ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার: মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৫১)

সংখ্যা: ১৯২তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

প্রসঙ্গ: স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-এর মুহব্বত ও সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত দশটি মাক্বাম হাছিল করার কোশেশ করবে।

(৩) রিয়াজত-মাশাক্কাত

 

দশটি মাক্বাম হাছিলের অভিলাসী মুরীদের তৃতীয় করণীয় হচ্ছে রিয়াজত-মাশাক্কাত। শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলার ছোহবত ইখতিয়ার, যিকির-ফিকির, ইবাদত-বন্দিগী সুসম্পন্ন করার জন্য দুঃখ, কষ্ট, তাকলীফ সহ্য করা তথা রিয়াজত-মাশাক্কাত করা আবশ্যক। হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার শায়খণ্ডএর ৩৩ বছর ছোহবত ইখতিয়ার করেছিলেন।

যিকির-ফিকির ও রিয়াজত-মাশাক্কাত করেছিলেন। উনার জীবনের সেই ঘটনাটি আগত-অনাগত সকল মুরীদের জন্যই উপদেশস্বরূপ। হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহিসহ উত্তরকালে সকল মাশায়িখে ইজাম স্ব স্ব মুরীদদেরকে উনার সেই ঘটনাটি বর্ণনা করে শুনাতেন। যামানার ইমাম ও মুজতাহিদ, খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ইমামুল আইম্মাহ, ম্হুইস সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা ইমাম রাজারবাগ শরীফ-এর মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী, তিনিও নছীহতস্বরূপ উক্ত ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন এবং তার অতি সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন। যা অত্র নিবন্ধে ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করা হলো-

(ধারাবাহিক)

এজন্য আল্লাহ পাক বলেন,

اطيعوا الله والرسول

আল্লাহ পাককে ইতায়াত করো, আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইতায়াত করো

لعلكم ترحمون

তাহলে অবশ্যই রহমত লাভ করবে।”

এবং অন্য আয়াত শরীফ-এ বলেন, যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাক,

اطيعوا الله ورسوله

 আল্লাহ পাককে এবং আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইতায়াত করো।

ان كنتم مؤمنين

 æযদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাক”  অর্থাৎ যারা হাক্বীক্বী মু’মিন হতে চায়, তাদের দায়িত্ব হবে আল্লাহ পাক উনার মতে মত হওয়া, আল্লাহ পাক উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথে পথ হওয়া। এর থেকে সে একবিন্দু পরিমাণও নড়তে পারবে না। যে সুন্নতের উপরে যতটুকু কায়িম থাকতে পারবে, সে ততটুকু হাক্বীক্বী মুসলমান, হাক্বীক্বী মুত্তাক্বী, হাক্বীক্বী মু’মিন অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে সেই হাক্বীক্বী মু’মিন হবে। হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন যে, হুযূর! আমি তখন থেকে সুন্নতের পূর্ণ পাবন্দ হয়ে গেলাম। হযরত শাক্বীক্ব বল্খী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন- হে হাতেম আসেম! তুমি উত্তম মাসয়ালা শিক্ষা করেছ। কারণ সুন্নত ছাড়া একটা লোক কখনই খালিছ আল্লাহওয়ালা হতে পারবে না।

            তোমার পঞ্চম মাসয়ালাটা কি?

তোমার পঞ্চম মাসয়ালা? উনি বললেন, হুযূর আমি আবার কুরআন শরীফ ফিকির করতে লাগলাম। কুরআন শরীফ ফিকির করতে করতে আমি একটা আয়াত শরীফ পেয়ে গেলাম। আমি দেখলাম- মানুষের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি, পরের সম্পদ আহরণ করার জন্য বৈধ-অবৈধভাবে মানুষ কোশেশ করে। অথচ আল্লাহ পাক বলেন,

نحن قسمنا بينهم معيشة فى الحيوة الدنيا

æআমি তোমাদের প্রত্যেকের জিন্দেগীতে যা দরকার আমি প্রত্যেককেই তা যথাযথ বণ্টন করে দিয়েছি।”

মানুষের জন্য হালাল গেজা রয়েছে, হালাল রিযিক রয়েছে, অস্থির হয়ে মানুষ হারাম খেয়ে থাকে। প্রত্যেকের জন্য আল্লাহ পাক হালাল খাদ্য হালাল রিযিক যথাযথভাবে বণ্টন করে দিয়েছেন। কাজেই হালাল রিযিক প্রত্যেকের আছে, কিন্তু মানুষ অস্থির হয়ে হারাম ভক্ষণ করে অর্থাৎ মূলতঃ

حب الدنيا رأس كل خطيئة

দুনিয়ার মুহব্বত সমস্ত গুনাহের মূল।”

ترك الدنيا رأس كل اطاعة

æদুনিয়ার মহব্বত তরক করা সমস্ত ইবাদতের মূল।”

দুনিয়ার মুহব্বতের কারণে মানুষ একজন আর একজনের সম্পদ লুটপাট করে থাকে। সম্পদ আহরণের সময় বৈধ-অবৈধ সে খেয়াল করে না, যার জন্য সে গুনাহ্গার হয়ে যায়। হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, আমি যখন চিন্তা করলাম এবং এই আয়াত শরীফ ফিকির করলাম যে আল্লাহ পাক প্রত্যেককেই তার সম্পদ যথাযথভাবে বণ্টন করে দিয়েছেন, চিন্তা ফিকিরের কোন ব্যাপারই নেই। আমার যা রয়েছে, তকদিরে সেটা তো অবশ্যই আসবে। কাজেই শরীয়তসম্মত যা কোশেশ করা দরকার, সেই কোশেশ আমি করে যাব, আর আমার যেটা সেটা আমার কাছে আসবেই। কাজেই বৈধ-অবৈধ অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, অবৈধ জিনিস গ্রহণ করা যাবে না। কারণ দুনিয়ার মুহব্বত থেকে দূরে থাকতে হবে, এ প্রসঙ্গে বলা হয়ে থাকে- হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু একদিন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দরবার শরীফ-এ গেলেন। হুজরা শরীফ-এ গিয়ে দরজায় বসে বসে কাঁদতে লাগলেন। আল্লাহ পাক উনার রসূল সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি  ওয়া সাল্লাম বললেন, হে উমর ইবনুল খত্তাব! আপনি কাঁদেন কেন? আপনার কি হয়েছে? উনি বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ্, ইয়া হাবীবাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার অবস্থা দেখে আমার কান্না আসছে। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, æকি আমার অবস্থা?” হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জবাব দিলেন যে, æআপনি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, আপনি ইমামুল মুরসালীন, আপনাকে সৃষ্টি না করা হলে আরশ-কুরসী, লৌহ-কলম, বেহেশ্ত-দোযখ, আসমান-যমিন কিছুই সৃষ্টি করা হতোনা, কিছুই সৃষ্টি হতোনা। অথচ আপনি একটা খেজুরের চাটাইয়ের মধ্যে শোওয়া অবস্থায় রয়েছেন। আপনার ঘরে মশকের মধ্যে সামান্য পানি, আর একটা পাত্রে কিছু যবের ছাতু অথচ রোম পারস্যের সম্রাট, যারা চির জাহান্নামী, যারা কাফির, যারা মরলে জাহান্নামে যাবে, তাদের কত শান-শওকত, কত বিলাসীতা। এটা স্মরণ হচ্ছে আমার আপনাকে দেখে দেখে, যার কারণে আমার কান্না আসছে। আমি সেজন্যই কাঁদছি, আমার মনের দুঃখে, মনের ব্যথায়।” তখন আল্লাহ পাক উনার রসূল সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছলাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, æহে উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু আপনি কি জানেন?”

ما لى ولدنيا انا والدنيا الاكراكب استظل تحت شجرة ثم راح وتركها.

হে ওমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আপনি কি জানেন?”

مالى ولدنيا

 æআমার মধ্যে দুনিয়ার মধ্যে কি সম্পর্ক?”

انا والدنيا الاكراكب استظل تحت شجرة ثم راح وتركها

æআমার মধ্যে আর দুনিয়ার মধ্যে এমন সম্পর্ক, যেমন একটা ঘোড় সাওয়ারী আর গাছের ছায়ার সম্পর্ক অর্থাৎ ঘোড় সাওয়ারী গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেয় অতঃপর চলে যায়।”

অর্থাৎ ঘোড় সাওয়ারীর সাথে একটা গাছের ছায়ার যে সম্পর্ক, আমার এবং দুনিয়ার মধ্যে তদ্রুপ সম্পর্ক। আমাদের জন্য দুনিয়া নয়।

الدنيا سجن المؤمن وجنة الكافر

æদুনিয়া মু’মীনদের জন্য কারাগার আর কাফেরদের জন্য বালাখানা বা জান্নাত।” আমাদের জন্য পরকাল রয়েছে, কাফিরদের জন্য দুনিয়া।

আমাদের জন্য দুনিয়া নয়। আমরা দুনিয়ার জন্য কেন মশগুল হব? আমরা তো আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত আল্লাহ পাক উনার রসূল-এর মুহব্বতে গরক থাকব। এজন্য বলা হয়েছে হাদীছ শরীফ-এ আল্লাহ পাক উনার রসূল উল্লেখ করেন,

لو كانت الدنيا تعدل عند الله جناحا بعوضة ما سقى كافرا منها شربا.

æআল্লাহ পাক উনার কাছে দুনিয়ার কদর, দুনিয়ার মূল্য যদি একটা মশার পাখার সমান হতো, তাহলে আল্লাহ পাক কোন বিধর্মীকে, কোন কাফিরকে এক ঢোক পানিও পান করাতেন না।”

এজন্য এটা চিন্তা ফিকিরের বিষয়। কাজেই হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, যখন আমি এই আয়াত শরীফ পেয়ে গেলাম, বারবার ফিকির করলাম, তখন আমি আমার অন্তর থেকে দুনিয়ার মুহব্বতটা দূর করে দিলাম (সুবহানাল্লাহ্)। দুনিয়ার মুহব্বত দূর করে দিলাম। তখন হযরত শাক্বীক্ব বল্খী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, হে হাতেম আসেম! তুমি তো উত্তম মাসয়ালা শিক্ষা করেছ, উত্তম মাসয়ালা শিক্ষা করেছ। কারণ দুনিয়ার মুহব্বত দূর করে দেয়া সোজা কথা নয়, খুব কঠিন ব্যাপার। আল্লাহ পাক যার প্রতি সদয় হন, যার প্রতি রহমত বর্ষণ করেন, সেই একমাত্র পারে, তার পক্ষেই সম্ভব। (অসমাপ্ত)

 ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল ল মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৪৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৫০)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল: মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৫২)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার: মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৫৩)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৫৪)