ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৫৪)

সংখ্যা: ১৯৫তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

প্রসঙ্গ : স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-উনার মুহব্বত ও সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত দশটি মাক্বাম হাছিল করার কোশেশ করবে।

(৩) রিয়াজত-মাশাক্কাত

দশটি মাক্বাম হাছিলের অভিলাষী মুরীদের তৃতীয় করণীয় হচ্ছে রিয়াজত-মাশাক্কাত। শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-উনার ছোহবত ইখতিয়ার, যিকির-ফিকির, ইবাদত-বন্দিগী সুসম্পন্ন করার জন্য দুঃখ, কষ্ট, তাকলীফ সহ্য করা তথা রিয়াজত-মাশাক্কাত করা আবশ্যক। হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার শায়খ-উনার ৩৩ বছর ছোহবত ইখতিয়ার করেছিলেন।

যিকির-ফিকির ও রিয়াজত-মাশাক্কাত করেছিলেন। উনার জীবনের সেই ঘটনাটি আগত-অনাগত সকল মুরীদের জন্যই উপদেশস্বরূপ। হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহিসহ পরবর্তীকালে সকল মাশায়িখে ইজাম স্ব স্ব মুরীদদেরকে উনার সেই ঘটনাটি বর্ণনা করে শুনাতেন। যামানার ইমাম ও মুজতাহিদ, খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ইমামুল আইম্মাহ, মুহইস সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা ইমাম রাজারবাগ শরীফ-এর মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী, তিনিও নছীহতস্বরূপ উক্ত ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন এবং তার অতি সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন। যা অত্র নিবন্ধে ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে-

(ধারাবাহিক)

হে হাতেম আসেম! তোমার শেষ মাসয়ালাটা কি?

তখন হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন যে, হুযূর আমি ফিকির করলাম, কুরআন শরীফ-এ, আবার রিসার্চ করলাম, আবার ফিকির করলাম। দেখলাম মানুষ নানান জিনিসের উপর ভরসা করে। কেউ সন্তানের প্রতি, কেউ ধন-দৌলত, কেউ টাকা-পয়সা, কেউ লোকজন, নানান কিছুর উপর ভরসা করে। কিন্তু আল্লাহ্ পাক বলেন তার ব্যতিক্রম-

ومن يتوكل على الله فهو حسبه

æযে আল্লাহ পাক-উনার উপর ভরসা করে, আল্লাহ পাক তিনিই তার জন্য যথেষ্ট।” (সূরা তলাক্ব-৩)

যে আল্লাহ পাক-উনার প্রতি ভরসা করে, আল্লাহ পাক তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হন। আমি এই আয়াত শরীফ যখন পেলাম, তখন মনে মনে চিন্তা করলাম, সত্যিই একমাত্র আল্লাহ পাক-উনার উপরই ভরসা করা উচিত। হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার একটা ঘটনা বলা হয় যে, উনি আল্লাহ পাক-উনার উপর কতটুকু ভরসা করতেন। উনার আর্থিক অবস্থা তত সচ্ছল ছিলনা। একবার হজ্জের সময় যখন হলো, তখন উনার সঙ্গী-সাথীরা বললো- হে হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি! আপনি কি হজ্জে যাবেন? উনি বললেন, দেখ আমি হজ্জে যাব কি করে? আমার তো আর্থিক সামর্থ্য নেই। আমার ছেলেমেয়ে রয়েছে, তাদের ভরণ-পোষণ দিতে হবে আমি হজ্জে থাকাকালীন অবস্থায়, আর আমার তো যাতায়াত খরচ দরকার কোথা থেকে পাব? তারা বললো, দেখেন আপনি যদি যেতে চান আমাদের সাথে যেতে পারেন। উনি সকালে উনার ছেলেমেয়েদের সাথে আলোচনা করলেন। হে আমার ছেলেমেয়েরা! তোমরা কি বল? আমি তো হজ্জে যেতে চাই। কারণ আল্লাহ পাক তিনিই তো সবকিছুর ফায়সালাকারী। তখন উনার ছোট্ট একটা মেয়ে ছিল, খুব নেককার পরহিযগার আল্লাহওয়ালী। সেই মেয়েটা বললো- ঠিক আছে, আপনি যদি হজ্জে যেতে চান তা হলে যান কোন অসুবিধা হবে না। আল্লাহ পাক আমাদের হিফাযত করবেন। তখন সকলেই সম্মতি দিল উনি রওয়ানা হয়ে গেলেন হজ্জে। কিন্তু উনার ঘরে পরের বেলায় খাওয়ারই কিছু ছিল না। উনি তো হজ্জে রওয়ানা হয়ে গেছেন। ঘরের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে গেল। সেই ছোট্ট মেয়েটার কথা বলার কারণেই উনি হজ্জে রওয়ানা হয়ে গেলেন। যখন উনি চলে গেলেন, এদিকে খাওয়ার অভাব দেখা দিল। উনার অন্যান্য ছেলেমেয়ে যারা ছিল, তারা বললো সেই বাচ্চা মেয়েটাকে, তোমার কারণেই আমাদের পিতা হজ্জে গিয়েছেন। আমাদের কামাই রোজগার করার আজকে কেউ নেই। সেই মেয়েটা বললো- দেখ আল্লাহ পাক উনিতো রিযিকের মালিক, আল্লাহ পাক ফায়সালা করবেন। আল্লাহ পাক-উনার উপর ভরসা কর। ইত্যবসরে দেখা গেল, সেই এলাকায় যে আমীর ছিল, সে আমীর শিকার করতে বের হয়েছে। শিকার করতে করতে সে তার কয়েকজন লোক নিয়ে রাস্তা ভুলে সেই হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার বাড়িতে এসে পৌঁছল। যখন এসে পৌঁছল তার সভাসদ যারা ছিল, তাদের মধ্যে একজন উযীর ছিল, সে কিন্তু হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে চিনতো এবং উনি বুযুর্গ এটা তারা জানতো। এসে বললো, আমাকে এক গ্লাস পানি দাও। তখন উনার ঘর থেকে এক গ্লাস পানি দেয়া হলো। কিন্তু উনার ঘরে খাওয়ার কিছু ছিল না যে, মেহমানদারীর জন্য কিছু দেওয়া যায়। উনারা কিছুই দিতে পারলেন না। ঐ উযীর সেটা বুঝতে পারলো। সে বুঝতে পেরে বললো- হে আমীর! এটা তো হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার বাড়ি। উনি খুব বুযুর্গ আল্লাহওয়ালা। উনার ঘরে কিন্তু খাওয়ার কিছু নেই, আমাদেরকে যে মেহমানদারী করবেন। তেমন কিছু নেই, আমাদের উচিত উনাকে কিছু সাহায্য করা। তখন সে আমীর বললো, তা হলে ঠিক আছে কি করা যায়? প্রত্যেকের কোমরে একটা কোমরবন্ধনী ছিল, একটা বেল্ট ছিল, সেটা তারা খুলে রাখল। বললো- ঠিক আছে, এটার যত মূল্য হয়, সেই মূল্য দিয়ে আমরা নিয়ে যাব। এটা তাদেরকে হাদিয়া দেব। আমরা এটা খরীদ করে নিয়ে যাব। ঠিক সেই আমীর তাই করলো। দেখা গেল অনেক টাকা হয়ে গেল। কয়েক হাজার টাকা হয়ে গেল সেগুলোর মূল্য। সেই টাকাগুলি উনাদেরকে হাদিয়া দিয়ে আমীর চলে গেল। তাদের সচ্ছলতা এসে গেল। তখন সেই ছোট্ট মেয়েটা দোয়া করল যে, আল্লাহ পাক! আপনি তো আমাদের একটা বন্দোবস্ত করে দিলেন। আমার যিনি পিতা হজ্জে গেছেন, উনার প্রতি আপনি দৃষ্টি রাখবেন, সে দোয়া করল। এদিকে তো হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি হজ্জে চলে গেলেন। উনি কিছু দূর যাওয়ার পরে আল্লাহ পাক-উনার কুদরত উনি যে কাফেলার সাথে রওয়ানা হয়েছেন; সেই কাফেলার মধ্যে যে প্রধান ব্যক্তি তার পেটে ব্যথা হলো। পেটে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। অনেক ডাক্তার কবিরাজ ডাকা হলো, কিছুতেই কিছু হলো না। শেষ পর্যন্ত এক লোক বললো, এখানে কোন আল্লাহওয়ালা লোক আছেন কি? কোন বুযুর্গ লোক আছে যাঁর ওসীলায় আল্লাহ পাক শিফা দিতে পারেন? কারণ ওষুধপত্রে তো কোন কাজ হচ্ছে না। এখন আল্লাহওয়ালা লোকের দোয়ায় যদি আল্লাহ পাক হিফাযত করেন। তখন এক লোক বললো যে, এই তো হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি তো আল্লাহ পাক-উনার ওলী, বুযুর্গ বলে আমরা মনে করি। উনি যদি আপনাকে কিছু দোয়া করেন, ফুঁ দেন বা কিছু করেন, তাহলে হয়ত কামিয়াব হতে পারেন। সেই ব্যক্তি বললো যে, হুযূর আমাকে দয়া করে কিছু বন্দোবস্ত করুন। উনি তার পেটের মধ্যে ফুঁ দিলেন, হাত বুলায়ে দিলেন, লোকটা সুস্থ হয়ে গেল সুবহানাল্লাহ! যখন সে সুস্থ হয়ে গেল, সেই ব্যক্তি আমীর ছিল। সে বললো যে, হুযূর বেয়াদবী মাফ করবেন, আমার সওয়ারী রয়েছে, একটা সাওয়ারীতে চড়েন এবং আপনার যাতায়াতের যত খরচ দরকার, সব খরচ আমি বহন করবো। সুবহানাল্লাহ! উনার ফায়সালা হয়ে গেল। উনার যখন ফায়সালা হয়ে গেল। উনি মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন যে, আমার তো ফায়সালা হয়ে গেল কিন্তু আমার বাড়ির কি অবস্থা? ঠিক ঐ রাত্রে উনি স্বপ্ন দেখেন। উনাকে বলা হচ্ছে আল্লাহ পাক-উনার তরফ থেকে, হে হযরত হাতেম আসেম! তুমি অস্থির হয়ো না। তোমার যেমন ফায়সালা হয়েছে তোমার বাড়িরও ফায়সালা হয়ে যাবে।

ومن يتوكل على الله فهو حسبه

যে আমার উপর ভরসা করে আমি তার সমস্ত ফায়সালা করে দেই।” সুবহানাল্লাহ!

তখন হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, হযরত শাক্বীক্ব বলখী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে। হুযূর! আমি যখন এ আয়াত শরীফ পেয়ে গেলাম, আল্লাহ পাক-উনার উপর হাক্বীক্বী ভরসা করলাম। হাক্বীক্বী ভরসা করলাম। আল্লাহ পাক আমার সমস্ত কাজগুলি যথাযথভাবে সমাধা, ফায়সালা করে দিতে লাগলেন। কারণ আল্লাহ পাক উনি তো কুদরতওয়ালা। যখন হযরত  হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, এই আটটি মাসয়ালা, তখন শাক্বীক্ব বলখী রহমতুল্লাহি আলাইহি যিনি ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত তরীক্বত ছিলেন। যিনি তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল, কুরআন শরীফ সবই পড়েছেন। উনি বললেন, হে হযরত হাতেম আসেম! আমার জীবন কামিয়াব হয়েছে। আমি ৩৩ বৎসর যাবৎ তোমাকে তালীম দিচ্ছি। ৩৩ বৎসর যাবৎ আমি তোমাকে তালিম দিচ্ছি। তুমি সত্য কথাই বলেছ। যে আটটি মাসয়ালা শিখেছ, সত্যিই আমি তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল, কুরআন শরীফ পড়েছি। আমি দেখেছি সমস্ত আসমানী কিতাবের মূল হলো এই আটটি মাসয়ালা সুবহানাল্লাহ! এই আটটি মাসয়ালার উপর যে কায়িম থাকবে, সে সমস্ত আসমানী কিতাব-এর উপর যেন কায়িম রইলো। তথা কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াস-এর উপর কায়িম থাকবে। কারণ পূর্ববর্তী সমস্ত আসমানী কিতাব-এর মূল হলো- কুরআন শরীফ। তার ব্যাখ্যা হাদীছ শরীফ, তার ব্যাখ্যা ইজমা এবং ক্বিয়াস।

কাজেই যে ব্যক্তি এই আটটি মাসয়ালার উপর কায়িম রইলো, সে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ এবং সুন্নাহ শরীফ-এর উপর কায়িম হয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ! এখন, ফিকির করেন, আমাদের প্রত্যেককেই প্রতিটি অবস্থায় আল্লাহ পাক-উনার মতে মত, আল্লাহ পাক-উনার রসূল-উনার পথে পথ হতে হবে। কোন অবস্থায়ই এর খিলাফ করা যাবেনা। ব্যক্তিগত বলেন, পারিবারিক বলেন, সামাজিক বলেন আর আন্তর্জাতিক বলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই। কিন্তু আমরা কতটুকু ফিকির করি, কতটুকু চিন্তা করি, সেটাই ফিকিরের বিষয়।

(অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৫০)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার: মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৫১)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল: মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৫২)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার: মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৫৩)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৫৫)