সুওয়াল-জাওয়াব

সংখ্যা: ১২৪তম সংখ্যা | বিভাগ:

 মুহম্মদ মন্জুরুল ইসলাম বক্সী

সাধারণ সম্পাদক- আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত ফুলবাড়ী, কুড়িগ্রাম।

সুওয়ালঃ হাটহাজারী মাদ্রাসার অখ্যাত মাসিক পত্রিকা নভেম্বর/২০০৩ঈসায়ী সংখ্যায় “তারাবীহের নামাযে কুরআন শরীফ খতম করা সম্পর্কে বলা হয়েছে, “নিজে পড়ে হোক কিংবা শ্রবণ করে হোক তারাবীহের নামাযে একবার সম্পূর্ণ কুরআন খতম করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্্”।   অথচ আমরা জানি “তারাবীহ্ নামাযে একবার সম্পূর্ণ  কুরআন শরীফ খতম করা সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া। কোনটি সঠিক? দয়া করে সঠিক জাওয়াব দানে বাধিত করবেন। জাওয়াবঃ “খত্মে তারাবীহ্ বা তারাবীহ্ নামাযে একবার সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ খতম করা” সুন্নতে মুয়াক্কাদা নয় বরং সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া। অতএব, হাটহাজারী মাদ্রাসার অখ্যাত মাসিক পত্রিকার উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং সম্পূর্ণ ভুল ও অশুদ্ধ হয়েছে। উল্লেখ্য, বিশ্বখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য ফিক্বাহ্ ও ফতওয়ার কিতাবসমূহে বলা হয়েছে,

التراويح سنة مؤكدة للرجال والنساء.

অর্থাৎ- পুরুষ ও মহিলা সকলের জন্যই তারাবীহ্ নামায পড়া সুন্নতে মুয়াক্কাদা।  আর বিশ্বখ্যাত ফতওয়ার কিতাবসমূহে তারাবীহ্র জামায়াতকে সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া বলা হয়েছে।  যেমন, কিতাবে উল্লেখ আছে,

وصلوتها بالجماعة سنة كفاية.

অর্থাৎ- “তারাবীহ্র নামায জামায়াতের সাথে আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া।”  কোন কোন কিতাবে উল্লেখ আছে,

والجماعة فيها سنة على الكفاية.

অর্থাৎ- “তারাবীহ্র নামাযের জামায়াত সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া।” আর তারাবীহ্র নামায জামায়াতে আদায় করা শুধুমাত্র পুরুষের জন্য সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া। মহিলাদের জন্য নয়। কারণ মহিলাদের জন্য তারাবীহ্সহ সকল প্রকার নামাযের জামায়াতে যাওয়া মাকরূহ তাহরীমীর অন্তর্ভুক্ত।” সুতরাং তারাবীহ্র জামায়াত যেহেতু সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া, সেহেতু “তারাবীহ্র জামায়াত” মহল্লায়, গ্রামে, শহরের কোন মসজিদে কায়িম হলে এবং তাতে কিছু লোক উক্ত জামায়াতে নামায আদায় করলে অন্যান্য সকলের পক্ষ হতে সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়ার হক্ব আদায় হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে কুরআন শরীফের হাফিয হওয়াও সকলের জন্য ফরয, ওয়াজিব বা সুন্নতে মুয়াক্কাদা কোনটিই নয়। বরং তা হচ্ছে জানাযার নামাযের ন্যায় ফরযে কিফায়ার অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ এলাকার কেউ বা কতক লোক হাফিয হলে অন্যান্য সকলের পক্ষ হতে তার হক্ব আদায় হয়ে যাবে। কাজেই এখন প্রশ্ন হলো, তারাবীহ্র জামায়াত যেখানে সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া এবং হাফিযে কুরআন হওয়া ফরযে কিফায়া, সেখানে তারাবীহ্র নামাযে একা হোক বা জামায়াতে হোক একবার সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ খতম করা কি করে সুন্নতে মুয়াক্কাদা হতে পারে? উল্লেখ্য, যদি খত্মে তারাবীহ্ বা তারাবীহ্ নামাযে একবার সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ খতম করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা হয়, তাহলে তারাবীহ্ নামাযের জামায়াতকেও সুন্নতে মুয়াক্কাদা বলতে হবে। কিফায়া বলা যাবে না। কারণ কিফায়া হলে তো কিছু লোক একাও নামায পড়তে পারেন।  অতএব, প্রথমতঃ যারা একা নামায পড়বেন, তারা যদি হাফিযে কুরআন না হন, তাহলে তারা তারাবীহ্ নামাযে কুরআন শরীফ কিভাবে খতম করবেন? তারাবীহ্ নামাযে কুরআন শরীফ খতম করা যদি সুন্নতে মুয়াক্কাদা হয়, তবে প্রত্যেককেই তো তা আদায় করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ তারাবীহ্ নামাযে কুরআন শরীফ খতম করা যদি সুন্নতে মুয়াক্কাদা হয়, তাহলে পৃথিবীর প্রতিটি মসজিদে তারাবীহ্ নামাযে অবশ্যই কুরআন শরীফ খতম করতে হবে। অন্যথায় সুন্নতে মুয়াক্কাদা তরকের গুণাহে গুণাহ্গার হতে হবে। অথচ পৃথিবীতে এমন অনেক স্থান, এমন অনেক গ্রাম-গঞ্জ রয়েছে, যেখানে কুরআন শরীফের হাফিয পাওয়া অসম্ভব, সেখানে কি করে কুরআন শরীফ খতম করা হবে?

তৃতীয়তঃ যদি তারাবীহ্ নামাযে কুরআন শরীফ খতম করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা হয়, তাহলে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক পুরুষ ও মহিলাকে কুরআন শরীফের হাফিয হতে হবে। অন্যথায় পুরুষ হোক কিংবা মহিলা হোক  তারাবীহ্র নামাযে কুরআন শরীফ খতম না করলে সুন্নতে মুয়াক্কাদা তরক করার কারণে ওয়াজিব তরকের গুণাহে গুণাহ্গার হতে হবে। চতুর্থতঃ যদি কোন ব্যক্তি যে হাফিয নয়, সে খতমে তারাবীহ্র জামায়াতে নামায পড়া শুরু করলে হঠাৎ কোন কারণবশতঃ সে ২ রাকায়াত বা ৪ রাকায়াত বা তার চেয়ে কম বা বেশী রাকায়াত নামায জামায়াতের সাথে পড়তে পারলো না। এখন সে কি করবে? সে যে কয় রাকায়াত নামায পড়তে পারল না তা পড়বে কি পড়বে না? যদি পড়ে তা কিভাবে পড়বে? যদি সূরা তারাবীহ্ পড়ে তাহলে তো তার খতম হল না। শুধু তাই নয় পুরা রমাদ্বান শরীফে তারাবীহ্র ২০ রাকায়াতের এক রাকায়াতও যদি কোন কারণবশতঃ পড়তে না পারে তাহলে তার খতম হবে না। পঞ্চমতঃ যদি খত্মে তারাবীহ্ বা তারাবীহ্ নামাযে কুরআন শরীফ খতম করা সুন্নতে মুয়াক্কাদাই হয়, তাহলে সূরা তারাবীহ্ পড়লে সুন্নতে মুয়াক্কাদা তরক করার কারণে গুণাহ্ হবে কি? ষষ্ঠতঃ যদি তারাবীহ্ নামাযে একবার সম্পূর্ণ  কুরআন শরীফ খতম করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা হয়, তাহলে সূরা তারাবীহ্র প্রশ্নই উঠতে পারে না। অথচ বিশ্বখ্যাত ফতওয়ার কিতাবসমূহে সূরা তারাবীহ্ পড়ার নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে।  যেমন ফতওয়ায়ে আলমগীরী কিতাবে উল্লেখ আছে,

ثم بعضهم اختار قل هو الله احد فى كل ركعة وبعضهم اختار قراءة سورة الفيل الى اخر القران وهذا احسن القولين لانه لايشتبه عليه عدد الركعات ولايشتغل قلبه بحفظها.

অর্থাৎ- “কেউ কেউ (সূরা ফাতিহার পর) প্রত্যেক রাক্য়াতে সূরা ইখলাছ পড়াকে পছন্দ করেছেন। আর কেউ কেউ সূরা ফীল থেকে কুরআন শরীফের শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ সূরা নাস পর্যন্ত পড়াকে পছন্দ করেছেন এবং এটাই উত্তম। কেননা এতে রাক্য়াত গণনার ক্ষেত্রে ভুল হয়না এবং তা স্মরণে অন্তর সন্দেহে পতিত হয়না।”  অতএব, প্রমাণিত হলো যে, খত্মে তারাবীহ্ বা তারাবীহ্ নামাযে একবার সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ খতম করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা নয়। বরং সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া।  সুতরাং হাটহাজারীর অখ্যাত মাসিক পত্রিকায় যে বলা হয়েছে, “নিজে পড়ে হোক কিংবা শ্রবণ করে হোক তারাবীহের নামাযে একবার সম্পূর্ণ কুরআন খতম করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্। তাদের এ বক্তব্য সম্পূর্ণ ভুল ও অশুদ্ধ এবং শরীয়তের খিলাফ বলেই প্রমাণিত হলো।   বিঃদ্রঃ তারাবীহ্ নামাযে একবার সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ খতম করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা নয়। বরং সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া। এ সম্পর্কে আরো জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ২৬,৭৮ ও ১০০তম সংখ্যাগুলো পাঠ করুন। সেখানে তারাবীহ্ নামাযে কমপক্ষে একবার কুরআন শরীফ খতম করা সম্পর্কে মাসিক মদিনার ভুল বক্তব্য খন্ডন করে সঠিক জাওয়াব দেয়া হয়েছে। এবার  প্রথম বারের মতো তারাবীহ্ নামাযে একবার সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ খতম করা সম্পর্কে হাটহাজারী মাদ্রাসার অখ্যাত মাসিক পত্রিকার ভুল বক্তব্য খন্ডন করে সঠিক জাওয়াব দেয়া হলো।  {দলীলসমূহ ঃ (১) বাহরুর রায়িক, (২) হিদায়া, (৩) আলমগীরী, (৪)ফতহুল ক্বাদীর, (৫) ইনায়া, (৬) শরহে মুনীয়া, (৭) মুহীত, (৮) জখীরা, (৯) খানিয়া, (১০) আল ইখতিয়ার, (১১) আল মুজতাবী (১২) তাজনীস, (১৩) জাহিদী, (১৪) শরহুন নিক্বায়া, (১৫) জাওহারাতুন্ নাইয়্যারাহ, (১৬) আইনুল হিদায়া, (১৭) শরহে বিক্বায়া, (১৮) দুররুল মুখতার, (১৯) রদ্দুল মুহ্তার, (২০) নূরুল ইজাহ্, (২১) মারাকিউল ফালাহ্, (২২) হাশিয়ায়ে তাহতাবী, (২৩) গায়াতুল আওতার, (২৪) ফতওয়ায়ে বায্যাযিয়াহ, (২৫) ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া, (২৬) আল আশবাহ ওয়ান্ নাযায়ির, (২৭) আনওয়ারুস্ সাভিয়া, (২৮) আওযাযুল মাসালিক, (২৯) নাইলুল মায়ারিব, (৩০) রওজুর রিয়াজ, (৩১) আল মুগনী(৩২) জামির্উ রুমুয ইত্যাদি।}

সাইয়্যিদ মুহম্মদ তীতুমীর, সাতক্ষীরা। মুহম্মদ নুরুল্লাহ্ খন্দকার, সিরাজগঞ্জ। মুহম্মদ ফয়জুল্লাহ্, লালমনিরহাট।

সুওয়ালঃ আমরা আগে আলিমগণের মুখে শুনতাম যে, টিভি দেখা জায়িয নেই। কিন্তু বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি অনেক মাওলানা ছাহেবরা টিভিতে অনুষ্ঠান করছে। বিশেষ করে মানুষ যাদেরকে বড় মাওলানা মনে করে তারাই সেটা করছে। তাদের সে অনুষ্ঠানগুলো এ.টি.এন টিভি চ্যানেলসহ আরো অনেক চ্যানেলে প্রায়ই দেখানো হয় এবং তাতে ইসলামের অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে বলে অনেকেই তা দেখে থাকে। এছাড়া মাসিক মদীনা মে/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যার ২১নং প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, “টেলিভিশন একটি যন্ত্রমাত্র। খোলা চোখে যা কিছু দেখা জায়িয বা মুবাহ টেলিভিশনের পর্দাতেও সেগুলি দেখা জায়িয বা মুবাহ। শিক্ষণীয় কিছু দেখলে বা শুনলে পূণ্য হওয়ারই কথা। অপর দিকে পাপযুক্ত যেসব দৃশ্য দেখানো হয় সেগুলি দেখা ও শোনাতে অবশ্যই গোনাহ্ হবে।”  অনুরূপ মাসিক রাহমানী পয়গাম জুলাই/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যার এক জিজ্ঞাসার জবাবে বলা হয়েছে, “টিভি দেখার শরয়ী মূলনীতি হলো, যে সকল বস্তু বা বিষয়াবলী (টিভির পর্দা, রেডিও ইত্যাদির মাধ্যম ছাড়া) সরাসরি দেখা ও শুনা জায়িয সেগুলো টিভির পর্দা, রেডিও ইত্যাদিতেও দেখা বা শুনা জায়িয। আর যে সকল বস্তু বা বিষয়াবলী সরাসরি দেখা ও শুনা জায়িয নেই সেগুলো টিভি, রেডিও ইত্যাদিতেও দেখা-শুনা জায়িয নেই।” এখন আমার জানার যে বিষয় তাহলো- (১) মাসিক মদীনা পত্রিকার প্রশ্নের উত্তর ও মাসিক রাহমানী পয়গাম পত্রিকার জিজ্ঞাসার জবাব শরীয়ত সম্মত হয়েছে কিনা? (২) ছবি কাকে বলে ও ছবির সংজ্ঞা কি? (৩) শরীয়তে টি.ভি দেখা জায়িয কিনা?  (৪) নাজায়িয পদ্ধতিতে ইল্মে দ্বীন শিক্ষা করা অর্থাৎ ইল্মে দ্বীন  শিক্ষার জন্য টিভি দেখা, শোনা ও টিভি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা শরীয়তসম্মত কিনা? (৫) নাজায়িয হলে যে সকল মাওলানা ছাহেব অনুষ্ঠান করে ও দেখে তাদের সম্পর্কে শরীয়তের ফতওয়া কি? এদেরকে আলিম বলা যাবে কিনা? এদের পিছনে নামায পড়া যাবে কিনা? কুরআন-সুন্নাহ্র দলীল সহকারে জাওয়াব দিলে খুবই উপকৃত ও খুশী হব।

জাওয়াবঃ সুওয়ালে বর্ণিত সুওয়ালকারীর পাঁচটি সুওয়ালের জাওয়াবই ধারাবাহিকভাবে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ্। (ধারাবাহিক) (৩) ‘শরীয়তে টিভি দেখা জায়িয কিনা?  এর জবাবে বলতে হয়, শরীয়তে টিভি দেখা সম্পূর্ণ নাজায়িয ও হারাম। কারণ টিভিতে জানদার প্রাণীর ছবির মাধ্যমে অনুষ্ঠান বা প্রগ্রাম করা হয়। আর শরীয়তের দৃষ্টিতে ছবি তোলা, আঁকা, রাখা, সম্পূর্ণ হারামের অন্তর্ভুক্ত। হালাল বা জায়িয বলা সম্পূর্ণরূপে কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। অনেকে বলতে পারে, ছবি তোলা, আঁকা ও রাখা সরাসরি কুরআন শরীফের দ্বারা হারাম প্রমাণিত নয়।  হ্যাঁ, কথাটি সত্য। তবে এর জবাবে বলতে হয়, ছবি তোলা, আঁকা, রাখা যদিও সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে কুরআন শরীফের দ্বারা হারাম বলে প্রমাণিত নয় কিন্তু পরোক্ষভাবে তা কুরআন শরীফের দ্বারাই হারাম বলে প্রমাণিত। কারণ, অসংখ্য বিশুদ্ধ হাদীছ শরীফের দ্বারা তা হারাম বলে প্রমাণিত।  কেননা, আল্লাহ্ পাক নিজেই বলেন,

وما ينطق عن الهوى ان هو الا وحى يوحى

অর্থঃ- “আল্লাহ্ পাক এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহী ব্যতীত নিজ থেকে কোন কথা বলেননা।” (সূরা নজম/৩,৪) অর্থাৎ আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্ পাক-এর নির্দেশ (ওহী) ব্যতীত কখনই কোন কথা বলেননি, কোন কাজ করেননি, কোন বিষয়ে সম্মতি দেননি এবং কাকেও কোন আদেশ ও নিষেধ পর্যন্ত করেননি।

ওহী দু’প্রকার। (১) ওহী মতলূ, (২) ওহী গাইরে মতলূ। ওহী মতলূ হচ্ছে, আল্লাহ্ পাক-এর কালাম কুরআন শরীফ যা হুবহু তিলাওয়াত করতে হয়। আর ওহী গইরে মতলূ হচ্ছে, আল্লাহ্ পাক-এর কালাম যা আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে। তা হচ্ছে হাদীছ শরীফ যা কুরআন শরীফের মত তিলাওয়াত করতে হয়না। আরো উল্লেখ্য, আল্লাহ্ পাক নিজেই তাঁর কালাম পাকে উভয় প্রকার ওহী দৃঢ়ভাবে ধারণ করার জন্য বলেছেন। যেমন, এ মর্মে তিনি ইরশাদ করেন,

وما اتكم الرسول فخذوه وما نهكم عنه فانتهوا واتقوا الله ان الله شديد العقاب.

অর্থঃ- “হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের জন্য যা নিয়ে এসেছেন তা তোমরা আঁকড়ে ধর এবং তিনি যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন তা থেকে তোমরা বিরত থাক। অতঃএব, (এ ব্যাপারে) তোমরা আল্লাহ্ পাককে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক কঠোর শাস্তিদাতা।” (সূরা হাশর/৭)

  এ আয়াত শরীফের তাফসীরে কিতাবে বর্ণিত রয়েছে যে, খলীফাতুল মুসলিমীন, আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর খিলাফতকালে তিনি একটি বোর্ড টাঙ্গিয়ে দিলেন, যার হেড লাইনে লিখে দেয়া হলো, আল্লাহ্ পাক-এর আদেশ। এর নীচে কতিপয় কুরআন শরীফের আয়াত শরীফ ও কয়েকখানা হাদীছ শরীফ লিখা হলো। এক ব্যক্তি বোর্ডে উল্লিখিত লিখাগুলো পড়ে খলীফাতুল মুসলিমীন, আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ইবনুল  খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো যে, হে খলীফাতুল মুসলিমীন, আমীরুল মু’মিনীন! আপনি যে বোর্ড টাঙ্গিয়ে দিয়েছেন, তাতে আল্লাহ্ পাক-এর আদেশ লেখার পর নিচে কতিপয় কুরআন শরীফের আয়াত শরীফ এবং কতিপয় হাদীছ শরীফ উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ্ পাক-এর আদেশ বলতে আমরা জানি, কুরআন শরীফ। কিন্তু আপনি হাদীছ শরীফকেও আল্লাহ্ পাক-এর আদেশরূপে উল্লেখ করেছেন এটা আমার বুঝে আসছেনা। তখন তিনি লোকটিকে বললেন, হে ব্যক্তি! তুমি কি কুরআন শরীফ পড়েছ? সে বললো জী হুযূর,  আমি কুরআন শরীফের হাফিয। হযরত উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আয়াত শরীফ তিলাওয়াত করে বললেন যে, তুমি কি এ আয়াত শরীফ পড়নি? সে ব্যক্তি বলল, জী হুযূর! আমি এখন বুঝতে পেরেছি। তিনি বললেন, কি বুঝতে পেরেছ? বুঝতে পেরেছি যে, আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথা অর্থাৎ হাদীছ শরীফ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ পাক-এরই কালামের অন্তর্ভুক্ত। এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে রয়েছে,

عن ابى رافع رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لا الفين احدكم متكئا على اريكته يأتيه الامر من امرى مما امرت به اونهيت عنه فيقول لا ادرى ما وجدنا فى كتاب الله اتبعناه.

অর্থঃ- “হযরত আবু রাফে’ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি তোমাদের কাউকে যেন এরূপ না দেখি- সে গদিতে হেলান দিয়ে বসে থাকবে আর তার নিকট আমার আদেশসমূহের কোন একটি আদেশ পৌঁছবে যাতে আমি কোন বিষয় আদেশ করেছি অথবা কোন বিষয়ে নিষেধ করেছি। তখন সে বলবে, আমি এসব কিছু জানিনা, আল্লাহ্ পাক-এর কিতাবে যা পাব কেবল তারই অনুসরণ করব।” (আহমদ শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ, তিরমিযী শরীফ, বাইহাক্বী শরীফ) হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত রয়েছে,

عن المقدام بن معديكرب رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم الا انى اوتيت القران وميثله معه.

অর্থঃ- “হযরত মেকদাম ইবনে মা’দীকারব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, জেনে রাখ, আমাকে কুরআন শরীফ এবং তার সাথে তার অনুরূপ (হাদীছ শরীফ) দেয়া হয়েছে।” (আবূ দাউদ  শরীফ, মিশকাত শরীফ) হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত রয়েছে,

عن العرباض بن سارية رضى الله تعالى عنه قال قام رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال ايحسب احدكم متكئا على اريكته يظن ان الله لم يكرم شيئا الا ما فى هذا القران الا و انى والله قد امرت ووعظت ونهيت عن اشياء انها لمثل القران.

অর্থঃ- “হযরত ইরবায ইবনে সারিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, একদিন হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (আমাদের মধ্যে) দাঁড়ালেন এবং বললেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার গদিতে হেলান দিয়ে একথা মনে করে যে, আল্লাহ্ পাক যা এ কুরআন শরীফে হারাম করেছেন তা ব্যতীত তিনি আর কিছুই হারাম করেননি? সাবধান! তোমরা জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ্ পাক-এর কসম করে বলছি, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের অনেক বিষয় আদেশ দিয়েছি, উপদেশ দিয়েছি এবং অনেক বিষয় নিষেধও করেছি। নিশ্চয়ই আমার এরূপ বিষয়গুলোও নিশ্চিত কুরআন শরীফের বিষয়েরই অনুরূপ।” (আবূ দাউদ শরীফ, মিশকাত শরীফ) উল্লেখ্য, মুসলমানদের দলীল শুধু কুরআন শরীফই নয়। এ প্রসঙ্গে উছূলের কিতাবে বর্ণিত রয়েছে,

اصول الشرح ثلاثة القران والحديث والاجماع ورابعها القياس.

অর্থঃ- “শরীয়তের উছূল বা দলীল হচ্ছে তিনটি। কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা এবং চতুর্থ দলীলটি হচ্ছে ক্বিয়াস।” (নূরুল আনোয়ার) যদিও ছবি তোলা, আঁকা ও রাখা হাদীছ শরীফের দ্বারা হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা আল্লাহ্ পাক কর্তৃক নিষেধের অন্তর্ভুক্ত বা অনুরূপ। আর টিভির সমস্ত অনুষ্ঠানগুলোই জানদার প্রাণির ছবি সম্বলিত। যেহেতু জানদার প্রাণির ছবি তোলা, আঁকা, রাখা সম্পূর্ণ হারাম সেহেতু টিভি দেখা সম্পূর্ণরূপে হারামের অন্তর্ভুক্ত। জানদার প্রাণির ছবি তোলা, আঁকা ও রাখা সম্পর্কে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

ان اشد الناس عذابا عند الله المصورون.

অর্থঃ- “নিশ্চয় মানুষের মধ্যে ঐ ব্যক্তিকে আল্লাহ্ পাক কঠিন শাস্তি দেবেন, যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি তোলে বা আঁকে।” (বুখারী শরীফ ২য় জিঃ, ৮৮০ পৃষ্ঠা) তিনি আরো ইরশাদ করেন,

ان من اشد اهل النار يوم القيمة عذابا المصورون.

অর্থঃ “নিশ্চয় ক্বিয়ামতের দিন দোযখবাসীদের মধ্যে ঐ ব্যক্তির কঠিন আযাব হবে, যে ব্যক্তি প্রাণির ছবি আঁকে বা তোলে।” (মুসলিম শরীফ ২য় জিঃ ২০১ পৃষ্ঠা) হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

عن ابى طلحة رضى الله تعالى عنه ان النبى صلى الله عليه وسلم قال لا تدخل الملئكة بيتا فيه كلب ولا صورة.

অর্থঃ- “হযরত আবু ত্বলহা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। নিশ্চয়ই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “ঐ ঘরে রহমতের ফেরেশ্তা প্রবেশ করেনা, যে ঘরে কুকুর বা প্রাণির ছবি থাকে।” (নাসাঈ শরীফ ২য় জিঃ ২৯৯ পৃষ্ঠা) হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

عن عائشة رضى الله تعالى عنها زوج النبى صلى الله عليه وسلم قالت دخل على رسول الله صلى الله عليه وسلم وقد سترت بقرام فيه تماثيل فلما راه تلون وجهه ثم هتكه بيده وقال ان اشد الناس عذاب يوم القيمة الذين يشبهون بخلق الله.

অর্থঃ- উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। আর আমি ঘরের মধ্যে প্রাণির ছবিযুক্ত একখানা পর্দা লাগিয়েছিলাম। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন  সেটা দেখলেন, তখন তাঁর চেহারা মুবারক রঙ্গীন হয়ে গেল এবং পর্দাখানা নিজ হাতে ছিড়ে ফেললেন এবং বললেন, নিশ্চয়ই ক্বিয়ামত দিবসে ঐ ব্যক্তির কঠিন শাস্তি হবে, যে আল্লাহ্ পাক-এর সৃষ্টির সাদৃশ্য কোন প্রাণির ছুরত তৈরী করে।” (নাসাঈ শরীফ ২য় জিঃ ৩০০ পৃষ্ঠা) হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

عن ابن عباس رضى الله تعالى عنهما قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من صور صورة عذبه الله حتى ينفخ فيها يعنى الروح وليس ينافخ فيها.

অর্থঃ- হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোন প্রাণির ছবি তৈরী করবে, আল্লাহ পাক তাকে ঐ ছবির মধ্যে প্রাণ না দেয়া পর্যন্ত শাস্তি দিবেন কিন্তু সেটার মধ্যে প্রাণ দিতে সক্ষম হবে না।” (তিরমিযী শরীফ ১ম জিঃ ২৮ পৃষ্ঠা) উপরোক্ত হাদীছ শরীফের ব্যাখ্যায় ইমাম, মুজতাহিদ ও ফক্বীহগণ বিশ্ববিখ্যাত ফিক্বহ্ ও ফতওয়ার কিতাবে বলেছেন বা ফতওয়া দিয়েছেন,

وان كان ورد فى حق عاص فيكون اشد عذابا من غيره من العصاة ويكون ذلك ذالا على المعصية المنكورة وفى الترضيح قال اصحابنا وغيرهم صورة الحيوان حرام اشد التحريم وهم من الكبائر سواء صنعه لما يمتهن او لغيره حرام بكل حال لان فيه مضاهاة لخلق الله وسواء كان فى ثوب او بساط او دينار او درهم او فلس او اناء او حئط.

অর্থঃ- “যদিও অন্যান্য গুরুতর পাপের জন্য হাদীছ শরীফে কঠিন  শাস্তির কথা বলা হয়েছে, কিন্তু ছবি বা প্রতিমূর্তি নির্মাণকারীর শাস্তি সর্বাপেক্ষা কঠিন হবে এবং কঠোর শাস্তিই পাপের গুরুত্ব প্রাণ করছে। ‘তাওজীহ্’ কিতাবে উল্লেখ আছে যে, জীব-জন্তুর ছবি বা প্রতিমূর্তি নির্মাণ করা নিষিদ্ধ,বরং কঠোর নিষিদ্ধ কাজ অর্থাৎ হারাম। এটা কবীরাহ্ গুণাহ। চাই এটাকে যতœ সম্মান প্রদর্শন করুক কিংবা অন্য যে কোন উদ্দেশ্যেই বানিয়ে থাকুক। কেননা এরূপ কাজে আল্লাহ পাক-এর সৃষ্টির অনুকরণ করা হয়। এটা বস্ত্রে, বিছানায়, মোহরে, মুদ্রায়, পয়সায়, পাত্রে ও প্রাচীর গাত্রে যে কোন স্থানে আঁকা বা নির্মাণ করা হারাম।” (উম্দাতুল ক্বারী, ফতওয়ায়ে ছিদ্দীক্বিয়া ৩৭৮ পৃষ্ঠা, আয্ যাওয়াজির  ২য় জিঃ, ৩৩ পৃষ্ঠা)

قال اصحابنا وغيرهم من العلماء تصوير صورة للحيوان حرام شديد التحريم وهو من الكبائر لانه متوعد عليه بهذا الوعيد الشديد المذكور فى الاحاديث سواء صنعه فى ثوب او بساط او دينار او درهم.

অর্থঃ- “আমাদের মাশায়িখগণ ও উলামাগণ বলেছেন যে, প্রাণির ছবি তৈরী করা হারাম, এমনকি গুরুতর হারাম। এটা কবীরাহ্ গুনাহ্। কেননা এরূপ কাজের জন্য বিশেষ ভীতিপ্রদ অবস্থা হাদীছ শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা কাপড়ে, বিছানায়, মোহরে, টাকা-পয়সায় কিংবা যে কোন স্থানে আঁকা থাকুক না কেন তা সমান কথা।”(শরহে মিরকাত, ফতওয়ায়ে ছিদ্দীক্বিয়া ৩৭৯ পৃষ্ঠা, নাইলুল আওতার ২য় জিঃ, ১০৫ পৃষ্ঠা)

ويكره ان يكون فوق راسه فى السقف او بيى يديه او بحذائه تصاوير او صورة معلقة – واشدها كراهة ان تكون امام المصلى ثم من فوق راسه – ثم على يمينه ثم على شماله ثم خلفه.

অর্থঃ- “নামায মাকরূহ্ তাহ্রিমী হবে, নামাযীর মাথার উপর, ছাদের মধ্যে অথবা সামনে অথবা জুতোর মধ্যে অথবা ঝুলন্ত অবস্থায় প্রাণির ছবি থাকলে। এবং নামায শক্ত মাকরূহ্ তাহ্রিমী হবে, প্রাণির ছবি নামাযীর সামনে, মাথার উপরে, ডানে, বাঁয়ে, পিছনে থাকলে।” (ফাতহুল কাদীর ১ম জিঃ ৩৬২ পৃষ্ঠা, আইনী শরহে হিদায়া ১ম জিঃ ৮০৭ পৃষ্ঠা, বাহ্রুর রায়িক ২য় জিঃ ২৭ পৃষ্ঠা, লিসসুরুখছিল মাবছুত ১ম জিঃ ২১১ পৃষ্ঠা, হিদায়া ১ম জিঃ ১৪২ পৃষ্ঠা, শরহে বিকায়া ১ম জিঃ ১২৮ পৃষ্ঠা, শরহে নিকায়া ১ম জিঃ ২১৭ পৃষ্ঠা, কিতাবুল ফিকাহ আলা মাযাহিবিল আরবা ১ম জিঃ ২৭৮ পৃষ্ঠা, মারাকিউল ফালায় ২৪০ পৃষ্ঠা, জামিউছ ছগীর ২৬ পৃষ্ঠা, মালাবুদ্দা মিন্হু ৬১ পৃষ্ঠা, আনোয়ারে মাহ্মূদ ৫৬ পৃষ্ঠা) উর্দূ কম্পোজ করতে হবে  অর্থঃ- প্রাণীর ছবিযুক্ত স্থানে নামায পড়া মাকরূহ্ তাহ্রিমী এবং উক্ত নামায দোহ্রানো ওয়াজিব। কেননা আলমগীরি, ফতহুল কাদীর কিতাবে মাকরূর বয়ানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নামাযের মধ্যে মাকরূহ্ তাহ্রিমী হলে নামায দোহ্রানো ওয়াজিব, আর মাকরূহ তান্জীহ্ হলে নামায দোহ্রানো মুস্তাহাব। (আহসানুল ফতওয়া ৩য় জিঃ পৃঃ ৪২৭, আলমগীরি, ফতহুল ক্বাদীর ইত্যাদি) অতএব, উপরোক্ত কুরআন-সুন্নাহ-এর আলোচনা দ্বারা এটাই ছাবেত বা প্রমাণিত হলো যে ছবি তোলা, আঁকা, রাখা ও দেখা ইত্যাদি সমস্ত কিছুই হারাম ও নাজায়িয। যেহেতু টিভির মূল বিষয়ই হচ্ছে ছবি সেহেতু টিভি দেখা রাখা ইত্যাদি প্রত্যেকটাই নাজায়িয ও শক্ত হারামের অন্তর্ভুক্ত। শরীয়তে হারামকে হালাল বলা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতপক্ষে তাদের এ কথা কুফরী হয়েছে। কারণ, তারা হারামকে হালাল করেছে যা কুফরী। শরীয়তের মাসয়ালা বা ফতওয়া হচ্ছে কেউ কুফরী করলে সে কাফির হয়। আর কোন মুসলমান কুফরী করলে সে মুরতাদ হয়ে যায়। মুরতাদের হুকুম হলো, তার যিন্দিগীর সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে যায়। বিয়ে করে থাকলে স্ত্রী তালাক হয়ে যায়, হজ্ব করে থাকলে হজ্ব বাতিল হয়ে যায়, তার ওয়ারিছী সত্ত্ব বাতিল হয়ে যায় এবং সে মারা গেলে তার জানাযার নামায পড়াও হারাম হয়ে যায়। কেউ যদি মুরতাদের জানাযার নামায পড়ায় তার উপরও মুরতাদের হুকুম বর্তাবে। কোন মুরতাদ মারা গেলে তাকে কোন মুসলমানের কবরস্থানে দাফন করাও জায়িয নেই। শরীয়তের হুকুম হচ্ছে মৃত মুরতাদকে কুকুর-শৃগালের মত গর্তে পুঁতে রাখা। এখন তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য হলো খালিছ তওবা-ইস্তিগফার করা। অন্যথায় তাদের উপর মুরতাদের হুকুম বর্তাবে। (চলবে)

মুসাম্মত সানজিদা আক্তার সভানেত্রী- ছাত্রী আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত মুহম্মদপুর, ঢাকা।

সুওয়ালঃ অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম এপ্রিল/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসার-জবাব বিভাগে নিম্নোক্ত ১২৪৭নং জিজ্ঞাসার-জবাব ছাপা হয়- জিজ্ঞাসা ঃ সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী ও আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন আমার মৃত্যুর পর পূর্ব দেশগুলির মধ্য হতে কোন একটি দেশ থেকে আমার উম্মতের ভিতর হতে একটি দল বের হবে। এই দলের সদস্যগণ হবে অশিক্ষিত ও মূর্খ। এদের মধ্যে কোন শিক্ষিত লোক গেলে সেও হয়ে যাবে মূর্খের মত। তাদের বক্তৃতা হবে বহু বহু গুণের ফজিলতের। তাদের মত বক্তৃতা বা বয়ান কারো হবে না। তাদের সকল আমল হবে খুবই নিখূঁত ও সুন্দর। তাদের নামাযের তুলনায় তোমরা তোমাদের নামাযকে তুচ্ছ মনে করবে, তাদের রোযা দেখে তোমাদের রোযাকে তোমরা তুচ্ছ ও নগণ্য মনে করবে। তাদের আমল দেখে তোমরা তোমাদের আমলকে হেয় মনে করবে, তারা কুরআন পড়বে কিন্তু তা তাদের গলার নিচে যাবেনা। তারা কুরআনের উপর আমল কিম্বা কুরআন-প্রতিষ্ঠার একটু চেষ্টাও করবে না কখনো। এদলের আমল যতই তোমাদেরকে আকৃষ্ট করুক না কেন, কখনই তাদের দলে যাবেনা। কারণ প্রকৃতপক্ষে এরা হবে ইসলাম হতে খারিজ, দ্বীন হতে বহির্ভূত। তীর যেমন ধনুক হতে বের হয়ে যায় সে আর কখনও ধনুকের নিকট ফিরে আসেনা। তেমনিই এরা দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে, আর কখনও দ্বীনের পথে, কুরআন ও সুন্নাহ্র পথে ফিরে আসবেনা। আমার প্রশ্ন হল, উপরোক্ত হাদীছ ছহীহ্ কি-না? ছহীহ্ হলে এ দ্বারা উদ্দেশ্য কারা? উক্ত হাদীসের সাথে তাবলীগ জামাতের কোন সম্পর্ক আছে কি-না? অনেকে এই হাদীসের সাথে তাবলীগ জামাতকে জড়াতে চান। উক্ত হাদীসের সঙ্গে তাবলীগ জামাতকে জড়ানো সঠিক কি-না?

জবাবঃ প্রশ্নে বর্ণিত হাদীছ ছহীহ্। মুহাদ্দিছীনে কেরাম উক্ত হাদীছসহ এ জাতীয় হাদীছসমূহের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এ সব হাদীছ দ্বারা একটি নির্ধারিত জামাত বা খারিজী ফেরক্বা নামে পরিচিত তাদেরকে বুঝানো হয়েছে। হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর খেলাফত আমলে এই হাদীছসমূহের বাস্তবতা এবং খাওয়ারেজদের অবস্থার সমন্বয় ঘটেছিল। যার দ্বারা একথা সুস্পষ্টভাবে বলা চলে যে, এ হাদীছসমূহ দ্বারা একমাত্র খাওয়ারেজদেরকেই বুঝানো হয়েছে। সুনির্দিষ্ট কোন প্রমাণাদি ছাড়া অন্য কোন জামাতকে এই হাদীসের অন্তর্ভুক্ত করা যাবেনা। কোন প্রকার প্রমাণ ছাড়া তাবলীগ জামাতকে এই হাদীছসমূহের মেসদাক বা উদ্দেশ্য বানানো, তাদেরকে খাওয়ারেজ বলা শরীয়তের দৃষ্টিতে মারাত্মক অন্যায় ও অপরাধ। তাবলীগের নিয়মনীতি ও কার্যক্রম পুরোপুরি শরীয়তসম্মত। ইসলাম পরিপন্থী কোন কিছু এতে নেই। বর্তমান বিশ্বে আল্লাহ্ তা’আলা তাবলীগ জামাতের মাধ্যমে পথহারা, ঈমানহারা, হেদায়েত থেকে বঞ্চিত অসংখ্য মানুষকে হেদায়েত করেছেন, ঈমান আনার তাওফিক দান করেছেন। এছাড়া এ জামাতের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে অসংখ্য জগদ্বিখ্যাত আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদ। অতএব, তাবলীগ জামাতকে খারেজী জামাত বলা, মিথ্যা অপবাদ বৈ কিছুই নয়। (ফতহুল বারী ১২ঃ৩৫০, আল মিরকাত ৭ঃ১০৭) উক্ত অখ্যাত পত্রিকার উল্লিখিত “জিজ্ঞাসা-জবাবের” প্রেক্ষিতে আমার সুওয়াল বা জানার বিষয় হলো- (১) উল্লিখিত হাদীছ শরীফে বর্ণিত গুণাবলী প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে আছে কি? (২) উল্লিখিত হাদীছ শরীফ দ্বারা কি শুধু খারিজী ফিরক্বার লোকদেরকেই বুঝানো হয়েছে? নাকি খারিজীদের ন্যায় আক্বীদা পোষণকারীদের ক্ষেত্রেও এ হাদীছ শরীফ প্রযোজ্য? (৩) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে শরীয়ত বিরোধী বা ইসলাম পরিপন্থী কোন নিয়মনীতি বা আক্বীদা, আমল নেই, এটা কতটুকু সত্য? (৪) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগের পৃষ্ঠপোষকতায় বা পরিচালনায় যারা রয়েছে তারা সকলেই হক্কানী আলিম, এ দাবী কতটুকু সঠিক? আসলে হক্কানী আলিমের সংজ্ঞা বা পরিচিতি কি? (৫) কুরআন-সুন্নাহ্র কোথাও প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ করার নির্দেশ আছে কি? প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ করা কুরআন-সুন্নাহ্ মতে জায়িয কিনা? কুরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াবঃ   প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ  জামায়াত সম্পর্কিত উক্ত অখ্যাত পত্রিকার জবাব শুদ্ধ হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন হয়েছে।  শুধু তাই নয়, তারা প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের সাফাই গাইতে গিয়ে বর্ণিত হাদীছ শরীফের অপব্যাখ্যা করেছে। সাথে সাথে “ছয় উছূলীদের মধ্যে কুরআন-সুন্নাহ্ বিরোধী কোন আক্বীদা-আমল নেই” বলে তাদের নির্লজ্জ দালালী করে নিজেদেরকে অপব্যাখ্যাকারী ও মিথ্যাবাদীরূপে সাব্যস্ত করেছে। সুওয়ালে উল্লিখিত বিষয়গুলোর ধারাবাহিক দলীলভিত্তিক আলোচনা করলেই তা আরো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে। তাই নিম্নে সুওয়ালে বর্ণিত বিষয়গুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হলো-  (ধারাবাহিক) ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে প্রশ্নে  উল্লিখিত অখ্যাত পত্রিকার অপব্যাখ্যা ও মিথ্যাচারীতার খণ্ডনমূলক জবাব (৩)  প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে অখ্যাত পত্রিকার ‘জিজ্ঞাসার জবাবের’ প্রেক্ষিতে আপনার তৃতীয় সুওয়াল হলো- “(৩) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে শরীয়ত  বিরোধী বা ইসলাম পরিপন্থী কোন নিয়মনীতি বা আক্বীদা-আমল নেই, এটা কতটুকু সত্য?” আপনার উক্ত সুওয়ালের প্রেক্ষিতে বলতে হয় যে, অখ্যাত পত্রিকার উক্ত বক্তব্য মোটেও সত্য নয়, কেননা প্রচলিত ছয় উছূলীদের মধ্যে একটি দু’টি নয়, বরং অসংখ্য কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী নিয়মনীতি বা আক্বীদা-আমল ও বক্তব্য রয়েছে, যা তাদের মুরুব্বীদের লিখা কিতাবাদিতেই বিদ্যমান রয়েছে। তাই নিম্নে ধারাবাহিকভাবে, পর্যায়ক্রমে প্রচলিত ছয় উছূলীদের কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী ও কুফরীমূলক বক্তব্যগুলোর সাথে সাথে কুরআন-সুন্নাহ্র দৃষ্টিতে তার সঠিক ফায়সালা তুলে ধরা হলো-  প্রচলিত ছয় উছূলীদের কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কুফরীমূলক বক্তব্য- ৪ প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াছ ছাহেবের “মলফূযাতের” ৪৯ পৃষ্ঠার, ৭৪নং মলফূযে একথা উল্লেখ আছে যে, “শুধুমাত্র জিহ্বা দ্বারাই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, যা প্রচলিত তাবলীগ ওয়ালাদের মাঝেই বিদ্যমান।” তাদের উক্ত বক্তব্যের জবাবে বলতে হয় যে, মাওলানা ইলিয়াছ ছাহেবের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ শরীয়তের খিলাফ হয়েছে। কুরআন ও সুন্নাহ্ খিলাফ বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ওয়াজিব। এ প্রকার বক্তব্যের কারণে মানুষ নেক কাজে উৎসাহিত তো হবেইনা বরং নেক কাজ থেকে গাফিল হবে। এ প্রসঙ্গে কুরআন শরীফে আল্লাহ পাক ইরশাদ ফরমান,

ان الذين امنوا وعملوا الصلحت كانت لهم جنت الفردوس نزلا خلدين فيها لايبغون عنها حوالا.

অর্থঃ- “নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে ও আমলে ছলেহ্ বা নেক্ কাজ করেছে, তাঁদের জন্যে জান্নাতুল ফিরদাউসে মেহমানদারীর ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে তাঁরা চিরকাল থাকবে, তাঁরা সেখান থেকে কখনো বের হতে চাইবেনা।” (সূরা কাহফ্/১০৭, ১০৮) এই আয়াত শরীফ দ্বারাও বুঝা যায় যে, কেবল ঈমান আনলেই বা জিহ্বা দ্বারা ইসলামের বাণী উচ্চারণ করলেই চলবেনা। তার সাথে আমলে ছলেহ্ করতে হবে বা নেক কাজ করতে হবে, তাহলেই নাযাত পাওয়া যাবে।  আমাদের হানাফী মায্হাবঞ্জমুতাবিক মু’মিনে কামিল হওয়ার শর্ত হচ্ছে তিনটি- (১) তাছদীক্ব বিল জানান- অর্থাৎ অন্তরে বিশ্বাস স্থাপন করা। (২) ইক্বরার বিল লিসান- অর্থাৎ মুখে স্বীকার করা। (৩) আমল বিল আরকান- অর্থাৎ আমলে পরিণত করা। এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, কোন বিধর্মী যদি অন্তরে ইসলামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের পর মুখে স্বীকার করে, তবে সে মু’মিন-মুসলমান হবে। আমল না করা পর্যন্ত মু’মিনে ফাসিক থাকবে, যখন আমল করবে, তখন মু’মিনে কামিল হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, শুধু জিহ¡ার দ্বারাই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে সেটা আমলে বাস্তবায়ন না করবে। শাফিয়ী মায্হাবে ঈমানদার হওয়ার জন্য আমল শর্ত। অর্থাৎ শুধু জবানে স্বীকার করলেই ঈমানদার হওয়া যাবেনা। (শরহে আক্বায়িদে নছফী, তাকমীলুল ঈমান, ফিক্বহে আকবর ইত্যাদি) অপরদিকে আমল না করে অপরকে বলার বা জিহ¡ার ব্যবহারের মধ্যে কোনই ফায়দা নেই, বরং তা বিপদের কারণ।  কুরআন শরীফের সূরা ছফ-এর ৩নং আয়াত শরীফে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,

 يايها الذين امنوا لم تقولون ما لاتفعلون كبر مقتا عند الله ان تقولوا ما لاتفعلون.

অর্থঃ- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা করনা, তা কেন বল? তোমরা যা করনা, তা বলা আল্লাহ পাক-এর কাছে খুবই অসন্তোষজনক।” (সূরা ছফ/২,৩) সূরা বাক্বারা-এর ৪৪ নং আয়াত শরীফে আল্লাহ্ পাক বলেন,

اتامرون الناس بالبر وتنسون انفسكم وانتم تتلون الكتب افلا تعقلون.

অর্থঃ-   “তোমরা কি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ কর আর নিজেদের ব্যাপারে ভুলে যাও?” অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত করে থাক। তবে কি তোমরা চিন্তা করোনা, বুঝনা?” (সূরা বাক্বারা/৪৪) উপরোক্ত আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় হাদীছ শরীফে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আমি মি’রাজের রাতে এরূপ কিছু লোককে দেখেছিলাম, যাদের ঠোঁটগুলো আগুনের কেঁচি দ্বারা কাটা হচ্ছিল। আমি বললাম, হে ভাই জীব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম! এই লোকগুলো কারা?” তিনি বললেন, “এরা আপনার উম্মতের আলিম শ্রেণী, যারা লোককে নেক আমলের হুকুম করতো এবং নিজেরা তা ভুলে থাকত।” (ছিহাহ্ সিত্তাহ্ ও সমূহ সীরাতের কিতাব) হাদীছ শরীফে এসেছে, “আখিরী যামানায় এমন অনেক লোক বের হবে, যাদের কথাগুলো হবে নবীদের মত, আমলগুলো হবে ফিরাউনের মত এবং অন্তরটা হবে নেকড়ে বাঘের মত।” হাদীছ শরীফে আরো রয়েছে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে জিহ¡া ও লজ্জাস্থানের জিম্মাদার হবে, আমি তার বেহেশ্তের জিম্মাদার হব।” (বুখারী, ফতহুল বারী, উমদাতুল ক্বারী, ইরশাদুস্ সারী) উপরোক্ত আয়াত শরীফ ও হাদীছ শরীফ দ্বারা বুঝা যায় যে, কেবল মুখে মুখে ইসলামের কথা বললে বা প্রচলিত তাবলীগের দাওয়াত দিলে কোনরূপ শ্রেষ্ঠত্বই অর্জন করা যাবে না বরং তা আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অসন্তুষ্টির কারণ হবে। যদি যা বলা হয়, সে অনুযায়ী আমল না থাকে এবং সে আমলগুলো ইখ্লাছের সাথে করা না হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা সূরা নিসা-এর ১১৪নং আয়াত উল্লেখ করে বলে,

لاخير فى كثير من نجوهم الا من امر رصدقة او معروف او اصلاح بين الناس.

অর্থঃ- “যারা পরামর্শ দেয় দান খয়রাত করতে অথবা সৎকাজ করতে অথবা মানুষের মধ্যে সন্ধি স্থাপন বা মীমাংসা করতে, তা উত্তম।” উপরোক্ত আয়াত শরীফ, আয়াত শরীফের অংশবিশেষ তার বাকী অংশে বলা হয়েছে,

ومن يفعل ذالك ابتغاء مرضات الله فسوف نؤتيه اجرا عظيما.

অর্থঃ- “যে এই কাজ আল্লাহ্ পাক-এর সন্তুষ্টির জন্য করবে, আমি অতি শীঘ্রই তাকে বিরাট ছওয়াব দান করবো।” (সূরা নিসা/১১৪) অর্থাৎ নেক্ কাজ করা বা বলার মধ্যে ফযীলত নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা আল্লাহ্ পাক-এর রেযামন্দী হাছিলের উদ্দেশ্যে, ইখ্লাছের সহিত আমল না করবে।  আরো উল্লেখ্য, এ ধরণের নেক্ কাজ যে কেবল প্রচলিত তাবলীগ ওয়ালাদের মাঝেই বিদ্যমান তা সম্পূর্ণই ভুল কথা। সত্যিকার অর্থে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বহু পূর্ব থেকেই সেগুলো যেমন অন্যান্যদের মাঝে বিশেষ করে, আহ্লে তাসাউফদের মাঝে অধিক মাত্রায় বিদ্যমান ছিল, তার ধারাবাহিকতা এখনো তেমনি বিদ্যমান আছে। অপরদিকে ক্ষেত্র বিশেষে জিহ¡ার চেয়ে বা মৌখিক কথার চেয়ে, লিখনীর মর্যাদা অধিক। যার জন্য হাদীছ শরীফে এসেছে, “আলিমের কলমের কালি, শহীদের রক্তের চেয়ে পবিত্র।” আরো হাদীছ শরীফে আছে, ক্বিয়ামতের দিন আলিমদের কালি শহীদগণের রক্তের বিনিময়ে ওজন করা হবে। (আব্দুল বার, ইহ্ইয়াউ উলুমিদ্দীন) অতএব, প্রমাণিত হলো যে, শুধুমাত্র জিহ¡ার দ্বারাই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নয় বরং সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারাই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। আর এ শ্রেষ্ঠত্ব শুধু আহ্লে তাছাউফ বা তরীক্বত পন্থীগণের মধ্যেই অধিক মাত্রায় বিদ্যমান।

সুতরাং ছয় উছূলী তাবলীগ ওয়ালারা বলেছে, “শুধুমাত্র জিহ¡ার দ্বারাই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, যা প্রচলিত তাবলীগ ওয়ালাদের মাঝেই বিদ্যমান।” তাদের এ বক্তব্য সম্পূর্ণ মনগড়া, বিভ্রান্তিকর, আপত্তিকর, কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী ও কুফরীমূলক হয়েছে। এরূপ বক্তব্য থেকে বিরত থাকা সকলের জন্যেই ফরয/ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত। (চলবে)

মুহম্মদ রায়হানুজ্জামান ‘মীম’ রাঙ্গুনীয়া, চট্টগ্রাম।

সুওয়ালঃ চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত রেযাখানী মাযহাবের মুখপত্র মার্চ-এপ্রিল/ ২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে “ধুমপান করা” সম্পর্কে নিম্নোক্ত প্রশ্নোত্তর ছাপা হয়- প্রশ্নঃ আমরা জানি ধূমপান করা মাকরূহ। তবে ধূমপান করলে স্বাস্থ্যের ক্ষতিও হয় এবং সমাজের ক্ষতি হয়। সুতরাং এটা বর্জন করা উচিত। এখন আমার জিজ্ঞাসা ধূমপান তথা বিড়ি-সিগেরেট  বিক্রয় করা জায়িয নাকি নাজায়িয? বিস্তারিত আলোচনার অনুরোধ রইল। উত্তরঃ ধূমপান হারাম বা মাকরূহ হওয়ার পেছনে শরীয়তের কোন সুস্পষ্ট দলীল নেই। শরীয়তের সুস্পষ্ট কোন দলীল-প্রমাণ ছাড়া কোন কিছুকে হারাম বা মাকরূহ বলা নিজে শরীয়ত প্রবক্তা হওয়ার নামান্তর; যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। যা জায়েয বা নাজায়েয হওয়ার ব্যাপারে শরীয়ত কোন কিছু বলেনি তা হলো মুবাহ্। সুতরাং ধুমপান মুবাহ্ বা বৈধ। তাই বিড়ি-সিগেরেট বিক্রি করাও বৈধ। যদিও ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই বলে শরীয়তের কোন প্রমাণ ছাড়া ধূমপানকে মাকরূহ বা হারাম বলা যাবে না। অবশ্যই ধূমপানের দ্বারা যদি স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় ও বিভিন্ন জটিল রোগের সৃষ্টি হয় তবে তা পরিহার করাই একজন মুসলমানের জন্য উত্তম ও শ্রেয়। এখন আমার সুওয়াল হলো ধুমপান করা সম্পর্কে রেযাখানী মুখপত্রের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়েছে কি? দলীল আদিল্লাহসহ সঠিক জাওয়াব জানিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াবঃ  ধুমপান করা  সম্পর্কে রেযাখানী  মুখপত্রের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং ভুল ও অশুদ্ধ হয়েছে। যা সম্পূর্ণই মনগড়া, বিভ্রান্তিকর ও দলীলবিহীন। আসলে শরীয়ত কাকে বলে এ জ্ঞানই তাদের নেই। কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের সমষ্টিই হচ্ছে শরীয়ত। উল্লিখিত চারটির যে কোন একটির মধ্যে থাকার অর্থই হলো শরীয়তের মধ্যে থাকা। ধুমপানের কথা কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলেও ইজমা-ক্বিয়াস তথা ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাবে সুস্পষ্টভাবে মাকরূহ তাহরীমীর কথা ঠিকই  উল্লেখ আছে। আর যেটা ফিক্বাহ্ ও ফতওয়ার কিতাবে ধুমপান মাকরূহ তাহরীমীর কথা উল্লেখ আছে সেটা শরীয়তের কোন সুস্পষ্ট দলীল নেই বলা শরীয়ত সম্পর্কে চরম জিহালতির পরিচয় নয় কি? কারণ ইজমা-ক্বিয়াস তথা ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাবে স্পষ্ট, ছহীহ্ ও গ্রহণযোগ্য ফতওয়া মুতাবিক ধুমপান যেখানে মাকরূহ্ তাহ্রীমী, কেউ কেউ হারামও বলেছেন। সেখানে মনগড়া ও দলীলবিহীন মত পেশ করে তারা যেমন নিজেদের গোমরাহী প্রকাশ করেছে, তেমনি সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার ব্যর্থ কোশেশও করেছে।  “ধুমপান করা মাকরূহ্ তাহরীমী” যা ইমামুল হিন্দ, শাহ ওয়ালী উল্লাহ্ মুহাদ্দিছ দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর “দূররে ছামীন” কিতাবে, সিরাজুল হিন্দ, শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর “ফতওয়ায়ে আযীযী” কিতাবে, হযরত আব্দুল হাই লখনভী ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর “ফতওয়ায়ে আব্দুল হাই” কিতাবে এবং শায়খ ইমাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর ‘হাদীয়াতুল ইমাদী’ কিতাবে উল্লেখ করেছেন। ফতওয়ায়ে আশরাফিয়া কিতাবে ধুমপান আযাবের কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া “মাজালিসুল আবরার, শারবুদ্দুখান, আদ্ দুররুল মুনতাক্বা” ইত্যাদি কিতাবেও ধুমপান করা হারাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

স্মর্তব্য, যে সমস্ত বিষয় শরয়ী দলীলের দ্বারা প্রমাণিত তা অস্বীকার করা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। কেননা এতে প্রকৃতপক্ষে শরীয়ত তথা ইসলামকেই অস্বীকার করা হয়। বিশেষ করে ধুমপানের মাসয়ালাটি ক্বিয়াসী মাসয়ালার অন্তর্ভুক্ত। যার বর্ণনা সরাসরি কুরআন শরীফ এবং হাদীছ শরীফে উল্লেখ নেই। তবে ইজমা-ক্বিয়াস তথা ফিক্বাহ ও ফওয়ার কিতাবে উল্লেখ আছে। কেননা ধুমপান তথা বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা ইত্যাদি যা তামাক দ্বারা তৈরী হয়। যার ব্যবহার আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, নূরে মুজাস্সাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যামানার অনেক পরে শুরু হয়েছে।  তামাকের  ইতিহাস আমেরিকার পাশে “কিউবা” নামক একটি দেশে তামাকের চাষ হতো। সেখান থেকে বাদশাহ্ জাহাঙ্গীরের শাসনামলে জনৈক রাষ্ট্রদূত ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম তামাক নিয়ে আসে। তখন থেকে এ উপমহাদেশে ধুমপানের সূত্রপাত ঘটে। তামাকের ইতিহাস সম্পর্কে ফিক্বাহ্র সর্বজনমান্য ও  বিখ্যাত কিতাব “দুররুল মুখতার” কিতাবে উল্লেখ আছে,

والتتن الذى حدث وكان حدوثه بد مشق فى سنة خمسة عشر بعد الألف.

অর্থঃ- তামাক যা (পরবর্তীতে) নতুনভাবে উৎপাদন হয়েছে। আর উক্ত তামাকের উৎপাদন হয়েছিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ১০১৫ হিজরী সালে। “গায়াতুল আওতার” কিতাবের ৪র্থ খণ্ডের ২৬৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, উর্দূ কম্পোজ করতে হবে  অর্থঃ তামাক নতুন উৎপাদন আর এর উৎপাদন হয়েছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ১০১৫ হিজরী সালে। তামাক সম্পর্কে সর্ব প্রথম ফতওয়া প্রদান করেন দ্বাদশ শতকের মুজাদ্দিদ হযরত শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ মুহাদ্দিছ দেহ্লভী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর ‘দুররে ছামীন’ কিতাবে। তাতে তিনি ধুমপান মাকরূহ তাহ্রীমী বলে ফতওয়া প্রদান করেন এবং তিনিই ধুমপানের সর্বপ্রথম ফতওয়া প্রদানকারী। তাঁর পরে ফতওয়া দেন তাঁর ছেলে হযরত শাহ্ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর “ফতওয়ায়ে আযীযী” কিতাবে। শায়খ ইমাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর ‘হাদীয়াতুল ইমাদী’ কিতাবে ধুমপান করাকে মাকরূহ তাহরীমী ফতওয়া  দেন। যা ছহীহ্ হাদীছ শরীফ থেকে ক্বিয়াস করে প্রদান করা হয়েছে এবং এটাই ছহীহ্ ও নির্ভরযোগ্য ফতওয়া। যার উপর উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণ একমত। হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

من اكل هذه الشجرة المنتنة فلا يقربن مسجدنا فان الملائكة تتأذى مما يتأذى منه الانس.

অর্থঃ- “যে ব্যক্তি এমন দুর্গন্ধযুক্ত বৃক্ষের (কাঁচা পিঁয়াজ বা রসূনের) কিছু খায়, সে যেন আমাদের মসজিদের নিকটেও না আসে। নিশ্চয়ই যে কারণে মানুষ কষ্ট পায় তা ফেরেশ্তাগণেরও কষ্টের কারণ। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত) হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত হয়েছে,

نهى عن هاتين الشجرتين يعنى البصل والثوم وقال من اكلهما فلا يقربن مسجدنا وقال ان كنتم لابد اكلهما فاميتوهما طبخا.

অর্থঃ- হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দু’টি বস্তু অর্থাৎ পিঁয়াজ ও রসূনঞ্জখেতে নিষেধ করেছেন।  এবং বলেছেন, “যে ব্যক্তি তা খায়, সে যেন আমাদের মসজিদের নিকটেও না আসে।” তিনি আরো বলেছেন, “তোমাদের যদি খেতেই হয়, তাহলে তা রান্না করে দুর্গন্ধ বিনষ্ট করে খাবে।” (আবূ দাউদ, মিশকাত) উল্লিখিত হাদীছ শরীফের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত মুহাদ্দিছ হযরত মাওলানা কুতুবুদ্দীন খান দেহ্লভী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “যে সকল দুর্গন্ধযুক্ত বস্তু দ্বারা মানুষের কষ্ট হয়, তা দ্বারা ফেরেশ্তাগণেরও কষ্ট হয়।” (মুযাহিরে হক্ব) সুতরাং কাঁচা পিঁয়াজ, কাঁচা রসূন, গাজর, মূলা এবং এ জাতীয় যে সমস্ত কাঁচা দ্রব্য খেলে মুখে দুর্গন্ধ হয়, সেটা খাওয়া মাকরূহ্ তান্যীহী এবং সেটা খেয়ে মসজিদে যাওয়া মাকরূহ্ তাহ্রীমী। এ মাসয়ালার উপর ক্বিয়াস করে ধুমপান করা মাকরূহ্ তাহ্রীমী এবং ধুমপান করে মসজিদে যাওয়া হারাম ফতওয়া প্রদান করা হয়েছে। কেননা কাঁচা পিঁয়াজ, কাঁচা রসুন খাওয়া অপেক্ষা ধুমপানে মুখ অনেক বেশী দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে থাকে। নিম্নে ধুমপান মাকরূহ তাহরীমী সম্পর্কে সর্বজনমান্য ও বিশ্বখ্যাত ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাব থেকে শরীয়তের সুস্পষ্ট দলীল-আদিল্লাহ পেশ করা হলো। যেমন, সর্বজনমান্য ও বিশ্বখ্যাত ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাব “দুররুল মুখতার” কিতাবে উল্লেখ আছে,

 وقد كرهه شيخنا العمادى فى هديته الحاقا له بالثوم والبصل.

অর্থঃ- আমাদের শায়খ হযরত ইমাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর “হাদিয়া কিতাবে” রসূন ও পিঁয়াজের সাথে ক্বিয়াস করে তামাক (ও তামাক দ্বারা প্রস্তুতকৃত বিড়ি সিগারেটের ধুমপান ইত্যাদি) মাকরূহ তাহ্রীমী বলেছেন। “গায়াতুল আওতার” কিতাবের ৪র্থ খণ্ডের ২৬৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, উর্দূ কম্পোজ করতে হবে  অর্থঃ আমাদের উস্তায হযরত ইমাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর ‘হাদীয়াতুল ইমাদী’ কিতাবে তামাককে রসূন পিঁয়াজের সাথে ক্বিয়াস করে তামাককে মাকরূহ তাহরীমী বলেছেন। ধুমপান প্রসঙ্গে “ফতওয়ায়ে আযীযী” কিতাবের ৫৯৬, ৫৯৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,  উর্দূ কম্পোজ করতে হবে  অর্থঃ- “হুক্কা পান করা হালাল কি হারাম এ ব্যাপারে ইখ্তিলাফ বা মতবিরোধ রয়েছে, তবেঞ্জঅধিক বিশুদ্ধ মত এই যে, হুক্কা পান করা মাকরূহ তাহ্রীমী।” “ফতওয়ায়ে আব্দুল হাই লখনভী” কিতাবের ৫০৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,  উর্দূ কম্পোজ করতে হবে অর্থঃ- “সিগারেট পান করা হুক্কা পান করার মতই মাকরূহ্ তাহরীমী।” “ফতওয়ায়ে শামী” কিতাবের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৪৬০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

ظاهر كلام العمادى انه مكروه تحريما.

অর্থঃ- সুস্পষ্ট বর্ণনা মতে ধুমপান করা মাকরূহ তাহরীমী। “ফতওয়ায়ে শামী” কিতাবের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৪৫৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, وبعضهم قال بحرمته. অর্থঃ- “কেউ কেউ ধুমপান করা হারাম বলেছেন।” “ফতওয়ায়ে শামী” কিতাবের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৪৫৯ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে,

وقد أفتى بالمنع من شربه.

অর্থঃ- আমাদের মাশায়িখে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ ফতওয়া দিয়েছেন যে, ধুমপান করা নিষিদ্ধ। এছাড়াও ধুমপান মাকরূহ্ তাহ্রীমী হওয়ার ব্যাপারে নিম্নোক্ত কারণসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে- (১) বিড়ি, সিগারেটে ‘নিকোটিন’ রয়েছে। যেটা পান করা বিষ পানের নামান্তর। (২) চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। (৩) ধুমপানে আর্থিক অপচয় হয়। কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

ان المبذرين كانوا اخوان الشيطين.

অর্থঃ- “নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (সূরা বণী ইস্রাঈল/২৭) (৪) ধুমপানে আগুনের ধোঁয়া মুখের ভিতর প্রবেশ করানো হয়, যা জাহান্নামীদের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায়।  (৫) ধুমপান বিধর্মীদের প্রচলিত অভ্যাস। ধুমপানে তাদের তাশাব্বুহ হয়। হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে,

من تشبه بقوم فهو منهم.

অর্থঃ- “যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখবে, তাদের সাথেই তার হাশর-নশর হবে।” (৬) ধুমপানে মানুষ ও ফেরেশ্তাদের কষ্ট হয়। হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে,

ايذاء المسلم كفر.

অর্থঃ- “মুসলমানদেরকে কষ্ট দেয়া কুফরী।” (৭) ধুমপানে নেশার সৃষ্টি হয়। হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে, كل مسكر حرام অর্থঃ- “সমস্ত নেশাজাতীয় দ্রব্যই হারাম।” এছাড়াও আরো শতসহস্র কারণ রয়েছে।  কাজেই যারা ধুমপান মুবাহ্ ফতওয়া দিয়েছে, তাদের ফতওয়া মোটেও গ্রহণয্যো নয়।  কারণ কাঁচা পিঁয়াজ, কাঁচা রসুন বা এ জাতীয় সাধারণ গন্ধযুক্ত খাদ্যদ্রব্য খাওয়া যেখানে মাকরূহ্ তান্যীহী, সেখানে ধুমপান তথা বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা ইত্যাদি মারাত্মক দুর্গন্ধযুক্ত দ্রব্য কি করে মুবাহ্ হতে পারে? সুতরাং ধুমপান সম্পর্কে শরীয়তের মূল ফতওয়া হচ্ছে- মাকরূহ্ তাহ্রীমী। কেউ কেউ হারাম ফতওয়াও দিয়েছেন।   অথচ এই ফতওয়ার বিপরীতে নিজেদের বদ্ নেশা ও মতকে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা ধুমপান মুবাহ্ বা বৈধ বলে উল্লেখ করেছে।

 আফসুস! ধুমপায়ী, হুক্কাখোর রেযাখানী মৌলভীদের জন্য। ফিক্বাহ্র এ উছূল বুঝতে তারা ব্যর্থ। এখানে শুধু কুরআন-হাদীছই নয় বরং কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস- এ সবের ভিত্তিতে কোন বিষয় হালাল, হারাম ও মাকরূহ স্পষ্ট হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চুপ হলে তা মুবাহ্র অন্তর্ভুক্ত হবে।

 কিন্তু ধুমপানের ব্যাপারে শরীয়ত নিশ্চুপ নয়। বরং কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ-এর ভিত্তিতে ক্বিয়াস করে ধুমপান মাকরূহ্ তাহরীমী, কেউ কেউ হারাম ফতওয়া দিয়েছেন। তাহলে সেটা মুবাহ্ বা বৈধ হয় কি করে? অতএব, উপরোক্ত শরীয়তের সুস্পষ্ট দলীল-আদীল্লাহ্র ভিত্তিতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, ধুমপান করা মাকরূহ তাহরীমী বা নিষিদ্ধ। সুতরাং ধুমপান করা যেমন মাকরূহ তাহরীমী বা নিষিদ্ধ অনুরূপ ধুমপান তথা বিড়ি-সিগারেট বিক্রয় করাও মাকরূহ তাহরীমী বা নিষিদ্ধ। যেমন, “ফতওয়ায়ে শামী” কিতাবের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৪৫৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

ويمنع من بيع الدخان وشربه.

অর্থঃ- ধুমপানের ক্রয় বিক্রয় উভয়ই নিষিদ্ধ। অতএব, ধুমপান সম্পর্কে রেযাখানী মুখপত্রের উক্ত উত্তর সম্পূর্ণরূপে শরীয়তের খিলাফ বা ভুল ও দলীলবিহীন বলে প্রমাণিত হলো। বিঃদ্রঃ ধুমপান করা মাকরূহ তাহরীমী বা নিষিদ্ধ। কেউ কেউ হারাম ফতওয়াও দিয়েছেন। এ সম্পর্কে জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ২২, ৩২, ৬৩তম সংখ্যা এবং বিশেষ করে ৮৬ ও ৮৮তম সংখ্যা পাঠ করুন সেখানে ধুমপান করা সম্পর্কে রেযাখানী মুখপত্রের ভুল বক্তব্য খণ্ডন করে সঠিক জাওয়াব  দেয়া হয়েছে। এবার তৃতীয়বারের মতো ধুমপান করা সম্পর্কে রেযাখানী মুখপত্রের ভুল বক্তব্য খণ্ডন করে  সঠিক জাওয়াব দেয়া হলো। {দলীলসমূহঃ (১) দুররে ছামীন, (২) ফতওয়ায়ে আযীযিয়া, (৩) ফতওয়ায়ে আব্দুল হাই লখনভী, (৪) ফতওয়ায়ে আমীনিয়া, (৫) ফতওয়ায়ে আশরাফিয়া, (৬) ইমদাদুল ফতওয়া, (৭) নেহায়া, (৮) আইনী, (৯) দুররুল মুখতার,(১০) আল আশবাহ্ ওয়ান্ নাজায়ির, (১১) ফতওয়ায়ে আলমগীরী, (১২) আল হালালু ওয়াল হারামু ফিল ইসলাম, (১৩) কিফায়াতুল মুফতী, (১৪) ফতওয়ায়ে হাম্মাদিয়া, (১৫) গায়াতুল আওতার, (১৬) শরহে ওহ্বানিয়া, (১৭) ক্বওলুস্ সাবিত, (১৮) তিবইয়ান, (১৯) তাফসীরে রুহুল মা’য়ানী, (২০) শরহে মাওয়াহিবুর রহ্মান,  (২১) বুখারী শরীফ, (২২) মুসলিম শরীফ, (২৩) মিশকাত শরীফ, (২৪) মুজাহিরে হক্ব, (২৫) দাইলামী শরীফ, (২৬) মাজালিসুল আবরার, (২৭) সুয়ালাতে আসরার, (২৮) হাদিয়া তরীক্বায়ে মুহাম্মদিয়া উছীলায়ে আহ্মদিয়া, (২৯) নাছীহাতু ইবাদিল্লাহ্ ওয়া উম্মতে রসূলিল্লাহ্, (৩০) তারবীহুল জানান বা তাশরীহে শারাবিদ্ দুখান,(৩১) আছ্ছূল্হু বাইনাল ইখওয়ানি ফী ইবাহাতে শারবিদ দুখান, (৩২) তুহ্ফাতুল ইখওয়ান ফী শারবিদ্ দুখান, (৩৩) তুহ্ফাতুল মাক্বাসিদে ওর্য়া রাসায়িল, (৩৪) ইমামুল ইখওয়ান ফী তাহ্রীমিদ্ দুখান, (৩৫) আল বুরহান ফী তাহ্রীমিদ্ দুখান (৩৬) হাদীয়াতুল ইমাদী, (৩৭) হাশিয়াতুত্ তাহতাবী আলাদ্ দুররিল মুখতার, (৩৮) শরহে দুরার (৩৯) আদ্ দুররুল মুনতাক্বা ইত্যাদি।}

মুসাম্মৎ রতনা বেগম শরীফ সুন্দর, পীরগাছা, রংপুর।

সুওয়ালঃ জনৈক মুসলমান ব্যক্তি এক হিন্দু পীরের অনুসারী। ঐ ব্যক্তির পীর প্রায় ত্রিশ-পয়ঁত্রিশ বছর পূর্বে মারা যায়। ঐ ব্যক্তি এখনও বিবাহ করেনি। তাকে বিবাহ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে সে বলে থাকে, তার পীরের ইজাযত পায়নি তাই সে বিবাহ করবে না। ঐ ব্যক্তি নিজেকেও পীর/দয়াল বলে দাবী করে থাকে। তার মধ্যে সুন্নতের কোন পাবন্দি নেই। তার দাড়ি নেই। সেই কোর্তা পরিধান করেনা। কিন্তু মাঝে মধ্যে টুপি পরিধান করে থাকে। সে ঠিক মত নামায, রোযা আদায় করে না। পর্দা নেই। তার ভক্তদের মধ্যে নারী-পুরুষ আছে। সে টেলিভিশন দেখে থাকে, তার পীরের ছবিকে সামনে রেখে নামায আদায় করে থাকে। সে নিজে ও তার ভক্তরা ছবিকে সামনে রেখে ধ্যান-মগ্ন হয়। ঐ ব্যক্তি তার ভক্তদের নিয়ে বাৎসরিক একটা অনুষ্ঠান করে থাকে। উল্লিখিত সুওয়ালের বিবরণে যে সকল প্রশ্নের উদয় হয় তা হলো-  (১) হিন্দু পীরের অনুসরণ করা। (২) হিন্দু পীরের ইজাযত না পাওয়ার কারণে বিবাহ হতে বিরত থাকা। (৩) নিজেকে পীর বা দয়াল বলে দাবী করা। (৪) সুন্নতের  পাবন্দি না করা। (৫) নামায রোযা আদায় না করা। (৬) পর্দা না করা। (৭) টিভি দেখা ও ছবিকে সামনে রেখে ধ্যানমগ্ন হওয়া। এখন আমার সুওয়াল হচ্ছে- উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে শরীয়তের ফায়সালা কি? এবং তার থেকে মসজিদের জন্য জমি নেয়া জায়িয হবে কিনা? মৃত্যুর পর তার জানাযায় শরীক হওয়া যাবে কিনা? তার সঙ্গে সামাজিক কোন কাজে উঠা-বসা করা যাবে কিনা? তার কোন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা যাবে কিনা? কুরআন-সুন্নাহ্র দলীলসহ জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।

জাওয়াবঃ আল্লাহ্ পাক কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন,

لقد كان لكم فى رسول الله اسوة حسنة.

অর্থঃ- “অবশ্যই তোমাদের জন্য আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।” (সূরা আহযাব/২১) অর্থাৎ মুসলমানকে মাথার তালু থেকে পায়ের তলা, হায়াত থেকে মউত পর্যন্ত আক্বাইদ-ইবাদত, মুয়ামালাত-মুয়াশারাত ইত্যাদি প্রতিক্ষেত্রেই একমাত্র আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ-অনুকরণ করতে হবে। কাজেই কোন মুসলমানের জন্য কোন বিধর্মীকে অনুসরণ ও অনুকরণ করা, তার কথা-কাজের উপর ইস্তিকামত  থাকা, তাকে অনুসরণ করে আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদেশ-নির্দেশের খিলাফ চলা, ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত তরক করা, হারাম-নাজায়িয আমল করা, বেপর্দা হওয়া, ছবি তোলা, টিভি দেখা ইত্যাদি সম্পূর্ণ নাজায়িয, হারাম ও কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। সুওয়ালে উল্লিখিত প্রত্যেকটি প্রশ্নেরই জাওয়াব ধারাবাহিকভাবে মাসিক আল বাইয়্যিনাতে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ। (১) হিন্দু পীরের অনুসরণ করা। কোন ঈমানদারের জন্যই কোন বিধর্মী সে যতকিছুই দাবী করুক না কেন যেমন, পীর, উস্তাদ, গুরু ইত্যাদি তার অনুসারী হওয়া বা তাকে অনুসরণ-অনুকরণ করা জায়িয নেই। বরং সম্পূর্ণরূপে হারাম ও কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।  কারণ এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,

ومن يبعغ غير الاسلام دينا فلن يقبل منه وهو فى الاخرة من الخسرين.

অর্থঃ- “যে ব্যক্তি দ্বীন ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন ধর্ম (বিধর্মী ও বিজাতীয়দের নিয়ম-নীতি ও তর্জ-তরীক্বা) তলব বা অনুসরণ ও অনুকরণ করে, তার থেকে তা কখনই গ্রহণ করা হবেনা এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা আলে ইমরান/৮৫) যার ব্যাখ্যায় হাদীছ শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে,

عن جابر رضى الله تعالى عنه عن النبى صلى الله عليه وسلم حين اتاه عمر رضى الله تعالى عنه فقال انا نسمع احاديث من يهود تعجبنا افترى ان نكتب بعضها فقال امتهوكون انتم كما تهوكت اليهود والنصارى لقد جئتكم بها بيضاء نقية ولو كان موسى حيا ما وسعه الا اتباعى.

অর্থঃ- “হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেন যে, একদিন হযরত উমর ইবনে খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এসে বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ্ (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমরা ইহুদীদের থেকে তাদের কিছু ধর্মীয় কথা শুনে থাকি, যাতে আমরা আশ্চর্যবোধ করি, এর কিছু আমরা লিখে রাখবো কি? হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরাও কি দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছ? যে রকম ইহুদী-নাছারারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে? অবশ্যই আমি তোমাদের নিকট পরিপূর্ণ, উজ্জ্বল ও পরিস্কার দ্বীন নিয়ে এসেছি। হযরত মুসা আলাহিস্ সালামও যদি দুনিয়ায় থাকতেন, তাহলে তাঁকেও আমার অনুসরণ করতে হতো।” (মুসনাদে আহ্মদ, বাইহাক্বী, মিশকাত) উল্লেখ্য, এ নিষেধ শুধু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই করা হয়নি বরং প্রতি ক্ষেত্রেই করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,

يايها النبى اتق الله ولاتطع الكفرين والمنفقين ان الله كان عليما حكيما واتبع ما يوحى اليك من ربك ان الله كان بما تعملون خبيرا.

অর্থঃ- “হে নবী! (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্ পাককে ভয় করুন। আর কাফিরদের ও মুনাফিকদের অনুসরণ করবেননা। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়। আর আপনার রবের তরফ হতে যা আপনার প্রতি ওহীরূপে প্রেরীত হয় তার অনুসরণ করুন। (হে মানুষেরা) নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক তোমাদের আমল সম্পর্কে পূর্ণ খবর রাখেন।” (সূরা আহযাব/১, ২) এর ব্যাখ্যায় হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

عن عمرو بن شعيب رضى الله تعالى عنه عن ابيه عن جده ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ليس منا من تشبه بغيرنا لاتشبهوا اليهود ولا بالنصارى.

অর্থঃ- “হযরত আমর বিন শুয়াইব রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর পিতা ও দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই রসূলুল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের ব্যতীত অন্য সম্প্রদায়ের সাথে (আক্বীদা-আমলে) তাশাব্বুহ্ বা মিল রাখে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। অতএব, তোমরা ইহুদী ও নাছারাদের সাথে সাদৃশ্য রেখনা।” (তিরমিযী, মিশকাত) আল্লাহ্ পাক আরো ইরশাদ করেন,

قل ان هدى الله هو الهدى ولئن اتبعت اهواءهم بعد الذى جاءك من العلم مالك من الله من ولى ولا نصير.

অর্থঃ- “বলুন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক-এর হিদায়াতই প্রকৃত হিদায়াত। আপনার নিকট ইল্ম (ইসলাম) আসার পর যদি তাদের নফ্সের (মতবাদের) অনুসরণ করেন তাহলে আপনি আল্লাহ্ পাক-এর তরফ থেকে ওলী (অভিভাবক) এবং সাহায্যকারী পাবেন না।” (সূরা বাক্বারা/১২০) কাজেই কেউ যদি ইসলাম ব্যতীত অর্থাৎ কুরআন-সুন্নাহ্ ব্যতীত বিধর্মী বা বিজাতীয়দের অনুসরণ ও অনুকরণ করে তবে তাদের যে কঠোর পরিণতি হবে সে সম্পর্কে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

عن عبد الله بن عمر رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من تشبه بقوم فهو منهم.

অর্থঃ- “হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে, সে তাদের দলভুক্ত এবং তার হাশর-নশর তাদের সাথেই হবে।” (মুসনাদে আহমদ, সুনানে আবূ দাউদ)  এ হাদীছ শরীফের ব্যাখ্যায় নিম্নলিখিত ঘটনাটি বর্ণিত রয়েছে। হিন্দুস্থানে একজন জবরদস্ত আল্লাহ্ পাক-এর ওলী ছিলেন। যিনি ইন্তিকালের পর অন্য একজন বুযূর্গ ব্যক্তি তাকে স্বপে¦ দেখে জিজ্ঞেস করেন, “হে আল্লাহ্ পাক-এর ওলী! আপনি কেমন আছেন?” তখন সেই আল্লাহ্ পাক-এর ওলী জাওয়াবে বলেন, “আপাততঃ আমি ভালই আছি, কিন্তু আমার উপর দিয়ে এক কঠিন সময় অতিবাহিত হয়েছে যা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার ইন্তিকালের পর আমাকে ফেরেশ্তারা সরাসরি আল্লাহ্ পাক-এর সম্মুখে পেশ করেন। আল্লাহ্ পাক তখন ফেরেশতাদেরকে বলেন, “হে ফেরেশ্তাগণ! তোমরা তাকে কেন এখানে এনেছ?” ফেরেশ্তাগণ বলেন, “আয় আল্লাহ্ পাক! আমরা তাকে খাছ বান্দা হিসেবে আপনার সাথে সাক্ষাৎ করানোর জন্য নিয়ে এসেছি।” এটা শ্রবণ করে আল্লাহ্ পাক বললেন, “তাকে এখান থেকে নিয়ে যাও, তার হাশর-নশর হিন্দুদের সাথে হবে। কেননা সে পূজা করেছে।” আল্লাহ্ পাক-এর ওলী বলেন, এটা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম এবং ভয়ে আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল। তখন আমি আল্লাহ্ পাক-এর নিকট আরজু পেশ করলাম, “আয় আল্লাহ্ পাক! আমার হাশর-নশর হিন্দুদের সাথে হবে কেন? আমি তো সব সময় আপনার এবং আপনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ফরমাবরদার ছিলাম। কখনও ইচ্ছাকৃত নাফরমানি করিনি আর পূজা করার তো প্রশ্নই উঠেনা। কারণ আমি কখনও মন্দিরের আশ-পাশ দিয়েও হাঁটিনি।” তখন আল্লাহ্ পাক বললেন, “তুমি পূজা করেছ। তুমি সেই দিনের কথা স্মরণ কর, যেদিন হিন্দুস্থানে হোলি পূজা হচ্ছিল। তোমার সামনে-পিছনে, ডানে-বামে, উপরে-নীচে সমস্ত গাছ-পালা, তরু-লতা, পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ সবকিছুকে রং দেয়া হয়েছিল। এমতাবস্থায় তোমার সামনে দিয়ে একটি গর্দভ যাচ্ছিল যাকে রং দেয়া হয়নি। তখন তুমি পান চিবাচ্ছিলে বা পান খাচ্ছিলে। তুমি সেই গর্দভের গায়ে এক চিপ্টি পানের রঙীন রস নিক্ষেপ করে বলেছিলে, “হে গর্দভ! আজ হোলী পূজার দিন। তোমাকে তো কেউ রং দেয়নি তাই আমি তোমাকে রং দিয়ে দিলাম। এটা কি তোমার পূজা করা হয়নি? তুমি কি জান না, আমার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

من تشبه بقوم فهو منهم.

অর্থঃ- “যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত এবং তার হাশর-নশর তাদের সাথে হবে। সুতরাং এখন তোমার হাশর-নশর হিন্দুদের সাথে হওয়া উচিৎ।” যখন আল্লাহ্ পাক এ কথা বললেন, তখন আমি লা-জাওয়াব হয়ে গেলাম এবং ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে, কাকুতি-মিনতি করে, রোনাজারী করে বললাম, “আয় আল্লাহ্ পাক! আমি এটা বুঝতে পারিনি আর আমাকে কেউ এটা বুঝিয়েও দেয়নি। তাছাড়া আমার অন্তরও সাড়া দেয়নি। কাজেই আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিন।” কিছুক্ষণ পর আল্লাহ্ পাক বললেন, “ঠিক আছে, তোমাকে অন্যান্য আমলের কারণে ক্ষমা করা হলো।”  আল্লাহ্ পাক-এর ওলী তখন স্বপ্নদ্রষ্টাকে বললেন, “তোমরা এ ধরণের মুশাবা থেকে সাবধান থেকো অন্যথায় নাজাত পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হবে।” আল্লাহ্ পাক সূরা ফাতিহার আয়াত শরীফেও সেটা উল্লেখ করেছেন, তোমরা এ দোয়াও করবে,

غير المغضوب عليهم ولا الضالين.

অর্থঃ- “আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে তাদের পথ দিবেন না, যারা গযবপ্রাপ্ত ও পথহারা, (ইহুদী-নাছারা)।” (সূরা ফাতিহা/৭) অর্থাৎ কোন বিধর্মীকে যেন আমরা অনুসরণ ও অনুকরণ না করি শুধু তাই নয় এমনকি কোন মুসলমান নামধারী বিদয়াতী ও বদ্ মাযহাব সম্পন্ন, বদদ্বীনকেও যেন অনুসরণ ও অনুকরণ না করি সেই তাওফীক দান করুন। অর্থাৎ কোন অবস্থাতেই কোন মুসলমানের জন্য কোন বিধর্মীকে অনুসরণ ও অনুকরণ করা জায়িয নেই। বরং তা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। যদি কেউ কোন বিধর্মীকে অক্বীদা, আমল উভয় ক্ষেত্রে অনুসরণ ও অনুকরণ করে তাহলে সে কাট্টা কাফির হবে। আর যদি কোন মুসলমান আক্বীদা বিশুদ্ধ রেখে কোন  বিধর্মীকে শুধুমাত্র অনুসরণ ও অনুকরণ করে তাহলেও সে চরম ফাসিক ও গোমরাহ্র অন্তর্ভুক্ত হবে। তাকেও কোন মুসলমানের জন্য অনুসরণ ও অনুকরণ করা জায়িয নেই। এর উদাহরণ  স্বরূপ বলা যেতে পারে যেমন, বর্তমানে যারা আলিম-উলামা, পীর-মাশায়িখ,  শায়খুল হাদীছ, মুফাস্সিরে কুরআন, মুফতী, খতীব নাম দিয়ে ইহুদী-নাছারাদের অনুসরণ করে ইসলামের নামে গণতন্ত্র, ভোট ও নির্বাচন করে থাকে, ব্লাসফেমী আইন তলব করে থাকে,  মৌলবাদী দাবি করে থাকে, নাস্তিক মাওসেতুং-এর অনুসরণ করে লংমার্চ  করে থাকে, হিন্দু গান্ধীকে অনুসরণ করে হরতাল করে থাকে, বিধর্মীকে অনুরসণ করে বেপর্দা হয়ে থাকে, ছবি তুলে থাকে ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গকে মুসলমান হওয়া সত্বেও কোন অবস্থাতেই অনুসরণ ও অনুকরণ  করা জায়িয নেই। {দলীলসমূহঃ (১) আহকামুল কুরআন, (২) কুরতুবী, (৩) মাযহারী, (৪) খাযিন, (৫) বাগবী, (৬) ইবনে  কাছীর, (৭) তাবারী, (৮) রুহুল মায়ানী, (৯) রুহুল বয়ান, (১০) কবীর, (১১) দূররে মানছুর, (১২) বুখারী, (১৩) মুসলিম, (১৪) আবূ দাউদ, (১৫) তিরমিযী, (১৬) মুসনাদে আহ্মদ, (১৭) বাইহাক্বী, (১৮) মিশকাত, (১৯) ফতহুল বারী, (২০) উমদাতুল ক্বারী, (২১) ইরশাদুস্ সারী, (২২) তাইসীরুল ক্বারী, (২৩) ফতহুল মুলহিম, (২৪) শরহে নববী, (২৫) বযলুল মাজহুদ, (২৬) মিরকাত, (২৭) আশয়াতুল লুময়াত, (২৮) লুময়াত, (২৯) শরহুত্ ত্বীবী, (৩০) তা’লীকুছ্ ছবীহ্ ইত্যাদি।}

সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল-জাওয়াব

সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগ