সুতরাং তাওয়াল্লুদ শরীফে আল্লাহ পাক-এর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিলাদত শরীফ বা আগমণের সুসংবাদ বা শুভ সংবাদ শ্রবণ করতঃ ক্বিয়াম করা বা দাঁড়িয়ে যাওয়া সুন্নত প্রমাণিত হলো।

মুসাম্মত সানজিদা আক্তার

সভানেত্রী- ছাত্রী আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত

মুহম্মদপুর, ঢাকা।

সুওয়ালঃ অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম এপ্রিল/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-জবাব বিভাগে নিম্নোক্ত ১২৪৭ নং জিজ্ঞাসার জবাব ছাপা হয়।

জিজ্ঞাসা: ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী ও আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন যে, রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আমার মৃত্যুর পর পূর্ব দেশগুলির মধ্য হতে কোন একটি দেশ থেকে আমার উম্মতের ভিতর হতে একটি দল বের হবে। এই দলের সদস্যগণ হবে অশিক্ষিত ও মূর্খ। এদের মধ্যে কোন শিক্ষিত লোক গেলে সেও হয়ে যাবে মূর্খের মত। তাদের বক্তৃতা হবে বহু বহু গুণের ফযীলতের। তাদের মত বক্তৃতা বা বয়ান কারো হবে না। …… তারা কুরআনের উপর আমল কিম্বা কুরআন প্রতিষ্ঠার একটু চেষ্টাও করবে না কখনো। উক্ত অখ্যাত পত্রিকা হাদীছ শরীফ ছহীহ স্বীকার করলেও মন্তব্য করেছে যে, প্রচলিত তাবলীগের কার্যক্রম পুরোপুরি শরীয়তসম্মত। ইসলাম পরিপন্থী কোন কিছু এতে নেই।

উক্ত অখ্যাত পত্রিকার উল্লিখিত “জিজ্ঞাসা-জবাবের” প্রেক্ষিতে আমার সুওয়াল বা জানার বিষয় হলো-

…. (৪) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের পৃষ্ঠপোষকতায় বা পরিচালনায় যারা রয়েছে তারা সকলেই হক্কানী আলিম, তাদের এ দাবি কতটুকু সঠিক? আসলে হক্কানী আলিমের সংজ্ঞা বা পরিচিতি কি?

কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে উল্লিখিত সুওয়ালগুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াব: প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে উক্ত অখ্যাত পত্রিকার জবাব শুদ্ধ হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন হয়েছে।

তাই নিম্নে সুওয়ালে বর্ণিত বিষয়গুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হলো-

ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে প্রশ্নে উল্লিখিত অখ্যাত পত্রিকার অপব্যাখ্যা ও মিথ্যাচারিতার খন্ডনমূলক জবাব (৪)

প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে অখ্যাত পত্রিকার ‘জিজ্ঞাসার জবাবের প্রেক্ষিতে আপনার চতুর্থ সুওয়াল হলো-

(৪) “প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগের পৃষ্ঠ পোষকতায় বা পরিচালনায় যারা রয়েছে তারা সকলেই হক্কানী আলিম, তাদের এ দাবি কতটুকু সঠিক? আসলে হক্কানী আলিমের সংজ্ঞা বা পরিচিতি কি?

আপনার উক্ত সুওয়ালের প্রেক্ষিতে বলতে হয় যে, প্রচলিত ছয় উছূলীদের উক্ত দাবি সম্পূর্ণই অবান্তর, মিথ্যা ও দলীলবিহীন। কারণ গত দুই সংখ্যায় প্রদত্ত হক্কানী আলিমের সংজ্ঞা বা পরিচিতিমূলক আলোচনা দ্বারা অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, হক্কানী আলিম বা সত্যিকার নায়িবে নবী তিনিই (১) যিনি ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত অনুযায়ী আক্বীদা পোষণ করেন, (২) ইলমে ফিক্বাহ অর্জন করার সাথে সাথে একজন হক্কানী শায়খ বা মুর্শিদের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করে তাছাউফ চর্চা করতঃ অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহভীতি বা তাক্বওয়া অর্জন করেছেন, (৩) অর্জিত ইলম অনুযায়ী পরিপূর্ণ আমল করেন, (৪) সুন্নতের পূর্ণ  পায়রবী করেন, (৫) হারাম-নাজায়িয ও শরীয়তবিরোধী কাজে লিপ্ত হননা। কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর দৃষ্টিতে তাঁরাই আলিম বা নায়িবে নবী।

অথচ প্রচলিত ছয় উছূলীদের কথিত আলিমদের মধ্যে উল্লিখিত গুণাবলীসমূহের কোনটাই বিদ্যমান নেই। আমরা যদি উল্লিখিত পাঁচটি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করি তবে বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।

হক্কানী আলিম হওয়ার জন্য দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে-

২. ইলমে ফিক্বাহ অর্জন করার সাথে সাথে একজন হক্কানী শায়খ বা মুর্শিদের নিকট বাইয়াত হয়ে ইলমে তাছাউফ চর্চা করতঃ অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহভীতি বা তাক্বওয়া অর্জন করা।

অথচ ছয় উছূলীরা ইলমে ফিক্বাহ যৎসামান্য শিক্ষা করলেও ইলমে তাছাউফ মোটেও শিক্ষা করেনা বরং ইলমে তাছাউফ ও পীর মাশায়িখ সম্পর্কে এলোমেলো কথা বলে থাকে। অথচ ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে ইলমে তাছাউফ অর্জন করা, হক্কানী মুর্শিদ বা শায়খ-এর নিকট বাইয়াত হওয়া, ছোহবত ইখতিয়ার করা, ক্বলবী যিকির করা প্রত্যেকটাই ফরযে আইন। নিম্নে এ সম্পর্কে দলীল-আদিল্লাসহ আলোচনা করা হলো।

পূর্ব প্রকাশিতের পর

গত কয়েক সংখ্যার আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, অন্তর পরিশুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ইল্মে তাছাউফ অর্জন করতে হলে এবং দায়িমী বা সার্বক্ষণিকভাবে আল্লাহ পাক-এর যিকিরে মশগুল থাকার জন্য বা হুযূরী ক্বল্ব অর্জন করতঃ অন্ততঃপক্ষে বেলায়েতে আম হাছিল করতে হলে, অবশ্যই একজন কামিল মুর্শিদ বা শায়খ-এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করতে হবে। কারণ মুর্শিদ বা শায়খ-এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করা ব্যতীত ইল্মে তাছাউফ অর্জন করার মাধ্যমে অন্তর পরিশুদ্ধ করতঃ হুযূরী হাছিল করা বা বেলায়েতে আম হাছিল করা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। তাই একজন কামিল শায়খ বা পীর বা মুর্শিদের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করা ফরয।

কামিল মুর্শিদ বা শায়খের আলামত

স্মরণযোগ্য যে, কামিল মুর্শিদ বা পীর বা শায়খের আরেকটি বিশেষ আলামত হচ্ছে এই যে, যিনি হক্কানী বা কামিল মুর্শিদ বা পীর হবেন তিনি অবশ্যই সুন্নতের সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ-অনুকরণ করবেন। ইচ্ছাকৃতভাবে একটি সুন্নতও তিনি তরক করবেন না। কারণ  সুন্নতের পরিপূর্ণ অনুসরণ ব্যতীত কারো পক্ষেই হক্কানী আলিম বা কামিল মুর্শিদ বা পীর হওয়া সম্ভব নয়।

যে প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামীন, পবিত্র কালামে পাকে ইরশাদ করেন,

قل ان كنتم تحبون الله فاتبعونى يحببكم الله ويغفرلكم ذنوبكم والله غفور رحيم

অর্থ: “(হে হাবীব) আপনি বলে দিন! যদি তোমরা আল্লাহ্ পাককে ভালবেসে বা মহব্বত করে থাক, তবে আমাকে (সুন্নতকে) অনুসরণ করো। তবেই আল্লাহ্ পাক তোমাদেরকে মহব্বত করবেন ও তোমাদের গুণাহ্ খাতাসমূহ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ পাক ক্ষমাশীল এবং দয়ালু।” (সূরা ইমরান-৩১)

আর হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর  পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-

من احب سنتى فقد احبنى

অর্থঃ- “যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে মুহব্বত(অনুসরণ) করলো, সে ব্যক্তি আমাকেই মুহব্বত (অনুসরণ) করলো।” (মেশকাত, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তা’লীকুছ ছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব)

উপরোক্ত আয়াত শরীফ ও হাদীছ শরীফ দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, মহান আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রসূলের সন্তুষ্টি হাছিল করার বা আল্লাহ্ওয়ালা হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে পরিপূর্ণভাবে সুন্নতের অনুসরণ ও অনুকরণ করা।

তাই সুলতানুল আরিফীন, হযরত বায়েজীদ বোস্তামী রহমতুল্লাহি আলাইহি, সাইয়্যিদুত্ ত্বাইফা, হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহিসহ আরো অনেক কামিল ওলীগণ বলেন, “কাউকে পানি দিয়ে হাঁটতে, বাতাস দিয়ে উড়তে ও আগুণের মধ্যে বসে থাকতে দেখেই তাকে ওলীআল্লাহ্ মনে করবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে সুন্নতের পূর্ণ অনুসরণ করতে না দেখবে।

কেননা তাছাউফের কিতাব সমূহে উল্লেখ আছে যে, যিনি হক্কানী ও কামিল মুর্শিদ বা ওলী আল্লাহ্, তিনি ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্ তরক করা বা ছেড়ে দেয়া তো দূরের কথা বরং তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন সুন্নতে যায়েদাহ্ বা মুস্তাহাবও তরক করবেননা। অনুরূপ হারাম ও নাজায়িয কাজ করা তো দূরের কথা বরং তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মাকরূহ্ কাজও করবেননা।

তবে হ্যাঁ, যাঁরা কামিল ও হক্কানী মুর্শিদ বা পীর বা ওলীআল্লাহ্ যদি তাঁদের দ্বারা অনিচ্ছা সত্বেও কোন সুন্নতও তরক হয়ে যায়, আল্লাহ্ পাক-এর পক্ষ হতে তাঁদেরকে সতর্ক বা সাবধান করে দেয়া হয়। তাই তাঁরা সর্বদা বা দায়িমীভাবে শরীয়তের খেলাফ বা সুন্নতের খেলাফ কাজে মশগুল থাকতে পারেননা।

যেমন- এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ করা হয় যে, ইমামুশ্ শরীয়ত ওয়াত্ ত্বরীক্বত, ইমাম সুফিয়ান ছাওরী রহমতুল্লাহি আলাইহি একদিন মসজিদে প্রবেশ করার সময় বেখেয়ালে ডান পার স্থলে বাম পা আগে দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেন। সাথে সাথে ইল্হাম (গায়েবী আওয়াজ) হলো- হে ছাওর! আপনার কি জানা নেই যে, মসজিদে প্রবেশ করার সময় প্রথমে ডান পা দেয়া আমার রসূলের সুন্নত। ইমাম সুফিয়ান ছাওরী রহমতুল্লাহি আলাইহি একথা শুনে বেহুশ হয়ে গেলেন। হুশ আসার পর ইস্তিগফার করলেন। আল্লাহ্ পাক তাঁকে ক্ষমা করে দিলেন।

এখানে ফিকিরের বিষয় এই যে, ইমাম ছুফিয়ান ছাওরী রহমতুল্লাহি আলাইহি অনিচ্ছাবশতঃ একটি সুন্নতে যায়েদাহ্ তরক করার কারণে আল্লাহ পাক তাঁকে সতর্ক বা সাবধান করে দিলেন। এতে বুঝা গেল যে, যিনি কামিল মুর্শিদ বা পীর হবেন, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে একটি সুন্নতও তরক করতে পারবেন না বা সর্বদা হারাম, নাজায়িয ও সুন্নতের খিলাফ কাজে মশগুল থাকবেন না।

অথচ আজকাল এমন কিছু লোক মুর্শিদ বা পীর বা হাদী দাবী করছে যাদের নেই ফরয পরিমাণ ইল্মে ফিক্বাহ্ ও ইল্মে তাছাউফ। যারা সুন্নত পালন করা তো দূরের কথা বরং সর্বদাই হারাম ও নাজায়িয কাজে মশগুল। যেমন- ছবি তোলা, লংমার্চ, হরতাল করা, ব্লাসফেমী আইন চাওয়া, ইসলামের নামে হারাম গণতন্ত্র চর্চা করা ও ইলেকশন বা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাসহ আরো বহুবিধ হারাম কাজে তারা লিপ্ত। অথচ একবারও আল্লাহ পাক তাদেরকে সতর্ক বা সাবধান করে দেন না। এতে কি বুঝা যায় না যে, তারা হক্কানী বা কামিল ওলী আল্লাহ্ নয়। যেখানে কিতাবে লেখা হয়েছে যে,

حسنات الابرار سيئات الـمقربين

অর্থাৎ, “সাধারণ লোকদের জন্য যা ছওয়াবের কাজ, খাছ বা বিশেষ লোকদের (হাদীদের) জন্য তা গুনাহের কারণ।” সেখানে মুর্শিদ বা পীর, হাদী, আলিম দাবী করে হারাম ও নাজায়িয কাজ করা কিরূপে সম্ভব?

যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

خذوا نصف دينكم من هذه الحميراء.

অর্থঃ- “আমার পর তোমরা অর্ধেক দ্বীন অর্থাৎ ওহীর বিষয় ব্যতীত সম্পূর্ণ দ্বীনই শিক্ষা লাভ করবে, হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর কাছ থেকে।” (মু’জামুল ওয়াজীয)

নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর  পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পর যেহেতু উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হাদী হবেন, তাই হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাকে হুযূর  পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম বলেন, “হে আয়িশা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা! মহিলাদের জন্য কয়েকটি জিনিস ব্যবহার করা জায়িয হলেও আপনার  জন্য সেগুলো ব্যবহার করা জায়িয নয়। (১) রেশমী কাপড় পরিধান করা। (২) লাল রং-এর কাপড়  পরিধান করা। (৩) স্বর্ণের অলংকার ব্যবহার করা। কারণ আপনি আমার পরে হাদী হবেন।” তখন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বললেন- “ইয়া রসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি রেশমী ও লাল রং-এর কাপড় পরিধান নাইবা করলাম, কিন্তু আমি যেহেতু মহিলা আমার তো অলংকার ব্যবহার করতে হবে।” তখন হুযূর  পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যদি অলংকার ব্যবহার করতেই হয়, তবে রূপার অলংকার ব্যবহার করবেন।” হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বললেন, “আমি কি সে রূপার অলংকারগুলো স্বর্ণের পানিতে রং করে নিব?” হুযূর  পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যদি রং করতেই হয়, তবে জাফরানের পানিতে রং করে নিবেন।”

উল্লিখিত ঘটনা দ্বারা বুঝা গেল যে, যিনি মুর্শিদ বা পীর, হাদী, আলিম, মুহাদ্দিছ, মুফতী ও আমীর হন বা হবেন, তাঁদেরকে হারাম ও নাজায়িয কাজ থেকে তো বেঁচে থাকতেই হবে বরং স্থানবিশেষে মোবাহ্ কাজও তরক করতে হবে। যেমন- হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর জন্য রেশমী ও লাল রং-এর কাপড় পরিধান করা এবং স্বর্ণের অলংকার ব্যবহার করা জায়িয থাকা সত্ত্বেও, হাদী হওয়ার কারণে তা পরিধান ও ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। কাজেই যারা সব সময় হারাম ও নাজায়িয কাজে মশগুল থাকে, আর অপরকে করতে উৎসাহিত করে, তারা মুর্শিদ বা পীর বা হাদী হওয়ার উপযুক্ত নয় এবং তাদের নিকট বাইয়াত হওয়া ও তাদেরকে অনুসরণ করাও জায়িয নয়।

অতএব, প্রমাণিত হলো যে, যিনি কামিল মুর্শিদ বা পীর বা হক্কানী ওলী, তিনি ফরজ ওয়াজিব তো অবশ্যই বরং সুন্নতে যায়িদাগুলোও পূর্ণরূপে আমল করবেন। এর বিপরীত যার আমল সে হক্কানী বা কামিল মুর্শিদ বা পীর নয়।

নায়েক মির্জা মুহম্মদ আনোয়ারুল হক

ঢাকা সেনানিবাস, ঢাকা।

সুওয়াল:  হানাফী মাযহাবে –

(১) নামাযের মুছল্লায় দাঁড়িয়ে অর্থাৎ জায়নামাযে দাঁড়িয়ে দুয়া পড়ে এবং নামাযের নিয়ত করে থাকে।

(২) ইমামের পিছনে মুক্তাদী সূরা ফাতিহাসহ কোন সূরা পাঠ করেনা।

(৩) জামায়াতে নামায আদায়কালে টাখনুর সাথে টাখনু বা গায়ের সাথে গা বা কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ায়।

(৪) ‘আমীন’ চুপে চুপে বলে।

(৫) রুকু-সিজদায় যাওয়ার ও উঠার সময় হাত উত্তোলন করেনা।

(৬) ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে হাত তুলে মুনাজাত করে।

(৭) তিন রাকায়াত বিতির নামায দু’বৈঠকে আদায় করে এবং তৃতীয় রাকায়াতে সূরা-ক্বিরায়াত শেষে দুয়া কুনূত পড়ে।

(৮) ইক্বামত আযানের মতোই তবে ইক্বামতে লফ্য বা শব্দগুলো যেরূপ জোড়া জোড়া তদ্রুপ ইক্বামতেও, তবে ইক্বামত আযান অপেক্ষা কিছুটা নিম্নস্বরে পড়ে এবং দু’বার ক্বদক্বামাতিছ্ ছলাহ বলে।

(৯) তারাবীহ্র নামায বিশ রাকায়াত পড়ে।

(১০) ঈদের নামায অতিরিক্ত ছয় তাকবীরের সাথে আদায় করে।

(১১) জুমুয়ার ছানী বা দ্বিতীয় আযানের পর ইমাম জুমুয়ার খুৎবা দেন।

(১২) উন্নতমানের আটার মূল্যে ছদক্বাতুল ফিতর আদায় করে ইত্যাদি।

কিন্তু লা-মাযহাবীরা উল্লিখিত মাসয়ালার বিপরীত আমল করে। আর ধারণা পোষণ করে যে, হানাফী মাযহাবে হয়ত মাসয়ালাগুলোর কোন দলীল-প্রমাণ নেই।

অতএব, দয়া করে মাসয়ালাগুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব: বিগত সংখ্যাগুলোতে অত্র সুওয়ালের জাওয়াবে মাযহাব মানা ফরয এবং মাযহাব অস্বীকার করা বা মাযহাবের বিরোধিতা করা কুফরী সে ফতওয়া সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনার পাশাপাশি হানাফী মাযহাবের ইমাম, ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত হানাফী মাযহাব সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে। আর ১৬১তম সংখ্যা থেকে উল্লেখিত মাসয়ালাগুলোর ধারাবাহিক জাওয়াব পেশ করা হচ্ছে-

(১২) উন্নতমানের আটার মূল্যে ছদক্বাতুল ফিতর আদায় করে ইত্যাদি।

এর জাওয়াব হলো: আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, হানাফী মাযহাবের ইমাম, ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি হাদীছ শরীফ-এর হাকিম ছিলেন। অর্থাৎ তিনি সমস্ত হাদীছ শরীফ সম্পর্কে ইলম রাখতেন। যার কারণে উনার প্রতিটি মাসয়ালার স্বপক্ষে হাদীছ শরীফ থেকে দলীল-আদিল্লাহ রয়েছে।

অতএব, হানাফী মাযহাবে উন্নতমানের আটার মূল্যে ছদক্বাতুল ফিতর আদায় করে। এটা মূলতঃ কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ শরীফ-এরই নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-

لن تنالوا البر حتى تنفقوا مما تحبون. وما تنفقوا من شىء فان الله به عليم.

অর্থ: “তোমরা কখনই নেকী, কল্যাণ হাছিল করতে পারবে না, যে পর্যন্ত না তোমরা তোমাদের প্রিয় বা পছন্দনীয় বস্তু দান করবে। এবং তোমরা যা কিছু দান কর সে সম্পর্কে আল্লাহ পাক অবশ্যই পূর্ণ খবর রাখেন।” (সূরা আলে ইমরান-৯২)

আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন-

يايها الذين امنوا انفقوا من طيبت ما كسبتم ومما اخرجنا لكم من الارض ولا تيمموا الخبيث منه تنفقون ولستم باخذيه الا ان تغمضوا فيه واعلموا ان الله غنى حميد.

অর্থ: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা স্বীয় উপার্জন থেকে এবং যা আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে উৎপন্ন করেছি তা থেকে উৎকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করো এবং নিকৃষ্ট জিনিস ব্যয় করতে নিয়ত বা মনস্থ করো না। কেননা, তোমরা তা থেকে অনিচ্ছাকৃতভাবে ব্যতীত গ্রহণ করবে না। জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।” (সূরা বাক্বারা-২৬৭)

এখানে সম্পদের যাকাত, জমির ফসলের ওশর, ফিতরা ইত্যাদি ফরয, ওয়াজিব, নফল সকল প্রকার দান-ছদক্বার কথাই বলা হয়েছে। অর্থাৎ যেটা উত্তম, উৎকৃষ্ট, মূল্যবান সেটাই দিতে হবে। যেটা নিকৃষ্ট, নিম্নমানের, নিম্নমূল্যের সেটা দেয়া তো দূরের কথা সেটা দেয়ার কল্পনা বা চিন্তা করাও যাবে না। কেননা খারাপটা কেউই গ্রহণ করতে চায় না। তাহলে আল্লাহ পাক সেটা কি করে গ্রহণ করবেন? এখন কেউ যদি চোখ বন্ধ করে নিজের খেয়াল খুশি মত সেটা দিয়ে দেয় সেক্ষেত্রে আল্লাহ পাক জানিয়েছেন যে, আল্লাহ পাক তোমাদের এসব দানের মুখাপেক্ষী নন। তিনি গণী বা অভামুক্ত এবং হামীদ বা চরম প্রশংসিত।

হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত রয়েছে-

عن ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ما تصدق احد بصدقة من طيب ولا يقبل الله عز وجل الا الطيب.

অর্থ: ‘হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কোন ব্যক্তি পবিত্র বা উৎকৃষ্ট বস্তু হতে দান করলো। আর আল্লাহ পাক তো পবিত্র বা উৎকৃষ্ট বস্তু ব্যতীত কোন কিছুই কবুল করেন না।’ (বুখারী শরীফ)

কাজেই, শরীয়ত তথা কুরআন-সুন্নাহর ফতওয়া হচ্ছে যেটা সবচেয়ে ভাল, পছন্দনীয় ও মূল্যবান সেটাই দান করতে হবে। আর যেটা খারাপ, নিম্নমানের ও নিম্নমূল্যের সেটা দান করা যাবে না। অর্থাৎ দান-ছদক্বার বস্তু যেমন হালাল হওয়া শর্ত তেমনি তা উৎকৃষ্ট ও সবচেয়ে মূল্যবান হওয়াও শর্ত। অন্যথায় তা আল্লাহ পাক-এর নিকট আদৌ কবুলযোগ্য নয়।

ছদক্বাতুল ফিতর-এর পরিমাণ সম্পর্কে হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে-

عن عبد الله بن ثعلبة او ثعلبة بن عبد الله بن ابى صعير عن ابيه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم صاع من بر او قمح عن كل اثنين صغير او كبير حر او عبد ذكر او انثى.

অর্থ: ‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সা’লাবা অথবা সা’লাবা ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আবু সুআইর তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, এক সাআ গম বা আটা দু’ব্যক্তির পক্ষ থেকে আদায় করতে হবে- ছোট হোক বা বড় হোক, আযাদ হোক বা গোলাম হোক এবং পুরুষ হোক বা মহিলা হোক।’ (আবূ দাউদ শরীফ)

অর্থাৎ প্রতি দু’জনের জন্য এক সাআ আটা। আর একজনের জন্য অর্ধ সাআ।

হানাফী মাযহাব মুতাবিক অর্ধ সাআ বলতে ১ সের সাড়ে ১২ ছটাক যা বর্তমানে গ্রাম হিসেবে ১৬৫৭ গ্রাম (প্রায়) হয়।

অতএব, যাদের উপর ছদক্বাতুল ফিতর ওয়াজিব অর্থাৎ ঈদের দিন ছুবহে ছাদিকের সময় যাদের নিকট নিছাব পরিমাণ (সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা অথবা এর সমপরিমাণ মূল্য) সম্পদ থাকে তাদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ এলাকার বর্তমান মূল্য অনুযায়ী ১ সের সাড়ে ১২ ছটাক বা ১৬৫৭ গ্রাম আটা বা এর সমপরিমাণ মূল্য দান করতে হবে।

উল্লেখ্য, দানের উদ্দেশ্য গরীবদের উপকার করা, সাহায্য সহযোগিতা করা, কাজেই যেভাবে দান করলে গরীবরা বেশি উপকৃত হবে সেভাবেই দান করা উচিত এবং কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ শরীফ-এর নির্দেশও তাই। যে কারণে হানাফী মাযহাবে স্বর্ণ ও রৌপ্যের মূল্যের তারতম্যে রুপার কম মূল্যের উপর ভিত্তি করে ছদক্বাতুল ফিতর কিংবা যাকাতের নিছাব নির্ধারণ করা হয়।

একই কারণে গম ও আটা এ দুয়ের মধ্যে আটা দান করার মধ্যে গরীবদের ফায়দা বা উপকারিতা বেশি। কারণ এতে গরীবদের বাড়তি কোন শ্রম, ব্যয় ও ঘাটতি নেই। কিন্তু গমের মধ্যে শ্রম, ব্যয় ও ঘাটতি ইত্যাদি রয়েছে। যে কারণে এতে গরীবদের উপকার কম। ফলে, হানাফী মাযহাবে উন্নতমানের আটার মূল্যেই ছদক্বাতুল ফিতর আদায় করা হয়ে থাকে। সুবহানাল্লাহ।

মুহম্মদ সামছুল হুদা

মানিকখালী, কিশোরগঞ্জ।

সুওয়াল: মাসিক মদীনা জুন/২০০৯ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে নিম্নোক্ত প্রশ্নোত্তর ছাপা হয়।

প্রশ্ন: আমি বিভিন্ন বইয়ে দেখেছি, টিভি দেখা নাজায়িয। তাহলে পিস টিভি এবং ইসলামী টিভি চ্যানেল দেখা কি?

উত্তর: টিভি দেখা অবৈধ নয়। টিভির পর্দায় যেসব অশ্লীল এবং শরীয়ত পরিপন্থী দৃশ্য দেখানো হয়, সেগুলি দেখা হারাম। শরীয়ত অনুমোদন করে এরূপ বিষয়াদি দেখা হারাম নয়।

এখন আমার সুওয়াল হলো- টিভি দেখা সম্পর্কে মাসিক মদীনার উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়েছে কি? দলীলসহ সঠিক জাওয়াব জানিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব: টিভি দেখা সম্পর্কে মাসিক মদীনার উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি; বরং তার উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই মিথ্যা, মনগড়া, দলীলবিহীন এবং কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস তথা শরীয়তের সম্পূর্ণ খিলাফ হওয়ায় কুফরী হয়েছে।

কেননা শরীয়তের দৃষ্টিতে হারমাকে হালাল বলা কুফরী। যেমন, কিতাবে স্পষ্টই উল্লেখ আছে-

استحلال المعصية كفر

অর্থাৎ, “গুনাহের কাজ বা হারামকে হালাল মনে করা কুফরী।” (শরহে আক্বাঈদে নাসাফী)

কাজেই, মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীন হারামকে হালাল বলে কুফরী করেছে। কারণ টিভির মুলই হচ্ছে ছবি। আর ইসলামী শরীয়তের ছহীহ ও গ্রহণযোগ্য ফতওয়া মতে টিভিতে প্রাণীর ছবিভিত্তিক যেকোন প্রোগ্রাম দেখা ও ইসলামী বা অনৈসলামীক যেকোন প্রোগ্রাম করা সম্পূর্ণরূপেই হারাম ও নাজায়িয। কেননা ছবি ছাড়া টিভির চিন্তাই করা যায় না। অর্থাৎ ধারণকৃত হোক বা সরাসরি সম্প্রচারিত হোক প্রত্যেকটাই ছবি। অথচ ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে যে কোন প্রাণীর ছবি তোলা-তোলানো, আঁকা-আঁকানো, রাখা-রাখানো, দেখা-দেখনো চাই তা হাতে আঁকা ছবি হোক বা ক্যামেরায় তোলা ছবি হোক সম্পূর্ণরূপেই হারাম ও নাজায়িয। যারা তুলবে বা তোলাবে এবং দেখবে বা দেখাবে তারা প্রত্যেকেই কবীরা গুনাহে গুণাহগার হবে। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

ان اشد الناس عذابا عند الله المصورون.

অর্থ: “নিশ্চয়ই মানুষের মধ্যে ঐ ব্যক্তিকে আল্লাহ পাক কঠিন শাস্তি দেবেন, যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি তোলে বা আঁকে। (বুখারী শরীফ ২য় জিল্দ, পৃষ্ঠা ৮৮০)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে-

كل مصور فى النار

অর্থ: “প্রত্যেক প্রাণীর ছবি তৈরিকারীই জাহান্নামে যাবে।” (ফতহুল বারী)

উপরোক্ত হাদীছ শরীফ-এর ব্যাখ্যায় হাদীছ শরীফ-এর শরাহ ও ফিক্বাহর কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে-

“আক্সি আশরাফী বেহেশ্তি জিওর” কিতাবের ৬ষ্ঠ খণ্ডে ৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

ان حدیثوں سے تصویر بنانا تصویر رکھنا سب کا حرام ھونا معلوم ھوتا ھے.

অর্থ: “পূর্বে বর্ণিত হাদীছ শরীফসমূহ দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, প্রাণীর ছবি তৈরি করা এবং এটা ঘরে রাখা সব হারাম।”

“ফতওয়ায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ” কিতাবের ১ম খণ্ডে ৭৪২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

تصویر کھینچنا اور کھنچوانا جدید طریق فوٹو گرافی سے ایساہی حرام ہے جیسا کہ دستی تصویر کھینچنا اور کھینچوانا ممنوع اور حرام ہے اور کہنا اسکا  ایسا ہی حرام ہے جیسا کہ دستی تصویر کا رکھنا ایسے فعل کا فاسق ہے اور امام بنانا اسکا حرام ہے اور  نماز اسکے پیچھے مکروہ تحریمی ہے.

অর্থ: “আধুনিক যে কোন পদ্ধতিতে প্রানীর ছবি তৈরি করা বা তৈরি করানো, হাতে তৈরি করা বা তৈরি করানোর মতোই হারাম ও নাজায়িয এবং প্রাণীর ছবি রাখাও তদ্রুপ হারাম। উক্ত আমলকারী ব্যক্তি ফাসিক এবং তাকে ইমাম নিযুক্ত করা হারাম এবং তার পিছনে নামায পড়া মাকরূহ তারীমী।”

উপরোক্ত দলীলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা অকট্যভাবেই প্রমানিত হলো যে, টিভির মূলই হচ্ছে ছবি। আর শরীয়তে প্রাণীর ছবি তোলা, আঁকা, রাখা, দেখা সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়িয। অতএব, প্রাণীর ছবিভিত্তিক টিভি দেখা, রাখা, শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম ও নাজায়িয। তেমনি তা কঠিন আযাবের কারণ।

অতএব, প্রমানিত হলো টিভি দেখা শুধু অবৈধই নয় বরং মহাঅবৈধ।

দ্বিতীয়তঃ টিভি দেখা হারাম হওয়ার মূলে প্রাণীর ছবি তো রয়েছেই, সাথে সাথে বেপর্দা ও অশ্লীলতার কারণেও টিভি দেখা হারাম।

কেননা টিভি চ্যানেলগুলো বেপর্দা ও অশ্লীলতা বিস্তারের একটি অন্যতম মাধ্যম। অথচ বেপর্দা ও অশ্লীলতা ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়িয। কুরআন শরীফ-এ সূরা নিসা, সূরা নূর, সূরা আহযাব ইত্যাদি সূরাসমূহে এবং অনেক হাদীছ শরীফ-এর পর্দা করার ব্যাপারে কঠোর আদেশ-নির্দেশ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

قل للمؤمنين يغضوا م ابصارهم ويحفظوا فروجهم ذالك ازكى لهم ان الله خبير بما يصنعون. وقل للمؤمنت يغضضن من ابصارهن ويحفظن فروجهن ولا يبدين زينتهن.

অর্থ: (হে হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনি মু’মিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের ইজ্জত-আবরু হিফাযত করে। এটা তাদের জন্য পবিত্রতার কারণ। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক তারা যা করে তার খবর রাখেন। আর আপনি মু’মিনদেরকে বলুন, তারাও যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের ইজ্জত-আবরু হিফাযত করে ও তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। (সূরা নূর-৩০, ৩১)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

لعن الله الناظر والمنظور اليه

অর্থ: “যে দেখে এবং দেখায় তার প্রতি আল্লাহ পাক-এর লা’নত। (বাইহাক্বী, মিশকাত)

হাদীছ শরীফ-এ আরো ইরশাদ হয়েছে-

الديوث لا يدخل الجنة

অর্থ: “দাইয়্যূছ বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।” দাইয়্যূছ ঐ ব্যক্তি যে নিজে পর্দা করে না এবং তার অধীনস্ত মহিলাদেরও পর্দা করায় না।” (মুসনাদের আহমদ)

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, পর্দা করা ফরযে আইন। আর বেপর্দা হওয়া হারাম। প্রতি দৃষ্টিতে একটি করে কবীরা গুনাহ। আর টিভি হচ্ছে সেই বেপর্দা, অশ্লীলতা ও কবীরা গুনাহের অন্যতম মাধ্যম। তাহলে টিভি দেখা কি করে শরীয়ত জায়িয হতে পারে?

অতএব, প্রমাণিত হলো যে, বেপর্দা ও অশ্লীলতা বিস্তারকারী টিভি দেখা ও রাখা হারাম ও নাজায়িয।

তৃতীয়তঃ টিভি হারাম হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে গান-বাজনা। টিভি চ্যানেলগুলোতে ২৪ ঘণ্টাই গান-বাজনা হয়ে থাকে। অথচ ইসলামী শরীয়তে গান-বাজনা করা ও শুনা সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়িয। কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর অনেক স্থানে গান-বাজনা সম্পর্কে কঠোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে। যেমন- গান-বাজনা হারাম বা নিষেধ হওয়ার ব্যাপারে হাদীছ শরীফ-এ আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

الغناء ينبت النفاق فى القلب كما ينبت الماء الزرع

অর্থাৎ “গান-বাজনা মানুষের অন্তরে মুনাফিক্বী পয়দা করে যেমনি পানি যমিনে ঘাস পয়দা করে।”

অন্য হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

بعثت لكسر المزامير والاصنام

অর্থাৎ “আমি গানা-বাজনা ও মূর্তি ধ্বংস করতেই প্রেরিত হয়েছি।”

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হলো যে, ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে গান-বাজনা সম্পূর্ণই হারাম ও নাজায়িয। কেননা গান-বাজনা হচ্ছে কাফিরদের খাছ আমল। যা ইসলামী শরীয়তে সম্পূর্ণ হারাম। অথচ টিভি চ্যানেলগুলোতে সর্বদাই গান-বাজা হয়ে থাকে। যদি তাই হয় তবে টিভি দেখা ও রাখা কি করে জায়িয হতে পারে?  মূলতঃ ইসলামী শরীয়তের দুষ্টিতে টিভি দেখা ও রাখা কাট্টা হারাম ও নাজায়িয। একে হালাল জানা কুফরী।

অথচ এ স্পষ্ট হারাম ও নাজায়িযকে ইসলামী অনুষ্ঠানের নাম দিয়ে প্রাণীর ছবিযুক্ত টিভি দেখা জায়িয বলা সুস্পষ্ট কুফরী।

হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে-

الحلال بين والحرام بين

অর্থ: “হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)

অর্থাৎ দ্বীন ইসলামে কোনটি হালাল এবং কোনটি হারাম, তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে। অতঃপর যদি কেউ কোন হারামকে হালাল এবং কোন হালালকে হারাম করার অপচেষ্টা চালায়, তবে তা হবে সম্পূর্ণ কুফরী এবং সে কাফির হয়ে যাবে।

কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

فيحلوا ما حرم الله زين لهم سوء اعمالهم والله   لايهدى القوم الكافرين.

অর্থ: “অতঃপর আল্লাহ পাক যা হারাম করেছেন, তারা তা হালাল করে। মূলতঃ তাদের জন্য মন্দ বা নিকৃষ্ট আমলই শোভন করে দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহ পাক কাফির সম্প্রদায়কে হিদায়েত দান করেন না।” (সূরা তওবা-৩৭)

কাজেই কোন অবস্থাতেই টিভিতে প্রাণীর ছবি সংক্রান্ত অনুষ্ঠান দেখা, শোনা ও উপভোগ করা কস্মিনকালেও জায়িয হবে না। ছূরতান তা যতই নির্মল, নিষ্কলূষ ও শিক্ষনীয় হোক বা তাতে ছূরতান যতই উপকারিতা দেখা যাকনা কেন?

যেমন আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন-

يسئلونك عن الخمر والـميسر قل فيهما اثم كبير ومنافع للناس واثمهما اكبر من نفعهما.

অর্থ: “(হে হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। আপনি বলে দিন, মদ জুয়ার মধ্যে মানুষের জন্য ফায়দা রয়েছে। তবে ফায়দার চেয়ে গুনাহই বড়।” (সূরা বাক্বারা-২১৯)

সুতরাং মদ ও জুয়ার মধ্যে উপকারিতা থাকা সত্ব্ওে তা যেমন গ্রহনীয় নয়, বরং শরীয়তে হারাম। তদ্রুপ প্রাণীর ছবির মাধ্যমে প্রচারিত অনুষ্ঠানে শিক্ষণীয় বিষয় বা উপকারিতা থাকা সত্বেও তা গ্রহনীয় নয়। যেহেতু শরীয়তে প্রাণীর ছবি তোলা আঁকা, রাখা, দেখা দেখানো সবই হারাম। তাই টিভিতে কোন অনুষ্ঠান করা বা দেখা সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নাজায়িয।

কারণ হাক্বীক্বীভাবে ছবিযুক্ত টিভির মাধ্যমে মানুষের ঈমান, আমল-আখলাক্ব সমস্ত কিছুই বরবাদ হয়েছে, হচ্ছে ও হবে।

কারণ ছবি হারাম। আর হারাম থেকে হারামই বের হয়।

যেমন আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

والذى خبث لا يخرج الا نكدا.

অর্থ: “যা নাপাক তা থেকে নাপাক ব্যতীত কিছুই বের হয় না।” (সূরা আ’রাফ-৫৮)

সুতরাং টিভির মধ্যে যদিও কোন প্রকার শিক্ষনীয় বিষয় প্রচার হয় অথবা ইসলামী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়, যেহেতু তার মূলই হলো ছবি, যা স্পষ্টত হারাম ও নাজায়িয। এছাড়াও বর্তমানে টিভির অন্যান্য অশ্লীলতার কারণেও টিভি দেখা হারাম। যেমন আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-

ولا تلبسوا الحق بالباطل

অর্থ: “সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না।” (সূরা বাক্বারা-৪২)

সুতরাং টিভি দেখা হারাম ও কবীরা গুনাহ।

পরিশেষে বলতে হয়ে যে, শরীয়ত অনুমোদন করে এরূপ বিষয়াদি টিভিতে নেই। কারণ “টিভি চ্যানেলে ইসলামী প্রোগ্রাম দ্বারা ইসলামের প্রচার হচ্ছে” এটা সম্পূর্ণই গোমরাহী কথা। বরং টিভিতে ইসলামী প্রোগ্রাম দ্বারা ইসলামের ক্ষতি হচ্ছে। কারণ, টিভিতে একদিকে ছবি আরেক দিকে বেপর্দা উভয়টিই আলাদাভাবে শক্ত হারাম ও কবীরা গুনাহরই প্রসার হচ্ছে। এছাড়া টিভিতে যারা ইসলামী প্রোগ্রাম করে তারা কেউই হক্কানী আলিম নয়। তারা হচ্ছে উলামায়ে ‘ছূ’। আর উলামায়ে ‘ছূ’রা ইসলামের অপব্যাখ্যা করে। তাই তাদের থেকে দ্বীন শিক্ষা করা সম্পূর্ণ নাজায়িয।

হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

فانظروا عمن تاخذون دينكم

অর্থ: “তোমরা কার নিকট থেকে দ্বীন শিক্ষা করছো, তাকে দেখে নাও।” (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ)

অর্থাৎ তার আক্বীদা-আমল কুরআন-সুন্নাহসম্মত কিনা? তা যাচাই-বাছাই করে নাও।

এছাড়া হাদীছ শরীফ-এ সরাসরি উলামায়ে ‘ছূ’দের থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আখিরী রসূল, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন-

ويل لامتى من علماء  السوء يتخذون هذا العلم تجارة يبيعونها من امراء زمانهم ربحا لانفسهم الا اربح الله تجارتهم.

অর্থ: “উলামায়ে ‘ছূ’দের কারণে আমার উম্মতের ক্ষতিসাধন হবে অর্থাৎ অর্থাৎ জাহান্নামী হবে। তারা ইলমকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করতঃ তাদের যুগের শাসকদের নিকট থেকে অর্থ ও পদ লাভের প্রচেষ্টা চালাবে।” আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সকল উলামায়ে ছূ’দের বিরুদ্ধে এই বলে বদদুয়া করেন যে, “আয় আল্লাহ পাক! যারা নিজেদের ইলম দ্বারা দুনিয়াবী সরকারের সাথে ব্যবসা করতে চায় তাদের ব্যবসায় বরকত দিবেন না।” (কানযুল উম্মাল, মিশকাত শরীফ)

অতএব, ইসলামের অজুহাত দিয়ে যারা টিভিকে জায়িয বলবে তারা কাফির হয়ে যাবে। আর মুসলমান হয়ে যারা টিভিকে জায়িয বলবে তারা মুরতাদ হয়ে যাবে।

সুতরাং টিভি হারাম ও কবীরা গুনাহ। যারা টিভি দেখবে তারা কবীরা গুনাহে গুনাহগার হয়ে ফাসিকের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর ফাসিকের পিছনে নামায পড়া মাকরূহ তাহ্রীমী; যা দোহরানো ওয়াজিব। কাজেই যারা টিভি দেখবে তাদের পিছনে নামায পড়া উচিত নয়।

(বিঃ দ্রঃ- ছবি, সিনেমা, টেলিভিশন, ভিসিআর, ভিডিও ক্যামেরা ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে আমাদের মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার ১৭৭, ১৭৮, ও ১৭৯তম সংখ্যা পড়–ন। আর বিশেষ করে ১৩, ২৫, ৩৮, ৬১, ৮৭ ও ৮৯তম সংখ্যা পড়–ন। সেখানে মাসিক মদীনা, মাসিক পৃথিবী, মাসিক দ্বীন দুনিয়া, মাসিক আত-তাওহীদ এবং মাসিক তরজুমানের টেলিভিশন দেখা সম্পর্কিত ভুল বক্তব্য খ-ন করে সঠিক জাওয়াব দেয়া হয়েছে।)

মুহম্মদ আব্দুল্লাহ

শান্তিবাগ, ঢাকা

-সুওয়াল:- রমাদ্বান মাস আসলেই কেউ কেউ পেপার পত্রিকায় ও প্রচার মাধ্যমে বলে থাকে যে, রোযা অবস্থায় ইনজেকশন, ইনসুলিন, স্যালাইন, ইনহেলার ইত্যাদি নিলে রোযা ভঙ্গ হয় না। এ বক্তব্য কতটুকু সঠিক?

-জাওয়াব:- যারা বলে, রোযা অবস্থায় ইনজেকশন, ইনসুলিন, স্যালাইন, ইনহেলার ইত্যাদি নিলে রোযা ভঙ্গ হয় না তাদের বক্তব্য মোটেও শুদ্ধ নয়। সম্পূর্ণ ভুল ও জিহালতপূর্ণ। উক্ত বক্তব্যের স্বপক্ষে তারা একটি দলীলও পেশ করতে পারবে না।

শরীয়তের ফতওয়া হলো- রোযা অবস্থায় যে কোন ইনজেকশন নিলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। যেমন- ‘হিদায়া মায়াদ দিরায়া’ কিতাবের ১ম খন্ডের ২২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

ومن احتقن … افطر لقوله صلى الله عليه وسلم الفطر مما دخل.

অর্থ: ‘এবং যদি কোন ব্যক্তি ইন্জেকশন নেয় … তাহলে রোযা ভঙ্গ হবে। কারণ আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কিছু ভিতরে প্রবেশ করলে রোযা ভঙ্গ হবে।’

‘বাহরুর রায়িক’ কিতাবের ২য় খন্ডের ২৭৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

واذا احتقن … افطر لقوله عليه السلام الفطر مما دخل وليس مـما خرج.

অর্থ: ‘যদি কোন ব্যক্তি ইন্জেকশন নেয় … তাহলে রোযা ভঙ্গ হবে। কারণ আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কিছু ভিতরে প্রবেশ করলে রোযা ভঙ্গ হবে এবং বের হলে রোযা ভঙ্গ হবেনা।’

 ‘ফতওয়ায়ে আলমগীরী’ কিতাবের ১ম খন্ডের ২০৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

ومن احتقن … افطر.

অর্থ: ‘এবং যদি কোন ব্যক্তি ইন্জেকশন নেয় … তাহলে রোযা ভঙ্গ হবে।’ অনুরূপ ‘ফতওয়ায়ে শামীতে’ও উল্লেখ আছে।

অতএব প্রমাণিত হলো, ইন্জেকশন নিলে অবশ্যই রোযা ভঙ্গ হবে।

{দলীলসমূহঃ (১) বুখারী, (২) মুসলিম, (৩) মিশকাত, (৪) আলমগীরী, (৫) ফতহুল ক্বাদীর, (৬) হিদায়া মায়াদ দিরায়া, (৭) শামী ইত্যাদি।}

{বিঃ দ্রঃ এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে, মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ২১, ২২ ও ৪৭তম সংখ্যা পাঠ করুন।}

হাফিয সালাহুদ্দীন

 ঘোড়াশাল, নরসিংদী

সুওয়াল:  অনেকে বলে থাকে ‘খত্মে তারাবীহ পড়া সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ’ তাদের এ বক্তব্য কতটুকু সঠিক?

জাওয়াবঃ ‘যারা বলে, ‘খত্মে তারাবীহ পড়া সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ’ তাদের সে বক্তব্য মোটেও শুদ্ধ নয়। কারণ, খত্মে তারাবীহ সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ হলে প্রত্যেক পুরুষ ও মহিলাকে তা পড়তে হবে। অন্যথায় সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ তরকের গুনাহে গুনাহ্গার হবে।

আর খত্মে তারাবীহ পড়তে হলে প্রত্যেককে হাফিযে কুরআন হতে হবে। চাই জামায়াতে পড়ুক অথবা একা পড়ুক। অথচ শরীয়তে হাফিয হওয়া ফরযে কিফায়া।

আর তারাবীহর জামায়াত যেহেতু সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ কিফায়া সেহেতু কিছু লোক একাও তারাবীহ পড়তে পারে। এছাড়া অসুস্থ ব্যক্তির জন্য একা পড়ার হুকুমই রয়েছে। আর মহিলাদের জন্য তো তারাবীহ্সহ সকল প্রকার নামাযের জামায়াতে যাওয়া আম ফতওয়া মতে মাকরূহ তাহ্রীমী আর খাছ ফতওয়া মতে কুফরী।

কাজেই, যারা একা নামায পড়বে, তারা যদি হাফিযে কুরআন না হয়, তবে তারা খত্মে তারাবীহ কি করে পড়বে?

যে ব্যক্তি হাফিয নয় সে খত্মে তারাবীহ্র জামায়াতে নামায পড়া শুরু করলো হঠাৎ কোন কারণবশতঃ সে ২ বা ৪ রাকায়াত বা তার চেয়ে কম-বেশী রাকায়াত পড়তে পারলোনা। এখন সে যে কয় রাকায়াত পড়তে পারলোনা তা কিভাবে পড়বে?

খত্মে তারাবীহ যদি সুন্নতে মুয়াক্কাদা হয়, তাহলে পৃথিবীর প্রতিটি মসজিদে তারাবীহ্ নামাযে অবশ্যই কুরআন শরীফ খতম করতে হবে। অথচ পৃথিবীতে এমন অনেক স্থান, গ্রাম-গঞ্জ রয়েছে, যেখানে কুরআন শরীফ-এর হাফিয পাওয়া অসম্ভব, সেখানে কি করে কুরআন শরীফ খতম করা হবে?

সঙ্গতকারণে বিশ্বখ্যাত ফতওয়ার কিতাবসমূহে ফতওয়া দেয়া হয়েছে যে, খত্মে তারাবীহ ও সূরা তারাবীহ কোনটিই সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ নয়। বরং উভয়টি সুন্নতে মুয়াক্কাদা কিফায়া।

অএতব, কেউ ইচ্ছা করলে খতম তারাবীহ পড়তে পারে। আবার কেউ ইচ্ছা করলে সূরা তারাবীহ পড়তে পারে।

{দলীলসমূহ ঃ  (১) বাহরুর রায়িক, (২) হিদায়া, (৩) আলমগীরী, (৪) ফতহুল ক্বাদীর, (৫) ইনায়া  ইত্যাদি।}

(এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ ১০০তম সংখ্যা পাঠ করুন।)

মুহম্মদ আনিছুর রহমান

চাঁদপুর সদর

সুওয়াল: তারাবীহ্র নামাযে দু’ রাকায়াত ও চার রাকায়াতের পর কি দুয়া পড়তে হয়? এবং কত রাকায়াত পর পর মুনাজাত করার নিয়ম?

জাওয়াব: তারাবীহ্র নামাযে দু’রাকায়াতের পর নিম্নোক্ত দুয়া পড়তে হয়-

هذا من فضل ربى يا كريم المعروف يا قديم الاحسان احسن الينا باحسانك القديم ثبت قلوبنا على دينك برحمتك يا ارحم الرحمين.

উচ্চারণ: হাযা মিন ফাদ্ব্লি রব্বী, ইয়া কারীমাল মা’রূফ, ইয়া ক্বদীমাল ইহসান, আহ্সিন ইলাইনা বিইহ্সানিকাল ক্বদীম, ছাব্বিত কুলূবানা আলা দ্বীনিকা বিরহ্মাতিকা ইয়া র্আহামার রাহিমীন।

অর্থ: ‘ইহা (রমাদ্বান শরীফের রোযা ও তারাবীহর নামায) আমার রবের করুণা বা দয়া। হে সম্মানিত দাতা, হে চির ইহসানকারী, আপনার ইহসানের দ্বারা আমাদের প্রতি ইহ্সান করুন এবং আপনার সদয় অনুগ্রহের দ্বারা আমাদের দিল-মনকে আপনার দ্বীনের উপর কায়িম রাখুন। আয় আল্লাহ পাক! আপনিই সর্বাপেক্ষা দয়ালু।’

আর চার রাকায়াতের পর নিম্নোক্ত দুয়া পড়তে হয়-

سبحن ذى الملك والملكوت سبحن ذى العزة والعظمة والهيبت والقدرة والكبرياء والجبروت. سبحن الـملك الحى الذى لا ينام ولا يموت ابدا ابدا سبوح قدوس ربنا ورب الـملئكة والروح.

উচ্চারণ: সুবহানা যিল মুল্কি ওয়াল মালাকূতি সুবহানা যিল ইয্যাতি ওয়াল আয্মাতি ওয়াল হাইবাতি ওয়াল কুদরতি ওয়াল কিব্রিয়ায়ি ওয়াল জাবারূত, সুবহানাল মালিকিল হাইয়িল লাযী লা-ইয়ানামু ওয়ালা-ইয়ামূতু আবাদান আবাদা, ছুব্বূহুন কুদ্দূসুন রব্বুনা ওয়া রব্বুল মালায়িকাতি ওর্য়া রূহ।

অর্থ: ‘আমি ঐ আল্লাহ পাক-এর পবিত্রতা ঘোষণা করছি যিনি সমস্ত কর্তৃত্ব ও ফেরেশতাগণের মালিক। আমি তাঁরই পবিত্রতা ঘোষণা করছি যিনি সমস্ত ইজ্জত, আযমত, হাইবত (প্রভাব), কুদরত, বড়ত্ব ও শক্তিমত্তার অধিকারী। আমি সেই চিরজীবি মালিকেরই পবিত্রতা ঘোষণা করছি যিনি বিশ্রাম করেন না, যিনি অমর, যিনি পুতঃপবিত্র, তিনিই আমাদের রব এবং ফেরেশতা ও রূহসমূহের রব।’

উল্লেখ্য, যদি কারো উপরোক্ত দুয়া জানা না থাকে তবে সে দুরূদ শরীফ পাঠ করবে।

তারাবীহর নামাযে চার রাকায়াত পর পর মুনাজাত করার নিয়ম। মুনাজাতটি নিম্নরূপ-

اللهم صل على سيدنا ونبينا وحبيبنا وشفيعنا ومولنا رسولنا صلى الله عليه وسلم. رب ارحم هما كما ربيانى صغيرا. ربنا افرغ علينا صبرا وتوفنا مسلمين. ربنا اتنا فى الدنيا حسنة وفى الاخرة حسنة وقنا عذاب النار.

اللهم انا نسئلك الجنة ونعوذبك من النار يا خالق الجنة والنار برحمتك يا عزيز يا غفار يا كريم يا ستار يا رحيم يا جبار يا خالق يا بار. اللهم اجرنا من النار يا مجير يا مجير يا مجير برحمتك يا ارحم الرحمين.

سبحن ربك رب العزة عما يصفون وسلم على الـمرسلين والحمد لله رب العالـمين.

উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা ছল্লি আলা সাইয়্যিদিনা ওয়া নাবিইয়িনা, ওয়া হাবীবিনা ওয়া শাফীয়িনা ওয়া মাওলানা রসূলিনা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। রর্ব্বিহাম হুমা কামা রব্বাইয়ানী ছগীরা। রব্বানা আফ্রিগ আলাইনা ছবরাঁও ওয়া তাওয়াফ্ফানা মুসলিমীন। রব্বানা আতিনা ফিদ্ দুন্ইয়া হাসানাহ, ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাহ, ওয়া ক্বিনা আযাবান্ নার।

আল্লাহুম্মা ইন্না নাস্আলুকাল জান্নাতি ওয়া নাউযুবিকা মিনান নার, ইয়া খালিক্বাল জান্নাতি ওয়ান্ নার, বিরহ্মাতিকা ইয়া আযীযু, ইয়া গফ্ফারু, ইয়া কারীমু, ইয়া সাত্তারু, ইয়া রহীমু, ইয়া জাব্বারু, ইয়া খালিকু, ইয়া র্বারু, আল্লাহুম্মা আর্জিনা মিনান নার, ইয়া মুজীরু, ইয়া মুজীরু, ইয়া মুজীরু বিরহ্মাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীন।

সুবহানা রব্বিকা রব্বিল ইয্যাতি আম্মা ইয়াছিফূন ওয়া সালামুন আলাল মুরসালীন ওয়াল হামদু লিল্লাহি রব্বিল আলামীন।’

অর্থ: ‘আয় আল্লাহ পাক! আপনি ছলাত-সালাম অর্থাৎ খাছ রহম ও শান্তি নাযিল করুন আমাদের সাইয়্যিদ, নবী, হাবীব, শাফায়াতকারী ও অভিভাবক হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি। আয় আল্লাহ পাক! আপনি আমাদের পিতা-মাতার প্রতি রহম-ইহ্সান করুন। যেরূপ তারা আমাদেরকে ছোট বেলায় দয়া-ইহ্সানের সাথে লালন-পালন করেছেন। আয় আল্লাহ পাক! আপনি আমাদেরকে ধৈর্য্যরে উপর ইস্তিক্বামত করে দিন এবং আমাদেরকে মুসলমান হিসেবে ইন্তিকাল দান করুন। আয় আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে ভালাই দান করুন এবং জাহান্নামের শাস্তি থেকে পরিত্রাণ দিন।

আয় আল্লাহ পাক! নিশ্চয়ই আমরা আপনারই নিকট জান্নাতের আবেদন করছি এবং আপনারই নিকট জাহান্নাম থেকে পানাহ তলব করছি, হে জান্নাত-জাহান্নাম সৃষ্টিকারী! হে ক্ষমতাশীল, হে ক্ষমাকারী, হে দানশীল, হে অপরাধ গোপনকারী, হে দয়ালু, হে পরাক্রমশালী, হে সৃষ্টিকর্তা, হে অনুগ্রহকারী। আয় আল্লাহ পাক! আপনার সদয় অনুগ্রহে আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তিদান করুন, হে মুক্তিদানকারী, হে মুক্তিদানকারী, হে মুক্তিদানকারী, হে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু আল্লাহ পাক।

সমস্ত ইজ্জত-সম্মানের মালিক আপনার রবের জন্যেই। যিনি পবিত্র তারা যা বর্ণনা করে থাকে তা থেকে। সালাম বা খাছ শান্তি বর্ষিত হোক রসূলগণের উপর। আর তামাম আলমের রব আল্লাহ পাক-এর জন্যেই সমস্ত প্রশংসা।’ (দলীল: সমূহ হাদীছ শরীফ, তাফসীর ও ফিক্বাহর কিতাব)

মুহম্মদ নো’মান

সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম

সুওয়াল: মহিলাদের জন্য তারাবীহ নামায জামায়াতে পড়ার হুকুম কি?

জাওয়াব: আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আম ফতওয়া হলো মহিলাদের পাঁচ ওয়াক্ত, জুমুয়া, তারাবীহ ও ঈদের নামাযসহ সকল নামাযের জামায়াতের জন্য মসজিদ, ঈদগাহ  যে কোন স্থানে যাওয়া মাকরূহ তাহরীমী। আর খাছ ফতওয়া হলো কুফরী।

(এ সম্পর্কে বিস্তারিত ফতওয়া জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ১১, ১৪, ১৯, ২২, ২৯, ৩৭, ৪৪, ৪৭, ৪৮, ৫৫, ৬৫, ৭১, ৮২, ১০১ ও ১০২তম সংখ্যাগুলো পড়ুন যাতে বিশ্বখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহ হতে প্রায় ১০০টি দলীল-আদিল্লাহ পেশ করা হয়েছে।

মাওলানা আব্দুর রহিম

চাক্তাই, চট্টগ্রাম

সুওয়াল: তারাবীহ নামাযে কুরআন শরীফ খতম করে উজরত বা বিনিময় গ্রহণ করা জায়িয আছে কি না? এ সম্পর্কে ফুক্বাহায়ে কিরামের সঠিক মতামত বা ফতওয়া জানতে ইচ্ছুক।

জাওয়াব: “সময় ও স্থান নির্ধারণ করার শর্তে কুরআন শরীফ খতম করা তথা খতমে তারাবীহ ও সূরা তারাবীহসহ সকল প্রকার ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নতে মুয়াক্কাদা ইত্যাদি সর্বপ্রকার ইবাদতের বিনিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক দেয়া এবং গ্রহণ করা জায়িয ও শরীয়তসম্মত।” এটাই গ্রহণযোগ্য এবং এমতের উপরই ফতওয়া। এর বিপরীত ফতওয়া দেয়া নাজায়িয ও হারাম।”

(বিঃ দ্রঃ তারাবীহ নামাযে কুরআন শরীফ খতম করে বিনিময় গ্রহণ করা জায়িয এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ২৩ ও ২৪তম সংখ্যার ফতওয়া বিভাগ পড়ুন এবং বিশেষ করে ৩৬, ৪৭, ৬৬, ৭১, ৭৭, ৮৭, ৮৮, ৯০ ও ১১১তম সংখ্যা পাঠ করুন। সেখানে মাসিক মদীনা, অখ্যাত মাসিক রহমানী পয়গাম এবং হাটহাজারীর অখ্যাত মাসিক পত্রিকার ভুল বক্তব্য খ-ন করে সঠিক জাওয়াব দেয়া হয়েছে।

মুসাম্মত আয়িশা ছিদ্দীক্বা

চাক্তাই, চট্টগ্রাম

সুওয়াল: আমরা জানি, তারাবীহ নামায বিশ রাকায়াত এবং তা আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। অথচ কেউ কেউ বলে আট রাকায়াত, আবার কেউ কেউ বলে বার রাকায়াত। কোনটি সঠিক?

জাওয়াব: আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ফতওয়া মোতাবেক তারাবীহর নামায বিশ রাকায়াত পড়াই সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। অতএব, কেউ যদি বিশ রাকায়াত থেকে এক রাকায়াতও কম পড়ে, তবে তার সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ তরক করার গুনাহ হবে। অর্থাৎ তারাবীহর নামায বিশ রাকায়াতই পড়তে হবে এবং এর উপরই ইজমা হয়েছে।

দলীলসমূহ: মুছান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ, সুনানুল কুবরা লিল বাইহাকী, আল কবীর লিত্ তবারানী, ফতওয়ায়ে আলমগীরী, বাহরুর রায়িক, মারাক্বিউল ফালাহ ইত্যাদি।

(এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ ২৫-৩০তম সংখ্যা পাঠ করুন। সেখানে ৩০৪ খানা অকাট্য ও নির্ভরযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে ছাবিত করা হয়েছে যে, তারাবীহর নামায বিশ রাকায়াত পড়াই সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ।)

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ