মাহে রবীউল আউয়াল শরীফ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

সংখ্যা: ১৯৪তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ শুয়াইব আহমদ

আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম উনার হাবীব যিনি নবীদের নবী, রসূলদের রসূল, নূরে মুজাস্সাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার অজুদ পাক অর্থাৎ নূর মুবারক সৃষ্টি করেন এবং সেই নূর মুবারক হতে জিন, ইনসান, ফেরেশতা, আরশ, কুরসী, লওহো, কলম, বেহেশত, দোযখ, আসমান, যমীন, মাটি, পানি, আগুন, বাতাস এক কথায় সমস্ত মাখলূকাত সৃষ্টি করেন। হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

اول ما خلق الله نورى وخلق كل شىء من نورى

আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম আমার নূর মুবারক সৃষ্টি করেন এবং আমার নূর মুবারক থেকেই সবকিছুই সৃষ্টি করেন। (হাক্বীক্বতে মুহম্মদী, আল ইনসানুল কামিল)

আল্লাহ পাক হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনাকে সৃষ্টি করে উনার কপাল মুবারকে এই নূর মুবারক স্থাপন করেন। অতঃপর এই নূর মুবারক হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম হতে ক্রমান্বয়ে বংশানুক্রমে নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার পূর্বপিতা ও মাতাগণের নিকট পৌঁছে। অবশেষে ৫৭০ ঈসায়ী সন ১২ই রবীউল আউয়াল শরীফ পবিত্র সোমবার ছুবহে ছাদিকের সময় মাতা হযরত আমিনাহ আলাইহাস সালাম-উনার মাধ্যমে যমিনে তাশরীফ আনেন। সুবহানাল্লাহ!

কালামুল্লাহ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

قد جاءكم من الله نور وكتاب مبين

অর্থ: ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে তোমাদের নিকট নূর এবং প্রকাশ্য কিতাব এসে পৌঁছেছে।’ (সূরা-মায়িদা-১৫) আয়াতে কারীমার মধ্যে হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘নূর’ বলা হয়েছে। ‘নূর’ তাকেই বলা হয় যে নিজেই নিজেকে প্রকাশ করে এবং অন্যকেও প্রকাশ করে। দেখুন সূর্য এমন আলো যাকে দেখার জন্য কোন আলোকের দরকার হয় না। সূর্য নিজেই আলোকিত এবং অন্যের উপর তার আলো পড়লে তাও আলোকিত হয়।

দুনিয়াতে কেউ বংশ দিয়ে, কেউ পেশা দিয়ে, কেউ সম্পদ দিয়ে কেউ রাজত্ব দিয়ে পরিচিত হয়। কিন্তু হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসব কোন কিছু দিয়েই পরিচিত বা আলোকিত হননি। যেহেতু তিনি নিজেই নূর বা আলো সেহেতু উনাকে কে আলোকিত করবে? বরং তিনিই সকলকে আলোকিত করেছেন। সূর্য উঠার আগে যেমন দুনিয়া আলোকিত হয় তদ্রুপ হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন শানওয়ালা নূর উনার বিলাদত শরীফ-হওয়ার আগেই যমীনে সাড়া পড়ে গেল যে উনি আসছেন। সূর্যের আলো দুনিয়াতে কম-বেশি হয়ে থাকে। আবার সূর্য এক সময়ে অর্ধেক পৃথিবীকে আলো দান করে। কিন্তু হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নূর মুবারক সমস্ত জাহানে আরশ কুরসীসহ সকল স্থানে সমভাবে আলো দান করছে। সূর্যের কিরণ হতে বাঁচতে হলে কোথাও আশ্রয় নিয়ে বাঁচা যায়। কিন্তু নূরে হাবীবীকে কোনখানেই আড়াল করা যায় না। যেখানে খোদা তায়ালার রুবুবিয়াত সেখানেই হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নূর ও রহমত বিরাজমান। সুবহানাল্লাহ!

হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার এমন শান যে তিনিই সকলের আদি, তিনিই সকলের অন্ত, তিনিই সকলের কাছে প্রকাশ, তিনিই সকলের কাছে গোপন এবং তিনিই সর্ববিষয় সম্বন্ধে জ্ঞাত। মোটকথা, তিনিও ঐ আয়াতে কারীমার হুবহু মিছদাক যে আয়াত শরীফখানা আল্লাহ পাক-উনার শান প্রকাশার্থে নাযিল করেছেন। আয়াত শরীফখানা হলো-

هو الاول والاخر والظاهر والباطن وهو بكل شىء عليم.

অর্থ: ‘তিনিই আদি, তিনিই অন্ত, তিনিই প্রকাশ্যে, তিনিই গোপন, তিনিই সবকিছু সম্বন্ধে জ্ঞাত।’ (সূরা হাদীদ-৩)

অর্থাৎ নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়া ও আখিরাতে সব জায়গায়ই তিনি আদি। সর্বপ্রথম উনার অজুদ পাক অর্থাৎ নূর মুবারক সৃষ্টি করা হয়েছে। বাহ্যিকভাবে হযরত আদম আলাইহিস সালাম আদি পিতা হাক্বীক্বতে নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিই আদি পিতা। নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই সর্বপ্রথম নবী ও রসূল। নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই বলেন-

كنت نبيا وادم بين الماء والطين

অর্থ: ‘আমি সে সময়ও নবী যে সময় হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম মাটি ও পানির মধ্যে অবস্থান করছিলেন।’ (মিশকাত, মিরকাত)

রোযে আযলে  الست بربكم ‘আলাস্তু বি-রব্বিকুম’ এর উত্তরে সর্বপ্রথম তিনিই  بلى ‘বালা’ বা হ্যাঁ বলেছিলেন। কিয়ামত দিবসে সর্বপ্রথম উনারই রওযা শরীফ খোলা হবে। সর্বপ্রথম উনারই উপর সিজদার হুকুম হবে। সর্বপ্রথম তিনিই শাফায়াত করবেন এবং শাফায়াতের দরজা উনার মুবারক হাত দিয়েই খোলা হবে। তিনিই সর্বপ্রথম বেহেশতের দরজায় খটখটি দিবেন। অতঃপর দরজা খোলা হবে এবং তিনিই সর্বপ্রথম বেহেশতে প্রবেশ করবেন। এক কথায় সব জায়গায় সর্বাবস্থায় উনাকেই প্রথম করা হয়েছে। সুবহানাল্লাহ!

এরপর সর্বশেষ উনাকেই করা হয়েছে। সবশেষে তিনিই প্রকাশ হয়েছেন। ‘খাতামুন্ নাবিইয়ীন’ উনারই লক্বব বা উপাধি। সবশেষে উনার কিতাবই অবতীর্ণ হয়েছে। সর্বশেষ দীন উনারই। সর্বশেষ অর্থাৎ কিয়ামত পর্যন্ত উনারই দীন অটুট বা জারি রাখা হয়েছে। সুবহানাল্লাহ!

এরপর যাহির সম্পর্কে বলতে হয় যে, নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রকাশ সকলের কাছে। সবসময় তিনি প্রকাশ থাকেন। মুসলমানের কাছে এমনকি কাফিরদের কাছেও। উনার পরিচিত হওয়ার বিষয়টি তুলনা দেয়া হয়েছে সন্তানের সাথে, পিতার সাথে নয়। কারণ হলো পিতা সন্তান থেকে না হওয়ার কারণে সন্তান পিতার সববিষয়ে জানেনা। আর সন্তান পিতা থেকে হওয়ার কারণে পিতা সন্তানের সবকিছুই জানেন। সমস্ত আলম পূর্ব থেকেই নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে জেনেছিল। পাহাড় উনাকে চিনতে পেরে সালাম জানায়, পাথর উনাকে খোশখবরী দেয়, গাছ ছায়া দেয়ার জন্য ঝুকে যায়, চন্দ্র উনার সাথে কথা বলে, জীব-জন্তু উনাকে চিনতো, উট সিজদা করেছিল, জঙ্গলের হরিণ আশ্রয় এবং শান্তি প্রার্থনা করেছিল। উনার ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল, ডুবন্ত সূর্য পুনরায় উদিত হয়েছিল। যমিনের উপরে যা কিছু রয়েছে সকলেই উনাকে জানে, চিনে। আসমানের উপর যারা আছেন সকলেই উনাকে জানেন ও চিনেন। বেহেশত-দোযখের সকলেই উনাকে জানে। বেহেশতে গাছের পাতা-পল্লবে, হুরগণের চক্ষুর উপর, গিলমানদের সিনার উপর অর্থাৎ বেহেশতের সকল জায়গায় লেখা আছে ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ’ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এককথায় যেখানে আল্লাহ তায়ালার আলোচনা সেখানেই হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার আলোচনা। উনার পবিত্র যিন্দেগীর বিভিন্ন অবস্থা দুধ পান, লালন-পালন, আনুষ্ঠানিক নুবুওওয়াত প্রকাশের পূর্ববর্তী ঘটনাসমূহ এবং আনুষ্ঠানিক নুবুওওয়াত প্রকাশের পর আভ্যন্তরীন ও বাহ্যিক অবস্থাসমূহ দুনিয়ার সকল স্থানেই প্রকাশ হয়েছে। পৃথিবীতে এমন কোন স্থান নেই যেখানে উনার পবিত্র বাণী পৌঁছেনি। তিনি সকল অবস্থায় সকল স্থানেই প্রকাশিত হয়েছেন। সুবহানাল্লাহ! আবার তিনি এইভাবে যাহির থেকেও এমনভাবে বাতিন বা গোপন আছেন যে উনার সকল ও প্রকৃত পরিচয় জানা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষের আকৃতিতে তিনি প্রকাশিত হলেও উনার হাক্বীক্বত একমাত্র আল্লাহ পাক ব্যতীত আর কেউই জানতে পারেনি। সুবহানাল্লাহ!  তিনি সকল বিষয় সম্মন্ধেই জ্ঞাত। কারণ আল্লাহ তায়ালা-উনার জাত ও ছিফাত এবং সমস্ত যাহির ও বাতিনের ইলম এবং মাখলূক্বের আউয়াল ও আখিরের সব ইলম উনার কাছেই জমা করা হয়েছে। সুবহানাল্লাহ!

মূলতঃ রব্বুল আলামীন আল্লাহ পাক-উনার ছানা-ছিফত বর্ণনা করে যেমন শেষ করা সম্ভব নয় তদ্রুপ রহমাতুল্লিল আলামীন হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনারও ছানা-ছিফত বর্ণনা করে শেষ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আর তাই বর্তমান পঞ্চদশ হিজরী শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল, ইমাম রাজারবাগ শরীফ-এর হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী তিনি উনার ক্বওল শরীফে উল্লেখ করেছেন যে, ‘নবীদের নবী, রসূলদের রসূল, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু আল্লাহ পাক নন। এছাড়া যত ছানা-ছিফত, দারাজাত-মাক্বামাত, ফযীলত-ইজ্জত, মর্যাদা-মর্তবা, শান-মান রয়েছে সবকিছুরই অধিকারী তিনি। সুবহানাল্লাহ! এ প্রসঙ্গে হাদীছে কুদসীতে ইরশাদ হয়েছে-

قال الله تعالى يا حبيبى انا وانت وما سواك خلقت لاجلك وقال رسول الله صلى الله عليه وسلم يا رب انت وما انا وما سواك تركت لاجلك

অর্থ: আল্লাহ পাক বলেন, হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! শুধু আমি এবং আপনি। এছাড়া কুল-মাখলূক্বাতের সবকিছু আমি আপনার কারণে বা জন্যেই সৃষ্টি করেছি। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ পাক-উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় খুছুছিয়াত বা বৈশিষ্ট্য প্রকাশার্থে উচ্চারণ করলেন, হে বারে ইলাহী! শুধু আপনিই, আমিও না। কারণ, আমিতো আপনার মধ্যেই ফানা ও বাক্বা। কাজেই, আমার জন্যে যা কিছু সৃষ্টি করা হয়েছে সবই আমি আপনার মুহব্বত ও সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই ত্যাগ করেছি। সুবহানাল্লাহ!

বর্ণিত রয়েছে, আল্লাহ পাক একাই ছিলেন এবং গোপন ছিলেন। অতঃপর আল্লাহ পাক নিজেকে যখন প্রকাশ করতে চাইলেন তখন তিনি উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সৃষ্টি করলেন অর্থাৎ নূরে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সৃষ্টি করে স্বীয় কুদরতের মধ্যে রেখে দিলেন। অতঃপর উনার যমীনে আগমন, অবস্থান, বিদায় সবই হয় কুদরতিভাবে। এমনকি বর্তমানে তিনি যে রওযা মুবারকে অবস্থান করছেন সেটাও কুদরতের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ আল্লাহ পাক-উনার সাথে উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার অবস্থানের বিষয়টি সর্বদা একই রকম। এ প্রসঙ্গে হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

لى مع الله وقت لا يسعن فيه ملك مقرب ولا نبى مرسل

অর্থ: আমার সাথে আল্লাহ পাক-উনার এমন নিগূঢ় সম্পর্ক যেখানে কোন নৈকট্যশীল ফেরেশতা এবং কোন নবী ও রসূল পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম নন। (সিররুল আসরার)

মাহে রমাদ্বান শরীফ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে শাওওয়াল-যিলক্বদ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে যিলহজ্জ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে মুহররমুল হারাম ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে রবীউছ ছানী ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা