মাহে রবীউল আউয়াল শরীফ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

সংখ্যা: ২০৩তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ শুয়াইব আহমদ

ঈদ মুবারক!          ঈদ মুবারক!!         ঈদ মুবারক!!!

খালিক্ব, মালিক, রব আল্লাহ পাক সুবহানাহূ ওয়া তায়ালা তিনি কুরআন শরীফ-এর একাধিক আয়াত শরীফ-এর মাধ্যমে এবং কুল-কায়িনাতের যিনি নবী ও রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বহু হাদীছ শরীফ-এর মাধ্যমে বান্দা  ও উম্মতকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের যমীনে আগমন বা বিলাদত শরীফ, বিছাল শরীফ এবং উনাদের বিশেষ ঘটনা অর্থাৎ উনাদের মুবারক শান বা বৈশিষ্ট্য প্রকাশার্থে যেসব ঘটনা যে দিনগুলিতে সংঘটিত হয়েছে সে দিনগুলি রহমত, বরকত, সাকীনা নাযিল ও হাছিলের দিন এবং সে দিনগুলি ঈদ বা খুশি প্রকাশের দিন।

যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফ-এর ছহীহ ও প্রসিদ্ধ কিতাব- মুয়াত্তা মালিক, ইবনে মাজাহ, মিশকাত শরীফ ইত্যাদি কিতাবে বর্ণিত রয়েছে, আল্লাহ পাক উনার প্রথম নবী ও রসূল হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার সৃষ্টি, উনার যমীনে আগমন ও উনার বিছাল শরীফ জুমুয়ার দিনে সম্পন্ন হয়েছে। যার কারণে এ জুমুয়ার দিনটিকে স্বয়ং আল্লাহ পাক তিনি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মাধ্যমে ঈদের দিন ঘোষণা করেন এবং এ দিনকে ঈদের দিন হিসেবে পালন করার জন্য নির্দেশ দেন। শুধু তাই নয়, এ দিনটিকে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক সম্মানিত দিন হিসেবে ঘোষণা দেন। এমনকি এ দিনটিকে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা এ দুই ঈদের দিন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত বলে ঘোষণা করেন।

উল্লেখ্য, হাদীছ শরীফ-এর ছহীহ ও প্রসিদ্ধ কিতাব আল মুসতাদরাক লিল হাকিম ৪র্থ খ- ১৫৮৩ পৃষ্ঠা, আছ ছহীহাহ ১ম খ- ৮৮ পৃষ্ঠা, কানযুল উম্মাল ১১ খ- ৪৫৫ পৃষ্ঠা ইত্যাদি কিতাবে বর্ণিত রয়েছে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সৃষ্টি করা না হলে হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনাকেসহ কোনো কিছুই সৃষ্টি করা হতো না।

স্মরণীয় যে, হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার সৃষ্টি, যমীনে আগমন ও বিদায়ের কারণে জুমুয়ার দিন যদি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত হয় তাহলে যিনি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সৃষ্টি করা না হলে হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনাকেসহ কোনো নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে সৃষ্টি করা হতো না এবং উনাদের বিশেষ কোনো ঘটনাও সংঘটিত হতো না, শুধু তাই নয়, আসমান-যমীন, লওহো-কলম, আরশ-কুরসী, জিন-ইনসান, ফেরেশতা, বেহেশত-দোযখ, এককথায় কায়িনাতের কোনো কিছুই সৃষ্টি করা হতো না উনার যমীনে আগমন তথা বিলাদত শরীফ ও বিছাল শরীফ-এর দিন ১২ই রবীউল আউয়াল শরীফ কতো মহান, কতো বড় খুশি বা ঈদের দিন হবে তা ফিকির করতে হবে।

আল্লাহ পাক উনার নবী ও রসূল হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম উনার সম্পর্কে কুরআন শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

وسلم عليه يوم ولد ويوم يموت ويوم يبعث حيا .

অর্থ: “উনার প্রতি সালাম (শান্তি বা অভিবাদন) যেদিন তিনি বিলাদত শরীফ লাভ করেন এবং যেদিন তিনি বিছাল শরীফ লাভ করেন এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হবেন।” (সূরা মারইয়াম : আয়াত শরীফ ১৫)

এ আয়াত শরীফ-এর দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের বিলাদত শরীফ ও বিছাল শরীফ-এর দিন খুশির দিন বা ঈদের দিন। কেননা সেদিন রহমত, বরকত, সাকীনা নাযিল ও হাছিলের দিন।

স্মরণীয় যে, অন্যান্য নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের বিলাদত শরীফ ও বিছাল শরীফ-এর দিন যদি ঈদ বা খুশির দিন হয় এবং রহমত, বরকত, সাকীনা, নাযিল ও হাছিলের দিন হয় তাহলে যিনি নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদেরও নবী ও রসূল, সাইয়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিলাদত শরীফ ও বিছাল শরীফ-এর দিন কতো লক্ষ কোটি গুণ বেশি খুশির দিন বা ঈদের দিন হবে এবং কতো বেশি রহমত, বরকত, সাকীনা নাযিল ও হাছিলের দিন হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আল্লাহ পাক উনার নবী ও রসূল হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তিনি উনার উম্মতের আরজু বা আবেদনের প্রেক্ষিতে আল্লাহ পাক উনার কাছে দু‘আ করেছিলেন-

اللهم ربنا انزل علينا مائدة من السماء تكون لنا عيدا لاولنا واخرنا واية منك وارزقنا وانت خير الرازقين. قال الله انى منزلها عليكم فمن يكفر بعد منكم فانى اعذبه عذابا لا اعذبه احدا من العالمين .

অর্থ: “আয় আমাদের রব আল্লাহ পাক! আমাদের জন্য আপনি আসমান হতে (বেহেশতী খাদ্যের) খাদ্যসহ একটি খাঞ্চা নাযিল করুন। খাঞ্চা নাযিলের উপলক্ষটি আমাদের জন্য, আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্য ঈদ (খুশি) স্বরূপ হবে এবং আপনার পক্ষ হতে একটি নিদর্শন হবে। আমাদেরকে রিযিক দান করুন। নিশ্চয় আপনিই উত্তম রিযিকদাতা। আল্লাহ পাক তিনি বললেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের প্রতি খাদ্যসহ খাঞ্চা নাযিল করবো। অতঃপর যে ব্যক্তি সে খাদ্যসহ খাঞ্চা নাযিলের দিনকে ঈদ বা খুশির দিন হিসেবে পালন করবেনা বরং অস্বীকার করবে আমি তাকে এমন শাস্তি দিবো, যে শাস্তি সারা কায়িনাতের অপর কাউকে দিবো না।” (সূরা মায়িদা : আয়াত শরীফ ১১৪, ১১৫)

উল্লেখ্য, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম উনার উক্ত দু‘আর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ পাক তিনি খাদ্যসহ খাঞ্চা নাযিল করেছিলেন। আর খাদ্যসহ খাঞ্চা নাযিলের দিনটিকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম উনার উম্মতদেরকে নিয়ে ঈদ বা খুশির দিনরূপে পালন করেছিলেন।

স্মরণীয় যে, সামান্য খাদ্যসহ এক খাঞ্চা নাযিলের দিনটি যদি হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এবং উনার উম্মতের জন্য খুশির দিন হয়ে যায় এবং সে দিনটিকে খুশির দিন হিসেবে পালন না করলে কঠিন শাস্তির যোগ্য হয়, তাহলে  যিনি সৃষ্টির মূল, যিনি সারা আলমের জন্য রহমত, যাকে সৃষ্টি না করলে কোনো কিছুই সৃষ্টি করা হতো না উনার বিলাদত শরীফ-এর দিনটিকে কিরূপ খুশির দিন হিসেবে পালন করা উচিত এবং সেদিন উপলক্ষে যদি কেউ খুশি প্রকাশ না করে তাহলে সে কতো কঠিন শাস্তির যোগ্য হবে তা চিন্তা-ফিকিরের বিষয়।

প্রসঙ্গত আরো উল্লেখ্য, কোনো লোকের সন্তান জন্মগ্রহণ করলে সে খুশি হয়, বিবাহ-শাদীতে খুশি হয়, চাকরি পেলে খুশি হয়, ব্যবসায় লাভ হলে খুশি হয়, বিপদ থেকে বেঁচে গেলে খুশি হয়, সুন্দর করে ঘর-বাড়ি করতে পারলে খুশি হয়, জায়গা-জমি কিনতে পারলে খুশি হয়, কোনো মর্যাদা কিংবা পদ লাভ করলে খুশি হয়, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ বা বের হলে খুশি হয়, বিশেষ করে মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার যেদিন ফল প্রকাশ হয় সেদিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রী ও তার অভিভাবক, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন খুশি হয়ে মিষ্টি কিনে বিতরণ করে থাকে ও খেয়ে থাকে। তারা এতো খুশি প্রকাশ করে যে, সেদিন মিষ্টির দোকানের সমস্ত মিষ্টি শেষ হয়ে যায়। দুনিয়াবী ক্ষণস্থায়ী সামান্য নিয়ামত লাভের দৃষ্টান্ত যদি এই হয়, তাহলে যিনি আগমন না করলে কুল-কায়িনাতের কিছুই সৃষ্টি হতো না, সৃষ্টি হতো না কোনো পিতা-মাতার, না কোনো সন্তানের সেক্ষেত্রে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক আগমন বা বিলাদত শরীফ-এর দিন উপলক্ষে কতো বেশি খুশি প্রকাশ করতে হবে, মিষ্টি দিয়ে, মাল দিয়ে, না জান দিয়ে তা ফিকির করতে হবে।

কারণ হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন-

لايؤمن احدكم حتى اكون احب اليه من والده و ولده والناس اجمعين وفى رواية من ماله و نفسه

অর্থ: “তোমাদের কেউ ততোক্ষণ পর্যন্ত মু’মিন হতে পারবে না যতোক্ষণ পর্যন্ত সে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সমস্ত মানুষ অপেক্ষা আমাকে বেশি মুহব্বত না করবে।” অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, তার মাল ও জান অপেক্ষা বেশি মুহব্বত না করবে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত শরীফ)

এ হাদীছ শরীফ থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয় যে, মানুষের জীবনে যতো রকম খুশি প্রকাশের বিষয় রয়েছে সমস্ত খুশির বিষয় থেকে লক্ষ-কোটি গুণ বেশি খুশি প্রকাশের উপলক্ষ হলো নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শুভাগমন বা বিলাদত শরীফ-এর দিনটি।

তাই, শরীয়ত এ মহিমান্বিত দিনটিকে সাইয়্যিদুল আ’ইয়াদ, সাইয়্যিদে ঈদে আ’যম ও সাইয়্যিদে ঈদে আকবার বলে ঘোষণা করেছে এবং এ ঈদ পালন বা উদযাপন করাকে বান্দা ও উম্মতের জন্য ফরযে আইন করে দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-

قل بفضل الله وبرحمته فبذلك فليفرحوا هو خير مما يجمعون .

অর্র্থ: “হে হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি উম্মাহকে জানিয়ে দিন, আল্লাহ পাক তিনি স্বীয় অনুগ্রহ ও রহমত হিসেবে উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে পাঠিয়েছেন, সে কারণে তারা যেনো খুশি প্রকাশ করে। এই খুশি প্রকাশ করাটা সেসব কিছু থেকে উত্তম, যা তারা দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য সঞ্চয় করে।” (সূরা ইউনুস : আয়াত শরীফ ৫৮)

অতএব, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মহানতম বিলাদত শরীফ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করে প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর সাধ্য-সামর্থ্য অনুযায়ী তাবারুকের ব্যবস্থাসহ মাহফিলের আয়োজন করা উচিত অর্থাৎ ঈদে বিলাদত বা মীলাদ শরীফ মাহফিলের আয়োজন করা উচিত। যামানার লক্ষ্যস্থল ওলীআল্লাহ, যামানার লক্ষ্যস্থল আওলাদে রসূল, মুজাদ্দিদে আ’যম, ইমাম রাজারবাগ শরীফ-এর হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী তিনি বলেন, যারা এ মাহফিলের আয়োজন করবে অবশ্যই তারা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সুবহানাল্লাহ!

মাহে শাওওয়াল-যিলক্বদ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে যিলহজ্জ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে মুহররমুল হারাম ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে রবীউল আউয়াল শরীফ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে রবীউছ ছানী ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা