মাহে রজব ও শা’বান এবং তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

সংখ্যা: ২০৫তম সংখ্যা | বিভাগ:

আল্লাহ পাক সুবহানাহূ ওয়া তায়ালা তিনি বছরের বারটি মাসকে চারটি মাসের দ্বারা সুসজ্জিত  করেছেন। সে মাসটি চারটি হলো যিলক্বদ, যিলহজ্জ, মুহররম ও রজব। যেমন কালামুল্লাহ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

منها اربعة حرم

অর্থাৎ “সম্মানিত মাসের সংখ্যা হলো চারটি।” এরমধ্যে তিনটি হলো লাগাতার বা একসাথে আর একটি ভিন্ন। এ ভিন্ন মাসটিই হলো রজব।

চারটি হারাম বা সম্মানিত মাসের তাৎপর্য সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে যে, আল্লাহ পাক উনার নিকট সম্মানিত মাসের সংখ্যা যেরূপ চারটি তদ্রƒপ উনার শ্রেষ্ঠ ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের সংখ্যাও চার। প্রধান আসমানী কিতাবের সংখ্যাও চার। ওযূর ফরযও চার। একইভাবে শ্রেষ্ঠ তাসবীহ’র কালিমার সংখ্যাও চার। যথা: সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার। অনুরূপভাবে অঙ্ক শাস্ত্রের মূল স্তম্ভের সংখ্যাও চার। যথা: একক, দশক, শতক ও হাজার। তাছাড়া সময় নির্ধারণের প্রধান অংশের সংখ্যাও চার। যথা: ঘণ্টা, দিন, মাস ও বছর। বছরের প্রধান ঋতুর সংখ্যাও চার। যথা: শীত, গ্রীষ্ম, হেমন্ত ও বসন্ত। এছাড়া মানুষের অধিকাংশ রোগ-ব্যাধির মূল উৎসের সংখ্যাও চার। যথা: রক্ত, পিত্ত, অম্ল ও শ্লেষ্মা। শুধু তাই নয়, কুল-কায়িনাতের নবী ও রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রধান ছাহাবী এবং হযরত খুলাফায়ে রাশিদীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সংখ্যাও চার। যথা: হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু, হযরত উমর ফারূক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত উছমান যুননূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। একইভাবে মা’রিফাতপন্থীদের প্রধান ত্বরীক্বার সংখ্যাও চার। যথা: ক্বাদিরিয়া, চীশতিয়া, মুজাদ্দিদিয়া ও নকশবন্দিয়া। অনুরূপভাবে দুনিয়ার মুসলমানদের অনুসরণীয় মাযহাবের সংখ্যাও চার। যথা- হানাফী, মালিকী, শাফিয়ী ও হাম্বলী। উল্লেখ্য যে, এই ধরনের চার সংখ্যাবিশিষ্ট আরো বহু মাহাত্ম্যপূর্ণ ব্যক্তি ও বস্তু দুনিয়ায় বিদ্যমান।

হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি হারাম মাস চতুষ্টয়ের (যিলক্বদ, যিলহজ্জ, মুহররম ও রজবে) তিনদিন করে রোযা রাখবে তার আমলনামায় নয় বছর ইবাদতের ছওয়াব লিখিত হবে।” বর্ণনকারী বলেন, এ হাদীছ শরীফখানা আমি নিজ কানে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার থেকে শ্রবণ করেছি। (মুকাশাফাতুল কুলূব)

হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “যখন রজব মাস আগমন করে তখন তোমরা বেশি বেশি নফল ইবাদত-বন্দিগীতে মশগুল হও।” এ মাসের চাঁদ দেখলে তিনি নিজে নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়তেন-

اللهم بارك لنا فى رجب وشعبان وبلغنا رمضان

উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা বারিক্লানা ফী রজাবা ওয়া শা’বান, ওয়া বাল্লিগ্না রমাদ্বান।’

অর্থ: “আয় আল্লাহ পাক! আমাদেরকে রজব ও শা’বানে বরকত দান করুন এবং রমাদ্বান মাস পর্যন্ত পৌঁছার তাওফীক দিন।” (হিলইয়াতুল আওলিয়া, তবাকাতুল আছফিয়া)

আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আরো ইরশাদ করেন, “যে মুসলমান পুরুষ-মহিলা রজব মাসের পহেলা তারিখ দিনে রোযা রাখবে এবং রাত্রিতে নফল ইবাদত-বন্দেগীতে কাটিয়ে দিবে আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে, আল্লাহ পাক তিনি তার আমলনামায় এক বৎসর দিনে রোযা রাখার এবং রাত্রিতে ইবাদত-বন্দেগী করার ছওয়াব লিখে দিবেন।” সুবহানাল্লাহ!

উল্লেখ্য, মাহে রমাদ্বান শরীফ ব্যতীত অন্যান্য প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সংখ্যক রোযা রাখা খাছ সুন্নত। শাওওয়াল মাসে ৬টি,  যিলহজ্জ মাসে ৯টি এবং অন্যান্য মাসে ৩টি।

সুতরাং এ মাসে রোযার সুন্নতটি পালন করতে হলে উত্তম ও আফযল হলো, পহেলা তারিখ, পহেলা জুমুয়ার তারিখ এবং সাতাশ তারিখের দিন রোযা রাখা। কারণ উক্ত দিন তিনটি অন্যান্য দিন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত।

যেমন বর্ণিত রয়েছে যে, রজবের পহেলা রাতটি দোয়া কবুলের খাছ রাত, পহেলা জুমুয়ার রাতটি হচ্ছে রগায়িবের রাত অর্থাৎ এ রাতে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনার আম্মা আলাইহাস সালাম উনার রেহেম শরীফ-এ তাশরীফ নেন এবং সাতাশ তারিখের রাতটি হচ্ছে  মি’রাজ শরীফ-এর রাত।

অতএব, প্রত্যেকের উচিত এ মাসেই খালিছভাবে তওবা-ইস্তিগফার করে যথাসাধ্য আমলে নিবেদিত হওয়া এবং তাওফীক কামনা করা, আল্লাহ পাক তিনি আমাদের সকলকে যেন মাহে শা’বান অতঃপর মাহে রমাদ্বান শরীফ-এর বারাকাত, ফুয়ুজাত, নিয়ামত, রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের পরিপূর্ণ হিসসা নছীব করেন।

শা’বান মাস অতিশয় কল্যাণ ও নেকীর মাস।

হযরত আবূ উমামা বাহিলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, যখন শা’বান মাস উপস্থিত হতো তখন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলতেন, “এ মাসে তোমরা তোমাদের অন্তরকে পাক-পবিত্র করে নাও এবং নিয়তকে বিশুদ্ধ করে নাও।” (তবারানী শরীফ)

হযরত উসামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আরজ করলাম: ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! শা’বান মাসে আপনাকে যত বেশি রোযা রাখতে দেখি অন্য কোনো মাসে তত বেশি দেখি না, এর কি কারণ? তিনি বললেন, “এ মাসটি রজব ও রমযান মাসের মধ্যবর্তী অতীব ফযীলতপূর্ণ মাস; অথচ লোকেরা এ মাসটির ব্যাপারে উদাসীন। এ মাসে মানুষের আমলসমূহ রব্বুল আলামীন উনার দরবারে পেশ করা হয়। আমার আমলসমূহ পেশ করা কালে আমি রোযাদার অবস্থায় থাকা পছন্দ করি।” (নাসায়ী শরীফ)

বস্তুত শা’বান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতটিই হচ্ছে সেই বরকতপূর্ণ রাত যেই রাতটিতে কেবল আমলনামা আল্লাহ পাক উনার দরবারে  পেশ করা হয় না বরং বান্দার রুযী-রোযগার, হায়াত-মউত ইত্যাদি বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ফায়ছালা করা হয়।

যেমন এ প্রসঙ্গে সূরা দুখান-এর ৪নং আয়াত শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, “এটি এমন এক রাত, যে রাতে সমস্ত প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয়ের ফায়ছালা করা হয়।”

এ আয়াত শরীফ-এর ব্যাখ্যায় হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, “এ রাতে কতজন সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, কতজন মৃত্যুবরণ করবে তার ফায়ছালা করা হয়। এছাড়া বান্দার আমল আল্লাহ পাক উনার নিকট পেশ করা হয় এবং বান্দার রিযিকের ফায়ছালা করা হয়।” (বায়হাকী, মিশকাত)

হযরত ইমাম সুবুকী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার তাফসীরগ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, শা’বানের মধ্যরাত অর্থাৎ শবে বরাতে ইবাদত করার ওসীলায় বিগত বছরের গুনাহ মাফ হয়। আর জুমুয়ার রাতে ইবাদতের ওসীলায় বিগত সপ্তাহের গুনাহ মাফ হয়। আর শবে ক্বদরে ইবাদতের ওসীলায় বিগত জীবনের গুনাহ মাফ হয়। এ কারণে শবে বরাতকে গুনাহ মাফীর রাতও বলা হয়।

শবে বরাতকে শাফায়াতের রাতও বলা হয়। হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উম্মতের জন্য ১৩ই শা’বানের রাতে সুপারিশ করেছিলেন, তাতে কবুল হয়েছিল এক তৃতীয়াংশ। অতঃপর ১৪ই শা’বানের রাতে পুনরায় সুপারিশ করেছিলেন, তাতে কবুল হয়েছিল আরেক তৃতীয়াংশ। অতঃপর ১৫ই শা’বানের রাতের সুপারিশে অবশিষ্ট তৃতীয়াংশ কবুল হয়ে তা পূর্ণতা লাভ করে। (মুকাশাফাতুল কুলূব)

নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “যখন শা’বান মাসের ১৫ই তারিখ উপস্থিত হয় তখন ওই রাতে তোমরা সজাগ থেকে ইবাদত-বন্দেগী করো এবং দিনে রোযা রাখো। কারণ ওই দিন আল্লাহ পাক তিনি সূর্যাস্তের পর থেকে পৃথিবীর আসমানে অবতরণ করেন অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করে ঘোষণা করতে থাকেন, কেউ ক্ষমাপ্রার্থী আছ কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। কেউ রিযিক প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তাকে রিযিক প্রদান করবো। কেউ বিপদগ্রস্ত আছ কি? আমি তার বিপদ দূর করে দিব। কেউ তওবাকারী রয়েছ, তার তওবা কবুল করবো। কোনো প্রার্থনাকারী আছ যার প্রার্থিত বিষয় দিয়ে দিব। এভাবে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত প্রত্যেক হাজতমান্দকে সম্বোধন করে আল্লাহ পাক তিনি ঘোষণা দিতে থাকেন।” সুবহানাল্লাহ!

কাজেই, প্রত্যেক মুসলমান পুরুষ মহিলা, জিন-ইনসানের কর্তব্য হলো, “লাইলাতুম মুবারাকাহ, লাইলাতুন নিছফি মিং শা’বান, লাইলাতুল ক্বিসমাহ, লাইলাতুত তাকফীর, লাইলাতুল ইজাবাহ, লাইলাতুল হায়াহ, লাইলাতু ঈদিল মালায়িকাহ, লাইলাতুল বারাআহ, লাইলাতুত তাজবীঝ, লাইলাতুল ফায়ছালাহ, লাইলাতুছ ছক্ক, লাইলাতুল জায়িঝাহ, লাইলাতুর রুজহান, লাইলাতুত তা’যীম, লাইলাতুত তাক্বদীর, লাইলাতুল গুফরান, লাইলাতুল ইতক্বি মিনান নীরান, লাইলাতুল ‘আফওি ওয়াল কারাম, লাইলাতুত তাওবাতি ওয়ান নাদাম, লাইলাতুয যিকরি ওয়াছ ছলাহ, লাইলাতুছ ছদাক্বাতি ওয়াল খইরাত, লাইলাতু ইনঝালির রহমাহ, লাইলাতু ছলাতিঁও ওয়া সালামিন ‘আলা সাইয়্যিদিল মুরসালীন ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এ অতিশয় বরকতপূর্ণ রাতটিতে সজাগ থেকে ইবাদত-বন্দেগী করা, জীবনের গুনাহখতার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা, তওবা ইসতিগফার করা এবং যার যা নেক দোয়া ও নেক মকছূদ রয়েছে তা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ওসীলায় খালিক্ব, মালিক, রব আল্লাহ পাক সুবহানাহূ ওয়া তায়ালা উনার নিকট পরিপূর্ণ ইয়াক্বীনের সাথে আরজু করা।

স্মরণীয় যে, আল্লাহ পাক তিনি উনার মনোনীত ওলী উনার ওসীলায় বান্দা ও উম্মতকে ক্ষমা ও কবুল করে থাকেন। তাই শবে বরাতে পরিপূর্ণ বারাকাত, ফুয়ূযাত, নিয়ামত, রহমত, মাগফিরাত লাভ করার জন্য যামানার লক্ষ্যস্থল ওলীআল্লাহ, যামানার লক্ষ্যস্থল আওলাদে রসূল, যামানার মহানতম মুজাদ্দিদ ও ইমাম, মুজাদ্দিদে আ’যম ইমাম রাজারবাগ শরীফ-এর হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী উনার মকবুল মুনাজাতে শামিল হওয়া উচিত। আল্লাহ পাক তিনি সবাইকে কবুল করুন। আমীন।

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ শুয়াইব আহমদ

মাহে যিলহজ্জ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে মুহররমুল হারাম ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে রবীউল আউয়াল শরীফ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে রবীউছ ছানী ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে জুমাদাল উখরা ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা