সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সংখ্যা: ১৯১তম সংখ্যা | বিভাগ:

মুহম্মদ মুশফিকুর রহমান

ঝাউতলা স্টেশন রোড, চট্রগ্রাম।

 

সুওয়াল: চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত রেযাখানীদের অখ্যাত মাসিক মুখপত্র ডিসেম্বর-জানুয়ারী /২০০৬ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে একটি মাসিক পত্রিকার কথা উল্লেখ করে “আল ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবায়া, আল জাওহারাতুন নাইয়ারাহ্ ও রদ্দুল মুহ্তার” কিতাবের বরাত দিয়ে বলেছে, “আযানের মৌখিক জাওয়াব দেওয়া মুস্তাহাব”…।

এখন আমার সুওয়াল হল- তারা “আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া সম্পর্কে যে সকল কিতাবের ইবারত উল্লেখ করেছে তা কতুটুকু গ্রহণযোগ্য?

জাওয়াব:ঃ আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া সম্পর্কে রেযাখানীদের অখ্যাত মাসিক মুখপত্রের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং স্ববিরোধী, ভুল ও অশুদ্ধ হয়েছে এবং ছহীহ হাদীছ শরীফ ও হানাফী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য বিশ্বখ্যাত অনুসরণীয় ফিক্বাহ ও ফতওয়ার  কিতাবসমূহে বর্ণিত তারজীহ্ বা প্রাধান্যপ্রাপ্ত তথা মুখতার বা গ্রহণযোগ্য মতের সম্পূর্ণ খিলাফ হয়েছে। কারণ আমাদের হানাফী মাযহাব মতে আযান শ্রবণকারীর সকলের জন্যই আযানের জাওয়াব মৌখিকভাবে দেয়া ওয়াজিব। আর এই আযানের মৌখিক জাওয়াব না দিলে, সে ওয়াজিব তরককারী হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে নাফরমানের অন্তর্ভুক্ত হবে।

সুতরাং মুয়ায্যিনের আযান শুনে আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব এবং এর উপরই ফতওয়া। হানাফীদের জন্য এর বিপরীত মত পোষণ করা সম্পূর্ণই জিহালতী ও গুমরাহী।

রেযাখানী মৌলভী ছাহেবরা “আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া মুস্তাহাব বলে জিহালতী ও গুমরাহীর পরিচয় দিয়েছে এবং কিতাবের নাম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়েছে। নিম্নে পর্যায়ক্রমে তাদের প্রতিটি দলীলের খ-নসহ সঠিক ও গ্রহণযোগ্য ফতওয়া উল্লেখ করা হচ্ছে-

(ধারাবাহিক)

 

রেযাখানীদের বক্তব্য খণ্ডন

উল্লেখ্য, রেযাখানীরা পরিশেষে বলেছে, “তবে অধিকাংশ হানাফী ফক্বীহ ও ইমামগণ … আযান শুনে নামায ও জামায়াতের দিকে হাজির হওয়াকে ওয়াজিব বলে ফায়সালা প্রদান করেছেন। বিস্তারিত দেখুন- আল ফিক্বহ আলাল মাযাহিবিল আরবায়া ও রদ্দুল মুহ্তার।

এর জাওয়াবে বলতে হয় যে, রেযাখানীদের উক্ত বক্তব্য ডাহা মিথ্যা ও দলীলবিহীন হয়েছে। কারণ অধিকাংশ হানাফী ফক্বীহ ও ইমামগণ … আযান শুনে নামায ও জামায়াতের দিকে হাজির হওয়াকে ওয়াজিব বলে যে ফায়সালা প্রদান করেছেন। এধরনের কিতাবের কোন ইবারত রেযাখানী মৌলভী সাহেবরা উল্লেখ করতে পারেনি। সুতরাং রেযাখানীদের দলীলবিহীন বক্তব্য মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আর রেযাখানীরা তাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে দলীল হিসাবে ‘আল ফিক্বহু আলাল মাযাহিবিল আরবায়া ও রদ্দুল মুহ্তার’ কিতাবের বরাত দিয়েছে, অথচ অধিকাংশ হানাফী ফক্বীহ ও ইমামগণ … আযান শুনে নামায ও জামায়াতের দিকে হাজির হওয়াকে ওয়াজিব বলে ফায়সালা প্রদান করেছেন। এধরনের কোন বক্তব্য, কোন বর্ণনা, কোন ইবারত তাদের উল্লিখিত ‘আল ফিক্বহু আলাল মাযাহিবিল আরবায়া ও রদ্দুল মুহ্তার’ কিতাবের ইবারতে উল্লেখ নেই।

সুতরাং প্রমাণিত হলো রেযাখানীরা তাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে ‘আল ফিক্বহু আলাল মাযাহিবিল আরবায়া ও রদ্দুল মুহ্তার’ কিতাবের নাম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়েছে।

দ্বিতীয়তঃ রেযাখানীরা ‘আল ফিক্বহু আলাল মাযাহিবিল আরবায়া ও রদ্দুল মুহ্তার’ কিতাব থেকে একখানা দলীলও পেশ করতে পারবে না যে অধিকাংশ হানাফী ফক্বীহ ও ইমামগণ … আযান শুনে নামায ও জামায়াতের দিকে হাজির হওয়াকে ওয়াজিব বলে ফায়সালা প্রদান করেছেন।

বরং আমরাই দলীল দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছি যে, আযান শুনে নামায ও জামায়াতের দিকে হাজির হওয়া ওয়াজিব এটা মুশকিল ও অসম্ভব।

কেননা আযান শুনে নামায ও জামায়াতের দিকে হাজির হওয়া ওয়াজিব হলে, প্রথম ওয়াক্তেই নামায ও জামায়াতের দিকে হাজির হয়ে ওয়াজিব আদায় করা তার উপর লাযিম হয়ে যায়। আর আযানের পূর্ব থেকেই জামায়াতের জন্য মসজিদে উপস্থিত থাকলে নামায ব্যতীত আযানের জাওয়াব দেয়ার জন্য জামায়াতে হাজির হওয়া যে ওয়াজিব তা নিরর্থক হয়ে যায়।

যেমন- ‘রদ্দুল মুহ্তার’ কিতাবের ১ম খ-ের ৩৯৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

قال فى النهر: وقوله بوجوب الاجابة بالقدم مشكل, لأنه يلزم عليه وجوب الأداء فى اول الوقت وفى المسجد اذ لا معنى لا يجاب الذهاب دون الصلاة.

অর্থ: ‘নাহরুল ফায়িক’ কিতাবে উল্লেখ আছে, নিশ্চয়ই হালওয়ানীর বক্তব্য কুদুম বা উপস্থিতির মাধ্যমে অর্থাৎ জামায়াতে নামায আদায় করার জন্য মসজিদে উপস্থিতির মাধ্যমে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব এটা মুশকিল। কেননা জামায়াতে নামায আদায় করার জন্য মসজিদে উপস্থিতির (গমনের) মাধ্যমে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব হলে প্রথম ওয়াক্তেই মসজিদে উপস্থিতির মাধ্যমে ওয়াজিব আদায় করা তার উপর লাযিম হয়ে যায়। আর আযানের পূর্ব থেকেই মসজিদে উপস্থিত থাকলে নামায ব্যতীত জাওয়াব দেয়ার জন্য মসজিদে গমন করা নিরর্থক। (কেননা সে তো আযানের পূর্ব থেকেই মসজিদে উপস্থিত)

তৃতীয়তঃ রেযাখানীরা অধিকাংশ হানাফী ফক্বীহ ও ইমামগণ বলে শুধুমাত্র হালওয়ানীর কথাই উল্লেখ করেছেন।

অথচ আমরা প্রমাণ করেছি যে, হালওয়ানীর উক্ত বক্তব্য যে গ্রহণযোগ্য নয় তা ‘বাহরুর রায়িক’ কিতাবেও উল্লেখ আছে-

واعلم ان قول الحلوانى بوجوب الاجابة بالقدم مشكل لانه يلزم عليه وجوب الاداء فى أول الوقت وفى المسجد اذ لا معنى لا يجاب الذهاب دون الصلاة.

অর্থ: ‘জেনে রাখুন! নিশ্চয়ই হালওয়ানীর বক্তব্য আল ইজাবাতু বিলকুদুম এর মাধ্যমে অর্থাৎ জামায়াতে নামায আদায় করার জন্য মসজিদে উপস্থিতির মাধ্যমে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব এটা মুশকিল। কেননা জামায়াতে নামায আদায় করার জন্য মসজিদে উপস্থিতির মাধ্যমে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব হলে প্রথম ওয়াক্তেই মসজিদে উপস্থিতির (গমনের) মাধ্যমে ওয়াজিব আদায় করা তার উপর লাযিম হয়ে যায়। আর আযানের পূর্ব থেকেই মসজিদে উপস্থিত থাকলে নামায ব্যতীত আযানের জাওয়াব দেয়ার জন্য মসজিদে গমন করা যে ওয়াজিব তা নিরর্থক হয়ে যায়।’

অতএব, হালওয়ানীর উক্ত বক্তব্য থেকে এটাই প্রমাণিত হলো যে, হালওয়ানী যেহেতু আযানের জাওয়াবে قدم বা উপস্থিত হওয়াকেই ওয়াজিব বলেছে, সেহেতু হালওয়ানীর উক্ত বক্তব্যে আযানের জাওয়াবে প্রথম ওয়াক্তেই মসজিদে উপস্থিত হওয়া বা মসজিদে গমন করা ওয়াজিব। যা কখনই সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়তঃ হালওয়ানীর উক্ত বক্তব্যে এটাও প্রমাণিত হলো যে, আযানের পূর্ব থেকেই জামায়াতে নামায আদায় করার জন্য মসজিদে উপস্থিত থাকলে নামায ব্যতীত আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব তার উপর বর্তায় না। কেননা সে তো قدم বা উপস্থিত হয়েই আছে। যা সম্পূর্ণই হাদীছ শরীফ-এর খিলাফ হওয়ায় মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

সুতরাং আযানের জাওয়াবে قدم বা উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব, হালওয়ানীর উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই ভুল ও অশুদ্ধ বলেই প্রমাণিত হলো। কারণ হাদীছ শরীফ-এ আযানের জাওয়াবে قدم বা উপস্থিত হওয়ার কথা বলা হয়নি। বরং হাদীছ শরীফ-এর মধ্যে قولوا শব্দটি উল্লেখ আছে।

যেমন- হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত আছে, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

اذ سمعتم الموذن فقولوا مثل ما يقول

অর্থ: ‘যখন তোমরা মুয়ায্যিনের আযান শুনবে, তখন মুয়ায্যিন যা বলে তোমরাও তা বল।’ এই বর্ণিত হাদীছ শরীফ-এর মধ্যে قولوا শব্দটি امر (আমর) এর ছিগাহ, যা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই ওয়াজিব প্রমাণিত হয়।

যেমন- এ প্রসঙ্গে ‘মুয়াত্তা ইমাম মুহম্মদ’ কিতাবের ৮৫ পৃষ্ঠার ৪ নম্বর হাশিয়ায় উল্লেখ আছে,

قوله فقولوا استدل به على وجوب اجابة المؤذن حكاه الطحاوى عن قوم من السلف وبه قال الحنيفة.

অর্থ: ‘হাদীছ শরীফ-এর ইবারতে উল্লিখিত فقولوا শব্দটির ভিত্তিতে দলীল গ্রহণ করা হয়েছে যে, মৌখিকভাবে মুয়ায্যিনের আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব। এটা হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও ছলফে-ছালিহীন রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের এক জামায়াত থেকেও বর্ণনা করেছেন।’ আর হাদীছ শরীফ-এর ইবারতে উল্লিখিত فقولوا শব্দটির ভিত্তিতে দলীল গ্রহণ করে হানাফী ফক্বীহ ও ইমামগণ বলেন, মৌখিকভাবে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব।

 

খন্দকার সেলিম আহমদ

পাহাড় কাঞ্চনপুর, টাঙ্গাইল

 

সুওয়াল: হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে, মাসিক আল বাইয়্যিনাত-অক্টোবর ২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রদত্ত “মীলাদ-ক্বিয়াম” সম্পর্কিত বক্তব্যের সমালোচনা করতে গিয়ে  এবং একই বিষয়ে এপ্রিল-২০০৫ ঈসায়ী ও মে-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় এছাড়াও মাসিক মদীনা পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে একই ধরনের জাওয়াব দেয়া হয়েছে।

তাদের বক্তব্যগুলোর মধ্যে যে বিষয়গুলো আমার নিকট সন্দেহজনক তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

যেমন, এপ্রিল-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে বলা হয়েছে, “আমাদের দেশে প্রচলিত মীলাদ ও ক্বিয়াম ইসলামী শরীয়ত পরিপন্থী; যা সম্পূর্ণভাবে মাকরূহে তাহরীমী। আইম্মায়ে মুজতাহিদীন কারো থেকে এই প্রচলিত মীলাদ ও ক্বিয়াম প্রমাণিত নয়। তাছাড়া মীলাদ ও ক্বিয়াম সম্পর্কে কোন প্রকার হাদীছও বর্ণিত নেই। ….”

এখন আমাদের সুওয়াল হলো, প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম সম্পর্কিত তাদের উল্লিখিত বক্তব্য কতটুকু দলীলসম্মত? কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াব: প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম সম্পর্কে হাটহাজারী মাদরাসার অখ্যাত মাসিক পত্রিকার জিজ্ঞাসার সমাধানে এবং অপর একটি পত্রিকার প্রশ্নোত্তর বিভাগে যা বলা হয়েছে তা শুদ্ধ তো হয়ইনি, বরং সম্পূর্ণই মিথ্যা, ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন এবং অনুসরণীয় ইমাম-মুজতাহিদ ও ফক্বীহগণের সর্বজনমান্য ও স্বীকৃত বিশ্ব বিখ্যাত ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাবসমূহের বক্তব্যের বিপরীত ও বিরুদ্ধমত। যা ইতঃপূর্বে আমাদের “মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ”-এর অনেক সংখ্যায় খ-ন করে সঠিক ও দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হয়েছে। আর “মাসিক আল বাইয়্যিনাত শীরফ”-এর জাওয়াবকে খ-ন করা হাটহাজারী মৌলভী সাহেবদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হয়নি, হবেও না ইনশাআল্লাহ। এরপরেও হাটহাজারীর মৌলভী সাহেব এবং তাদের সকল সমজাতীয়রা বার বার মীলাদ ক্বিয়াম সম্পর্কে বিনা তাহক্বীকে ও বিনা দলীলে উক্ত ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছে।

(ধারাবাহিক)

যেমন, উল্লিখিত প্রথম বক্তব্যের প্রথমেই তারা বলেছে, “আমাদের দেশে প্রচলিত মীলাদ ও ক্বিয়াম ইসলামী শরীয়ত পরিপন্থী; যা সম্পূর্ণভাবে মাকরূহে তাহরীমী।”

এর জাওয়াবে বলতে হয় যে, তাদের উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই দলীলবিহীন, ডাহা মিথ্যা ও কুফরীমূলক হয়েছে। কারণ, “আমাদের দেশে প্রচলিত মীলাদ ও ক্বিয়াম ইসলামী শরীয়ত পরিপন্থী নয়। বরং শরীয়তসম্মত, যা সম্পূর্ণভাবে সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সুন্নতে ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম-এর অন্তর্ভুক্ত। কারণ মীলাদ-ক্বিয়াম স্বয়ং নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের যামানাতেই ছিল। তবে মীলাদ শরীফ-এর তরতীব হচ্ছে সুন্নতে উম্মত ও মুস্তাহসান।”

দ্বিতীয়তঃ উল্লিখিত বক্তব্যের শেষের অংশে তারা বলেছে, “তাছাড়া মীলাদ ও ক্বিয়াম সম্পর্কে কোন প্রকার হাদীসও বর্ণিত নেই।…”

এর জাওয়াবে বলতে হয় যে, তাদের এ বক্তব্যও ডাহা মিথ্যা ও কুফরীমূলক হয়েছে। কারণ, তাদের এ বক্তব্যে এটাই প্রমাণিত হয় যে, তারা “হাদীছ শরীফকে অস্বীকার করেছে।” অথচ “হাদীছ শরীফে মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়ামের অনেক প্রমাণ রয়েছে।” যা আমরা দলীলসহ প্রমাণ করে দিয়েছি।

দ্বিতীয়তঃ ক্বিয়াম সম্পর্কেও অনেক হাদীছ শরীফ বর্ণিত আছে। শুধু তাই নয় স্বয়ং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই ক্বিয়াম করেছেন এবং ক্বিয়াম করার জন্য সরাসরি নির্দেশও দিয়েছেন।

যেমন ক্বিয়াম القيام শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে-قیام کرنا.کھڑا ہونا অর্থাৎ ক্বিয়াম করা বা দাঁড়ানো। (কামূস আল মুহীত, তাজুল উরুস, লিসানুল আরব, মিছবাহুল লুগাত, আল মুনজিদ)

আর ক্বিয়াম শব্দের ইস্তিলাহী বা পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে, আখিরী রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি ‘সালাম’ পাঠকালে তা’যীমার্থে ও মুহব্বতে ক্বিয়াম করা বা দাঁড়ানো ।

এছাড়াও মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে আলিম-উলামা, পীর-মাশায়িখ, উস্তাদ, পিতা-মাতা, দ্বীনি নেতৃস্থানীয় সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে ক্বিয়াম করা বা দাঁড়ানো সুন্নত।

যেমন, ‘মিশকাত শরীফ’ ৪০৩ পৃষ্ঠার ৭ নম্বর হাশিয়ায় ‘মিরকাত শরীফ’ ৯ম খণ্ডে ৮৫ পৃষ্ঠায় এবং ‘শরহুত ত্বীবী’ কিতাবের ৯ম খ-ের ৪৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

ان قيام المرء بين يدى الرئيس الفاضل والوالى العادل وقيام المتعلم للمعلم مستحب

অর্থাৎ “নিশ্চয়ই নেতৃস্থানীয় মর্যাদাবান ব্যক্তির ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের সামনে দাঁড়ানো এবং উস্তাদ বা শিক্ষকের জন্য ছাত্রদের দাঁড়ানো মুস্তাহাব।”

উক্ত কিতাবগুলোর উক্ত পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে যেটা হযরত ইমাম বাইহাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন-

وقال البيهقى هذا القيام يكون على وجه البر ولااكرام كما كان يام الانصار لسعد وقيام طلحة لكعب بن مالك رضى الله تعالى عنهم

অর্থ: “হযরত ইমাম বাইহাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, এই ক্বিয়াম সদ্ব্যবহার এবং সম্মানের কারণে হবে। যেমন, হযরত আনছার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ, হযরত সা’দ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর সম্মানে ক্বিয়াম করেছেন এবং হযরত কা’বা ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর সম্মানে, হযরত ত্বলহা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ক্বিয়াম করেছেন।”

‘মিশকাত শরীফ’-এর ৪০৩ পৃষ্ঠার ৭ নম্বর হাশিয়ায় ‘মিরকাত শরীফ’-এর ৯ম খণ্ডে ৮৫ পৃষ্ঠায় এবং ‘তালিকুছ ছবীহ’ কিতাবের ৫ম খ-ের ১২৯ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে-

وقاموا من تلقاء انفسهم طلبا للثوب او لارادة التواضع فلاباس به.

অর্থ: “যদি পরস্পরের সাক্ষাতে ছওয়াবের উদ্দেশ্যে অথবা বিনয়ের উদ্দেশ্যে দাঁড়ায় তাহলে এতে কোন অসুবিধা নেই।”

তাছাড়া মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী তদীয় ‘ফতওয়ায়ে রশীদিয়া’ কিতাবের ৪৫৯ পৃষ্ঠায় বলেছেন-

تعظیم دیندار کو کھرا ھونا درست ھے اور پاؤں چومنا ایسے ھی شخص کا بھی درست ھے, حدیث سے ثابت ھے.

অর্থ: “দ্বীনদার লোকের তা’যীমের জন্য দ-ায়মান হওয়া জায়িয, এরূপ লোকের পদ চুম্বন করাও জায়িয। একথা হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত।”

সুতরাং উক্ত বর্ণনার দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, আলিম, ফাজিল, উস্তাদ, ন্যায় বিচারক, সম্মানিত ব্যক্তি পিতা-মাতা, পরহিযগার আল্লাহওয়ালা ব্যক্তির আগমন এবং সম্মানে দাঁড়ানো বা ক্বিয়াম করা মুস্তাহাব ও ছওয়াবের কাজ। যদি তাই হয় তাহলে ‘মীলাদ শরীফ-এর ক্বিয়াম’ করতে নিষেধ কোথায়? বরং ‘মীলাদ শরীফ-এর ক্বিয়াম করাই মুস্তাহাব, সুন্নতে উম্মত মুস্তাহ্সান।

মুলকথা হলো, ‘ক্বিয়াম’ সম্পর্কিত উপরোক্ত বিস্তারিত আলোচনার দ্বারা যে বিষয়গুলো সাব্যস্ত হয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম হলো- সাধারণ মু’মিনগণের কবর, আল্লাহ পাক-এর ওলীগণের মাযার শরীফ এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম-এর পবিত্র রওযা শরীফ যিয়ারত করার সময় বা সালাম পেশ করার সময় ক্বিয়াম করা বা দাঁড়িয়ে সালাম দেয়াই হচ্ছে খাছ সুন্নত। অনুরূপ শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত ব্যক্তিগণের আলোচনা বা তাদের বিলাদত বা আগমনের সুসংবাদ শ্রবণ করত তা’যীম বা মুহব্বতে ক্বিয়াম করা বা দাঁড়িয়ে যাওয়াও মুস্তাহাব-সুন্নত।

সুতরাং মীলাদ শরীফে যে ক্বিয়াম করা হয় তা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিলাদত শরীফ-এর বা আগমনের সুসংবাদ শ্রবণ করত এবং তাঁর প্রতি সালাম পেশ করার উদ্দেশ্যে তা’যীমার্থে করা হয়। মোটকথা, মীলাদ শরীফ-এর ক্বিয়াম খাছ সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত।

কাজেই, মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম সম্পর্কিত হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবদের উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্যা, মনগড়া, দলীলবিহীন, কুফরী ও প্রতারণামূলক। (চলবে)

 

মুহম্মদ সুলাইমান হুসাইন, চাঁদপুর

 

সুওয়াল: মাসিক মদীনা জানুয়ারী/২০০৯ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে নিম্নোক্ত প্রশ্নোত্তর ছাপা হয়

প্রশ্ন: অসুস্থতার কারণে মহিলাদের ছুটে যাওয়া রমযানের রোযার কাযা শাওওয়ালে করার সময়, শাওওয়ালের ৬টি নফল রোযার নিয়তও করে নিলে উভয়টা আদায় হবে কিনা?

উত্তর: …….. যদি কেউ কাজা ফরজ রোযাগুলি রাখে এবং নফলগুলি আদায় করতে সমর্থ হয় না, সেও ফরয রোযার সাথে সাথে নফলের ছওয়াব পেয়ে যাবে।

এখন আমার সুওয়াল হলো- মাসিক মদীনার উক্ত উত্তর সঠিক হয়েছে কি? আর সত্যিই কি শাওওয়াল মাসের নফলগুলি না রেখে শুধুমাত্র অসুস্থতার কারণে ছুটে যাওয়া রমযানের ফরয রোযাগুলোর কাযা শাওওয়াল মাসে রাখলে ফরযের সাথে সাথে নফলের ছওয়াব পাবে কি? দয়া করে দলীল-আদিল্লাহসহ সঠিক জাওয়াব জানিয়ে আমাদের সন্দেহ দূর করবেন।

জাওয়াব: না, শাওওয়াল মাসের নফলগুলি না রেখে শুধুমাত্র অসুস্থতার কারণে ছুটে যাওয়া রমযানের ফরয রোযাগুলোর কাযা শাওওয়াল মাসে রাখলে ফরযের সাথে সাথে নফলের ছওয়াব পাওয়া সম্পর্কে মাসিক মদীনার উক্ত উত্তর সঠিক হয়নি। বরং সম্পূর্ণ ভুল, অশুদ্ধ ও দলীলবিহীন হয়েছে। কারণ শাওওয়াল মাসের নফলগুলি না রেখে শুধুমাত্র রমযানের ফরয রোযাগুলোর কাযা শাওওয়াল মাসে রাখলে কস্মিনকালেও ফরযের সাথে সাথে নফলের ছওয়াব পাবে না। কারণ এখানে দু’ধরনের রোযার কথা বলা হয়েছে।

(১) রমযান মাসে অসুস্থতার কারণে অনাদায়ী কাযা রোযা, যা ফরয রোযারই অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ ফরযের কাযা আদায় করাও ফরয।

সুতরাং রমযান মাসের রোযা মেয়েলোকের অসুস্থতার কারণে আদায় করতে না পারলে তা রমযান ব্যতীত অন্য মাসে কাযা আদায় করা ফরয। কারণ আল্লাহ পাক পাক ইরশাদ করেন-

فمن كان مريضا او على سفر فعدة من ايام اخر.

অর্থ: “অতঃপর যে অসুস্থ অথবা সফরে থাকবে, সে অন্য সময় কাযা আদায় করবে।” (সূরা বাক্বারা-১৮৫)

অর্থাৎ রমযানের কাযা আদায় করাও ফরয।

(২) শাওওয়াল মাসের ছয় রোযা, যা সুন্নতে যায়িদা বা নফল, তা রাখলে অধিক ফযীলত রয়েছে। যেমন- আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

من صام رمضان ثم اتبعه ست من شوال كان كصيام الدهر.

অর্থ: “যে ব্যক্তি রমযানের রোযা রাখার পরে শাওওয়ালের ছয় রোযা রাখবে সে যেন সারা বছরই রোযা রাখলো।” (মুসলিম শরীফ, শরহে নববী, ফতহওল মুলহীম)

এ হাদীছ শরীফ থেকে শাওওয়াল মাসের ছয়টি রোযা নফল সাব্যস্ত হয়েছে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, রমযানের কাযা রোযা আদায় করা ফরয, যা কুরআন শরীফ দ্বারা ছাবিত। আর শাওওয়াল মাসের ছয়টি রোযা আদায় করা নফল, যা হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত।

কাজেই, রমযানের ফরয রোযাগুলোর কাযা শাওওয়াল মাসে রাখলে ফরযের সাথে সাথে নফলের ছওয়াব পাওয়া যাবে একথা বলা চরম জাহিলী ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে রমযানের ফরয রোযাগুলোর কাযা শাওওয়াল মাসে রাখলে ফরয আদায় হবে, নফল আদায় হবে না এবং নফলের ছওয়াবও পাওয়া যাবে না।

অতএব, রমযানের কাযা রোযা যা কাযা আদায় করা ফরয। আর ফরযের নিয়ত দ্বারা ফরযই আদায় হবে। কিন্তু শাওওয়ালের নফল রোযা আদায় হবে না এবং ছওয়াবও পাওয়া যাবে না। কারণ একই দিনে একটি রোযাতে দু’টি রোযা আদায় হয় না। এবং একই দিনে ফরযের নিয়তে একটি রোযাতে ফরযের সাথে সাথে নফলের ছওয়াব পাওয়া যাবে না।

যেমন, এ প্রসঙ্গে ‘ফতওয়ায়ে আলমগীরী’ কিতাবের ১ম খ-ের ১৯৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

واذا نوى قضاء بعض رمضان والتطوع يقع عن رمضان.

অর্থাৎ “যদি কোন ব্যক্তি একই রোযার মধ্যে রমযানের কোন কাযা রোযা এবং শাওওয়াল মাসের বা অন্যান্য মাসের নফল রোযার নিয়ত করে রাখে তাহলে রমযানের কাযা রোযা আদায় হবে। (নফল আদায় হবে না এবং নফলের ছওয়াবও পাওয়া যাবে না)।”

আর রমযানের কাযা রোযার সঙ্গে শাওওয়ালের নফল রোযা আদায় হওয়া তো দূরের কথা এমনকি রমযানের কাযা রোযার সঙ্গে যদি মান্নতের রোযার নিয়ত করা হয় তাহলে সেক্ষেত্রেও রমযানের কাযা রোযা আদায় হবে। মান্নতের রোযা আদায় হবে না।

যেমন, ‘ফতওয়ায়ে আলমগীরী’ কিতাবের ১ম খণ্ডের ১৯৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে,

فاذا نوى عن قضاء رمضان والنذر كان عن قضاء رمضان استحسانا.

অর্থাৎ “যদি কেউ একই রোযার মধ্যে রমযানের কাযা রোযা এবং মান্নতের রোযার নিয়ত করে তবে ইস্তিহসান হিসেবে রমযানের কাযা রোযা আদায় হবে।”

এমনিভাবে যদি কেউ রমযানের কাযা রোযার সঙ্গে জিহারের কাফফারার রোযার নিয়ত করে এ ক্ষেত্রেও রমযানের কাযা রোযা আদায় হবে, জিহারের কাফফারার রোযা আদায় হবে না ।

যেমন, ‘ফতওয়ায়ে আলমগীরী’ কিতাবের ১ম খণ্ডের ১৯৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

ولو نوى قضاء رمضان وكفارة الظهار كان عن القضاء استحسانا.

অর্থাৎ “যদি কেউ একই রোযার মধ্যে রমযানের কাযা রোযা এবং জিহারের কাফফারার রোযার নিয়ত একই সঙ্গে করে তাহলে এক্ষেত্রে ইস্তিহসান হিসেবে রমযানের কাযা রোযা আদায় হবে।”

আর দু’টি সমান মর্যাদার রোযার নিয়ত একই দিনে করলে কোনটিই আদায় হবে না বরং রোযা নফল হয়ে যাবে। যেমন, রমযানের কাযা এবং হত্যার কাফফারার রোযার নিয়ত অথবা জিহারের কাফফারা রোযা এবং হত্যার কাফফারার রোযার নিয়ত একই দিনে করা হলে রোযা কোনটিই আদায় হবে না। রোযা নফল হয়ে যাবে।”

যেমন, ‘ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া’ কিতাবের ২য় খণ্ডের ৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

اور اگر کفارہ ظہار اور کفارہ قتل کی نیت کی یا قضاء رمضان اور کفارہ قتل کی نیت کی تو بالاتفاق روزہ نفل ہوگا.

অর্থ: “আর যদি কেউ একটি রোযার মধ্যে জিহারের কাফ্ফারার রোযা এবং হত্যার কাফ্ফারার রোযার নিয়ত করে অথবা রমযানের  কাযা রোযা এবং হত্যার কাফফারা রোযার নিয়ত করে তাহলে সকলের ঐক্যমতে রোযা নফল হয়ে যাবে।”

উল্লেখ্য, যদি দু’টি রোযার মধ্যে গুরুত্ব ও মর্যাদা হিসেবে একটি বড় হয় তবে বড়টিই আদায় হবে অন্যটি আদায় হবে না। যেমন রমযানের কাযা রোযা এবং শাওওয়াল মাসের বা অন্যান্য মাসের নফল রোযা অথবা নির্দিষ্ট মান্নতের রোযা ও অন্যান্য নফল রোযার নিয়ত একত্রে একই দিনে করলে রমযানের কাযা রোযা অথবা নির্দিষ্ট মান্নতের রোযা আদায় হবে। কিন্তু নফল রোযা আদায় হবে না এবং নফলের ছওয়াবও পাওয়া যাবে না।

এ প্রসঙ্গে “ফতওয়ায়ে আলমগীরী” কিতাবের ১ম খ-ের ১৯৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে-

ومتى نوى شيئين مختلفين متساويين فى الوكادة والفريضة ولا رجحان لاحدهما على الاخر بطلا ومتى ترجع احدهما على الاخر ثبت الراجح.

অর্থাৎ “যখন একই রোযার মধ্যে দু’টি সমমর্যাদা সম্পন্ন ভিন্ন ভিন্ন রোযার নিয়ত করা হয় বা ফরয ও তাকিদ সম্পন্ন তখন উক্ত রোযা দু’টি যদি একটি অপরটির উপর গুরুত্ব ও মর্যাদা হিসেবে প্রাধান্য না পায় বরং দু’টিই গুরুত্ব ও মর্যাদা হিসেবে সমান মর্যাদার হয় তাহলে দু’টি রোযাই বাতিল বলে গণ্য হবে। আর আর যখন দু’টি ভিন্ন ভিন্ন রোযা একটি অপরটির উপর গুরুত্ব ও মর্যাদা হিসেবে প্রাধান্য পাবে তখন যেটি প্রাধান্য পাবে সেটি আদায় হয়ে যাবে।”

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হলো যে, একই দিনে একত্রে দু’টি রোযার নিয়ত করলে একটি রোযা দ্বারা একই সঙ্গে কস্মিনকালেও দু’টি রোযা আদায় হবে না। বরং যে রোযাটি গুরুত্ব ও মর্যাদা হিসেবে বড় হবে সেটি আদায় হবে। আর উভয় রোযা যদি গুরুত্ব ও মর্যাদা হিসেবে সমান সমান হয় তাহলে কোনটিই আদায় হবে না। বরং রোযা নফল হিসেবে আদায় হবে।

সুতরাং রমযানের কাযা রোযা এবং শাওওয়ালের নফল রোযা একত্রে নিয়ত করে একই দিনে রাখলে শুধু রমযানের কাযা রোযা আদায় হবে, শাওওয়ালের নফল রোযা আদায় হবে না। অনুরূপভাবে শাওওয়াল মাসের নফলগুলি না রেখে শুধুমাত্র রমযানের ফরয রোযাগুলির কাযা শাওওয়াল মাসে রাখলে কস্মিনকালেও ফরযের সাথে সাথে নফলের ছওয়াব পাবে না। উপরের বিস্তারিত ও দলীলসমৃদ্ধ আলোচনা দ্বারা তা বর্ণনা করা হয়েছে।

কাজেই, নফলের নিয়ত দ্বারা ফরয অথবা ফরযের নিয়ত দ্বারা নফল আদায় হয় একথা বলা চরম জিহালতী ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে একই দিনে এক সঙ্গে ফরয ও নফল উভয়ের নিয়ত করলে ফরয আদায় হবে, নফল আদায় হবেনা  এবং একই দিনে ফরযের নিয়তে একটি রোযাতে ফরযের সাথে সাথে নফলের ছওয়াব পাওয়া যাবে না। এটাই মূল ফতওয়া। এর বিপরীত মত পোষণ করা গুমরাহী।

আরো উল্লেখ্য যে, মাসিক মদীনার সম্পাদক তার মূর্খতার কারণে বারংবার এরূপ দলীলবিহীন ভুল মাসয়ালা দিয়ে থাকে। যার কারণে তার দেয়া উত্তর শ্রবণ করা ও পালন করা থেকে বিরত থাকা সকল মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য।

অতএব, মাসিক মদীনার উক্ত দলীলবিহীন ও মনগড়া উত্তর সঠিক হয়নি এবং সে অনুযায়ী আমল করা জায়িয হবে না।

[দলীলসমূহ: ১. আহকামুল কুরআন জাস্্সাস, ২. কুরতুবী, ৩. রুহুল মায়ানী, ৪. মাযহারী, ৫. আহমদী, ৬. রুহুল বয়ান, ৭. খাযেন, ৮. বাগবী, ৯. যাদুল মাসীর, ১০. তাবারী, ১১. মুসলিম শরীফ, ১২. শরহে নববী, ১৩. ফতহুল মুলহীম, ১৪. মিশকাত, ১৫. মিরকাত, ১৬. আশয়াতুল লুময়াত, ১৭. লুময়াত, ১৮. তালীক্ব, ১৯. তীবি, ২০. মুযাহেরে হক্ব, ২১. ফতওয়ায়ে আলমগীরী, ২২. জখীরা, ২৩. সিরাজুল ওহ্হাজ, ২৪. মুহীত, ২৫. ছরখছি, ২৬. কাজীখান, ২৭. হিন্দিয়া ইত্যাদি।]

 

মুসাম্মত সানজিদা আক্তার

সভানেত্রী- ছাত্রী আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত

মুহম্মদপুর, ঢাকা।

 

সুওয়াল: অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম এপ্রিল/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-জবাব বিভাগে নিম্নোক্ত ১২৪৭ নম্বর জিজ্ঞাসার জবাব ছাপা হয়।

জিজ্ঞাসা: ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী ও আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন যে, রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আমার মৃত্যুর পর পূর্ব দেশগুলির মধ্য হতে কোন একটি দেশ হতে আমার উম্মতের ভিতর হতে একটি দল বের হবে। এই দলের সদস্যগণ হবে অশিক্ষিত ও মূর্খ। এদের মধ্যে কোন শিক্ষিত লোক গেলে সেও হয়ে যাবে মূর্খের মত। তাদের বক্তৃতা হবে বহু বহু গুণের ফযীলতের। তাদের মত বক্তৃতা বা বয়ান কারো হবে না। …… তারা কুরআনের উপর আমল কিম্বা কুরআন প্রতিষ্ঠার একটু চেষ্টাও করবে না কখনো। উক্ত অখ্যাত পত্রিকা হাদীছ শরীফ ছহীহ স্বীকার করলেও মন্তব্য করেছে যে, প্রচলিত তাবলীগের কার্যক্রম পুরোপুরি শরীয়তসম্মত। ইসলাম পরিপন্থী কোন কিছু এতে নেই।

উক্ত অখ্যাত পত্রিকার উল্লিখিত “জিজ্ঞাসা-জবাবের” প্রেক্ষিতে আমার সুওয়াল বা জানার বিষয় হলো-

…. (৪) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের পৃষ্ঠপোষকতায় বা পরিচালনায় যারা রয়েছে তারা সকলেই হক্কানী আলিম, তাদের এ দাবি কতটুকু সঠিক? আসলে হক্কানী আলিমের সংজ্ঞা বা পরিচিতি কি?

কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে উল্লিখিত সুওয়ালগুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াব: প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে উক্ত অখ্যাত পত্রিকার জবাব শুদ্ধ হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন হয়েছে।

তাই নিম্নে সুওয়ালে বর্ণিত বিষয়গুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হলো-

 

ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে প্রশ্নে উল্লিখিত

 অখ্যাত পত্রিকার অপব্যাখ্যা ও মিথ্যাচারিতার খ-নমূলক জবাব (৪)

 

প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে অখ্যাত পত্রিকার জিজ্ঞাসার জবাবের প্রেক্ষিতে আপনার চতুর্থ সুওয়াল হলো-

(৪) “প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগের পৃষ্ঠপোষকতায় বা পরিচালনায় যারা রয়েছে তারা সকলেই হক্কানী আলিম, তাদের এ দাবি কতটুকু সঠিক? আসলে হক্কানী আলিমের সংজ্ঞা বা পরিচিতি কি?

আপনার উক্ত সুওয়ালের প্রেক্ষিতে বলতে হয় যে, প্রচলিত ছয় উছূলীদের উক্ত দাবি সম্পূর্ণই অবান্তর, মিথ্যা ও দলীলবিহীন। কারণ গত দুই সংখ্যায় প্রদত্ত হক্কানী আলিমের সংজ্ঞা বা পরিচিতিমূলক আলোচনা দ্বারা অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, হক্কানী আলিম বা সত্যিকার নায়িবে নবী তিনিই (১) যিনি ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত অনুযায়ী আক্বীদা পোষণ করেন, (২) ইলমে ফিক্বাহ অর্জন করার সাথে সাথে একজন হক্কানী শায়খ বা মুর্শিদের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করে তাছাউফ চর্চা করতঃ অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহভীতি বা তাক্বওয়া অর্জন করেছেন, (৩) অর্জিত ইলম অনুযায়ী পরিপূর্ণ আমল করেন, (৪) সুন্নতের পূর্ণ  পায়রবী করেন, (৫) হারাম-নাজায়িয ও শরীয়তবিরোধী কাজে লিপ্ত হননা। কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর দৃষ্টিতে তাঁরাই আলিম বা নায়িবে নবী।

অথচ প্রচলিত ছয় উছূলীদের কথিত আলিমদের মধ্যে উল্লিখিত গুণাবলীসমূহের কোনটাই বিদ্যমান নেই। আমরা যদি উল্লিখিত পাঁচটি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করি তবে বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।

হক্কানী আলিম হওয়ার জন্য তৃতীয় শর্ত হচ্ছে-

(৩) অর্জিত ইলম অনুযায়ী পরিপূর্ণ আমল করা।

অর্থাৎ হক্কানী আলিম তিনিই যিনি ফরয, ওয়াজিব, সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ আমল বা পালন করার সাথে সাথে সুন্নতে যায়িদাহ বা মুস্তাহাবগুলোও পালন করেন। অথচ ছয় উছূলীরা সুন্নতে যায়িদাহ বা মুস্তাহাব পালন করা তো দূরের কথা বরং ফরযই সঠিকভাবে পালন করে না। এখানে প্রমাণস্বরূপ দুই একটি বিষয় উল্লেখ করা হলো। আর তাতেই মূলতঃ বিষয়টি সবার নিকট সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।

কেননা প্রবাদ রয়েছে,

العاقل تكفيه الاشارة

‘জ্ঞানীদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট।’ তাছাড়া রাঁধুনী যখন ভাত পাক করে তখন ভাত হয়েছে কিনা তা জানার জন্য কিন্তু সবগুলো ভাত টিপ দেয়না বরং দুই একটি ভাত টিপলেই বুঝা যায় যে, ভাত হয়েছে কিনা।

অনুরূপভাবে কেউ ভ-, প্রতারক, নাহক্ব কিনা তা বুঝার জন্য সেই ব্যক্তির সারা জীবনের সব আমল দেখার প্রয়োজন নেই দুই একটি আমলই যথেষ্ট। কাজেই, ছয় উছূলীদের কথিত মাওলানারা যে হক্কানী আলিম নয় তা বুঝার জন্যও নিম্নে উল্লিখিত দুটি বিষয়ই যথেষ্ট।

১.   ছয় উছূলীদের অধিকাংশই খাছ শরয়ী পর্দা করেনা। তাদের কথিত ইস্তেমায়ও বেপর্দার ছড়াছড়ি। যা তারা কখনোই অস্বীকার করতে পারবে না। অথচ পর্দা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফরয আমল।

কুরআন শরীফে “সূরা নিসা, সূরা নূর ও সূরা আহযাব” সূরাসমূহে পর্দা করার ব্যাপারে আদেশ-নির্দেশ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-

قل للمؤمنين يغضوا من ابصارهم ويحفظوا فروجهم ذلك ازكى لهم ان الله خبير بما يصنعون. وقل للمؤمنت يغضضن من ابصارهن ويحفظن فروجهن ولا يبدين زينتهن.

অর্থঃ- “(হে হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনি মু’মিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের ইজ্জত-আবরু হিফাযত করে। এটা তাদের জন্য পবিত্রতার কারণ। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক তারা যা করে তার খবর রাখেন। আর আপনি মু’মিনাদেরকে বলুন, তারাও যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের ইজ্জত-আবরু হিফাযত করে ও তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে।” (সূরা নূর-৩০,৩১)

হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

عن بريدة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لعلى يا على لا تتبع النظرة النظرة فان لك الاولى وليست لك الاخرة.

অর্থ: “হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, হে আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু দৃষ্টিকে অনুসরণ করবেননা। প্রথম দৃষ্টি (যা অনিচ্ছা সত্ত্বে পতিত হয় তা) ক্ষমা করা হবে; কিন্তু পরবর্তী দৃষ্টি ক্ষমা করা হবে না।” অর্থাৎ প্রতি দৃষ্টিতে একটি কবীরা গুনাহ লেখা হয়ে থাকে। (আহমদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, দারিমী, মিশকাত)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

عن الحسن مرسلا قال بلغنى ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال لعن الله الناظر والمنظور اليه.

অর্থ: “হযরত ইমাম হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি মুরসাল সূত্রে বর্ণনা করেন, আমার নিকট এই হাদীছ শরীফ পৌঁছেছে, যে দেখে এবং দেখায় তার প্রতি আল্লাহ পাক-এর লা’নত।” (বাইহাক্বী, মিশকাত)

অর্থাৎ আল্লাহ পাক কালাম পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হাদীছ শরীফ দ্বারা সরাসরি পর্দাকে ফরয করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয় বরং চোখের দৃষ্টিসহ সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে হিফাযত করে পর্দা করতে বলেছেন।

এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

عن ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم العينان زناهما النظر والاذنان زناهما الاستماع واللسان زناه  الكلام واليد زناها البطش والرجل زناها الخطى والقلب يهوى ويتمنى ويصدق ذلك الفرج ويكذبه.

অর্থ: “হযরত আবু হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “চোখের ব্যভিচার হলো দৃষ্টি করা, কানের ব্যভিচার হলো শ্রবণ করা, মুখের ব্যভিচার হলো কথা বলা, হাতের ব্যভিচার হলো স্পর্শ করা, পায়ের ব্যভিচার হলো ধাবিত হওয়া, অন্তর চায় ও আকাঙ্খা করে এবং লজ্জাস্থান সেটাকে সত্য অথবা মিথ্যায় প্রতিপন্ন করে।” (বুখারী, মুসলিম, কানযুল উম্মাল)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

الديوث لايدخل الجنة

অর্থ: “দাইয়্যূছ বেহেশ্তে প্রবেশ করতে পারবেনা।” দাইয়্যূছ ঐ ব্যক্তি যে নিজে পর্দা করেনা এবং তার অধীনস্ত মহিলাদেরকেও পর্দা করায়না।” (মুসনাদে আহমদ)

অর্থাৎ যারা বেপর্দা হয়ে থাকে হাদীছ শরীফের বর্ণনা মুতাবিক তারা সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা অবৈধ কাজ তথা ব্যভিচারে মশগুল বা লিপ্ত।

পর্দার গুরুত্ব সম্পর্কে আরো উল্লেখ্য যে, আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন,

النبى اولى بالمؤمنين من انفسهم وازواجه امهتهم.

অর্থ: “আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মু’মিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর আহলিয়াগণ তাদের মাতা।” (সূরা আহযাব-৬)

ما كان لكم ان تؤذوا رسول الله ولا ان تنكحوا ازواجه من بعده ابدا ان ذلكم كان عند الله عظيما.

অর্থ: “আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেয়া এবং তাঁর বেছাল শরীফের পর তাঁর আহলিয়াগণকে আক্বদ করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। আল্লাহ পাক-এর কাছে এটা গুরুতর অপরাধ।”  (সূরা আহযাব-৫৩)

স্মরণীয় যে, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আহলিয়াগণ হচ্ছেন মু’মিনগণের মাতা। যাদেরকে আক্বদ করা বা আক্বদের চিন্তা করাটাও উম্মতের জন্য হারাম ও কুফরী এবং সেটা আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেয়ার শামিল এবং স্বয়ং আল্লাহ পাক-এর কাছে গুরুতর অপরাধ অর্থাৎ কুফরী। তারপরও উম্মুল মু’মিনীনগণ যে কিরূপ পর্দা করেছেন তা নিম্নোক্ত হাদীছ শরীফ হতে অনুধাবন করা যায়।

যেমন হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

عن ام سلمة رضى الله تعالى عنها انها كانت عند رسول الله صلى الله عليه وسلم وميمونة رضى الله عنهما اذ اقبل ابن ام مكتوم فدخل عليه فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم احتجبا منه فقلت يا رسول الله صلى الله عليه وسلم ا ليس هو اعمى لا يبصرنا فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم افعمياوان انتما الستما تبصرانه.

অর্থ: “হযরত উম্মু সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হতে বর্ণিত। একবার তিনি এবং হযরত মাইমূনা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা হযরত রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে বসা ছিলেন। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন অন্ধ ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। হযরত রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মুল মু’মিনীনগণকে বললেন, আপনারা দু’জন তাঁর হতে পর্দা করুন। আমি বললাম: ইয়া রসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! তিনি কি অন্ধ নন? তিনি তো আমাদেরকে দেখতে পাচ্ছেন না। উত্তরে হযরত রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আপনারাও কি অন্ধ? আপনারাও কি তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন না?” (মুসনাদে আহমদ, আবূ দাঊদ)

এখানে ফিকিরের বিষয় যে, কুরআন শরীফে ‘যাদেরকে ‘মু’মিনগণের মা’ বলা হয়েছে, যাদের ব্যাপারে অন্তরে কোন প্রকার খারাপ চিন্তাও উদয় হওয়া সম্ভব নয়। তাদেরকেও পর্যন্ত আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্দা করার জন্য কঠোর তাকিদ দিয়েছেন।  তাহলে সাধারণ লোকের জন্য পর্দার কতটুকু গুরুত্ব রয়েছে তা চিন্তা-ফিকিরের বিষয়। অর্থাৎ ইসলামে পর্দা করা ফরয। বেপর্দা  হওয়া শক্ত হারাম ও কবীরা গুনাহ।

কাজেই, যারা শরীয়তের একটি গুরুত্বপুর্ণ ফরয পর্দা সঠিকভাবে পালন করে না বরং পর্দার হুকুম চরমভাবে লঙ্ঘন করে থাকে তারা আবার হক্কানী আলিম হয় কিভাবে? (চলবে)

 

মুহম্মদ রফিকুল ইসলাম

সদর, চাঁদপুর

 

সুওয়াল: ধর্মব্যবসায়ীদের মাদ্রাসাতে তথা জঙ্গি তৈরিকারী মাদ্রাসাগুলোতে কুরবানীর চামড়া দেয়া জায়িয হবে কি?

জাওয়াব: ধর্মব্যবসায়ীদের মাদ্রাসাতে তথা জঙ্গি তৈরিকারী মাদ্রাসাগুলোতে কুরবানীর চামড়া দেয়া জায়িয হবে না। কুরবানীর চামড়া দেয়ার উত্তম স্থান হলো ‘মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ’।

কুরবানী প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-

فصل لربك وانحر

অর্থ: আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামায আদায় করুন এবং কুরবানী করুন।” (সূরা কাওছার-২)

আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন-

لكل امة جعلنا منسكا هم ناسكوه فلا ينازعنك فى الامر

অর্থ: “প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি যবেহ্র বিধান দিয়েছিলাম যা তারা অনুসরণ করে। সুতরাং আপনার সাথে এ ব্যাপারে বিতর্কে প্রবৃত্ত হওয়া তাদের উচিত নয়।” (সূরা হজ্জ-৬৭)

কুরবানী একটি ঐতিহ্যবাহী শরয়ী বিধান ও ইসলামী কাজ। যা উম্মতে হাবীব ছল্ল্াল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য ওয়াজিব। কাজেই কুরবানী দেয়ার সাথে সাথে কুরবানীর চামড়া সঠিক স্থানে দেয়াও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

উল্লেখ্য, কুরআন শরীফে সবস্থানে আল্লাহ পাক আগে ‘ঈমান’ আনার কথা বলেছেন পরে ‘আমলের’ কথা বলেছেন।

এক খোদা তায়ালাকে প্রায় সবাই মানে কিন্তু হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে না মানার কারণেই অর্থাৎ আক্বীদার পার্থক্যের কারণেই পৃথিবীতে মুসলমান ব্যতীত হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদি হাজারো বিধর্মী তথা কাফিরের দল রয়েছে। কুরআন শরীফের ভাষায় তারা সবাই জাহান্নামী যদি তওবা-ইস্তিগফার করে ঈমান না আনে।

স্মরণীয় যে, শুধু কাফির সম্প্রদায়ই নয়, মুসলমান নামধারী অনেক মাওলানা, মুফতী,  মুহাদ্দিছ, মুফাস্সির, শাইখুল হাদীছ, ইমাম, খতীব তথা অনেক ইসলামী দলও রয়েছে যাদের মূলতঃ আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে আক্বীদা খারাপ রয়েছে। কাজেই তারা মুসলমান নামধারী হলেও তারা মুসলমানের অন্তর্ভুক্ত নয়। তারা ইসলামী দল নামধারী হলেও আসলে তারা ইসলামী দলের অন্তর্ভুক্ত নয়।

উল্লেখ্য, ইসলামে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ হারাম। ইসলামের নামে ব্যবসা করা হারাম। ইসলামের নামে গণতান্ত্রিক দল করা হারাম। ইসলামের নামে নির্বাচন করা হারাম। ইসলামের নামে ভোট চাওয়া হারাম।

আরো উল্লেখ্য, বর্তমানে অধিকাংশ মাদ্রাসাগুলোই হচ্ছে জামাতী, ওহাবী, খারিজী মতাদর্শের তথা জঙ্গি তৈরির সুতিকাগার। ইসলামের দোহাই দিয়ে, ইসলামের নামে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক স্বার্থ ও প্রতিপত্তি হাছিলের প্রকল্প। ইসলামের নামে নির্বাচন করার ও ভোটের রাজনীতি করার পাঠশালা- যা ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম।

কাজেই, কুরবানীর চামড়া কোথায় দেয়া হচ্ছে তা দেখে দিতে হবে। জামাতী, খারিজী, ওহাবী ও জঙ্গি-মৌলবাদী তথা ধর্মব্যবসায়ীদের মাদ্রাসাতে কুরবানীর চামড়া দিলে তা কস্মিনকালেও জায়িয হবে না।

জামাতী, ওহাবী তথা জঙ্গিদের মাদ্রাসায় কুরবানীর চামড়া দিলে তাতে বদ আক্বীদা ও বদ আমলের প্রচারে সহায়তা করা হবে। জঙ্গি-জামাতী ও ধর্মব্যবসায়ী তৈরিতে সাহায্য করা হবে। তাতে লক্ষ-কোটি কবীরাহ গুনাহে গুনাহগার হতে হবে।

মূলতঃ ধর্মব্যবসায়ীদের মাদ্রাসায় কুরবানীর চামড়া, যাকাত-ফিতরা ইত্যাদি দান-ছদকা না দেয়া আল্লাহ পাক-এর নির্দেশ। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশ তথা সন্তুষ্টির কারণ।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে নির্দেশ করেন-

تعاونوا  على البر والتقوى ولا تعاونوا على الاثم والعدوان واتقوا الله ان الله شديد العقاب.

অর্থ: ‘তোমরা নেক কাজে পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করো। বদ কাজে পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করো না। আর এ বিষয়ে আল্লাহ পাককে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক কঠিন শাস্তিদাতা’ (সূরা মায়িদা-২)

আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

 عن جرير رضى الله تعالى عنه قال قال النبى صلى الله عليه وسلم من سن فى الاسلام سنة سيئة كان عليها وزرها و وزر من عمل بها من بعده.

অর্থ: “হযরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে কেউ একটা বদ কাজের সূচনা করলো যতজন তাতে শরীক হলো তাদের সবার গুনাহ যে বদকাজের সূচনা করেছে তার উপর গিয়ে পড়বে।” (মুসলিম, মিশকাত)

পত্রিকার রিপোর্টে পাওয়া যায়, জামাতী-খারিজীরা তাদের নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসায় সংগৃহীত যাকাত, ফিতরা, কুরবানীর চামড়ার মাধ্যমে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা আয় করে। যা মূলতঃ তাদের বদ আক্বীদা ও বদ আমল তথা ধর্মব্যবসার কাজেই ব্যয়িত হয়।

অনুরূপভাবে কোন জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনকেও কুরবানীর চামড়া দেয়া জায়িয হবে না। কারণ তারা তা আমভাবে খরচ করে থাকে। যেমন রাস্তা-ঘাট, পানির ব্যবস্থা, বেওয়ারিশ লাশ দাফন করার কাজে। অথচ কুরবানীর চামড়া গরীব মিসকীনদের হক্ব। তা গরীব মিসকিনদের মালিক করে দিতে হবে।

আফদ্বালুন নাস বা’দাল আম্বিয়া হযরত আবু বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যাকাতের একটি রশির জন্যও জিহাদ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। কাজেই, যাকাতের একটি রশির মতই কুরবানীর একটি চামড়াও যাতে ভুল উদ্দেশ্যে ও ভুল পথে পরিচালিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “কুরবানীর রক্ত ও গোশত কিছুই আল্লাহ পাক-এর দরবারে পৌঁছায় না। পৌঁছায় তোমাদের বিশুদ্ধ নিয়ত।“ কাজেই বিশুদ্ধ নিয়তে কুরবানীর চামড়া ঠিক জায়গায় দিতে হবে। অনেকে পাড়ার মাস্তান, গু-া-পা-া, ছিনতাইকারী ও হিরোইনখোরদের ভয়ে বা হাতে রাখার উদ্দেশ্যে তাদেরকে কম দামে কুরবানীর চামড়া দেয়। এতে কিন্তু নিয়ত বিশুদ্ধ হবে না এবং কুরবানীও আদায় হবে না।

তাই বর্তমান হিজরী শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, যামানার মুজতাহিদ ও ইমাম, ইমামুল আইম্মাহ, মুহ্ইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, হুজ্জাতুল ইসলাম, সাইয়্যিদুল আওলিয়া, আওলাদে রসূল, মুজাদ্দিদে আ’যম ইমাম রাজারবাগ শরীফ-এর হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী বলেছেন, বর্তমানে হক্ব মত-পথ ও সুন্নতী আমলের একমাত্র ও উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো, ‘মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ’।

কাজেই, যাকাত-ফিতরা বা কুরবানীর চামড়া দিয়ে যারা ছদকায়ে জারীয়ার ছওয়াব হাছিল করতে চায় তাঁদের জন্য একমাত্র ও প্রকৃত স্থান হলো ‘মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ’ ৫ নং আউটার সার্কুলার রোড, রাজারবাগ শরীফ, ঢাকা।

মুহম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন শিশির

মুহম্মদপুর, ঢাকা

 

সুওয়াল: আমরা জানি, ছবি তোলা হারাম এবং বেপর্দা হওয়াও হারাম। কিন্তু বর্তমানে পুরুষ ও মহিলাকে হজ্জ করতে হলে বিশেষ করে এ দু’টি হারাম কাজের শিকার হতে হয়। এমতাবস্থায় হজ্জ করার ক্ষেত্রে শরীয়তের কি হুকুম? জানতে ইচ্ছুক।

জাওয়াব: স্বয়ং আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন তাঁর কালাম পাকে এবং স্বয়ং আল্লাহ পাক-এর হাবীব রহমাতুল্লিল আলামীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হাদীছ পাকে হজ্জের বিধি-বিধান সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। সেই সমষ্টিগত বর্ণনা থেকে আখিরী উম্মতগণের প্রতি জীবনে একবার হজ্জ করা ফরয সাব্যস্ত হয়েছে। এবং এ ক্ষেত্রে শর্ত করা হয়েছে পথের সামর্থ্য ও নিরাপত্তার।

পথের সামর্থ্য বলতে “সাংসারিক প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পর হজ্জে যাওয়া ও ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণের অতিরিক্ত সম্বল ও পাথেয় থাকা এবং যানবাহনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা থাকা।” আর পথের নিরাপত্তা বলতে সুস্থ্য থাকা এবং জান-মাল, ঈমান ও আমলের নিরাপত্তা থাকা।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-

ولله على الناس حج البيت من استطاع اليه سبيلا.

অর্থঃ “আল্লাহ পাক-এর জন্যেই মানুষের প্রতি হজ্জ করা ফরয যার পথের সামর্থ্য ও নিরাপত্তা রয়েছে।” (সূরা আলে ইমরান-৯৭)

আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন-

فمن فرض فيهن الحج فلا رفث ولا فسوق ولا جدال فى الحج.

অর্থঃ “যে ব্যক্তির প্রতি হজ্জ ফরয সে যেন হজ্জ পালন করতে গিয়ে নির্জনবাস ও তার সংশ্লিষ্ট কোন কাজ না করে এবং কোন প্রকার ফাসিকী বা নাফরমানীমূলক কাজ না করে এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে।” (সূরা বাক্বারা-১৯৭)

আয়াত শরীফে স্পষ্টরূপে বলা হয়েছে যে, হজ্জ করতে গিয়ে যদি ঈমান ও আমলের নিরাপত্তা না থাকে তথা হজ্জ করতে গিয়ে যদি কাউকে হারাম ও কুফরী কাজ করতে হয় তাহলে তার উপর হজ্জ ফরয হবে না। যেমন ছবি তোলা, পর্দা লঙ্ঘণ করা উভয়টি শক্ত হারাম ও কবীরা গুনাহ এবং চরম ফাসিকী ও নাফরমানীমূলক কাজ। সুতরাং হজ্জের অজুহাতে এই হারাম ও নাফরমানীমূলক কাজ করা কখনই শরীয়তসিদ্ধ নয়। বরং সর্বক্ষেত্রে হারাম কাজ হতে বিরত থাকার সাথে সাথে হারাম কাজে বাধা প্রদান করাও প্রত্যেক মু’মিন-মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব।

এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোন অন্যায় কাজ সংঘটিত হতে দেখে সে যেন তা হাত দ্বারা বাধা দেয়। যদি সে তা হাত দ্বারা বাধা দিতে না পারে তাহলে সে যেন যবান দ্বারা বাধা দেয়। যদি যবানের দ্বারাও বাধা দিতে না পারে তাহলে যেন অন্তরে তা ঘৃনা করে দূরে সরে থাকে। আর এটাই সবচেয়ে দূর্বল ঈমানের পরিচয়। এরপর ঈমানের আর শরিষা পরিমাণও অবশিষ্ট নেই। (মুসলিম শরীফ)

অর্থাৎ ক্ষমতা থাকলে প্রথমতঃ শক্তি বা বল প্রয়োগ করে ছবি ও বেপর্দা বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ সেই ক্ষমতা যদি না থাকে তাহলে যবানে বা মুখে বলতে হবে বা জানিয়ে দিতে হবে যে, ছবি তোলা, বেপর্দা হওয়া হারাম। হজ্জসহ সর্বক্ষেত্রে ছবি তোলা ও বেপর্দা হওয়া হারাম ও কবীরা গুনাহ। জায়িয মনে করা কুফরী। কাজেই মক্কা শরীফ, মদীনা শরীফ এবং হজ্জের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল স্থান থেকে সি.সিটিভি ও ক্যামেরা সরিয়ে নেয়া হোক। তৃতীয়তঃ যদি যবানে বলার ক্ষমতাও না থাকে তাহলে ছবি তোলা ও বেপর্দা হওয়াকে অন্তর থেকে হারাম ও গুনাহর কাজ স্বীকার করে তা থেকে দূরে সরে থাকতে হবে। আর এটা হচ্ছে একেবারে দূর্বল ঈমানদারের পরিচয়। এরপরে ঈমানের আর কোন স্তর নেই। অর্থাৎ যারা হাতেও বাধা দিবে না, যবানেও প্রতিবাদ করবে না এবং সেই হারাম কাজকে অন্তরে খারাপ জেনে বিরত বা দূরেও সরে থাকবে না বরং সেটাকে সমর্থন করবে এবং তাতে জড়িত হবে হাদীছ শরীফ মোতাবেক তাদের ঈমান নেই। তাহলে ছবি তুলে ও বেপর্দা হয়ে হজ্জ করা কি করে জায়িয হতে পারে?

অতএব, কেউ যদি সত্যিই শরীয়তের নির্দেশ অনুযায়ী হজ্জ কতে চায় তাহলে তাকে আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ঘোষণাকৃত ছবি তোলা ও বেপর্দাসহ সর্বপ্রকার হারাম কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি হজ্জ করতে গিয়ে ছবি তোলা, বেপর্দা হওয়া অথবা অন্য কোন হারাম কাজে জড়িত হতে হয় তাহলে হজ্জ ফরয হবে না। যেমন কোন মহিলা যদি সারা পৃথিবীর মালিকও হয়, আর তার যদি কোন মাহ্রাম পুরুষ না থাকে তাহলে তার উপর হজ্জ ফরয হবে না। কারণ মাহ্রাম পুরুষ ব্যতীত হজ্জে গেলে তার দ্বারা হারাম কাজ হওয়ার আশঙ্কা বিদ্যমান।

কেউ কেউ কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে বলে, “জরুরত বা মা’জুরতার কারণে হারামটা মুবাহ হয়ে যায়। তাই হজ্জের জন্য ছবি তুললে  কোন গুণাহ হবে না। কারণ তা জরুরতবশতঃ তোলা হয়। এর জবাবে বলতে হয় যে, হজ্জের ক্ষেত্রে তাদের উক্ত বক্তব্য আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ হজ্জের জন্য ছবি তোলাটা কখনই মা’জুরের পর্যায়ে পড়ে না। কেননা হজ্জ করার জন্য সরকার বা অন্য কারো পক্ষ থেকে বাধ্য করা হয়নি এবং ঈমান ও আমলের নিরাপত্তা না থাকায় যেখানে হজ্জই ফরয নয় সেখানে কি করে সে মা’জুর হলো? এখন কোন মহিলা যদি বলে, আমার সম্পদ রয়েছে কিন্তু মাহরাম নেই এক্ষেত্রে আমি মা’জুর, সুতরাং মাহরাম ছাড়াই হজ্জ করবো। তার এ কথা কি শরীয়তে গ্রহণযোগ্য হবে? কস্মিনকালেও নয়। কারণ মাহ্রাম ছাড়া তার উপর হজ্জ ফরয নয়। আর যদি হজ্জ ফরয না হয় তাহলে সে মা’জুর হলো কি করে? বরং কোন সরকারের পক্ষ থেকে হজ্জের ক্ষেত্রে ছবি তোলাকে আবশ্যক করাটা হজ্জের ফরয সাকিত বা রহিত হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম একটি কারণ বা বাধা। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

عن ابى امامة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من لم يمنعه من الحج حاجة ظاهرة او سلطان جائر او مرض حابس.

অর্থঃ “হযরত আবূ উমামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কোন ব্যক্তির হজ্জ ফরয হওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধকারী বিষয় হচ্ছে- প্রকাশ্য বাধা অথবা অত্যাচারী শাসক অথবা গুরুতর অসুখ।” (মাছাবীহুস সুন্নাহ, দারিমী, মিশকাত, মিরকাত)

অর্থাৎ, কোন ব্যক্তির হজ্জ করার সামর্থ না থাকলে অথবা অত্যাচারী শাসকের কারণে জান-মাল, ঈমান ও আমলের নিরাপত্তা না থাকলে অথবা কঠিন অসুস্থতা থাকলে তার উপর হজ্জ ফরয হবে না। অর্থাৎ হজ্জের ফরয সাকিত হয়ে যাবে। (দলীলসমূহঃ সমূহ হাদীছ শরীফ, তাফসীর শরীফ ও ফিক্বাহর কিতাব দ্রষ্টব্য)

মুহম্মদ আল আমীন

ঘোড়াশাল, নরসিংদী

সুওয়াল:   কুরবানী কার উপর ওয়াজিব?

জাওয়াব:  যিলহজ্ব মাসের দশ, এগার, বার অর্থাৎ দশ তারিখের সুবহে সাদিক হতে বার তারিখের সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যদি কেউ মালিকে নিসাব হয় অর্থাৎ হাওয়ায়েজে আসলিয়াহ্ (নিত্য প্রয়োজনীয় ধন-সম্পদ) বাদ দিয়ে সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা বা তার সমপরিমাণ মূল্যের মালিক হয়, তাহলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব। উল্লেখ্য যে, যদি কারো নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থাকে এবং তা যদি নিসাব পরিমাণ হয়, যেমন- কারো পাঁচটি ঘর আছে, একটির মধ্যে সে থাকে আর তিনটির ভাড়া দিয়ে সে সংসার চালায় আর একটি অতিরিক্ত, যার মূল্য নিসাব পরিমাণ। এ ক্ষেত্রে তার উপরে কুরবানী ওয়াজিব হবে। {দলীলসমূহঃ- (১) আলমগীরী, (২) শামী, (৩) আইনুল হিদায়া, (৪) ফতহুল কাদীর, (৫) গায়াতুল আওতার, (৬) শরহে বিকায়া, (৭) বাহর, (৮) দুররুল মুখতার, (৯) কাজীখান, (১০) ইনায়া ইত্যাদি।}

মুহম্মদ গোলাম রব্বানী, রাজশাহী।

সুওয়াল:   ওয়াজিব ও নফল কুরবানী, ওলীমা ও  আক্বীকা এক সাথে জায়িয হবে কিনা? জাওয়াব:   হ্যাঁ, জায়িয হবে।  {দলীলঃ- শামী, আলমগীরি ইত্যাদি।}

মুহম্মদ মিজানুর রহমান, চাঁদপুর।

সুওয়াল:   আইয়ামে নহর বা কুরবানীর দিনে কুরবানীর পশু কুরবানীকরার পূর্বে অথবা কুরবানীকরার সময়ে হাঁস, মুরগী, কবুতর ইত্যাদি যবেহ্ করা জায়িয আছে কি? জাওয়াব: মুসলমানদের আইয়ামে নহর বা কুরবানীর দিনে যারা মজুসী বা অগ্নী উপাসক তারা তাদের ধর্মীয় বিধান মুতাবিক হাঁস-মুরগী ইত্যাদি যবেহ্ করে থাকে। এখন যদি কোন মুসলমান তাদের সাথে মুশাবা বা সাদৃশ্য রেখে কোরবানীর দিন হাঁস-মুরগী ইত্যাদি যবেহ্ করে, তাহলে সেটা কুফরী হবে। কারণ আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

من تشبه بقوم فهو منهم.

অর্থ: “যে, যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে, সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত।”

আর যদি কোন মুসলমান সাধারণভাবে উক্ত সময়ে হাঁস-মুরগী ইত্যাদি যবেহ্ করে, তাহলে সেটা মাকরূহ্ তাহ্রীমী হবে, যেহেতু এটাও মোশাবাহ্ হয়ে যায়।

আর যদি কোন মুসলমান খুব জরুরতে হাঁস-মুরগী ইত্যাদি যবেহ্ করে, তাহলে সেটাও মাকরূহ্ তান্যিহী হবে। আর এমন কোন মুসলমান, যার উপর কুরবানী ওয়াজিব অথবা ওয়াজিব নয়, তারা যদি কুরবানীর দিন হাঁস, মুরগী ইত্যাদি খেতে চায়, তাহলে তারা যেন সুব্হে সাদিকের পূর্বেই সেটা যবেহ্ করে, কেটে, পাক করে রেখে দেয় অথবা শুধু যবেহ্ করে, কেটে রেখে দিবে পরে পাক করলেও চলবে।  (এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ৪৪, ৭০, ৭৯, ১০৭, তম সংখ্যাগুলো পাঠ করুন।)

{দলীলসমূহঃ শামী, আলমগীরি, ফতহুল ক্বাদীর, শরহে হিদায়া ইত্যাদি।}

মুসাম্মত সোলেমা, মুসাম্মত পান্না, রংপুর

সুওয়াল:  হালাল পশুর কোন কোন অংশ খাওয়া নিষিদ্ধ? জাওয়াব:  কুরবানীবা হালাল পশুর ৮টি জিনিস খাওয়া যাবেনা। (১) দমে মাছফুহা বা প্রবাহিত রক্ত হারাম, (২) অন্ডকোষ, (৩) মুত্রনালী, (৪) পিত্ত, (৫) লিঙ্গ, (৬) গুহ্যদ্বার, (৭) গদুদ বা গুটলী মাকরূহ্ তাহ্রীমী, (৮) শিরদাড়ার ভিতরের মগজ, এটা কেউ মাকরূহ্ তাহ্রীমী, আবার কেউ মাকরূহ্ তান্যিহী বলেছেন। {দলীলসমূহঃ শামী, মাতালেবুল মু’মিনীন, উমদাতুল কালাম, কিতাব- শাইখুল ইসলাম ইত্যাদি।”

মুহম্মদ সিরাজুল ইসলাম, কক্সবাজার।

সুওয়াল:    কুরবানীর পশু যবেহ করার পূর্বে চামড়া বিক্রি করা জায়েয আছে কি? জাওয়াব:  কুরবানীর পশু অথবা অন্য যে কোন হালাল পশুই হোক, তা জবেহ্ করার পূর্বে চামড়া বিক্রি করা জায়িয নেই। এমনিভাবে বাঁটে দুধ থাকতে, ঝিনুকে মুক্তা থাকতে, মেষের পিঠে লোম থাকতে, সে দুধ, মুক্তা, লোম বিক্রি করা নাজায়িয। (ফতওয়ায়ে শামী)

মুহম্মদ উমর ফারুক, চাঁদপুর।

সুওয়াল:   কুরবানীর কিছুদিন আগে নাকি হাত ও পায়ের নখ কাটা, মোছ ছাটা এবং মাথার চুল ইত্যাদি কাটা যায় না? কুরবানী করার পর কাটতে হয়! কথাটা কতটুকু সত্য? বিস্তারিত জানাবেন। জাওয়াবঃ  হ্যাঁ, যারা কুরবানী দেয়ার নিয়ত রাখেন, তাদের পক্ষে যিলহজ্বের চাঁদ ওঠার পর থেকে এই চাঁদের দশ তারিখ কুরবানীকরা পর্যন্ত মাথার চুল হাতের ও পায়ের নখ ইত্যাদি না কাটা মুস্তাহাব। যেমন হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

عن ام سلمة رضى الله تعالى عنها قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من راى هلال ذى الحجة و اراد ان يضحى فلا ياخذ من شعره ولا من اظفاره.

 অর্থঃ- “হযরত উম্মে সালমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হতে বর্ণিত, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখলো এবং কুরবানী করার নিয়ত করলো, সে যেন (কুরবানীনা করা পর্যন্ত) তার শরীরের চুল, নখ ইত্যাদি না কাটে।” (মুসলিম শরীফ)

মূলতঃ ছহীহ্ ও গ্রহণযোগ্য মত হলো এই যে, যারা কুরবানীকরবে এবং যারা কুরবানী করবেনা, তাদের উভয়ের জন্যই উক্ত আমল মুস্তাহাব ও ফযীলতের কারণ। আর এ ব্যাপারে দলীল হলো এ হাদীছ শরীফ- যেমন হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে,

عن عبد الله بن عمرو رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم امرت بيوم الاضحى عيدا جعله الله لـهذه الامة قال له رجل يا رسول الله صلى الله عليه وسلم ارايت ان لم اجد الا منيحة انثى افاضحى بـها قال لا ولكن خذ من شعرك واظفارك وتقص شاربك وتحلق عانتك فذلك تمام اضحيتك عند الله.

অর্থঃ- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আমি কুরবানীর দিনকে ঈদের দিন হিসেবে নির্ধারণ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। আল্লাহ পাক উক্ত দিনটিকে এই উম্মতের জন্য ঈদ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। এক ব্যক্তি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলো, হে আল্লাহ পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি যদি একটি মাদী মানীহা (উটনী) ব্যতীত অন্য কোন পশু কুরবানীর জন্য না পাই, তাহলে আপনি কি (আমাকে) অনুমতি দিবেন যে, আমি উক্ত মাদী মানীহাকেই কুরবানী করবো। জবাবে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, না। তুমি উক্ত পশুটিকে কুরবানী করবে না। বরং তুমি কুরবানীর দিনে তোমার (মাথার) চুল ও হাত-পায়ের নখ কাটবে। তোমার গোঁফ খাট করবে এবং তোমার নাভীর নীচের চুল কাটবে, এটাই আল্লাহ্ পাক-এর নিকট তোমার পূর্ণ কুরবানী অর্থাৎ এর দ্বারা তুমি আল্লাহ্ পাক-এর নিকট কুরবানীর পূর্ণ ছওয়াব পাবে।” (আবু দাউদ শরীফ)

উক্ত হাদীছ শরীফের ব্যাখ্যায় উল্লেখ আছে যে, যারা কুরবানী করবে না, তাদের জন্যও যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী করার আগ পর্যন্ত নিজ শরীরের চুল, নখ ইত্যাদি না কাটা মুস্তাহাব। আর যে ব্যক্তি তা কাটা থেকে বিরত থাকবে, সে একটি কুরবানীর ছওয়াব পাবে। {দলীলসমূহঃ- নাসায়ী, মিশকাত, শরহে নববী, বজলুল মাযহুদ, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তা’লীকুছ্ ছবীহ্, মুযাহেরে হক্ব ইত্যাদি।}

মুহম্মদ কবীর হুসাইন, বরিশাল

সুওয়ালঃ অনেকে বলে থাকে, সন্তানের নামে যে পশু আক্বীকা দেয়া হয়, তার গোশ্ত পিতা-মাতা খেতে পারবে না, এটা শরীয়তসম্মত কি না? জানালে খুশী হবো।

জাওয়াবঃ যারা বলে, সন্তানের নামে যে পশু আক্বীকা দেয়া হয় তার গোশ্ত পিতা-মাতা খেতে পারবে না তাদের সে কথা শরীয়ত সম্মত নয়। শরীয়তের মাসয়ালা হলো, আক্বীকার পশুর গোশতের হুকুম কুরবানীর পশুর গোশতের হুকুমের মত। কাজেই, সন্তানের নামে যে পশু আক্বীকা দেয়া হবে তার গোশত পিতা-মাতাসহ সকলেই খেতে পারবে। এটাই শরীয়তসম্মত মাসয়ালা বা ফতওয়া। (সমূহ ফিক্বাহর কিতাব)

মুহম্মদ রায়হানুর রহমান, ঢাকা

 

সুওয়াল: ওয়াজিব ও নফল কুরবানী, ওলীমা ও আক্বীকা এক সাথে জায়িয হবে কিনা?

জাওয়াব: হ্যাঁ, জায়িয হবে। (দলীলসমূহ: শামী, আলমগীরী ইত্যাদি)

 

মুসাম্মত উম্মু মা’রূফা জান্নাত

শান্তিবাগ, ঢাকা

সুওয়াল: হজ্জ পালনের ক্ষেত্রে পুরুষ ও মহিলার আমলের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি?

জাওয়াব: হ্যাঁ, পুরুষ ও মহিলার আমলের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। তন্মধ্যে জরুরী কিছু পার্থক্য বর্ণনা করা হলো:

১.   হজ্জে পুরুষেরা মাথা খোলা রাখবে মহিলারা মাথা ঢেকে রাখবে।

২.    পুরুষেরা তালবিয়া পাঠ করবে উচ্চস্বরে আর মহিলারা তালবিয়া পাঠ করবে নিম্নস্বরে।

৩.   পুরুষেরা তাওয়াফের সময় রমল করবে মহিলারা রমল করবে না।

৪.    ইজতেবা পুরুষেরা করবে মহিলাদের করতে হয় না।

৫.   সাঈ করার সময় পুরুষেরা মাইলাইনে আখজারাইনের মাধ্যস্থানে দৌড়াবে। মহিলারা দৌড়াবে না।

৬.   পুরুষেরা মাথা কামাবে মহিলারা শুধু মাথার চুল এক অঙ্গুলি বা এক ইঞ্চি পরিমাণ ছাটবে।

৭.    বিদেশী পুরুষ হাজী ছাহেবদের জন্য তাওয়াফে বিদা করা ওয়াজিব। বিদেশী মহিলা হাজীদের জন্যও ওয়াজিব। তবে প্রাকৃতিক কারণে মহিলারা অসুস্থ হয়ে পড়লে এ ওয়াজিব তাদের জন্য সাকিত হয়ে যায়।

৮.   পুরুষদের জন্য সেলাই করা কাপড় নিষিদ্ধ। মহিলারা সেলাই করা কাপড় পরিধান করতে পারবে।

 

মুহম্মদ আব্দুল কাদির

শহীদবাগ, ঢাকা

সুওয়াল: হজ্জ আদায়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্থানে যে আলাদা আলাদা দোয়া-দরূদ ও তাসবীহ পড়ার নিয়ম রয়েছে তা প্রায় অনেক হাজী ছাহেবদের পক্ষেই আদায় করা সম্ভব হয় না। তার কারণ হচ্ছে- ১. স্মরণ শক্তির অভাব, ২. সময়ের স্বল্পতা ও ৩. অধিক ব্যস্ততা ইত্যাদি।

এক্ষেত্রে তাদের জন্য এমন কোন আমল আছে কি যা হাজী ছাহেবরা সহজে আদায় করতে পারবে?

জাওয়াব: হ্যাঁ, যে সমস্ত হাজী ছাহেবরা হজ্জের বিস্তারিত দোয়া-দুরূদ ও তাসবীহ ইত্যাদি পাঠ করতে অপরাগ তাদের জন্য সবচেয়ে সহজ আমল হচ্ছে তারা প্রতি ক্বদমে, প্রতি মাক্বামে ও প্রতি স্থানে শুধু দরূদ শরীফ পাঠ করবে। আর দরূদ শরীফ-এর মধ্যে সবচেয়ে সহজ দরূদ শরীফ হলো-

صلى الله عليه وسلم

উচ্চারণ: “ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম”

আর যদি কোন হাজী ছাহেবদের পক্ষে সম্ভব হয় তাহলে উক্ত দরূদ শরীফ পাঠ করার ফাঁকে ফাঁকে যা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাছ দোয়া, তা পাঠ করতে পারে। দোয়াটি হচ্ছে-

لا اله الا الله وحده لا شريك له له الملك وله الحمد وهو على كل شىء قدير.

উচ্চারণ: “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা শারীকালাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদির।”

মুহম্মদ রনি

ভোলাহাট, চাপাইনবাবগঞ্জ

সুওয়াল: কুরবানী করার সুন্নতী পদ্ধতি এবং নিয়ত জানালে খুশি হবো। জাওয়াব:  কুরবানীর পশুর মাথা দক্ষিণ দিকে এবং পা পশ্চিম দিকে রেখে অর্থাৎ ক্বিবলামুখী করে শোয়ায়ে পূর্ব দিক থেকে চেপে ধরতে হবে, তারপর কুরবানীর করতে হবে। আর  কুরবানী করার সময় খেয়াল রাখতে হবে যে, সীনার উপরিভাগ এবং কণ্ঠনালীর মাঝামাঝি স্থানে যেন যবেহ করা হয়। আরো উল্লেখ্য যে, গলাতে চারটি রগ রয়েছে, তন্মধ্যে গলার সম্মূখভাগে দু’টি- খাদ্যনালী ও শ্বাসনালী এবং দু’পার্শ্বে দু’টি রক্তনালী। এ চারটির মধ্যে খাদ্যনালী, শ্বাসনালী এবং দু’টি রক্তনালীর মধ্যে একটি অবশ্যই কাটতে হবে। অর্থাৎ চারটি রগ বা নালীর মধ্যে তিনটি অবশ্যই কাটতে হবে, অন্যথায় কুরবানী হবেনা। যদি সম্ভব হয়, তবে ছুরি চালানোর সময় বিজোড় সংখ্যার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।

কুরবানীর নিয়ত: (যবেহ করার পূর্বে)

انى وجهت وجهى للذى فطر السموت والارض حنيفا وما انا من المشركين ان صلاتى ونسكى ومحياى ومماتى لله رب العلمين لا شريك له وبذلك امرت وانا من المسلمين. اللهم منك ولك.

উচ্চারণ: ইন্নী ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাত্বারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাও ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকীন। ইন্না ছলাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহ্ইয়া ইয়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। লা শারীকালাহু ওয়া বি যালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমীন। আল্লাহুম্মা মিনকা ও লাকা। এ  দোয়া  পড়ে بسم الله الله اكبر

বিস্মিল্লাহি আল্লাহু আকবর বলে যবেহ করতে হবে।

যবেহ করার পর এ দোয়া পড়বে-

 اللهم تقبله منى كما تقبلت من حبيبك سيدنا رسول الله صلى الله عليه وسلم وخليلك سيدنا ابراهيم عليه السلام

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা তাক্বাব্বালহু মিন্নী কামা তাক্বাব্বালতা মিন হাবীবিকা সাইয়্যিদিনা রাসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও খালীলিকা ইব্রাহীমা আলাইহিস সালাম।

যদি নিজের কুরবানী হয়, তবে منى (মিন্নী) বলতে হবে। আর যদি  অন্যের  কুরবানীহয়, তবে  من (মিন) শব্দের পর যার বা যাদের কোবানী, তার বা তাদের নাম উল্লেখ করতে হবে। আর যদি অন্যের সাথে শরীক হয়, তাহলে منى (মিন্নী)ও বলবে, অতঃপর من (মিন) বলে অন্যদের নাম বলতে হবে। কেউ যদি উপরোক্ত নিয়ত না জানে, তাহলে জবেহ করার সময় শুধু বিস্মিল্লাহি আল্লাহু আকবর বলে কুরবানী করলেও শুদ্ধ হয়ে যাবে। কারণ নিয়ত অন্তরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তবে অবশ্যই প্রত্যেক যবেহকারীর উচিৎ উপরোক্ত নিয়ত শিক্ষা করা। কেননা উপরোক্ত নিয়ত পাঠ করে কুরবানী করা সুন্নাতের অন্তর্ভূক্ত।

{দলীলসমূহঃ- আহমদ, আবূ দাউদ, তিরমীযী, দারিমী ইবনে মাযাহ, বজলূল মযহুদ, মিশকাত, মিরকাত, মুযাহেরে হক্ব, লুমায়াত, ত্বীবী, তালিক্ছ্ ুছবীহ, আশয়াতুল লুমায়াত, আলমগীরী, শামী, দুররুল মুখতার, আইনুল হিদায়া ও বাহর ইত্যাদি।}

  মুহম্মদ মুশারফ হুসাইন, নরসিংদী।

সুওয়াল:   বর্তমান সময়ে কোন ব্যক্তি যদি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে ছাগল, বকরী, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি কুরবানী দেয় অথবা গরু, মহিষ, উটের সাত নামের মধ্যে যদি এক নাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নাম মুবারকে দেয়, তবে উক্ত নামের গোশ্তের হুকুম কি? এটা কি সকলে খেতে পারবে? অথবা এ গোশ্ত অছিয়তকৃত গোশ্তের হুকুমের অন্তর্ভুুক্ত হবে কি না? জাওয়াব:  হ্যাঁ, উক্ত কুরবানীকৃত গোশ্ত সকলে খেতে পারবে। আর এটা অছিয়তকৃত গোশ্তের হুকুমের অন্তর্ভূক্ত হবে না। কেননা হাদীছ শরীফে আছে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে বিশেষভাবে কুরবানী করার জন্যে যে নির্দেশ দিয়েছেন এটা তাঁর জন্যই খাছ। বর্তমান সময়ে কোন ব্যক্তি যদি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তরফ থেকে কোরবানী দেয়, তবে এটা তার ফযীলত, তথা বারাকাত, ফুয়ুজাত, নিয়ামত, রহ্মত, মাগফিরাত, নাজাত সর্বোপরি আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি লাভ করা ও তার কুরবানী কবুল হওয়ার একটি উসীলা।

কাজেই আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তরফ থেকে যদি কেউ কুরবানী দেয়, তবে উক্ত কুরবানীকৃত গোশ্ত সকলেই খেতে পারবে। {দলীলসমূহঃ আবূ দাউদ, তিরমীযী, বজলুল মজহুদ, শরহে তিরমীযী, মিশকাত, মিরকাত, লুমায়াত, আশয়াতুল লুমায়াত, ত্বীবী, তালিক ও মুজাহের ইত্যাদি।}

 মুহম্মদ মুফিজুর রহমান, চাঁদপুর

 সুওয়াল:  যাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব হয়নি, এমন দুই বা ততোধিক ব্যক্তি এক নামে কুরবানী দিয়ে গোশ্ত বন্টন করে নিতে পারবে কিনা? জাওয়াব:  হ্যাঁ, যাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব হয়নি, এমন দুই বা ততোধিক ব্যক্তি কুরবানী দিয়ে গোশ্ত বন্টন করে নিতে পারবে। তবে কুরবানীর পশু গরু, মহিষ ও উটে সাত নাম এবং দুম্বা, মেষ  বা ভেড়া, বকরী, খাসিতে এক নাম দেয়ার হুকুম রয়েছে।

গরু, মহিষ, উটে সাত নামের বেশী দিলে কুরবানী দুরুস্ত হবেনা। আর সাত নামের কমে কুরবানী করলে দুরুস্ত হবে। আর ছাগল, দুম্বা, ভেড়া এক নামের বেশী নামে কুরবানীকরলে কারো কুরবানী দুরুস্ত হবেনা।

যেমন- যদি ৪০ জন ব্যক্তি ২০০ টাকা করে ৮০০০ টাকা দিয়ে একটা গরু কিনে সাত নামে বা তার থেকে কম নামে কুরবানী করে গোশ্ত বন্টন করে নেয়, তাতেও কুরবানী শুদ্ধ হবে।

তদ্রুপ একটা খাসি তিনজনে মিলে পয়সা দিয়ে খরীদ করে, যদি এক নামে কুরবানী করে গোশ্ত বন্টন করে নেয়, তবে সে কুরবানীও শুদ্ধ হবে।

এখন প্রশ্ন হলো- যারা সম্মিলিতভাবে টাকা দিয়ে কুরবানী করতে চায়, তারা কার নামে কুরবানী করবে?

এর জাওয়াব হচ্ছে- এরূপ কুরবানীর ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই যেহেতু নিজস্ব নামে কুরবানী করতে চাইবে, কুরবানীর ফযীলত হাছিলের জন্য। আর গরু, মহিষ ও উটে সাত নামের বেশী এবং ছাগল, ভেড়া ও দুম্বাতে এক নামের বেশী দেয়া যায় না। কার নাম দিবে বা কার নাম বাদ দিবে, এ নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদ ও মনোমালিন্যের সৃষ্টি হবে। এছাড়াও যদি কারো নামে দেয়া হয়, অন্য কেউ  প্রকাশ্যে আপত্তি না করে কিন্তু অন্তরে সম্মতি না থাকে তাহলে কুরবানী শুদ্ধ হবেনা। কারণ একজনের টাকা দিয়ে অন্যজনের নামে কুরবানী করলে কুরবানী শুদ্ধ হবেনা। টাকাওয়ালার সম্মতি ব্যতীত। এজন্য উত্তম ও আদব হচ্ছে- এক নাম দিলে আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নাম দেয়া। এরপর অন্য কারো নাম দিলে যাদের মাধ্যমে কুরবানীর বিধান চালু হয়ে আসছে, যেমন- হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম, হযরত ইসমাইল আলাইহিস্ সালাম, হযরত হাজেরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তাঁদের নামে কুরবানী দেয়া উত্তম। আরো বেশী নামে কুরবানী দিলে হযরত আম্বিয়া আলাইহিস্ সালাম, আহ্লে বাইত রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম, উম্মুল মু’মিনীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুন্না এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ-এর নামেও কুরবানী করা যেতে পারে। {দলীলসমূহঃ শামী, আলমগীরি, ফতহুল ক্বাদীর, কাজীখান ইত্যাদি।}

  মুহম্মদ সরোয়ার হুসাইন, বরিশাল।

 সুওয়াল:   কুরবানীর পশুর চামড়া বিক্রি করে সে টাকা মসজিদ কিম্বা ঈদগাহের ইমামকে দেয়া জায়িয হবে কিনা? জাওয়াব:  মসজিদ ও ঈদগাহে ইমামতি করা বাবদ উক্ত টাকা ইমাম ছাহেবকে দেয়া জায়িয হবেনা। অবশ্য ইমাম ছাহেব যদি ফিৎরা ও কুরবানীর ছাহিবে নিছাব না হন, তাহলে দান হিসেবে উক্ত টাকা নিতে পারেন। কিন্তু ছাহিবে নিছাব হলে, তা নিতে পারবেন না। আর চামড়া বিক্রয় না করে পুরো চামড়াটিই যদি ইমামকে দান হিসেবে দেয়া হয়, তবে ইমাম ধনী হলেও তা নিতে পারবেন। (সমূহ ফিক্বাহের কিতাব)

 মুহম্মদ মামুন, কক্সবাজার

 

সুওয়াল: মৃত ব্যক্তির নামে কুরবানী করা জায়িয কিনা?

জাওয়াব: কুরবানী আল্লাহ পাক-এর নামে করতে হবে। যেমন- بسم الله الله اكبر

উচ্চারণ: “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বলে কুরবানী করতে হবে।

এখন যদি কেউ কোন ব্যক্তির নামে, হোক সে জীবিত অথবা মৃত-এর নামে করে, যেমন- “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” এর পরিবর্তে আব্দুর রহীম, আব্দুল করীম, বকর, যায়িদ, আমর ইত্যাদি নামে কুরবানী করে, তাহলে কুরবানী অশুদ্ধ হবে। উক্ত পশুর গোশ্ত খাওয়াও হারাম হবে ও সাথে সাথে কুফরী ও কবীরা গুনাহ হবে। মূলতঃ কুরবানী একমাত্র আল্লাহ পাক-এর নামেই করতে হবে। তবে পশুতে সাত নাম ও এক নাম দেয়ার কথা যে উল্লেখ করা হয়েছে, তাহলো- সাতজন অথবা একজন (চাই তারা জীবিত হোক অথবা মৃত হোক)-এর তরফ থেকে বা পক্ষ থেকে আল্লাহ পাক-এর নামে কুরবানী করা।

এ মাসয়ালাটি না বুঝার কারণে অনেকে সরাসরি বলে থাকে, কুরবানীর পশুতে মৃত পূর্ব পুরুষদের নাম দেয়া যাবে না। (দলীলসমূহ: আলমগীরী, শামী, নুরুল হিদায়া, বাজ্জাজিয়া, কাযীখান ইত্যাদি)

 

মুহম্মদ মিজানুর রহমান

বাবুরহাট, চাঁদপুর

 

সুওয়াল: কোন ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব। সে তার নিজের নামে কুরবানী না দিয়ে মৃত বা জীবিত পিতা-মাতার নামে কুরবানী দিলে তার নিজের কুরবানী আদায় হবে কিনা?

জাওয়াব: আমাদের হানাফী মাযহাব মতে মালিকে নিছাব প্রত্যেকের উপর আলাদাভাবে কুরবানী করা ওয়াজিব। যার উপর কুরবানী ওয়াজিব তার পক্ষ থেকেই কুরবানী করতে হবে। যার উপর কুরবানী ওয়াজিব সে তার নামে কুরবানী না করে মৃত বা জীবিত অপরের নামে কুরবানী করলে ওয়াজিব তরকের কারণে সে কঠিন গুনাহে গুনাহগার হবে। যদিও বাবা মা এর নামে কুরবানী করে। যাদের প্রতি কুরবানী ওয়াজিব নয়। (দলীলসমূহ: সমূহ হাদীছ শরীফ, তাফসীর শরীফ ও ফিক্বাহর কিতাব দ্রষ্টব্য)

বিঃ দ্রঃ এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত ১৫৩তম সংখ্যার সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগ পাঠ করুন।

মুহম্মদ সোহেল

সৌদি আরব

 

সুওয়াল: যে সকল মাদ্রাসার লিল্লাহ্  বোডিংয়ে যাকাত, ফিৎরা ও কুরবানীর চামড়া তোলা হয়, সে লিল্লাহ বোডিংয়ে উক্ত মাদ্রাসার শিক্ষকগণ খেতে পারবে কিনা? এবং সে টাকা দ্বারা শিক্ষকদের বেতন দেয়া ও ছাত্রদের থাকা ও পড়ার জন্য মাদ্রাসা ঘর তৈরী করা জায়িয হবে কিনা? বিস্তারিত জানিয়ে উপকৃত করবেন।

জাওয়াব:  যাকাত, ফিৎরা, কুরবানীর চামড়া বা তার মূল্য ইত্যাদি গরীব, মিস্কীন ও ইয়াতীমদের হক্ব অর্থাৎ ওয়াজিব ছদ্কা (আদায় হওয়ার জন্য) গরীব, মিস্কীন ও ইয়াতীমদেরকে তার (ছদ্কার) মালিক করে দেয়া শর্ত। তাই যে সকল মাদ্রাসায় লিল্লাহ বোডিং অর্থাৎ গরীব, মিস্কীন ও ইয়াতীম ছাত্র রয়েছে, সে সকল মাদ্রাসায় যাকাত, ফিৎরা ও কুরবানীর চামড়া বা তার মূল্য দেয়া যেরূপ জায়িয, তদ্রুপ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের জন্য তা লিল্লাহ্ বোডিংয়ে গ্রহণ করাও জায়িয।

উল্লেখ্য, উক্ত ছদ্কার টাকা দিয়ে শুধুমাত্র ছাত্রদেরকে খাওয়ালেই চলবেনা বরং ছাত্রদেরকে তা’লীম দেয়ার জন্য ওস্তাদ বা শিক্ষকের প্রয়োজন রয়েছে ও ছাত্রদের থাকার জন্য ঘরের দরকার রয়েছে, আর তার জন্যে টাকা-পয়সারও জরুরত রয়েছে। তাই সম্মানিত ফক্বীহ্গণ এরূপ ছদ্কার ব্যাপারে একটি সুন্দর সমাধান বা ফায়সালা দান করেছেন। অর্থাৎ তাঁরা বলেছেন, “ছদ্কার টাকা হিলা করা হলে, তা দ্বারা ওস্তাদদের বেতন দেয়া, খাওয়ার ব্যবস্থা করা ও মাদ্রাসার জন্য ঘর তৈরী করা সবই জায়িয।”

আর হিলার পদ্ধতি হলো- মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ কোন গরীব, মিস্কীন বা ইয়াতীমকে উক্ত ছদ্কার টাকাগুলোর মালিক করে দিবে। অতঃপর উক্ত গরীব, মিস্কীন ও ইয়াতীম সে টাকাগুলো মাদ্রাসায় দান করে দিবে।

অতএব, শুধুমাত্র উক্ত ছূরতেই ছদ্কার টাকা দিয়ে ওস্তাদদের বেতন দেয়া, খাওয়ার ব্যবস্থা করা ও মাদ্রাসার জন্য ঘর তৈরী করা জায়িয ও শরীয়তসম্মত।

{দলীলসমূহঃ শামী, দুররুল মুখতার, আলমগীরী, আইনুল হিদায়া, নাওয়াদিরুল ফতওয়া ইত্যাদি।}

মুহম্মদ ফাহিমুর রহমান

মাদারিপুর

সুওয়াল: ঈদুল আযহার নামায কখন পড়া সুন্নত? জানতে বাসনা রাখি।

জাওয়াব: সূর্য পূর্ণভাবে উদিত হবার পর থেকে (অর্থাৎ মাকরূহ ওয়াক্ত শেষ হবার পর থেকে অথবা সূর্য উদয়ের শুরু থেকে ঘড়ির মিনিট অনুযায়ী ২৩ মিনিট পর) ঈদের নামাযের ওয়াক্ত শুরু হয়। আর যাহওয়াতুল কুবরা বা যাওয়াল অথবা শরয়ী অর্ধদিন বা দ্বিপ্রহর অর্থাৎ সূর্যের এস্তাওয়া আরম্ভ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ঈদের নামাযের ওয়াক্ত থাকে।

ফজরের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পর ২৩ মিনিট পর্যন্ত মাকরূহ ওয়াক্ত এবং এরপর ঈদের নামাযের ওয়াক্ত শুরু হয় এবং যুহরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার ১ ঘণ্টা পূর্ব পর্যন্ত ঈদের নামাযের ওয়াক্ত থাকে। সূর্য পূর্ণভাবে উদিত হওয়ার পর থেকে অর্থাৎ মাকরূহ ওয়াক্ত যা ঘড়ির হিসাব অনুযায়ী ২৩ মিনিট অতিক্রম হওয়ার পূর্বে ঈদের নামায আদায় করলে নামায হবে না এবং যুহরের নামাযের ওয়াক্ত হওয়ার পূর্বের ১ ঘন্টা যা মাকরূহ ওয়াক্ত নামে পরিচিত অর্থাৎ যাহওয়াতুল কুবরা বা সূর্যের এস্তাওয়া আরম্ভ হওয়ার পর ঈদের নামায আদায় করলে তা আদায় হবে না।

ঈদের নামায কোন্ সময় আদায় করলে তা সুন্নত হবে সে সম্পর্কে হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, “ঈদের দিন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামায পড়ে হুজরা শরীফে গিয়ে সকাল সকাল গোসল করতেন এবং ঈদুল ফিতর হলে বিজোড় সংখ্যক (৩, ৫, ৭) খোরমা খেজুর খেয়ে ঈদগাহে যেতেন। আর ঈদুল আযহার সময় কিছু না খেয়ে সরাসরি ঈদগাহে যেতেন এবং ঈদের নামাযের ওয়াক্ত হওয়ার সাথে সাথে ঈদের নামায আদায় করতেন। তারপর খুৎবা দিতেন এবং নছীহত করতেন।”

“হযরত আবুল হোয়ায়রেস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আমর ইবনে হাযম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে নাজরানের গভর্ণর থাকা অবস্থায় চিঠি দিয়ে আদেশ করেছেন, ঈদুল আযহার নামায খুব সকাল সকাল পড়বে এবং ঈদুল ফিতরের নামায ঈদুল আযহার চেয়ে অল্প একটু দেরীতে পড়বে এবং নামাযের পরে মানুষকে নছীহত করবে।

কাজেই, ঈদের নামায সকাল সকাল পড়া সুন্নত। ঈদের নামাযের সম্মানার্থে এবং ঈদের নামায যাতে আদায়ে দেরী না হয়, সেজন্য ঈদের দিন ইশরাকসহ অন্যান্য নফল নামায পড়া নিষিদ্ধ।

মুহম্মদ ফাহিমুর রহমান

বরিশাল

সুওয়াল: তাকবীরে তাশরীক কাকে বলে? এবং তা কতবার বলতে হয়?

জাওয়াব: পবিত্র যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আছর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরয নামাযের পর যে তাকবীর পাঠ করা হয় তাকেই তাকবীরে তাশরীক বলে। জামায়াতে বা একাকী, মুসাফির অথবা মুকীম, শহর অথবা গ্রামে প্রত্যেককেই প্রতি ফরয নামাযের পর উক্ত তাকবীর পাঠ করতে হবে।

“দুররুল মুখতার” কিতাবে উল্লেখ আছে যে, “তাকবীরে তাশরীক একবার বলা ওয়াজিব, তবে যদি (কেউ) একাধিকবার বলে, তাহলে তা ফযীলতের কারণ হবে। আর “ফতওয়ায়ে শামী” কিতাবে উল্লেখ আছে,

وقيل ثلاث مرات

অর্থ: কেউ কেউ বলেছেন (তাকবীরে তাশ্রীক) তিনবার।”  “গায়াতুল আওতার শরহে দুররুল মুখতার” কিতাবে উল্লেখ আছে,

اور واجب ہے تکبیر تشریق صحیح ترقول میں ایکبار بسبب اسکے مامور ہونے کے اور اگر زیادہ کہےایکبار سے تو ہوگا ثواب.

অর্থ: “বিশুদ্ধ বর্ণনা মতে (আল্লাহ্ পাক-এর পক্ষ থেকে) আদিষ্ট হওয়ার কারণে একবার তাকবীরে তাশ্রীক বলা ওয়াজিব। আর যদি একবারের চেয়ে অতিরিক্ত বলে তবে ছাওয়াবের অধিকারী হবে।”

উপরোক্ত নির্ভরযোগ্য কিতাবের বর্ণনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, একবার তাকবীরে তাশ্রীক বলা ওয়াজিব এবং তিনবার বলা মুস্তাহাব। {দলীলসমূহঃ শামী, আইনী, আলমগিরী, হাশিয়ায়ে তাহ্তাবী, রদ্দুল মুহ্তার, দুররুল মুখতার ইত্যাদি।}

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ