সম্পাদকীয়

সংখ্যা: ২০৬তম সংখ্যা | বিভাগ:

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মালিক রব তায়ালা উনার জন্য সব ছানা-সিফত। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্যই সকল দুরূদ ও সালাম। উনার উছীলায় মহান আল্লাহ পাক তিনি উম্মতে হাবীবীকে নছীব করেছেন রমদ্বানুল মুবারক।

পৃথিবীতে প্রথম ইবাদতসমূহের মাঝে রোযা অন্যতম। হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম যে রোযা রাখতেন তা ‘আইয়্যামে বীজ’ নামে পরিচিত। এরপর আহলে কিতাবগণ ছাড়াও রোযার দর্শন ও প্রয়োগ প্রতিফলিত হয় অন্যান্য ধর্মেও। প্রাচীন গ্রীক, পারস্য, মিসর, ভারতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। গ্রীক বর্ষপঞ্জির থিসমোফোরিয়া মাসের তৃতীয় দিনের উপবাস, পারসিকদের পাঁচসালা উপবাস ব্রত এবং হিন্দুদের একাদশীর ব্রত এক্ষেত্রে বিশেষ উদাহরণ।

প্রায়শ্চিত্য সিয়াম এবং জাতীয় দুর্যোগ শোকের ক্ষেত্রসহ ‘আব’ মাসের প্রথম নয় দিন এবং তামুসের সতের তারিখে আংশিক সিয়ামের বিবরণ জিউস এনসাইক্লোপিডিয়াতে পাওয়া যায়। অপরদিকে হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম সিয়াম পালন করলেও তাঁর সিয়াম পালনের যে ধারাবাহিকতা পাদ্রী সম্প্রদায় অব্যাহত রাখেনি।

পাদ্রী পল, এরিনিয়াসহ নানা পাদ্রীর নানা মত প্রবর্তনের পর চার্চ তাদের সিয়ামের দিন নির্ধারণ করে এবং এখানেই শেষ নয় ষষ্ঠ এডওয়ার্ড, প্রথম জেমস ও এলিজাবেথের সময় পার্লামেন্টেও সিয়ামের ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ আরোপ করে। পার্লামেন্ট এই মর্মে ঘোষণা দেয় যে, ‘সিয়ামের দিন গোশ্ত খাওয়া যাবে না।’ পার্লামেন্ট যুক্তি হিসেবে দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের সহায়ক বলে উল্লেখ করে।

স্মর্তব্য, ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টকে বলা হয় গণতন্ত্রের জননী। আর আসমানী কিতাব হারিয়ে এবং কুরআন শরীফ অস্বীকারের পর ডেমোক্রেটিক পার্লামেন্ট গঠন এবং সকল বিষয়সহ ধর্মীয় ক্ষেত্রেও পার্লামেন্টের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া খ্রিস্টানদের সীমাহীন গুমরাহীই প্রমাণ করে।

বলা যায়, সেই একই পার্লামেন্টারী পদ্ধতিতে কাজ করে, ইসলামী আন্দোলনের ধুয়ো তুলছেন আমাদের তথাকথিত আলেম সমাজ। পবিত্র মাহে রমাদ্বান শরীফ উপলক্ষে আমরা তাদের হিদায়েত হওয়ার উদাত্ত আহবান জানাই। কেননা রমাদ্বান শরীফ বহুভাবে একই হেদায়েতের দিক নির্দেশনা দেয়। ইহুদী খ্রীস্টানদের ন্যায় দেরীতে ইফতার করা, সাহরী না করা, অবিরামভাবে না খাওয়াকে স্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে হাদীছ শরীফ-এ। শুধু তাই নয়- æযে রোযা রেখে মিথ্যাচার পরিত্যাগ করলনা, তার রোযার কোন প্রয়োজন আল্লাহ পাক উনার কাছে নেই” বলে বুখারী ও মুসলিম শরীফ-এর হাদীছ শরীফ-এ ব্যক্ত করা হয়েছে। অন্য হাদীছ শরীফ-এ আরো স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, æঅনেক সিয়াম পালনকারী এমন, যাদের ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকাই সার হয়েছে। তদ্রুপ অনেক ইবাদতকারী এমন, যাদের বিনিদ্র রজনীই ব্যর্থ হয়েছে।” (বুখারী শরীফ, আবু দাঊদ শরীফ, তিরমিযী শরীফ)

প্রসঙ্গক্রমে হাদীছ শরীফদ্বয়ের আলোকে প্রশ্ন উঠে- যারা হারাম গণতন্ত্র ও নির্বাচন করে, ছবি তুলে, লংমার্চ করে, ব্লাসফেমী আইন চায়, মৌলবাদী পরিচয়ে খুশী প্রকাশসহ হরতাল, অসহযোগ ইত্যাদি তাবত হারাম ও নাজায়েয কাজ করে এবং এসব হারাম কাজ সমূহকেই ইসলামী আন্দোলন বলে ব্যক্ত করে, তাদের সেই তথাকথিত আন্দোলনসমূহ যে কত অন্তসারশূন্য ও ভয়াবহ পরিণামযুক্ত তা কি বলার অপেক্ষা রাখে? ইসলামী আন্দোলন খুবই ফযীলতপূর্ণ, তবে যদি তা ইসলামের আঙ্গিকেই হয়। নচেৎ তার পরিণতি সেরকমই যেমন হাদীছ শরীফ-এ বলা হয়েছে- æরোযা হচ্ছে ঢাল স্বরূপ। যদি না সে নিজেই তা ফুটো করে দেয়। (নাসাঈ শরীফ)

কাজেই যেসব তথাকথিত ইসলামী আন্দোলনকারীর দল নির্বাচন তথা গণতন্ত্রকেই ইসলামের নামে গ্রহণ করেছে তারা মূলতঃ ঐরকমই যারা নিজেরাই সহীহ ইসলামী আন্দোলনের মূলে কুঠারাঘাত করেছে। তাই তাদেরকে পরিহার করা সকলের আবশ্যকীয় কর্তব্য।

উল্লেখ্য, রোযার সাথে যাকাতের একটা অন্তর্নিহিত সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, যাকাতও পবিত্রতা ঘটায়। তবে এ পবিত্রতা মালের বা অর্থের। আর অর্থের মূল মালিক হচ্ছেন আল্লাহ পাক। কাজেই আল্লাহ পাক উনার নির্দেশিত পথে অর্থ আয়-ব্যয়েই- ব্যক্তি, সমাজ তথা রাষ্ট্রের সফলতা ও সমৃদ্ধি। সে সফলতার দ্বার বন্ধ রেখে ভিন্ন পথে ঘুরে যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় তার জন্য কেবল আফসুসই করা যায়।

প্রসঙ্গতঃ বিবেচ্য, অপেক্ষাকৃত অনেক বড় স্বার্থ বিকিয়ে দেবার পাঁয়তারার অভিযোগের পরিবর্তে সামান্য গঙ্গার পানি নিয়ে চুক্তি, তিস্তার পানি নিয়ে চুক্তি এবং তারপরে সেসব চুক্তির ব্যর্থতায় আমাদের যে পরিহাস, সে পরিহাস কি সত্যিই কবুল করার মত? অথচ হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, ‘যাকাত অনাদায়ের কারণে অতিবৃষ্টি আর অনাবৃষ্টি হয়।” মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে এই হাদীছ শরীফ-এর প্রতি অবমাননা করাই কী হবে আমাদের সঠিক পরিচয়? ইসলামী আইন শাস্ত্র বিশারদদের মতানুযায়ী যাবতীয় অবৈধ কর রহিতকরণের বিপরীতে বলিষ্ঠভাবে যাকাত আদায়ের কোন সদিচ্ছাই কী আমাদের জাগবে না? জাগবেনা কী তার সুফল দর্শনের এতটুকু বাসনা? আর সে কী বহুদূর? এক হিসেবে জানা যায়, বাংলাদেশে যে পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে আমানত রয়েছে তা থেকে যথাযথ যাকাত আদায় হলে প্রায় অর্ধলাখ কোটি টাকা যাকাত আদায় সম্ভব।

স্মর্তব্য যে, কিছুকাল পূর্বে এক সমীক্ষায় বলা হয়েছিলো, কেবলমাত্র কয়েক হাজার কোটি টাকার সুষ্ঠু প্রয়োগের দ্বারাই বাংলাদেশের দারিদ্র্য মোচন সম্ভব। কিন্তু তারপরেও যারা সে পথ পরিহার করে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন, æউত্তম জিনিসের পরিবর্তে নিকৃষ্ট জিনিসই কী তোমাদের পছন্দ।” (সূরা বাক্বারা-৬১)

বলার অপেক্ষা রাখেনা, যাকাতবিহীন, পুঁজিবাদী, সুদী ও দুর্নীতি নির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাংলাদেশে দরিদ্রদের আরো দরিদ্র এবং বিত্তশালীদের আরো বিত্তবান করছে।

গভীর পরিতাপের বিষয়, আজকে মুসলমানগণ নামাযকে যতটা গুরুত্ব দেয়, যতটা আগ্রহভরে তারা মসজিদের পর মসজিদ করে, রোযা তাদের জীবনে  যতটা প্রভাব বিস্তার করে সে তুলনায় যাকাতের বিষয়টি তাদের মানসিকতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে।

জেদ্দাস্থ আইডিবি সূত্র মতে, বিশ্বের অর্ধশতাধিক মুসলিম রাষ্ট্রের মাঝে মাত্র ৬টি মুসলিম দেশে যাকাত  আদায়ের নামমাত্র ব্যবস্থা রয়েছে। অথচ মুসলিম দেশগুলো যদি যাকাত ঠিকমত দিত তাহলে কঙ্গো, সোমালিয়াসহ কোনো মুসলিম দেশেই দুর্ভিক্ষ থাকতো না।

বলাবাহুল্য, সবাই এবারের রোযায় পরিবর্তিত আবহাওয়ার আমেজ অনুভব করছেন। এর কারণ হলো, রোযার সাথে চাঁদের সম্পর্ক। কিন্তু পূর্বে প্রায় সকল ধর্মেই রোযার সাথে সৌর মাসের সম্পর্ক ছিলো। যে কারণে আমাদের ন্যায় পালাবদলের পরিক্রমায় রোযা রাখার স্বাদ গ্রহণের সুযোগ তাদের ছিলো না। কিন্তু চাঁদের মাস হিসেবে আখিরী উম্মতগণ বিভিন্ন ঋতুতে রোযা রাখার নিয়ামত লাভে লাভবান হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বিশেষভাবে স্মর্তব্য যে, রোযা-ঈদ চাঁদ দেখার সাথে সম্পর্কযুক্ত, উদয়ের সাথে নয়। হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, æতোমরা চাঁদ দেখে রোযা শুরু কর এবং চাঁদ দেখে তা শেষ করো।” (তিরমিযী শরীফ)

স্মর্তব্য, রোযা এমন একটি আমল যার সার্থকতা হাছিল ছলাত, যাকাত ইত্যাদি সঠিকভাবে আদায়সহ যাবতীয় হারাম থেকে বিরত থাকা তথা তাক্বওয়া হাছিলের সাথে সম্পৃক্ত। আর একমাত্র মুজাদ্দিদে আ’যম ঢাকা রাজারবাগ শরীফ-এর মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী উনার ছোহবত ইখতিয়ারের মাধ্যমেই রোযার সে হক্ব আদায় সম্ভব। মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদের সকলকে সে তাওফীক দান করুন। (আমীন)

 

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়