মাহে শা’বান ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

সংখ্যা: ১৮৯তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ শুয়াইব আহমদ

মাহে শা’বান আরবী মাসের অষ্টম মাস। এ মাসটির অন্যতম ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতটি।’ এই রাতটিকে কুরআন শরীফ-এ ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ এবং হাদীছ শরীফ-এ ‘লাইলাতুন্ নিছফি মিন শা’বান’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ফার্সী ভাষায় এই রাতটিকে বলা হয় ‘শবে বরাত’ বা ভাগ্য রজনী এবং এ নামেই আমাদের এ উপমহাদেশে রাতটি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।

এ মাস ও তন্মধ্যে অবস্থিত উক্ত রাতটির ফযীলত ও আমল সম্পর্কে বহু হাদীছ শরীফ বর্ণিত রয়েছে। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মাহে রজব ও রমযান শরীফ-এর মধ্যখানে এমন এক মাস রয়েছে, যার মর্যাদা সম্পর্কে মানুষের জানা নেই। এই মাসে মানুষের আমল আল্লাহ তায়ালার নিকট পৌঁছানো হয়। সুতরাং আমার আকাঙ্খা, যখন আমার আমল আল্লাহ তায়ালা’র দরবারে পৌঁছানো হয় তখন যেন আমি রোযা অবস্থায় থাকি।’ অর্থাৎ মাহে শা’বান-এর চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতটিতে মানুষের বিগত এক বছরের আমলগুলি আল্লাহ তায়ালা’র নিকট পেশ করা হয়।

হযরত আনাস বিন মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘অন্যান্য মাসের উপর রজব মাসের তেমনি সম্মান, যেমন অন্য সব কিতাবের উপর কুরআন মজীদ-এর সম্মান। অনুরূপ অন্য মাসসমূহের উপর শা’বান মাসের তেমনি সম্মান, যেমন অন্য সকল নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম-এর উপর আমাকে সম্মান দান করা হয়েছে। আর অন্য সব মাসের উপর মাহে রমযান শরীফ-এর তেমনি সম্মান, যেমন সমগ্র সৃষ্টিজগতের উপর আল্লাহ তায়ালা’র সম্মান।’

উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বর্ণনা করেন, ‘আমি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, এমন চারটি রাত রয়েছে, যেসব রাতে আল্লাহ তায়ালা সকল মানুষের উপর নেকীর দরজা খুলে দেন। তা হলো- ঈদুল ফিতরের রাত, ঈদুল আযহার রাত, শা’বান-এর মধ্যবর্তী রাত অর্থাৎ শবে বরাত, আরাফার রাত। এইসব রাতে আল্লাহ তায়ালা মানুষের হায়াত, রিযিক এবং হজ্জ সম্পর্কে আদেশ লিপিবদ্ধ করেন।’

হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘শা’বান-এর মধ্যবর্তী রাতে অর্থাৎ শবে বরাতে হযরত জিব্রীল আলাইহিস্ সালাম আমার নিকট আগমন করে বলেন, আসমানের দিকে মাথা মুবারক উত্তোলন করুন, কেননা এটি বরকতের রাত। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সেই বরকত কি? তিনি বললেন, এ রাতে আল্লাহ তায়ালা রহমতের তিনশ’ দরজা খুলে দেন এবং উনার সাথে যারা শরীক করে না তাদেরকে মাফ করে দেন। তবে জাদুকর, গণক, সর্বদা মদ্যপায়ী, সুদখোর, ব্যভিচারী- এরা তওবা না করা পর্যন্ত ক্ষমা পাবে না।’

হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন, ‘এই মুবারক রাতটির চতুর্থাংশ অতিবাহিত হওয়ার পর হযরত জিব্রীল আলাইহিস্ সালাম পুনরায় আমার কাছে আসেন এবং বলেন, আপনার মাথা মুবারক উত্তোলন করুন। আমি মাথা মুবারক উঠিয়ে আসমানের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই, জান্নাতের সব দরজা খোলা রয়েছে। প্রথম দরজায় একজন ফেরেশতা দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছেন, যে এই রাতে রুকু করে তার জন্য সুসংবাদ। দ্বিতীয় দরজায় দ-ায়মান ফেরেশতা ডেকে বলছেন, যে এই রাতে সিজদা করে তার জন্য সুসংবাদ। তৃতীয় দরজায় দাঁড়ানো ফেরেশতা ডেকে বলছেন, যে এই রাতে দুয়া করে তার জন্য সুসংবাদ। চতুর্থ দরজায় দাঁড়ানো ফেরেশ্তা ঘোষণা করছেন, যে এই রাতে আল্লাহ তায়ালার ভয়ে কান্নাকাটি করে তার জন্য সুসংবাদ। পঞ্চম দরজায় দাঁড়িয়ে একজন ফেরেশ্তা বলছেন, আজ রাতে যে তাসবীহ-তহালীল পাঠ করেছে তার জন্য সুসংবাদ। ষষ্ঠ দরজায় দাঁড়িয়ে আরেক ফেরেশতা বলছেন, এই রাতে সকল মুসলমানের জন্য সুসংবাদ। সপ্তম দরজায় দাঁড়িয়ে এক ফেরেশতা ডেকে বলছেন, কারো কিছু প্রার্থনা করার থাকলে করুক, তার প্রার্থনা পূরণ করা হবে। অষ্টম দরজায় দাঁড়ানো ফেরেশতা বলছেন, মাগফিরাত বা ক্ষমার আবেদন জানাবার কেউ আছে কি? তার আবেদন কবুল করা হবে।’ হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি হযরত জিব্রীল আলাইহিস্ সালামকে জিজ্ঞেস করলাম, জান্নাতের এইসব দরজা কখন পর্যন্ত খোলা থাকে? তিনি বললেন, ছুবহে ছাদিক অর্থাৎ ভোর হওয়া পর্যন্ত। আরো বললেন, আল্লাহ তায়ালা এই রাতে বণী কালব অর্থাৎ কালব গোত্রের মেষের পশম সংখ্যক লোককে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেন।’ (গুনিয়াতুত্ ত্বালিবীন)

অতএব, প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উচিত এ মুবারক রাতটিতে সারা রাত সজাগ থেকে ইবাদত-বন্দিগী করা, নিজের গুনাহসমূহ হতে তওবা-ইস্তিগফার করা, আল্লাহ তায়ালা’র দরবারে কাকুতি মিনতি সহকারে কান্নাকাটি করা, এই মাসের মালিক হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওসীলায় আল্লাহ তায়ালা’র রহমত প্রার্থনা করা সর্বোপরি আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মত ও পথে ইস্তিক্বামত থাকার তাওফীক কামনা করা। আর দিনের বেলায় রোযা রাখা।

হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত রয়েছে, স্বয়ং হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মুবারক রাতটি ইবাদত-বন্দিগী করে অতিবাহিত করেছেন এবং দিনের বেলা রোযা রেখেছেন এবং উম্মতকেও এ ব্যাপারে আদেশ করেছেন। যেমন এ প্রসঙ্গে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যখন অর্ধ শা’বানের রাত উপস্থিত হবে তখন তোমরা উক্ত রাতে সজাগ থেকে ইবাদত-বন্দিগী করবে এবং দিনের বেলা রোযা রাখবে।’ (ইবনে মাজাহ)

মাহে রবীউছ্ ছানী ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে জুমাদাল উখরা ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে রজব ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে রমাদ্বান শরীফ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে শাওওয়াল-যিলক্বদ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা